বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-মন্ত্রিসভায় রদবদল : চমক নয় মানুষ চায় সুফল by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে আলোচনা চলছিল। জনপ্রত্যাশা ছিল অন্য রকম, অর্থাৎ মন্ত্রিসভায় ব্যাপক রদবদল। কিন্তু আপাতত তা হলো না। তবুও শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিসভায় রদবদল ঘটানো হলো ৫ ডিসেম্বর, ২০১১। নতুন নিয়োগ পাওয়া দুই মন্ত্রীর দপ্তর বণ্টনের পাশাপাশি কয়েকজনের দপ্তর অদলবদল হয়েছে। গুঞ্জন আছে, শিগগিরই মন্ত্রিসভায় ফের বড় ধরনের রদবদল হবে। আগামী ৫ জানুয়ারি, ২০১২ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট


সরকারের তিন বছর পূর্তি হচ্ছে। 'মন্ত্রীদের আমলনামা প্রধানমন্ত্রীর হাতে'_এ রকম একটি সংবাদও খুব চাউর। গত তিন বছরে সরকারে স্থান পাওয়া মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন হবে এরই ভিত্তিতে এমন গুঞ্জন আছে, যা অস্বাভাবিকও নয় বটে। অভিজ্ঞতাবিহীন নতুন মুখ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহা চ্যালেঞ্জে নেমেছিলেন, কিন্তু এই মন্ত্রীরা জনপ্রত্যাশা পূরণে কতটা কী করতে সক্ষম হয়েছেন এ নিয়ে কথা আছে বিস্তর এবং এর সিংহভাগই নেতিবাচক। আরো গুঞ্জন আছে, শুধু মন্ত্রিসভায়ই নয়, দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলেও প্রবীণ ও অভিজ্ঞ রাজনৈতিক তারকা নেতাদের অনেকেরই সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনের দরজাও খুলে যাচ্ছে_সরকার ও দলের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ এমন মন্তব্য খুব জোরের সঙ্গেই করেছেন। সরকারের তিন বছর পূর্তির প্রাক্কালে যেকোনো দিন এই কাজগুলো হতে পারে। বাতাসে খবর আরো ভেসে বেড়াচ্ছে। যেমন এও শোনা গেছে, স্থানীয় সরকার, কৃষি, শিক্ষা ও খাদ্য ছাড়া অন্য প্রায় সব মন্ত্রণালয়েই রদবদলের সম্ভাবনা প্রবল এবং নতুন মুখ মন্ত্রিসভায় যোগ হবেন বটে, তবে মন্ত্রিত্ব একেবারে হারাবেন সে সংখ্যা কম। তবে কয়েক বছর ধরে কার্যত 'ওএসডি' হয়ে থাকা দলের বয়োজ্যেষ্ঠ, অভিজ্ঞ, পোড়খাওয়া তিন-চারজন রাজনীতিকের প্রতি বিশেষ সুদৃষ্টি পড়তে পারে বলে আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য সূত্রে এও প্রকাশ। একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির রাজনৈতিক সরকারের নির্বাহী প্রধান প্রধানমন্ত্রী। সেখানে এসব ক্ষেত্রে তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, ইচ্ছা-অনিচ্ছাটাই বড়। আমরা জানি, মন্ত্রিত্ব কোনো মেয়াদি চাকরি হিসেবে দুনিয়ার কোথাও কখনো বিবেচিত হয়নি কিংবা হয় না। এ দেশের প্রেক্ষাপটে এটুকু বলা যায়, অপেক্ষাকৃত তরুণ কিংবা নবীন নেতৃত্ব আনার ফলে সব ক্ষেত্রে যে গতিশীলতা অর্জনের আশা করা হয়েছিল, গত তিন বছরে তা অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে।
ইতিমধ্যে পরিবর্তন যেটুকু হয়েছে, তা অত্যন্ত ছোট বটে কিন্তু মহাজোট সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশাটা অনেক বড়। বহুল আলোচিত-সমালোচিত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে সৈয়দ আবুল হোসেন ও ফারুক খানের নাম প্রায় সর্বমহলেই নেতিবাচকভাবে উচ্চারিত হলেও তাঁরা অন্য মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়েছেন। তবে সব কিছু বিশ্লেষণ করে এটুকু বলা যায়, মন্ত্রিসভায় বড় ধরনের পরিবর্তন না হলেও এ রদবদল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। নবনিযুক্ত মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও ওবায়দুল কাদের যথাক্রমে রেল ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের গুরুভার পেয়েছেন। এর আগে দুটি মন্ত্রণালয় একত্রে ছিল। রেল মন্ত্রণালয়কে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে যে উদ্দেশ্যেই পৃথক করা হোক না কেন, এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে এ খাতের গুরুত্ব বৃদ্ধি নয়ই, উন্নয়নেও সহায়ক হবে। তা ছাড়া এটি দেশবাসীরও দাবি ছিল। দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় রেল যে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারত, নানা কারণে তা সম্ভব হয়নি। পুরো খাতটিকে ঘুণপোকা কুরে কুরে খাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। তা ছাড়া অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, সেবার মানের নিম্নমুখিতা ইত্যাদি কারণে এর অবনতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক রূপ নিয়েছে। এ অবস্থায় মন্ত্রণালয়টির দায়িত্ব পেলেন বিজ্ঞ এবং আলোচিত পার্লামেন্টারিয়ান ও পরীক্ষিত রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ইতিমধ্যে তিনি বলেছেন, রেলকে লাভজনক খাতে পরিণত করার চেষ্টা করবেন। রেলের ব্যথা এখন সর্বাঙ্গে। ক্রমেই স্টেশন বন্ধ হচ্ছে, রেলের সীমানাপথ কমছে এবং জনবাহন থেকে রেল যেন ক্রমেই দুষ্কর্মকারীদের মাদক কিংবা অন্য অবৈধ পণ্যের বাহনে পরিণত হচ্ছে। তা ছাড়া রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বড় একটা অংশের মধ্যে ভয়াবহ ব্যাধি ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে দুর্নীতি। সমস্যা আরো আছে, যা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে সব বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। এ সব কিছু আমলে রেখে রেলকে ঢেলে সাজানো কঠিন কাজ হলেও নবনিযুক্ত মন্ত্রী দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হবেন_এ প্রত্যাশা সংগতই খুব পুষ্ট। জনদাবি হলো, রেলের পুনরুজ্জীবন ঘটানো। একই চিত্র যোগাযোগ মন্ত্রণালয়েরও। পাহাড়সম ব্যর্থতার অভিযোগ থেকে মন্ত্রণালয়টিকে বের করে আনতে নতুন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম শুরু থেকেই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বর্তমান সরকারের মেয়াদ আছে মাত্র আর দুই বছর। তবে যদি সদিচ্ছা থাকে, এই দুই বছরেই অনেক কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। সবই যে পারতে হবে, তা তো নয়। যে বিশ্বাস কিংবা আস্থা নিয়ে তাঁদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, তা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালনের চেষ্টাটা যদি প্রবল হয়, তাহলে ফল লাভ না হওয়ার কোনো কারণ নেই। দেশের উন্নয়নে প্রধান শর্ত হচ্ছে যোগাযোগ অবকাঠামো। এ কথাও ঠিক, বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত হলেও আমাদের যোগাযোগ অবকাঠামো চরম খারাপ নয়। যেটুকু খারাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা হলো শুধু দায়িত্বহীনতা, হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণের অপচেষ্টা আর দেখভালের অভাবের কুফল। সর্বত্র লুকিয়ে আছে কালো বিড়াল, যে বিড়ালগুলোকে বের করে আনাটা সর্বাগ্রে জরুরি।
এই যে মন্ত্রিসভায় রদবদলের ব্যাপারে বারবার চমকের কথাটা আসছে, তা মুখ্য বিষয় নয়। জরুরি হলো, কে কতটা দায়িত্ব-কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে পেরেছেন কিংবা পারছেন। এ দেশের সিংহভাগ মানুষকে নানামুখী দুর্ভোগের সঙ্গে নিত্য লড়াই করতে হয়। মানুষ এখন আর সংগত কারণেই আশ্বাসে বিশ্বাস রাখে না। কাজটাই সর্বাগ্রে দেখতে চায়। দারিদ্র্যপীড়িত এই জনগোষ্ঠীর অর্থের অপচয় রোধ করাটা জরুরি, যা এ দেশে কখনোই সম্ভব হয়নি। এ দেশের বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে কোনো সরকারকেই বিলাসী হয়ে ওঠার কোনো অবকাশ নেই। সরকারের ব্যয় না কমালে এর নেতিবাচক প্রভাব হবে আরো বহুমুখী। শুধু প্রতিশ্রুতি দিলে আর অঙ্গীকার করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। দেশের মানুষ চমক চায় না, তারা চায় সুফল। আর জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষ যাতে সুফল পায়, তা নিশ্চিত করার দায় সরকারের। আবারও বলতে হয়, সরকারের অঙ্গীকার ও এজেন্ডা বাস্তবায়নে জরুরি কাজগুলো সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য মন্ত্রিপরিষদে যোগ্য-দক্ষদের পাশাপাশি সৎ ও নিষ্ঠাবানদের সমাহার ঘটানো অপরিহার্য। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবেই গণ্য হয়ে থাকে। বিশেষ করে কোথাও শৈথিল্য বা গতিহীনতা দেখা দিলে সেখানে পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়ে। এই জরুরিটা আরো অনেক আগেই জরুরি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল_এমন মন্তব্য মোটেই অমূলক নয়। অনেক ক্ষেত্রে এ সরকারের সাফল্য কম নয়। কৃষি, শিক্ষাসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য ঈর্ষণীয়। কিন্তু জননিরাপত্তার বিষয়টি শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। অথচ মহাজোটকে মানুষ অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম প্রধান এই কারণেও অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বিপুল রায় দিয়ে ক্ষমতারোহণের পথ মসৃণ করে দিয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ ক্ষেত্রে চিত্র এখনো পাল্টায়নি। অতিকথন মন্ত্রীদের আরেকটি বড় অযোগ্যতা। এই অতিকথন দিয়ে অনেকে পার পেয়ে যেতে চাচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা প্রকারান্তরে সরকারের চেয়ারেই পেরেক মারছেন। কারণ মানুষ এখন আর এত অসচেতন নয়। তা ছাড়া মিডিয়ার চিত্রও আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি উজ্জ্বল। মিডিয়া একেবারে ক্লোজসার্কিট ক্যামেরার মতো কাজ করছে এবং জনগণ এর ফলে অনেক সজাগ রয়েছে। মানুষের গঠনমূলক সমালোচনা আমলে নেওয়া উচিত, যা এ দেশের রাজনীতিকদের ধাতে সয় না। গঠনমূলক সমালোচনা যাঁরা সহ্য করতে পারেন, সহজে তাঁরাই নিজেকে শুধরে নেওয়ার পথটাও বাতলাতে পারেন। এতে কল্যাণ হয় সবারই। তাই সরকার ও জনগণের প্রয়োজনেই উচিত ব্যর্থদের শাস্তি আর সফল কিংবা যোগ্যদের পুরস্কৃত করা। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কে কত বেশি অনুগত এর চেয়ে অবশ্যই বেশি বিবেচিত হওয়া উচিত কে কত বেশি সৎ, যোগ্য এবং দক্ষ। দূরদর্শী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টিও আমলে থাকা খুব জরুরি। একজন দূরদর্শী পোড়খাওয়া রাজনীতিকের বড় বেশি দরকার একটি রাজনৈতিক সরকারের জন্য। অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিয়ে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাক্যবাগীশ নয়, মানুষ চায় কর্মবাগীশ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। চমক যদি আসে সেদিকে আসুক। এ দেশে এত সমস্যা যে মন্ত্রীদের এর সমাধানে ব্যস্ত থাকতে গিয়ে কথা বলার ফুরসতই পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করছি, অনেক মন্ত্রী কাজ ফেলে অহেতুক কথা বলেই চলেছেন। তাঁরা কেউ দ্রব্যমূল্য কমানোর লক্ষ্য অর্জনে দেশবাসীকে কম খেতে উপদেশ খয়রাত করেছেন। দৃষ্টান্ত এমন অনেক আছে। আবার কেউ নিজেদের দপ্তর উপেক্ষা করে অন্যদের কাজ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। এ সবই অভিজ্ঞতার ঘাটতির কুফল। এবার তাঁদের চোখ খুলবে_এটাই প্রত্যাশা। আমরা সে অপেক্ষায়ই রইলাম। মন্ত্রীরা কথা কম বলুন, কাজ করুন বেশি_এটিই হলো দেয়াল লিখন। এ লিখন পড়তে ব্যর্থ হলে মূল্য তো দিতে হবেই।

লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.