অনুসন্ধান-দুস্থদের বরাদ্দ অর্থ লুট-* প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ইউজেএমএস-* ৫২ কোটি টাকার এক-তৃতীয়াংশ লোপাট by শফিকুল ইসলাম জুয়েল

প্রকল্পের নাম ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট ফর দি আল্ট্রা পুওর (ভিজিডিইউপি)। বাস্তবায়নকারী চার সংস্থার মধ্যে অন্যতম ছিল উত্তরায়ণ জনকল্যাণ মহিলা সমিতি (ইউজেএমএস)। তবে 'আল্ট্রা পুওর' তথা অতিদরিদ্র নারীদের জন্য নেওয়া এ প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে ইউজেএমএস যা করেছে, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। 'স্থায়ী সম্পদ' গড়ার লক্ষ্যে হতদরিদ্র প্রতি দুস্থ মহিলার জন্য সাড়ে সাত হাজার টাকা। আর ইউজেএমএসের প্রতিনিধিরা দিয়েছেন দেড় হাজার


টাকারও কম মূল্যের অসুস্থ ছাগল। নগদ বিতরণের জন্য মাথাপিছু ১৯০০ টাকা বরাদ্দ থাকলেও দেওয়া হয়েছে ৭৫০ টাকা। ফলে শুধু এই দুই খাতেই ২২ হাজার ২২২ জন হতদরিদ্র দুস্থ গ্রামীণ মহিলার নামে বরাদ্দ হওয়া প্রায় ১৬ কোটি টাকার মধ্যে ১২ কোটি টাকাই আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এ ছাড়া বেতন-ভাতা, আসবাবপত্র ক্রয়, অফিস খরচ, প্রকাশনা খরচ, গবেষণা, কনফারেন্স, বিলবোর্ডসহ আনুষঙ্গিক নানা খাতে আরো চার কোটি থেকে পাঁচ কোটি টাকারও বেশি লোপাট হয়েছে। সব মিলিয়ে ৫২ কোটি টাকার ভিজিডিইউপি প্রকল্পটির এক-তৃতীয়াংশ অর্থই আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত এক সপ্তাহ সিরাজগঞ্জ ও ময়মনসিংহ ঘুরে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এ অনিয়মের খবর জানা যায়। উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা, উপজেলা এনজিও প্রকল্প ম্যানেজার, উপজেলা পিটিএফ প্রোগ্রাম সুপারভাইজার এবং উপকারভোগী গ্রুপের প্রতিনিধি_এই চার পক্ষের স্বাক্ষর ছাড়া অর্থ লেনদেন সম্ভব ছিল না। তাই অর্থ বিতরণে অনিয়মের সঙ্গে তাঁদের নামও উঠছে জোরালোভাবে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তদারক প্রতিষ্ঠান মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ও উপজেলা মহিলা কর্মকর্তা সবাই অনিয়ম-দুর্নীতির কথা স্বীকার করেছেন। তবে তাঁরা প্রকল্পের নানা অনিয়ম তুলে ধরে একজন অন্যজনকে দোষারোপ করেন।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ইউজেএমএসের নির্বাহী পরিচালক খায়রুন নাহার খানমের সঙ্গে বৃহস্পতিবার রাতে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে দাবি করেন, 'আমরা টাকা ঠিকই ছাড় করেছি।' পরে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে ধরলে তিনি অনিয়মের কথা স্বীকার করে বলেন, 'মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা কোথাও কোথাও টাকা কম দিয়েছেন। অভিযোগ পেয়ে আমি নিজে গিয়ে সিরাজগঞ্জের চৌহালীর চরাঞ্চলের মানুষের হাতে তাদের প্রাপ্য টাকা দিয়ে এসেছি।' তিনি বলেন, 'সুবিধাভোগী নির্বাচন থেকে শুরু করে অনেক ক্ষেত্রেই অনিয়ম হয়েছে। আর এর সবই করেছেন প্রকল্পের চেয়ারম্যান ও মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তারা।'
তবে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা মাহফুজা বেগম বলছেন, অনিয়ম করেছে সংশ্লিষ্ট এনজিও। তিনি বৃহস্পতিবার রাতে টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এনজিওগুলোর কিনে দেওয়া ছাগলই বিতরণ করেছি। মরে গেলে তা এনজিওরই দোষ। এ ছাড়া যে পরিমাণ টাকা ছাড় করেছে, সেটিই দিয়েছি। এ ক্ষেত্রে এনজিও-ই অনিয়ম করেছে। তদারক কর্মকর্তা হিসেবে এনজিওর বিরুদ্দে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, 'অফিসে আসেন সব বলব।'
এদিকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক ও যুগ্ম সচিব ড. মোহাম্মদ আলী গত সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বেশ কিছু জায়গায় ছাগল মরার খবর শুনেছিলাম। এমনকি সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার সদস্যদের মধ্যে টাকাও কম দেওয়ার অভিযোগ পেয়েছিলাম। পরে তদারকির মাধ্যমে পুরো টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।' তিনি জানান, সব জায়গা থেকে অভিযোগ না আসায় তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি।
দুস্থ মহিলারা যা বলেন : সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাঁকোয়াদীঘি গ্রামের বাসিন্দা আখতার হোসেনের স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা প্রকল্পটির শুরু থেকেই সদস্য হিসেবে আছেন। তিনি বলেন, '২০০৯ সালের জানুয়ারিতে শুরুর পর চলতি বছরের ৩০ জুন প্রকল্পটি শেষ হলেও হঠাৎ করেই দুই মাস আগে (সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে) মোবাইল ফোনে ডেকে নিয়ে প্রত্যেক সদস্যকে ৮০০ টাকা করে ধরিয়ে দেয় ইউজেএমএস। শুনেছিলাম, আমাদের প্রত্যেকের নামে ১৯০০ টাকা করে বরাদ্দ ছিল। এর আগেও এই এনজিও দুস্থদের স্থায়ী সম্পদ গড়ে দেওয়ার নামে সাড়ে সাত হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়ে ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা দাম দিয়ে অসুস্থ ছাগল কিনে দিয়েছিল, যার প্রায় সবই বিতরণের দু-এক দিনের মধ্যেই মারা যায়। শুধু বেঁচে ছিল এ ওয়ার্ডের ৪১ সদস্যের মধ্যে বানিয়াবহু গ্রামের আয়াজউদ্দিনের মেয়ে আফরোজার একটি ছাগল।'
একই গ্রামের বৃদ্ধ সোবহানের স্ত্রী আছিয়া বেগম বলেন, 'আমাকে ছাগলটি যেদিন দিয়েছে, সেদিনই মারা গেছে।' রব্বানের স্ত্রী ছাবিনা বলেন, 'কঙ্কালসার ছাগল দেখে আমরা কয়েকজন নিইনি। প্রতিবাদ করার কারণে আমাদের ডেকে ব্যবসা করার জন্য চার হাজার টাকা করে দিয়ে চুপ থাকতে বলেছে। আর প্রকল্পের সময় শেষ হওয়ার পরে গত সেপ্টেম্বরে দিয়েছে ৮০০ টাকা করে। এ সময় সঞ্চয় জমা রাখা পাস বইটি এনজিওকর্মীরা তুলে নিয়ে গেছেন।' তিনি জানান, মোবাইল ফোনে ডেকে তড়িঘড়ি করে প্রায় মরা ছাগলগুলো বিতরণ করা হয়েছে। আর ছাগল বহন করা ট্রাক যেন কেউ না দেখে সে জন্য গ্রামের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল। একই গ্রামের মৃত সখিমের স্ত্রী বৃদ্ধ রহিমন বলেন, 'শুনেছিলাম, ছাগল না নিলে ব্যবসার জন্য সাড়ে সাত হাজার টাকা করে পাওয়া যাবে; কিন্তু দিয়েছে মাত্র চার হাজার টাকা।' একই ধরনের অভিযোগ সাঁকোয়াদীঘি গ্রামের আফসারের স্ত্রী জয়নাব, আমজাদের স্ত্রী চম্পা, আজগরের স্ত্রী ফাতেমা, রফিকুলের স্ত্রী ময়না, গোলাম হোসেনের মেয়ে মতিজান এবং বানিয়াবহু গ্রামের আমজাদের মেয়ে রোজিনা ও আয়াজউদ্দিনের মেয়ে আফরোজার।
এরপর কথা হয় সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার ৬ নম্বর ইউনিয়নের চকজয়কৃষ্ণপুর গ্রামের মৃত নরেশের বৃদ্ধা স্ত্রী অষ্টবালা, আফজালের স্ত্রী চম্পা, নরেন্দ্রনাথের স্ত্রী অঞ্জনার সঙ্গে। তাঁরা কালের কণ্ঠকে জানান, আশপাশের ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডের সদস্যরা সেপ্টেম্বরে ৮০০ টাকা করে পেলেও তাঁদের (চকজয়কৃষ্ণপুর, রঘুনালী, মঙ্গলবাড়িয়া, উলুপুর ও পাঁচাল গ্রামের) ৩১ সদস্যের গ্রুপের প্রত্যেককেই দেওয়া হয়েছে ৭০০ টাকা করে। আর ছাগল নেয়নি এমন প্রতিবাদী ছয়জনকে পরে গোপনে ডেকে ব্যবসা করার জন্য সাড়ে চার হাজার টাকা করে দিয়ে কাউকে না বলতে নির্দেশ দিয়েছে। তাঁরা দাবি করেন, এই গ্রুপের ২৫ জনকে দেওয়া প্রত্যেকের ছাগলের গড় মূল্য এক থেকে দেড় হাজার টাকার বেশি কোনোভাবেই হবে না। আর দুজন ছাড়া প্রত্যেকের ছাগল অসুস্থতার কারণে তিন দিনের মধ্যেই মারা গেছে।
প্রকল্প এলাকা ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের দুস্থ মহিলাদের সঙ্গে কথা বলে একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়। ৯ নম্বর বাগনাবাড়ী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাগনাবাড়ী, খোদাবঙ্পুর ও কাশিয়াচর গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাকের স্ত্রী রোমেলা খাতুন, আজিজুল হকের স্ত্রী ফাতেমা বেগম, রিয়াজ উদ্দিনের স্ত্রী সাহার বানু, আবুল কাশেমের স্ত্রী নুরজাহান ও মুকবুলের স্ত্রী তহুরা খাতুন বলেন, ব্যবসার জন্য মাত্র কয়েকজনকে গোপনে চার হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। বাকি ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মহিলাই পেয়েছেন এক-দেড় হাজার টাকা মূল্যের মৃতপ্রায় ছাগল। আর প্রকল্প শেষেরও তিন মাস পর পাওয়া গেছে নগদ ৭৫০ টাকা করে।
অনিয়ম-দুর্নীতির মহাযজ্ঞ : ইউজেএমএসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রকল্পে মোট ২২ হাজার ২২২ জন সদস্য ছিলেন। এর মধ্যে অন্তত ৮০ শতাংশকেই (১৭ হাজার ৭৭৭ জন) এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা মূল্যের ছাগল দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ১৫০০ টাকা হিসেবে দুই কোটি ৬৬ লাখ ৬৬ হাজার ৪০০ টাকা ব্যয় হয়। হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ছয় হাজার টাকা হিসেবে ১০ কোটি ৬৬ লাখ ৬২ হাজার টাকা। বাকি ২০ শতাংশকে (চার হাজার ৪৪৫ জন) দেওয়া হয়েছে নগদ চার হাজার ৫০০ টাকা করে। এ ক্ষেত্রে বিতরণ করা হয় দুই কোটি দুই হাজার ৫০০ টাকা। হাতিয়ে নেওয়া হয় তিন হাজার টাকা হিসেবে এক কোটি ৩৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া নগদ বরাদ্দ ১৯০০ টাকার বিপরীতে গড়ে ৭৫০ টাকা করে বিতরণ হিসাবে ২২ হাজার ২২২ জন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে এক কোটি ৬৬ লাখ ৬৬ হাজার ৫০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে জনপ্রতি এক হাজার ১৫০ টাকা কম দিয়ে সরানো হয়েছে দুই কোটি ৫৫ লাখ ৫৫ হাজার ৩০০ টাকা। অথচ এ খাতে ১৯০০ টাকা হিসাবে বরাদ্দ ছিল চার কোটি ২২ লাখ ২১ হাজার ৮০০ টাকা।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয়েছে এমন সব সদস্যই জানিয়েছেন, তাঁদের সঞ্চয় জমা এবং টাকার পরিমাণ লিখে রাখা 'পাস বই' সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ফেরত নিয়ে গেছেন। তাঁদের সন্দেহ, দুর্নীতির প্রমাণ নষ্ট করতেই এ কৌশল নেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অনুমোদিত অর্থের বড় একটা অংশ লোপাট হয়েছে পরিচালন ব্যয় খাত থেকে। কারণ বরাদ্দের বেশির ভাগ খাতেই এনজিওটি কোনো ব্যয় করেনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ ছিল মানবসম্পদ (হিউম্যান রিসোর্স, বেতন-ভাতাদিসহ) বাবদ তিন লাখ ১৩ হাজার ৪৫০ ইউরো (প্রায় তিন কোটি ২৫ লাখ ৬৫ হাজার ৫২৮ টাকা), যন্ত্রপাতি বাবদ ৩০ হাজার ৫০০ ইউরো (প্রায় ৩১ লাখ ৬৮ হাজার ৭৩১ টাকা), স্থানীয় অফিস খরচ ৭৯ হাজার ৬৩৪ ইউরো (প্রায় ৮২ লাখ ৭৪ হাজার ৫৬০ টাকা), প্রকাশনা খরচ ২২ হাজার ২২২ ইউরো (প্রায় ২৩ লাখ ৯ হাজার ২৯ টাকা), শিক্ষা ও গবেষণা বাবদ ২০ হাজার ইউরো (প্রায় ২০ লাখ ৭৮ হাজার ৪১১ টাকা), অডিট খরচ সাত হাজার ৬০০ ইউরো (প্রায় সাত লাখ ৯০ হাজার ৯০০ টাকা), মূল্যায়ন সাত হাজার ৬০০ ইউরো (প্রায় সাত লাখ ৯০ হাজার ৯০০ টাকা), ব্যাংক চার্জ দুই হাজার ৮০০ ইউরো (প্রায় দুই লাখ ৯১ হাজার ৩৮৪ টাকা), সম্মেলন ব্যয় এক হাজার ৯০০ ইউরো (প্রায় এক লাখ ৯৭ হাজার ৭৮৩ টাকা), বিলবোর্ড-সাইনবোর্ড খরচ পাঁচ হাজার ৭০০ ইউরো (প্রায় পাঁচ লাখ ৯৩ হাজার ৩৫০ টাকা)।
সুবিধাভোগী নির্বাচনে অনিয়ম : সুবিধাভোগী নির্বাচনের শর্তও উপেক্ষিত হয়েছে। দাতা সংস্থা এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের শর্ত অনুযায়ী ১০ শতাংশের নিচে যাঁদের জমি আছে, উৎপাদনশীল সম্পদের কোনো মালিকানা নেই, কর্মক্ষম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ সদস্য বাড়িতে নেই, দিনমুজর বা অন্যের বাসায় কাজ করেন, স্বামী পরিত্যক্তা, তালাকপ্রাপ্তা, প্রতিবন্ধী, অসহায় অবিবাহিত দুস্থ মহিলারাই এ প্রকল্পের উপকারভোগী হিসেবে বিবেচিত হবেন। কিন্তু জমির মালিক ও সচ্ছল পরিবারের অসংখ্য মহিলাকে সদস্য বানিয়েছে ইউজেএমএস।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাঁকোয়াদীঘি গ্রামের বাসিন্দা এবং ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মহিলা সদস্য রাজিয়া সুলতানাও প্রকল্পের সদস্য ছিলেন। তিনি কালের কণ্ঠের কাছে স্বীকার করেন, তাঁর মতো সচ্ছল অনেকেই এ এনজিওর সদস্য ছিলেন। অথচ একই গ্রামে অনেক হতদরিদ্র মহিলা থাকলেও তাঁরা বঞ্চিত হয়েছেন।
এ ছাড়া সুবিধাভোগীদের নামধাম উল্লেখ করার ক্ষেত্রে গ্রামের নাম এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং দুর্নীতির স্বার্থেই তা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে অনুসন্ধানের সময় সুবিধাভোগী সব সদস্যকেও খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়েছে। অথচ দাতা সংস্থার নির্দেশনায় এবং 'ক্যাশ গ্র্যান্ট ডিস্ট্রিবিউশন প্ল্যান'-এ উল্লেখ ছিল_সুবিধাভোগীর জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ডের পাশাপশি সুবিধাভোগীর গ্রুপের নাম, পরিচিতি নম্বর এবং সুনির্দিষ্ট এলাকা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে।
মিথ্যা তথ্য দিয়ে কাজ নেয় ইউজেএমএস : যোগ্যতার মাপকাঠিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বড় দাতা সংস্থার কাজ পেতে ইউজেএমএসের মতো ছোট প্রতিষ্ঠান যথেষ্ট ছিল না। অভিযোগ আছে, মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের কেউ কেউ দেশের বড় বড়, প্রতিষ্ঠিত এনজিওগুলোকে বাদ দিয়ে ইউজেএমএসের মতো ছোট এবং অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করে।
ভিজিডিইউপি প্রকল্পের কাজ পেতে জমা দেওয়া ইউজেএমএসের প্রকল্প প্রস্তাবে বড় ধরনের অসংগতি কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানেও বেরিয়ে এসেছে। এনজিওটি প্রকল্প প্রস্তাবে পুষ্টি ও স্বাস্থ্য প্রকল্পে ১১ থেকে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করলেও 'জাতীয় পুষ্টি প্রকল্পে' তারা কাজ করেছে মাত্র পাঁচ বছর_২০০৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাবনা জেলার সাঁথিয়া, ঈশ্বরদী ও আটঘরিয়া উপজলোয়। এ ছাড়া সিকিউরিটি সিস্টেম ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিফর্ম, এইড টু রিফিউজি, ইনফেকশন ডিজিজ কন্ট্রোল কাজের অভিজ্ঞতা দেখালেও বাস্তবে তারা এসব কর্মসূচির কোনোটিই করেনি। এমনকি আবেদন প্রস্তাবে ১০০ জনের ওপরে স্থায়ী কর্মী আছেন উল্লেখ করলেও এর সত্যতা নেই।
সরেজমিনে গত সপ্তাহে মহাখালী নিউ ডিওএইচএসের ২৯ লেনের ৪০৩ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায় ইউজেএমএসের অফিসে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় দেড় হাজার বর্গফুটের অফিসে ১০-১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন। প্রকল্পের অনুমোদিত বাজেটের বরাদ্দ মোতাবেক ১০টি উপজেলার জন্য একজন প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর, তিনজন জেলা ম্যানেজার, ১০ জন উপজেলা ম্যানেজার, চারজন মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন অফিসার, ৩০ জন ফিল্ড সুপারভাইজার, ১৪ জন অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট কাম অ্যাকাউন্ট্যান্ট, চারজন হিসাবরক্ষক, ১৪ জন পিয়নসহ ৭৮ জন লোকবল নিয়োগ দেখিয়ে ৩০ মাসে বেতন বাবদ তিন লাখ ১৩ হাজার ৪৫০ ইউরো (প্রায় তিন কোটি ২৫ লাখ ৬৫ হাজার ৫২৮ টাকা) খরচ দেখানো হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে টেলিফোনে সার্বিক অনিয়ম-দুর্নীতি ও অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউজেএমএসের নির্বাহী পরিচালক খায়রুন নাহার খানম কালের কণ্ঠকে বলেন, শর্ত অনুযায়ী ৬০ শতাংশ সুবিধাভোগী বাছাই সঠিক হয়নি। এ ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানরা অনিয়ম করেছেন। আর টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম হলে এরও দায়ভার উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাদের। কারণ তাঁদের হাতেই সব কিছু হয়। তথ্য গোপন করে এই বড় কাজ বাগিয়ে নেওয়া প্রসঙ্গে বলেন, 'কমিটমেন্ট দিয়ে কাজ করি বলে ছোট এনজিওর মালিক হয়েও টিকে আছি।' তিনি আরো বলেন, 'এ দেশে ভালো কাজ তেমন হয় না। এমনকি রিপোর্ট করলেও নয়। এই ধরুন, আপনি রিপোর্ট করবেন, এ জন্য আমাকে বড়জোর একটু মন্ত্রণালয়ে দৌড়াতে হবে_এর বেশি নয়।'
তদারক প্রতিষ্ঠান মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক ও যুগ্ম সচিব ড. মোহাম্মদ আলী বলেন, 'অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর তদারকির দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা এবং প্রজেক্ট কর্মকর্তাকেও (পিটিএফ) শাস্তির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।'
এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর পরিচালক (প্রজেক্ট-১) এস এম আশরাফুজ্জামান বলেন, এনজিওগুলোর মাঠপর্যায়ে কাজের তেমন তদারকি হয় না বলেই তারা অনায়াসে অনিয়ম-দুর্নীতি করে যায়। এ খাতে কঠোর তদারকি রাখা প্রয়োজন। ইউজেএমএস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এনজিওটি অনিয়ম-দুর্নীতি করলে তা আমরা সংশ্লিষ্ট দাতা সংস্থাকে জানাব। পরে তদন্তে প্রমাণিত হলে অন্যদের মতো নিবন্ধন বাতিল পর্যন্ত করব।'
ভিজিডিইউপি প্রকল্পটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অর্থায়নে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত হয়েছে। প্রকল্পটির আওতায় দেশের গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম, ময়মনসিংহ, রংপুর ও নীলফামারী জেলার ৩৬ উপজেলার ৮০ হাজার দুস্থ মহিলা আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে দেশের চারটি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রংপুর দিনাজপুর রুর‌্যাল সার্ভিস (আরডিআরএস বাংলাদেশ) কুড়িগ্রাম জেলার ৯ উপজেলার ২০ হাজার জনকে, পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র (পিএমইউকে) নেত্রকোনা জেলার সাত উপজেলার ১৫ হাজার ৫৫৬ জনকে, রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টার (রিক) রংপুর, নীলফামারী ও গাইবান্ধা জেলার ১০ উপজেলার ২২ হাজার ২২২ জনকে এবং উত্তরায়ণ জনকল্যাণ মহিলা সমিতি (ইউজেএমএস) জামালপুর, সিরাজগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলার ১০ উপজেলায় ২২ হাজার ২২২ জন দুস্থ মহিলার উন্নয়নে অনুদান বিতরণ করেছে। ইউজেএমএস প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া, গৌরীপুর, হালুয়াঘাট ও ফুলপুর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, কাজিপুর ও চৌহালী এবং জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলায়। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন মেয়াদ ছিল ৩০ মাস (২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত)। তবে ইউজেএমএস ছাড়া বাকি সংস্থাগুলোর কাজ নিয়ে কালের কণ্ঠ এখনো কোনো অনুসন্ধান চালায়নি।
চার উন্নয়ন সংস্থার জন্য অনুমোদিত মোট প্রকল্প ব্যয় ছিল দুই কোটি পাঁচ লাখ ইউরো (বর্তমানে ২০০ কোটি টাকারও বেশি)। এর মধ্যে দুই কোটি ইউরো ইইউ এবং পাঁচ লাখ ইউরো বাংলাদেশ সরকার অর্থায়ন করে। এ ক্ষেত্রে ইউজেএমএসের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫০ লাখ ৭৬ হাজার ১৮৯ ইউরো (বর্তমানে প্রায় ৫২ কোটি ৭৫ লাখ দুই হাজার ৫৮৩ টাকার সমান)। প্রকল্পের শর্ত অনুযায়ী প্রকল্প খরচের ৯৩.০৬ শতাংশ দাতা এবং ৬.৯৪ শতাংশ বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে বহন করতে হবে। এ হিসাবে ইউজেএমএসের দেওয়ার কথা তিন লাখ ৫২ হাজার ২৮৭ ইউরো (তিন কোটি ৬৫ লাখ ৯৯ হাজার ২৯২ টাকার সমান)। ইউজেএমএসের মতো ছোট মাপের সংস্থার পক্ষে নিজস্ব তহবিল থেকে প্রকল্প চলার সময়ে এ অর্থ জোগান দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটি হয় এ অর্থ আদৌ বিনিয়োগ করেনি, করে থাকলেও সেখানে অনিয়ম হয়েছে।
২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে প্রকল্প শুরুর পর ২০১১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ইউরোর মুদ্রাবিনিময় হারের তারতম্যের কারণে অনুমোদিত বাজেটের সঙ্গে প্রকল্পের ব্যয়িত অর্থের তারতম্য ঘটেছে।
শর্ত ছিল, প্রকল্পের আওতায় প্রত্যেক উপকারভোগী মহিলা প্রতি মাসে ৪০০ টাকা করে ভাতা পাবেন। এ ভাতা থেকে প্রতি মাসে ৫০ টাকা সঞ্চয় হিসেবে কেটে রাখা হবে। প্রকল্প মেয়াদের ২৪ মাসে সঞ্চয়ের ১২০০ টাকা প্রকল্প শেষে ফেরত পাবেন। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শেষে আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজে বিনিয়োগের নিমিত্তে প্রত্যেককে সাত হাজার ৫০০ টাকা করে দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে সমপরিমাণ অর্থে ছাগল কিনে কিংবা নগদ টাকা বিতরণের নির্দেশনা ছিল। এ ছাড়া প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ অবশিষ্ট থাকায় দাতা সংস্থা এবং সরকারের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে পুনরায় প্রতিজন দুস্থ মহিলাকে নগদ এককালীন ১৯০০ টাকা করে দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ইউজেএমএসের যেসব সদস্যের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকেই বলেছেন, শেষ সময়ের নগদ অর্থ ও ছাগল দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়ম হলেও দুই বছর প্রতি দুই মাস অন্তর ৭০০ টাকা এবং শেষ সময়ে জমা রাখা সঞ্চয়ের ১২০০ টাকা তাঁরা ঠিকই পেয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.