চরাচর-মৌলভীবাজারের শব্দকরদের জীবনচিত্র
পেশার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষের জীবনযাপন ছিল এককালে হিন্দু সম্প্রদায়ের অলঙ্ঘনীয় প্রথা। পৈতৃক পেশা গ্রহণই ছিল তখন জীবিকার একমাত্র উপায়। তবে পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে আজ সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন অনুজ শ্রেণীর মানুষ যোগ্যতার ভিত্তিতে যেকোনো পেশা গ্রহণ করতে পারে। করতে পারে তার ভাগ্য পরিবর্তন। মৌলভীবাজারের চিরবঞ্চিত শব্দকররা তাদের জীবনে পরিবর্তন এনেছে।
তারা বিভিন্ন ধরনের পেশা গ্রহণ করে বেঁচে থাকতে শিখেছে। শব্দকর বা পেশাজীবী বাদক সম্প্রদায় আমাদের সমাজের একটি পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী। দেশের সব জেলায়ই এদের কম-বেশি দেখা যায়। তবে মৌলভীবাজারে এদের বিপুল সংখ্যায় দেখা যায়। এ জেলার সদর থানার অন্তর্গত ১৫-১৬টি গ্রামে প্রায় ৩০০ শব্দকর পরিবারের বসবাস। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তজ শ্রেণীর লোক হলেও সামাজিকভাবে ছিল বিচ্ছিন্ন। পূজা-পার্বণ ও বিবাহ উপলক্ষে ঢাক বাজানোর জন্য বর্ণ হিন্দুদের বাড়িতে তাদের ডাক পড়লেও বাড়ির ভেতর প্রবেশাধিকার ছিল না। এমনকি অন্তজ শ্রেণীর অন্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গেও তাদের মেলামেশার অধিকার ছিল না। সাম্প্রতিক আর্থ-সামাজিক পরিবেশ এ অবস্থার অনেক পরিবর্তন এনেছে। শব্দকররা নিজেরাই নিজেদের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। একসময় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ১২ মাসে ১৩ পার্বণের প্রচলন ছিল। এ জন্য শব্দকরদের ১২ মাসই চাহিদা ছিল। তা ছাড়া সামাজিক ও বৈবাহিক উৎসবেও শব্দকরদের ডাক পড়ত। মৌলভীবাজার অঞ্চলে এককালে হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যাপক বসবাস ছিল। কিন্তু দেশ ভাগ এবং অন্যান্য কারণে এ এলাকার বিত্তবান হিন্দু পরিবারগুলো দেশত্যাগ করে। ফলে শব্দকরদের জীবনে দুর্দিন নেমে আসে। এর মধ্যে বিনোদনের নতুন নতুন উপকরণ যেমন টিভি, ভিসিআর, টুইন-ওয়ান ইত্যাদির প্রচলন হলে শব্দকররা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। শব্দকররা তাদের পরিবার নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটায়। ফলে বাধ্য হয়ে তারা মুটে-মজুরের কাজ, রিকশা-ঠেলা চালানো, চা, পান-বিড়ির দোকান দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। সংসারে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করে। কৃষিকাজ, সরকারি প্রকল্পের রাস্তা মেরামত, বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে তারা পরিবারের সাহায্য করে। এভাবে নিরন্তর পরিশ্রম করে তারা ভাগ্য বদলাতে সক্ষম হয়। শব্দকর পরিবারের সন্তানরা স্কুলে পড়ালেখা করে। উদোম শরীরের কোনো বালক-বালিকা এখন আর দেখা যায় না। শব্দকররা নিজেরাই চাঁদা তুলে জাঁকজমকের সঙ্গে এখন দুর্গাপূজা করে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ায় এখন অন্য শ্রেণীর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা কমে গেছে। এমনকি তাদের মধ্যে বিয়ে পর্যন্ত হচ্ছে। মৌলভীবাজারের শব্দকর পরিবারের বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থা প্রসঙ্গে উন্নয়নকর্মী বাবুল চন্দ্র সূত্রধর বলেন, 'কয়েক বছর আগেও এ জেলার শব্দকর পরিবারগুলো হাজারো সমস্যায় জর্জরিত ছিল। এখন শব্দকর পরিবারের ছেলেরা কলেজে পড়ছে, মেয়েরাও স্কুলে যাচ্ছে। যদি সরকার এবং এনজিওগুলো তাদের সহায়তা করে, তবে সমাজের আর দশজন মানুষের মতো তারাও জাতি গঠনে অবদান রাখবে।
স্বপন কুমার দাস
স্বপন কুমার দাস
No comments