চির উন্নত শির শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ by দেবদাস মজুমদার
বাঙালির ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সব স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আমাদের পথ দেখিয়েছে। আর ৭ই মার্চের শাণিত ভাষণ, ১১ দফা ও এক দফার লড়াইয়ে লড়াকু বাঙালির উঠে দাঁড়ানোর এ এক দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। লাল-সবুজের পতাকায় উজ্জীবিত ও গর্বিত এ বাঙালি জাতি আজ বিশ্বস্বীকৃত। তাই সার্বভৌমত্ব ,বাকস্বাধীনতা আর মুক্তির লড়াইয়ে লাখো শহীদের জীবনদান আজ বাঙালির অহংকারের এক সমৃদ্ধ
ইতিহাস। এই মহিমান্বিত গৌরব অর্জনে শহীদ স্মৃতি আমাদের চেতনার ঐতিহ্যে লালিত। তাই শহীদ স্মৃতি স্মরণীয় রাখতে নানা উদ্যোগ আমাদের দেশপ্রেমিক দায়িত্বশীলতায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে। সে রকম একটি উদ্যোগ বাস্তবায়নের কাজ চলছে নীরবে-নিভৃত এক পাড়াগাঁয়ের জনপদে। উপকূলীয় বরগুনার বামনা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ডৌয়াতলার বিস্তীর্ণ সবুজের প্রকৃতি ছাপিয়ে গড়ে উঠছে এক শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। 'চির উন্নত শির' নামের ৩৬ ফুট উচ্চতার এ শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটির নির্মাণকাজ চলছে ছয় মাস ধরে। দৃষ্টিনন্দন নকশায় নির্মিত হচ্ছে এই স্মৃতিস্তম্ভ। আশার কথা এই যে উপকূলীয় এলাকায় আমাদের স্বাধীনতা ও ভাষা আন্দোলনের সমৃদ্ধ ইতিহাস, বিশেষ করে স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনারগুলোর যেখানে সুরক্ষার অভাব আর আমাদের বধ্যভূমিগুলো যেখানে এখনো অরক্ষিত, তেমন বৈরী সময়ে বামনা উপজেলার ডৌয়াতলা গ্রাম্য বাজারের খেলার মাঠে নির্মাণাধীন শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি সবার দৃষ্টি কেড়েছে। প্রতিদিন উপকূলীয় এ জনপদের মানুষ পাড়াগাঁয় এমন একটি নান্দনিক স্থাপনার উদ্যোগ দেখছে এখন মুগ্ধ হয়ে।
যেভাবে শুরু : মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ নম্বর সেক্টরের সাবসেক্টর ছিল বামনা উপজেলার বুকাবুনিয়া। উপকূলীয় অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা বুকাবুনিয়া সাবসেক্টরে সমবেত হয়েই এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধে বামনা এক সমৃদ্ধ ইতিহাসের অংশ। বুকাবুনিয়ার পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন ডৌয়াতলা। সেখানে মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, প্রাইমারি স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ আর নানা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে গড়ে উঠেছে পরিকল্পিত হাটবাজার। সংগত কারণে ডৌয়াতলা ইউনিয়ন বাজার এখন মানুষের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। দেশের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের শ্বশুরবাড়ি এই ডৌয়াতালা গ্রামে। সেখানে তিনি ও তাঁর স্বামী বাংলাদেশ বিমানের সাবেক মহাব্যবস্থাপক ও মুক্তিযোদ্ধা মো. আনোয়ার হোসেন খান মিলে ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন নামে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। মানবাধিকার, সুশাসন ও শিক্ষার নানা ইস্যু নিয়ে এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওই সংগঠনের মাধ্যমে তাঁরা অনেক দিন ধরে কাজ করছেন। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ আর আমাদের ভাষাসংগ্রামের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে 'চির উন্নত শির' নামের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। ডৌয়াতলা ওয়াজেদ আলী খান ডিগ্রি কলেজ ও সমবায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে খেলার মাঠের পূর্ব দিকে ৩৬ ফুট উচ্চতার শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটির নির্মাণকাজ শুরু হয় চলতি বছরের জুন মাসে। স্মৃতিস্তম্ভটির মূল নকশা করতে দায়িত্ব পায় ঢাকার শহীদুল্লাহ অ্যাসোসিয়েট নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি দেশের খ্যাতিমান স্থাপত্যবিদ ও কবি রবিউল হুসাইনকে দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভটির মূল নকশার মডেল নির্মাণ করেন। সে মডেল অনুযায়ী মূল স্তম্ভটি নির্মাণ করছে মেসার্স জ্যোতি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ও ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন পরিচালনা কমিটির নির্বাহী সদস্য তপন কুমার হাওলাদার কালের কণ্ঠকে বলেন, স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ প্রকল্পে ১১ থেকে ১৫ লাখ টাকা সম্ভাব্য ব্যয় ধরে এর নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। আশা করছি, আগামী ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে উদ্যোক্তা কর্তৃপক্ষ স্মৃতিস্তম্ভটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধনী ওই অনুষ্ঠান ঘিরে ওই সময় দেশের খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, কবি ও সাংবাদিকদের নিয়ে এখানে একটি মিলন উৎসব হবে।
সৃজনশীলতার মহতী উদ্যোগ : দেশের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বাঙালির উঠে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের প্রতি গভীর এক শ্রদ্ধাবোধে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। মনেপ্রাণে বাঙালি হিসেবে গভীর এক কর্তব্যবোধের তাই এটি এক সৃজনশীল নির্মাণ। স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণে অর্থের জোগানও আসছে আরেক সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমে। এযাবৎ খ্যাতিমান এই কথাসাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মের অর্জিত পুরস্কারের প্রাপ্ত অর্থ থেকেই এর নির্মাণ ব্যয় মেটানো হচ্ছে। আর এ কাজে ব্যয় করা হবে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। সেলিনা হোসেন তাঁর সাহিত্যকর্মের অর্জিত পুরস্কারের অর্থ দিয়ে সৃজনীলতার মহতী এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের বিষয়টি এ জনপদের মানুষের, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং একটি শুভ উদ্যোগ হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে। ডৌয়াতলা ওয়াজেদ আলী খান ডিগ্রি কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র মো. মান্নান শরীফ বলেন, 'নন্দিত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তাঁর সাহিত্যকর্ম দিয়ে যে পুরস্কার পেয়েছেন, তার অর্থ দিয়ে এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হচ্ছে। এ জন্য আমরা আনন্দিত। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। আমরা শিক্ষার্থীরা এই পাড়াগাঁয় এমন একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে প্রতিবছর শহীদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে পারব। এটা অনেক সৌভাগ্যের ও আনন্দের।'
সংগ্রামের প্রতীক : শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সব স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জীবন উৎসর্গিত সব শহীদের স্মৃতির উদ্দেশে নির্মিত শ্রদ্ধার নান্দনিক প্রতীক। এ স্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খান জানান, সব শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই চির উন্নত শির স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করা হচ্ছে। সে কারণে এর নির্মাণশৈলীতে তার প্রতীকী ধারণার বর্ণনাও স্পষ্ট করা হবে। তিনি জানান, স্মৃতিস্তভের মূল বেদিতে ওঠার সাতটি সিঁড়ি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, মূল বেদির ওপর দণ্ডায়মান ১১টি স্তম্ভ মুক্তিযুদ্ধের ১১ দফা, মাঝখানের সবচেয়ে উঁচু স্তম্ভটি এক দফা মানে আমাদের স্বাধীনতা, স্তম্ভগুলোর সামনে গোলাকৃতি অংশে ২১টি ফাঁকা প্রকোষ্ঠ আমাদের ভাষাসংগ্রামের মহান একুশে ফেব্রুয়ারি, ওই ২১টি ফাঁকা প্রকোষ্ঠের মাঝখানে বড় ফাঁকা বৃত্তটি আমাদের জাতীয় পতাকার লাল বৃত্ত আর স্তম্ভটির পাদদেশের বেদিতে ফুলেল সম্মাননার স্থান। বেদির ওপর থেকে বড় ফাঁকা বৃত্তটির মাঝখান দিয়ে আকাশে উড়বে বাংলার জাতীয় পতাকা। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম আর আজন্ম দ্রোহের প্রতীক হিসেবেই এ 'চির উন্নত শির' গড়ে উঠবে।
স্থানীয় বিশিষ্টজনের ভাষ্য : গ্রাম্য জনপদে আমাদের শহীদ মিনার কিংবা স্মৃতিসৌধগুলো যেমন ক্ষুদ্রাকৃতির, তেমনি তা সুরক্ষিত নয়। বেশির ভাগ স্থাপনা নান্দনিক বিষয় কিংবা সুরক্ষিতভাবে নির্মাণ করা হয় না। সে ক্ষেত্রে এ উপকূলে চির উন্নত শির শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি একটি ব্যতিক্রমী স্থাপত্য আর নান্দনিক নির্মাণের মডেল হতে পারে। এমন একটি স্থাপনা দেখে এ জনপদের অন্যান্য শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধের নির্মাণশৈলী বদলে যেতে পারে। আর এমন একটি মহতী কাজে আরো অনেক উদ্যোক্তা মানুষের অংশগ্রহণ বাড়তে পারে বলে স্থানীয় বিশিষ্টজনরা মনে করছেন। বরগুনার প্রবীণ সাংস্কৃতিক সংগঠক চিত্তরঞ্জন শীল বলেন, 'শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ আমাদের শহীদদের প্রতি সম্মাননা জানানোরই প্রতীক। নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চিরঞ্জীব করতে এটি একটি মহতী উদ্যোগ। আমাদের সংস্কৃতি টিকে থাকার লড়াই আর স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত রাখতে শুভ উদ্যোক্তা মানুষদের অভিনন্দন জানাই।' হলতা ডৌয়াতলা সমবায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নূরুল হক বলেন, শহীদ স্মৃতি স্মরণে চির উন্নত শির স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ একটি ভালো উদ্যোগ। গ্রাম্য জনপদে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটির নির্মাণশৈলীও দৃষ্টিনন্দন লাগছে। ডৌয়াতলা ওয়াজেদ আলী খান ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবদুল খালেক বলেন, 'মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির গর্বের ধন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছেই চির উন্নত শির শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ একটি মহতী উদ্যোগ।' বামনা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. গোলাম সাত্তার বলেন, উপকূলীয় এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বামনা অঞ্চল ইতিহাসের অংশ। কারণ এখানে ৯ নম্বর সেক্টরের সাবসেক্টর ছিল। এই সাবসেক্টর ছিল উপকূলীয় অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের মিলনকেন্দ্র। সংগত কারণেই মুক্তিযুদ্ধে এ অঞ্চলের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। ডৌয়াতলায় একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ সেই চেতনারই একটি প্রতীক। ডৌয়াতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাইতুল ইসলাম লিটু মৃধা বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। মুক্তিযুদ্ধে বামনা জনপদের ঐতিহাসিক অর্জন আছে। শহীদ স্মরণে ডৌয়াতলায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের বিষয়টি শুভ উদ্যোগ।' বামনার উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ সৈয়দ মানজুরুর রব মুর্তযা আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে বামনার সমৃদ্ধ একটি ইতিহাস আছে। ৯ নম্বর সেক্টরের সাবসেক্টর ছিল বামনার বুকাবুনিয়া। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসমৃদ্ধ এ জনপদে এমন একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ভালো উদ্যোগ। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত বুকাবুনিয়ার ওই স্থানটি আজও অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে ঐতিহাসিক স্থানটি সুরক্ষা করা প্রয়োজন।
লেখক : সাংবাদিক
যেভাবে শুরু : মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ নম্বর সেক্টরের সাবসেক্টর ছিল বামনা উপজেলার বুকাবুনিয়া। উপকূলীয় অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা বুকাবুনিয়া সাবসেক্টরে সমবেত হয়েই এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধে বামনা এক সমৃদ্ধ ইতিহাসের অংশ। বুকাবুনিয়ার পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন ডৌয়াতলা। সেখানে মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, প্রাইমারি স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ আর নানা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে গড়ে উঠেছে পরিকল্পিত হাটবাজার। সংগত কারণে ডৌয়াতলা ইউনিয়ন বাজার এখন মানুষের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। দেশের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের শ্বশুরবাড়ি এই ডৌয়াতালা গ্রামে। সেখানে তিনি ও তাঁর স্বামী বাংলাদেশ বিমানের সাবেক মহাব্যবস্থাপক ও মুক্তিযোদ্ধা মো. আনোয়ার হোসেন খান মিলে ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন নামে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। মানবাধিকার, সুশাসন ও শিক্ষার নানা ইস্যু নিয়ে এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওই সংগঠনের মাধ্যমে তাঁরা অনেক দিন ধরে কাজ করছেন। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ আর আমাদের ভাষাসংগ্রামের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে 'চির উন্নত শির' নামের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। ডৌয়াতলা ওয়াজেদ আলী খান ডিগ্রি কলেজ ও সমবায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে খেলার মাঠের পূর্ব দিকে ৩৬ ফুট উচ্চতার শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটির নির্মাণকাজ শুরু হয় চলতি বছরের জুন মাসে। স্মৃতিস্তম্ভটির মূল নকশা করতে দায়িত্ব পায় ঢাকার শহীদুল্লাহ অ্যাসোসিয়েট নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি দেশের খ্যাতিমান স্থাপত্যবিদ ও কবি রবিউল হুসাইনকে দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভটির মূল নকশার মডেল নির্মাণ করেন। সে মডেল অনুযায়ী মূল স্তম্ভটি নির্মাণ করছে মেসার্স জ্যোতি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ও ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন পরিচালনা কমিটির নির্বাহী সদস্য তপন কুমার হাওলাদার কালের কণ্ঠকে বলেন, স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ প্রকল্পে ১১ থেকে ১৫ লাখ টাকা সম্ভাব্য ব্যয় ধরে এর নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। আশা করছি, আগামী ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে উদ্যোক্তা কর্তৃপক্ষ স্মৃতিস্তম্ভটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধনী ওই অনুষ্ঠান ঘিরে ওই সময় দেশের খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, কবি ও সাংবাদিকদের নিয়ে এখানে একটি মিলন উৎসব হবে।
সৃজনশীলতার মহতী উদ্যোগ : দেশের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বাঙালির উঠে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের প্রতি গভীর এক শ্রদ্ধাবোধে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। মনেপ্রাণে বাঙালি হিসেবে গভীর এক কর্তব্যবোধের তাই এটি এক সৃজনশীল নির্মাণ। স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণে অর্থের জোগানও আসছে আরেক সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমে। এযাবৎ খ্যাতিমান এই কথাসাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মের অর্জিত পুরস্কারের প্রাপ্ত অর্থ থেকেই এর নির্মাণ ব্যয় মেটানো হচ্ছে। আর এ কাজে ব্যয় করা হবে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। সেলিনা হোসেন তাঁর সাহিত্যকর্মের অর্জিত পুরস্কারের অর্থ দিয়ে সৃজনীলতার মহতী এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের বিষয়টি এ জনপদের মানুষের, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং একটি শুভ উদ্যোগ হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে। ডৌয়াতলা ওয়াজেদ আলী খান ডিগ্রি কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র মো. মান্নান শরীফ বলেন, 'নন্দিত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তাঁর সাহিত্যকর্ম দিয়ে যে পুরস্কার পেয়েছেন, তার অর্থ দিয়ে এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হচ্ছে। এ জন্য আমরা আনন্দিত। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। আমরা শিক্ষার্থীরা এই পাড়াগাঁয় এমন একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে প্রতিবছর শহীদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে পারব। এটা অনেক সৌভাগ্যের ও আনন্দের।'
সংগ্রামের প্রতীক : শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সব স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জীবন উৎসর্গিত সব শহীদের স্মৃতির উদ্দেশে নির্মিত শ্রদ্ধার নান্দনিক প্রতীক। এ স্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খান জানান, সব শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই চির উন্নত শির স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করা হচ্ছে। সে কারণে এর নির্মাণশৈলীতে তার প্রতীকী ধারণার বর্ণনাও স্পষ্ট করা হবে। তিনি জানান, স্মৃতিস্তভের মূল বেদিতে ওঠার সাতটি সিঁড়ি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, মূল বেদির ওপর দণ্ডায়মান ১১টি স্তম্ভ মুক্তিযুদ্ধের ১১ দফা, মাঝখানের সবচেয়ে উঁচু স্তম্ভটি এক দফা মানে আমাদের স্বাধীনতা, স্তম্ভগুলোর সামনে গোলাকৃতি অংশে ২১টি ফাঁকা প্রকোষ্ঠ আমাদের ভাষাসংগ্রামের মহান একুশে ফেব্রুয়ারি, ওই ২১টি ফাঁকা প্রকোষ্ঠের মাঝখানে বড় ফাঁকা বৃত্তটি আমাদের জাতীয় পতাকার লাল বৃত্ত আর স্তম্ভটির পাদদেশের বেদিতে ফুলেল সম্মাননার স্থান। বেদির ওপর থেকে বড় ফাঁকা বৃত্তটির মাঝখান দিয়ে আকাশে উড়বে বাংলার জাতীয় পতাকা। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম আর আজন্ম দ্রোহের প্রতীক হিসেবেই এ 'চির উন্নত শির' গড়ে উঠবে।
স্থানীয় বিশিষ্টজনের ভাষ্য : গ্রাম্য জনপদে আমাদের শহীদ মিনার কিংবা স্মৃতিসৌধগুলো যেমন ক্ষুদ্রাকৃতির, তেমনি তা সুরক্ষিত নয়। বেশির ভাগ স্থাপনা নান্দনিক বিষয় কিংবা সুরক্ষিতভাবে নির্মাণ করা হয় না। সে ক্ষেত্রে এ উপকূলে চির উন্নত শির শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি একটি ব্যতিক্রমী স্থাপত্য আর নান্দনিক নির্মাণের মডেল হতে পারে। এমন একটি স্থাপনা দেখে এ জনপদের অন্যান্য শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধের নির্মাণশৈলী বদলে যেতে পারে। আর এমন একটি মহতী কাজে আরো অনেক উদ্যোক্তা মানুষের অংশগ্রহণ বাড়তে পারে বলে স্থানীয় বিশিষ্টজনরা মনে করছেন। বরগুনার প্রবীণ সাংস্কৃতিক সংগঠক চিত্তরঞ্জন শীল বলেন, 'শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ আমাদের শহীদদের প্রতি সম্মাননা জানানোরই প্রতীক। নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চিরঞ্জীব করতে এটি একটি মহতী উদ্যোগ। আমাদের সংস্কৃতি টিকে থাকার লড়াই আর স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত রাখতে শুভ উদ্যোক্তা মানুষদের অভিনন্দন জানাই।' হলতা ডৌয়াতলা সমবায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নূরুল হক বলেন, শহীদ স্মৃতি স্মরণে চির উন্নত শির স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ একটি ভালো উদ্যোগ। গ্রাম্য জনপদে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটির নির্মাণশৈলীও দৃষ্টিনন্দন লাগছে। ডৌয়াতলা ওয়াজেদ আলী খান ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবদুল খালেক বলেন, 'মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির গর্বের ধন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছেই চির উন্নত শির শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ একটি মহতী উদ্যোগ।' বামনা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. গোলাম সাত্তার বলেন, উপকূলীয় এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বামনা অঞ্চল ইতিহাসের অংশ। কারণ এখানে ৯ নম্বর সেক্টরের সাবসেক্টর ছিল। এই সাবসেক্টর ছিল উপকূলীয় অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের মিলনকেন্দ্র। সংগত কারণেই মুক্তিযুদ্ধে এ অঞ্চলের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। ডৌয়াতলায় একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ সেই চেতনারই একটি প্রতীক। ডৌয়াতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাইতুল ইসলাম লিটু মৃধা বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। মুক্তিযুদ্ধে বামনা জনপদের ঐতিহাসিক অর্জন আছে। শহীদ স্মরণে ডৌয়াতলায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের বিষয়টি শুভ উদ্যোগ।' বামনার উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ সৈয়দ মানজুরুর রব মুর্তযা আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে বামনার সমৃদ্ধ একটি ইতিহাস আছে। ৯ নম্বর সেক্টরের সাবসেক্টর ছিল বামনার বুকাবুনিয়া। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসমৃদ্ধ এ জনপদে এমন একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ভালো উদ্যোগ। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত বুকাবুনিয়ার ওই স্থানটি আজও অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে ঐতিহাসিক স্থানটি সুরক্ষা করা প্রয়োজন।
লেখক : সাংবাদিক
No comments