শেয়ারবাজার-নতুন বছরে ভালো কিছুর প্রত্যাশা by নাজমুল আলম শিশির
২৩ নভেম্বরের ২১ দফা ঘোষণায় দীর্ঘ মেয়াদে বাজারে স্থিতিশীলতা আনার প্রয়াস থাকলেও দরপতনের ধারায় ফিরে যাচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের শেয়ারবাজার। গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সূচক ৯৮.৮৮ পয়েন্ট পড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯৩২.৩০-এ। গত বছরের ৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া বিপর্যয়ের পর থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সূচক কমেছে ৩৯৮৬.২১ পয়েন্ট। বাজার মূলধন কমেছে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা।
লেনদেনের পরিমাণ তিন হাজার দুই কোটি থেকে নেমে এখন প্রতিদিন লেনদেন হচ্ছে ২০০ কোটি টাকার মধ্যে। বৃহস্পতিবার ডিএসইর লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২০২ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এসইসি ঘোষিত গুচ্ছ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছিলেন, ঘোষিত এসব সিদ্ধান্তে শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে তাতে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে বাজারে চাহিদা বাড়বে। সেই সঙ্গে বাজারে শেয়ারের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বাজারের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে মির্জ্জা আজিজ বলেন, এখন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বছর শেষের হিসাব চলছে। ফলে তারা হয়তো চাইছে না ঝুঁকিপূর্ণ বাজারে বিনিয়োগ করতে। আগামী বছরের শুরুতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা হয়তো তাদের বিনিয়োগ শুরু করবে। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ শুরু হলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদেরও আস্থা ফিরে আসবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'এখন তো শেয়ারের দাম অনেক কমে গেছে। এখন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ভাবতে পারেন তাঁরা বিনিয়োগ করবেন কি না। তবে আমি মনে করি, এখনই বিনিয়োগের উৎকৃষ্ট সময়। তাঁরা তো বছর শেষে যে লভ্যাংশ পাবেন তার পরিমাণও ব্যাংকের সুদের হার থেকে বেশি হবে।' মির্জ্জা আজিজ আরো বলেন, সরকারও ধার করে চলছে, এখন শেয়ারবাজারেও যদি ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে তাহলে সেটা অন্য বিষয়।
এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে গতিশীলতা নেই। তবে তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের সঙ্গে বাজারের উত্থান-পতনের কোনো সম্পর্ক নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তদন্ত কমিটির প্রধান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, 'পুঁজিবাজারের দরপতন ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রীকে আলোচনায় নামানো ঠিক হয়নি। প্রধানমন্ত্রী হয়তো ভেবেছেন তিনি আলোচনায় বসলে বাজার ঠিক হয়ে যাবে। এটা তাঁর উদারতা। তবে যাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে আলোচনায় নামিয়েছেন, তাঁরা সঠিক কাজটি করেননি বলে আমি মনে করি। বিশ্বের কোথাও প্রধানমন্ত্রী বাজারের দরপতন ঠেকাতে বৈঠক করেন না।'
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, 'এসইসির আগের পরিচালনা পর্ষদ কিংবা চেয়ারম্যানের ওপর মানুষের আস্থা ছিল না। কিন্তু আমার মনে হয় বর্তমান চেয়ারম্যানের ওপরও বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না। এসইসির মেমোরেন্ডামের শুরুতেই লেখা আছে, প্রতিষ্ঠানটি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে কাজ করবে। কিন্তু তিনি বৃহৎ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থেই কাজ করছেন, তাঁদের সঙ্গেই বৈঠক করছেন এবং তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দাবি-দাওয়া নিয়েই আলোচনা করছেন; ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে নয়। তা ছাড়া এসইসি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। বর্তমান পর্ষদ দায়িত্ব গ্রহণের পর আমাদের কমিটির রিপোর্ট ধরে ধরে বাজার স্থিতিশীল করার নানা উদ্যোগ নেওয়ার কথা। কিন্তু তিনি তা না করে বারবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে ছুটছেন। এতে বিনিয়োগকারীরা তাঁর ওপর আস্থা হারাচ্ছেন বলে আমি মনে করি।'
তদন্ত কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, 'তখন আমরা তদন্ত করে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিলাম। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দেওয়ার সময় যে পরিবেশ ছিল তখন যদি আমাদের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হতো তাহলে হয়তো বাজার ভালো হয়ে যেত। প্রণোদনাসহ এত বেশি কিছুর প্রয়োজন হতো না। এখন তো অনেক কিছু করার পরও লোকজনের আস্থা ফিরে আসছে না।' বর্তমানে ব্যক্তি শ্রেণীর ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁদের ফিরিয়ে আনতে হবে। তাঁদের না আনতে পারলে তো এই শেয়ারবাজার স্থিতিশীল হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ওসমান ইমাম বলেন, বর্তমানে শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের পরিমাণ কমে গেছে, যার ফলে সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আস্থাও কমে গেছে। গত বছরের এই সময়ে যেখানে ব্যাংকগুলোর পোর্টফোলিও ছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা, সেখানে বর্তমানে তা ৯ হাজার কোটি টাকায় এসেছে ঠেকেছে। ব্যাংকগুলোরও তো কিছু সমস্যা রয়েছে। তাদের তারল্য সংকট আছে। এ ছাড়া বর্তমানে ডিসেম্বর ক্লোজিং চলছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে।
ব্যাংক মালিক ও ব্যাংকারদের সংগঠন বিএবি ও এবিবি থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ নিয়ে যেসব ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, এর সমালোচনা করে এই বাজার বিশ্লেষক বলেন, তারা ভালো করেই জানে তাদের সমস্যা কোথায়। এর পরও এ ধরনের কথা বলা ঠিক নয়। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতায় প্রতিদিনই লেনদেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে মন্তব্য করে ড. ওসমান ইমাম বলেন, সরকার গুচ্ছ প্রণোদনাসহ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন। যখন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা দেখবেন বাজারে টার্নওভার ভালো, তখন এমনিতেই তাঁদের আস্থা ফিরে আসবে। তবে এর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করতে হবে।
ডিএসইর সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. সালাউদ্দিন আহমেদ খান বলেন, 'পুঁজিবাজারের ধর্মের মধ্যে আছে ওঠা ও নামা। নামার পর উঠে যাবে এটাই স্বাভাবিক। এর পরও এত দীর্ঘ মেয়াদে বাজারের পতনের কিছু কারণ থাকতে পারে বলে আমার মনে হয়। গত জানুয়ারিতে যখন বাজারে পতন হলো তখন আমরা কিছু পরিকল্পনা নেওয়ার কথা বলেছিলাম। এর আলোকে বাংলাদেশ ফান্ড গঠন করা হলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয়নি। ফলে শেয়ারবাজার পতনের ধারাতেই রয়েছে।'
সামান্য তহবিল দিয়ে বাজার চাঙ্গা করা সম্ভব নয় মন্তব্য করে ড. সালাউদ্দিন বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ দিয়ে বাজারকে সাপোর্ট দেওয়া প্রয়োজন। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বড় সাপোর্ট থাকলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে। বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগ থেকে বিরত রয়েছেন।
ড. সালাউদ্দিন বলেন, গত বছর শেয়ারের সরবরাহের বিপরীতে অতিরিক্ত চাহিদা ছিল, আর বর্তমানে সরবরাহ থাকলেও চাহিদার ঘাটতি রয়েছে। এই সরবরাহ এবং চাহিদার মধ্যে সমন্বয় হলেই বাজার স্থিতিশীল হয়ে যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ শুরু হলে এবং কম্পানির পরিচালকরা শেয়ার কেনা শুরু করলেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে। আর আস্থা ফিরে এলে বাজার ঠিক হয়ে যাবে। তবে এর জন্য কিছু সময়ের প্রয়োজন।
চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জের নবনির্বাচিত সভাপতি আল মারুফ খান বলেন, 'এসইসির কাজ নীতি নির্ধারণ করা। বাজারে লেনদেন হয় মার্কেট প্লেসে বা স্টক এঙ্চেঞ্জে। তাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অনেকটা নির্ভর করে আমাদের স্টক এঙ্চেঞ্জের ওপর। বিশেষ করে স্টক এঙ্চেঞ্জের সার্ভিলেন্সের ওপর। এর ওপর নির্ভর করে বিনিয়োগকারীদের আস্থা।' তিনি বলেন, বর্তমানে ব্যাংকসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মতো আচরণ করছে। তারা স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তাদের উচিত দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করা।
No comments