বিচিত্র বান্দরবান by উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা
মেঘ ছোঁয়ার ইচ্ছে কার না হয়! ঘন মেঘের ভেতর হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতিটাই তো অন্যরকম। অন্যরকম সেই অনুভূতিটা কতটা আনন্দের হতে পারে তা কেবল বান্দরবান এলেই উপলব্ধি করা যায়। দেশের যে কোনো জেলার চেয়ে বৈচিত্র্যময় বান্দরবান। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়েছে এ জেলাকে। সারি সারি পাহাড়-পর্বত, ছোট-বড় অসংখ্য ঝরনা, দেশের সর্বোচ্চ উঁচু পর্বত তাজিংডং (বিজয়), দ্বিতীয় পর্বত কেওক্রাডং, নীল আকাশ ছুঁয়ে যাওয়া
নীলগিরি, সাঙ্গু নদী, বাংলার নায়াগ্রা খ্যাত নাফাখুম জলপ্রপাত, বৌদ্ধদের বিখ্যাত স্বর্ণজাদি মন্দির, প্রান্তিক লেক, বগা লেকসহ কী নেই এখানে। এখানে বাস করে ১২টি আদিবাসী সম্প্রদায়। যা বাংলাদেশের অন্য কোনো জেলায় নেই। এসব আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভাষা, পোশাক, খাওয়া-দাওয়া সবকিছুই সম্পূর্ণ আলাদা।
যাবেন যেভাবে
নগরীর বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে প্রতি আধঘণ্টা পরপর পূরবী ও পূর্বাণী বাস ছাড়ে বান্দরবানের উদ্দেশে। জনপ্রতি ভাড়া নেয় ৯০ টাকা। ঝামেলা এড়াতে প্রাইভেট গাড়িতে কিংবা ভাড়া করা গাড়িতেও আসা যায়। কক্সবাজার কিংবা রাঙামাটি থেকেও সরাসরি বান্দরবান আসার বাস রয়েছে।
বেড়াবেন যেখানে
বান্দরবান বেড়াতে আসতে হলে অবশ্যই হাতে কয়েকটি দিন রাখতে হবে। তা না হলে এর সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করতে পারবেন না। যদি সময় না থাকে তবে শহরের আশপাশের স্পটগুলো ঘুরেই বিদায় নিতে হবে। অবশ্য শহরের স্পটগুলো এক দিনের মধ্যেই ঘুরে শেষ করা যাবে। অন্যদিকে যারা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় তারা ঘুরে আসতে পারেন দুর্গম থানচির বড় ও ছোট মদক, রেমাক্রি, নাফাখুম, রুমার কেওক্রাডং, তাজিংডং, বগা লেক, ঋজুক ঝরনা, রাইনক্ষ্যং পুকুর কিংবা আলীকদমের আলী সুড়ঙ্গে।
নীলাচল : শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের এ স্পটে যে মৌসুমেই যান না কেন সব সময় একটা শীতল হাওয়া পাবেন। এখান থেকে পুরো শহর দেখা যায়। রাতে এখান থেকে শহরের সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে যে কাউকে। শীতের সকালে ঘন কুয়াশায় ঢাকা থাকে নীলাচল। মেঘের ফাঁক গলিয়ে সূর্যের ঝিলিক দেখতে অপূর্ব লাগে। ভাগ্যদেবী পাশে থাকলে সকালে ছুঁতে পারেন মেঘও! এ কারণে নীলাচলকে বলা হয় বাংলার দার্জিলিং। দার্জিলিংয়ের মতো এখানেও হঠাৎ মেঘ এসে পুরো পাহাড় ঢেকে দেয়। শহর থেকে নীলাচল যাওয়ার জার্নিটাও বেশ উপভোগ্য।
স্বর্ণজাদি : স্বর্ণজাদির আসল নাম বুদ্ধধাতু চেতী। এমন সুন্দর কারুকাজে তৈরি এ মন্দির দর্শনেই মন পবিত্র হয়ে যায়। শহর থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার দূরের এ জাদিটি বৌদ্ধদের কাছে পবিত্র এক তীর্থস্থান। মন্দিরের আশপাশ থেকে সবাই এর সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারবেন। তবে পূজা কিংবা প্রণাম করার উদ্দেশ্যে যে কেউ যেতে পারবেন এর ভেতরেও। এ মন্দিরের পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে ঐতিহ্যবাহী এক পুকুর। বৌদ্ধরা এ পুকুরকে সম্মানের চোখে দেখে; কারণ এটি যে দেবতা পুকুর! ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াও পূর্ণিমায় এখানে জড়ো হন হাজার হাজার পুণ্যার্থী।
মেঘলা : সবার কাছে পরিচিত এক নাম মেঘলা। প্রতিবছর ঈদে ও শীতে এখানে পর্যটকের ঢল নামে। পার্বত্যাঞ্চলের প্রথম স্থাপিত কেবল কারও রয়েছে এখানে। এটিতে চড়তে কিংবা মেঘলায় প্রবেশের আগে অবশ্য টিকিট কাটতে হবে। এখানে ঝুলন্ত সেতর পাশাপাশি রয়েছে মিনি চিড়িয়াখানা। ইচ্ছে হলে উঠতে পারেন প্যাডেল বোটে। রাতযাপনের জন্য এখানে রয়েছে ছোট ছোট কটেজ। রয়েছে খাবারের ব্যবস্থাও।
শৈলপ্রপাত : প্রকৃতির আরেক সৌন্দর্য শৈলপ্রপাত। নীলগিরি যাওয়ার পথে পড়বে এটি। শহর থেকে এর দূরত্ব আট কিলোমিটার। এখানে এলে এর শীতল পানিতে শরীরটা এলিয়ে দিতে ইচ্ছে করবে। একটু সাবধানে শৈলপ্রপাতে নেমে আপনি সহজেই পূরণ করতে পারেন এ ইচ্ছে। শৈলপ্রপাতের পাশে বিক্রি হয় আদিবাসীদের তৈরি করা বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক। বম সম্প্রদায়ের মেয়েরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে তৈরি করে মনকাড়া এসব পোশাক।
প্রান্তিক লেক : মেঘলার মতো আরেক কৃত্রিম লেক প্রান্তিক লেক। শীতে এখানে অসংখ্য অতিথি পাখির আগমন ঘটে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ চারপাশের পরিবেশ মুখর করে রাখে। শহর থেকে এর দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের হলদিয়ার ভেতর দিয়ে সেখানে যেতে হয়। হলদিয়া বাজারের পাশে রয়েছে সেনাবাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জ। প্রান্তিক লেকের চারপাশ ঘিরে
আছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। নিরাপত্তা নিয়ে পর্যটকদের ভাবতে না হলেও এখানে রাতযাপনের সুব্যবস্থা নেই।
মিলনছড়ি : শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে নীলগিরি যাওয়ার পথে পড়ে মিলনছড়ি। ব্যক্তিমালিকানায় গড়ে তোলা এ পর্যটনকেন্দ্রে রাতযাপনের জন্য রয়েছে ছোট ছোট কটেজ। এর আগে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী রেস্টুরেন্ট সাকুরা। এখানেও রয়েছে রাতযাপনের ব্যবস্থা। তবে শীতকালে আগেভাগে বুকিং না দিলে এখানে রুম পাওয়া যায় না।
চিম্বুক : পর্যটকদের কাছে পরিচিত এক নাম চিম্বুক। দেশি-বিদেশি অসংখ্য পর্যটক প্রতিনিয়ত ভিড় করেন এখানে। সারাবছরই চিম্বুকে শীত-শীত অনুভব হয়। শহর থেকে এর দূরত্ব ২৭ কিলোমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় দুই হাজার ৮শ' ফুট। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পর্যটকদের জন্য এখানে রয়েছে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত হয়েছে একটি রেস্ট হাউসও। মেঘ ছোঁয়া যায় চিম্বুক পাহাড় থেকেও। এ পাহাড়ে জুমচাষিরা বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি গাঁদা ফুলের চাষ করেন।
নীলগিরি : বান্দরবান ঘুরে গেছেন কিন্তু নীলগিরি যাওয়া হয়নি, তবে নিশ্চিত থাকুন আপনার বেড়ানোর অর্ধেকই অপূর্ণ রয়ে গেছে। এককথায় অসাধারণ এক পর্যটন স্পট নীলগিরি। শহর থেকে এর দূরত্ব ৪৭ কিলোমিটার। উঁচু-নিচু দীর্ঘ পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে তবেই এখানে পেঁৗছতে হবে। যদি চালক ভালো পান তবে সর্পিল এ পথের পুরোটাই আপনি দারুণভাবে উপভোগ করতে পারবেন। আমাদের দেশটা কত সুন্দর নীলগিরি না এলে তা জানতেই পারবেন না।
পাহাড় বেয়ে গাড়ি কখনও উঠবে, আবার কখনও নামতে থাকবে। গাড়ি যতদূর এগোবে সৌন্দর্য যেন ততই বাড়তে থাকবে। দু'চোখ যেদিকে যায় শুধু সবুজ আর সুবজ। গাড়ি থেকে সামনে তাকালে দেখতে পাবেন গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ। বুঝি এগুলো ধরা যাবে! কিন্তু সেখানে গেলে দেখবেন মেঘগুলো যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ভাদ্রের তালপাকা গরমেও শীত শীত অনুভূতি দিয়ে মেঘ জানান দেবে_ সে হাওয়ায় হারিয়ে যায়নি, এখানেই আছে। পেছনে তাকাতেই চোখে পড়বে মেঘের গুচ্ছ। এ যেন প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাখেলা।
নীলগিরি যাওয়ার পথেই দেখবেন আদিবাসী নারী-পুরুষ পাহাড়ের ওপর বসে বিক্রি করছে কলা, পেঁপে, পেয়ারাসহ তাদের ক্ষেতের বিভিন্ন ফল। গাড়ি থামিয়ে একেবারে সস্তায় কিনে নিতে পারেন এসব ফল। দাম কম হলেও এসব ফলের স্বাদ কিন্তু কম নয়। টাটকা ফল খাওয়ার মজাটা নিতে পারবেন এখান থেকে। দুর্গম পাহাড়ের দীর্ঘ ভ্রমণপথে এসব ফল মনে হবে অমৃত।
সূর্য মামা ভালোভাবে নিজেকে মেলে ধরার আগে যদি নীলগিরি পেঁৗছতে পারেন তবে নিশ্চিত থাকুন আপনার জন্য অপেক্ষা করছে সারাজীবন স্মরণে রাখার মতো এক মুহূর্ত_ সবুজ পাহাড়টা ভরে আছে সাদা মেঘে। যেখানেই তাকান মেঘ আর মেঘ। মেঘের কারণে দূরের পাহাড়গুলোতেও সবুজের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে পেঁৗছতে যদি একটু দেরি হয় তাহলেও মন খারাপ করার কারণ নেই। তখনও দেখা যাবে, হঠাৎ একদল মেঘ এসে ঢেকে দিয়েছে পুরো নীলগিরি। আবার কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে সেই মেঘ। এভাবে মেঘের দলবেঁধে আসা-যাওয়ার খেলা মুহূর্তেই আপনাকে নিয়ে যাবে স্বপ্নের এক জগতে।
নীলগিরিতে এক রাত যদি থাকতে পারেন তবে নিশ্চিতভাবেই সেটি হবে আপনার জীবনের স্মরণীয় এক রাত হবে। তবে এ স্বপ্ন পূরণ করাটা কিন্তু খুবই কঠিন। কারণ এখানে থাকতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার। একে তো পর্যটকের ভীষণ আগ্রহ, তার ওপর এখানে রয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি রুম। পর্যটকদের জন্য গড়ে তোলা মেঘদূত, নীলাতানা ও আকাশ নীলাই বছরজুড়েই বুকিং থাকে। তাই বান্দরবান আসতে হলে আগে নীলগিরিতে রুম বুকিং দিয়ে তবেই আসতে হবে। যদি রুম পেয়ে যান তবে নিশ্চিন্তে চলে আসুন নীলগিরি। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকায় এখানে নিরাপত্তা নিয়ে এতটুকু চিন্তাও করতে হবে না। রাতের বেলা এখানে শুনতে পাবেন বন্য হরিণ, শেয়াল, বানরসহ বিভিন্ন পশু-পাখির শব্দ।
জীবননগর : নীলগিরি থেকে জীবননগরের দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। তবে শহর থেকে এর দূরত্ব ৫২ কিলোমিটার। থানচি যাওয়ার পথে পড়বে জীবননগর। জেলার পাকা সড়কের মধ্যে জীবননগর সড়কটি সবচেয়ে খাড়া ও ঢালু। সমতলে চলাচলে অভ্যস্ত পর্যটকদের কাছে এটি হতে পারে অন্যরকম এক জার্নি। এখানে এসে আপনি নিজেকে ঢেকে দিতে পারেন ঘন মেঘের চাদরে। ঘন কুয়াশার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের হাসি আপনাকে নির্মল আনন্দ দেবে।
রিজুক ঝরনা : রুমা বাজার থেকে নৌকায় কিংবা হেঁটে রিজুক ঝরনা যাওয়া যায়। হেঁটে গেলে সময় লাগবে আধঘণ্টা; নৌকায় যেতে লাগবে পৌনে এক ঘণ্টা। এ ঝরনায় সারাবছর পানি থাকে। প্রায় ৬০-৭০ ফুট উঁচু থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় এখানে পর্যটক খুব বেশি হয় না। তবে কষ্ট করে যদি সেখানে যান তাহলে এতটুকু নিশ্চিত, ঝরনার সৌন্দর্য নিমিষেই ভুলিয়ে দেবে পথের সব কষ্ট। ঝরনার সৌন্দর্য আপনাকে এতটাই বিমোহিত করবে, শীতের মধ্যেও শরীরটা এলিয়ে দিতে ইচ্ছে হবে এর হিম শীতল পানিতে।
বড় মদক ও ছোট মদক : থানচি বাজার থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করে মদক যেতে হবে। সময় লাগবে সাত ঘণ্টা। তাই খুব ভোরে রওনা দিতে হবে। সাঙ্গু নদীর উৎপত্তিস্থলের দিকে নৌকা এগুতে থাকবে। নদীর দু'ধারে চোখে পড়বে ছোট-বড় অসংখ্য পাথর। খরস্রোতা পানি ডিঙিয়ে উজানের দিকে যত এগোতে থাকবেন ততই মুগ্ধ হবেন। বান্দরবানে এমন সুন্দর জায়গা আছে কল্পনাই করতে পারবেন না। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্যটকদের জন্য এটি আনন্দের এক ভ্রমণ। তবে এ ভ্রমণে সাধারণ পর্যটকদের সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। নৌকা চলার সময় হঠাৎ পাথরের সঙ্গে ধাক্কা লাগতে পারে। যদি সতর্ক না থাকেন তবে নৌকা থেকে পড়ে আহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া নদীর স্রোতে পরিধেয় পোশাকও ভিজে যেতে পারে। তাই যাওয়ার আগে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
ছোট ও বড় মদকের আগে পড়বে রেমাক্রি। রেমাক্রি পেঁৗছার আগে দেখতে পাবেন বড় একটি পাথর। যা স্থানীয়দের কাছে পরিচিত দেবতার পাথর হিসেবে। মারমা ভাষায় বিশালাকার ওই পাথরটিকে বলা হয় 'ভংড'।
এ ভ্রমণে সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে পাহাড়ি পিচ্ছিল পথে পা ফেলার সময়। কারণ একটু অসতর্ক হলেই আপনার আনন্দের ভ্রমণটা মুহূর্তেই ছেয়ে যাবে বিষাদে।
কেওক্রাডং : বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কেওক্রাডং। এর উচ্চতা প্রায় চার হাজার ৩৩২ ফুট। তাজিংডং আবিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত এর অবস্থান ছিল প্রথমে। যারা বগা লেকে রাতযাপন করবেন তারা কেওক্রাডং ঘুরে আসতে পারেন। বগা লেক থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। রুমা বাজার থেকে দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। রুমা বাজার থেকে পায়ে হেঁটেও সেখানে যাওয়া যায়। তবে তা খুব কষ্টসাধ্য। কেওক্রাডং যাওয়ার আগে সঙ্গে স্থানীয় একজন গাইড থাকা জরুরি।
বগা লেক : প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে অনেক কিছু সৃষ্টি করে, যা মানুষের পক্ষে সৃষ্টি করা কখনোই সম্ভব নয়। বগা লেক হচ্ছে প্রকৃতির এমনই এক সৃষ্টি। শীতে রুমা বাজার থেকে চাঁদের গাড়িতে বগা লেক যাওয়া যায়। লেকের পাড়ে কয়েকটি কটেজ নির্মাণ করেছেন স্থানীয়রা। কটেজের সামনে ছোট হোটেলে রয়েছে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না; পাশেই রয়েছে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। এ লেক সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন হাজার ফুট উঁচুতে। ১৫ একর জায়গা নিয়ে এ লেকের অবস্থান। বর্ষায় এ লেকের পানি ঘোলা হয় না, আবার গরমের দিনে শুকিয়েও যায় না। রুমা বাজার থেকে এর দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। যারা অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন তারা স্থানীয় একজন গাইড নিয়ে পাঁয়ে হেঁটে এখানে আসতে পারেন।
তাজিংডং (বিজয়) : দেশের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ তাজিংডং (বিজয়)। স্থানীয়দের কাছে এটি তজিডং নামেই বেশি পরিচিত। এর উচ্চতা প্রায় চার হাজার ৫শ' ফুট। রুমা থেকে এর দূরত্ব ২৭ কিলোমিটার।
রাইনক্ষ্যং পুকুর : রোয়াংছড়ি ও রুমা বাজার থেকে যাওয়া যায় রাইনক্ষ্যং পুকুর। রুমা থেকে পায়ে হেঁটে যেতে আট ঘণ্টা লাগবে। সঙ্গে অবশ্যই স্থানীয় একজন গাইড নিতে হবে। তা না হলে পথ হারিয়ে ফেলার শঙ্কা রয়েছে। আর একবার যদি পথ হারান তবে টের পাবেন বিপদ কাকে বলে।
রুমা বাজার থেকে রাইনক্ষ্যং পুকুর সবচেয়ে কাছে। তবে এর আগে একটি রাত আপনাকে রুমার কোনো বোর্ডিংয়ে কাটাতে হবে। পরদিন খুব ভোরে গাইড নিয়ে রওনা দিতে হবে। সঙ্গে ফাস্ট এইড, টর্চলাইট, মোম, দিয়াশলাই, শুকনো খাবার ও পানি নিতে হবে। ভারি কোনো জিনিসপত্র সঙ্গে রাখা সঙ্গত হবে না। বড়টলিপাড়ায় কোনো ত্রিপুরার বাড়িতে ম্যানেজ করে দুপুরের খাওয়া সেরে নিতে পারেন। এরপর আবার রওনা দিতে হবে। পাহাড়ের চূড়ায় রাইক্ষ্যং পুকুরের অবস্থান। এর দৈর্ঘ্য প্রায় এক কিলোমিটার।
অনন্য এক পর্যটন স্পট রাইনক্ষ্যং পুকুর। এ পুকুর থেকে বড় বড় তেলাপিয়া মাছ ধরে নিজেরাই রান্না করে খেতে পারবেন। পাড়ার কার্বারিকে (পাড়াপ্রধান) অথবা পাড়ার কোনো লোককে টাকা দিলে তিনিই রান্নার ব্যবস্থা করে দেবেন। বগা লেকের মতো এ পুকুর নিয়েও স্থানীয়দের কাছে অনেক কাহিনী শোনা যায়।
মিরিঞ্জা : লামা সড়কে এর অবস্থান। কক্সবাজারের চকরিয়া হয়ে মিরিঞ্জা যেতে হয়। এখানে রয়েছে টাইটানিক নামে একটি পাহাড়। মিরিঞ্জা পর্যটনকেন্দ্রের প্রায় এক হাজার ফুট নিচুতে রয়েছে একটি ঝরনা। মিরিঞ্জায় যেতে হলে প্রথমে চকরিয়াতে নামতে হবে। এরপর জিপ অথবা বাসে করে যেতে হবে। তবে বান্দরবান শহর থেকে সরাসরিও এখানে আসা যায়। মিরিঞ্জায়ও রয়েছে রাত যাপনের সুব্যবস্থা।
নাফাখুম জলপ্রপাত : থানচি বাজার থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে রেমাক্রি যেতে হবে। সেখানে রাতযাপন করে পরদিন ভোরে নাফাখুময়ের উদ্দেশে রওনা দিতে হবে। যাত্রা আরামদায়ক করতে স্যান্ডেল পরে রওনা দিতে হবে। কারণ যাওয়ার পথে অনেকবার পানি পার হতে হবে। আবার পাহাড়ের ঢাল বেয়ে যাওয়ার সময় সাবধান থাকতে হবে যাতে পা পিছলে না পড়েন। রেমাক্রি বাজার থেকে নাফাখুম পেঁৗছতে সময় লাগবে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। ভ্রমণটা কষ্টকর হলেও নাফাখুম জলপ্রপাত পেঁৗছলে এর সৌন্দর্যের কাছে কষ্টটা তুচ্ছ মনে হবে। নাফাখুম পরিচিত বাংলার নায়াগ্রা হিসেবে। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের মতো বিশাল না হলেও বাংলাদেশের জন্য এটি অনেক বড় জলপ্রপাত বলা যেতে পারে। প্রায় চলি্লশ ফুট উঁচু থেকে এখানে পানি গড়িয়ে পড়ে। এখানে প্রতি ঘণ্টায় প্রবাহিত হয় হাজার হাজার গ্যালন পানি। এটি প্রায় দেড়শ' ফুট চওড়া। বর্ষায় গেলে এর দেখা যাবে এর ভয়ানক রূপ।
খাওয়া-দাওয়া
বান্দরবানের পর্যটন স্পটের বেশিরভাগই দুর্গম এলাকায়। তাই পথিমধ্যেই যা পাওয়া যায় তা দিয়ে সেরে নিতে হয় খাওয়া। যদি শহরে থাকেন তবে খেতে পারেন আয়েশ করে। এজন্য মেঘলা পর্যটনের পাশেই রয়েছে হলিডে ইন রিসোর্ট (০১৫৫৬৯৮০৪৩২ ও ০৩৬১-৬২৮৯৬)। এখানে দেশি খাবারের পাশাপাশি পাওয়া যায় চাইনিজও। ঐতিহ্যবাহী রাজার মাঠ ও সিনেমা হলের সামনে রয়েছে রী সংসং চাইনিজ রেস্টুরেন্ট (০৩৬১-৬২৯১৭), দি কিং অফ বান্দরবান (০৩৬১-৬২৮৮৭), হোটেল আমিরাবাদ ও হোটেল খাওয়া-দাওয়া। এছাড়া শহরের ভেতর মাঝারি মানের আরও অনেক হোটেল রয়েছে।
থাকতে পারেন যেখানে
বান্দরবান শহরের স্পটগুলো ঘুরতে হলেও এখানে একটি রাত থাকতে হবে। বাজেট অনুযায়ী পছন্দ করতে হবে হোটেল। এ জন্য যোগাযোগ করতে পারেন পর্যটন মোটেল মেঘলা (০১৮১৭৭১৬৯১৬, ০১৫৫৬৫৪৫৭৪৬, ০৩৬১-৬২৩৩২,৬২৭৪১), হোটেল পূরবী (০১১৯৯৭৬১৪৮৫ ও ০৩৬১-৬২৫৩১), হোটেল গ্রীন হিল (০১৫৫৬৫৩৩০৩৫ ও ০৩৬১-৬২৫৭৪), হোটেল ফোর স্টার (০৩৬১-৬২৪৬৬), হোটেল হিলবার্ড (০১১৯৯৭৬১৪৮৫ ও ০৩৬১-৬২৪৪১), হোটেল রয়েল (০৩৬১-৬২৯২৬), হোটেল বিলকিছ (০৩৬১-৬২০৬১), হোটেল সারওয়ার (০১৫৫৩৫৮৮৩৮৯ ও ০১৫৫৬৫৩৩১৫৫), হোটেল অতিথি (০১৫৫৬৩৯১৬৪৭ ও ০৩৬১-৬২৫৩৫), হোটেল শাওন (০১৭১৩৬১৭১২৯ ও ০৩৬১-৬২৪৪৯), হোটেল রাজু (০১৮২০২৫৪৬৮ ও ০৩৬১-৬২৮৯১), হোটেল হিরু (০৩৬১-৬২১৪০), হোটেল আল-আমিন (০১৮১২৬৮৪৭৪৯ ও ০৩৬১-৬২৪৩১), হোটেল কামাল (০১১৯০৭৮০০৮৩), হোটেল আজমীর (০১৫৫৬৩৯১৬৪৭), হোটেল প্রু আবাসিক (০৩৬১-৬২২৫৭) কিংবা হোটেল হাবিবে (০১৮২০২৪০৪১৪)। এ ছাড়াও সরকারিভাবে এলজিইডি, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, বন বিভাগ কিংবা জেলা পরিষদের রেস্ট হাউসেও থাকতে পারেন।
যাবেন যেভাবে
নগরীর বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে প্রতি আধঘণ্টা পরপর পূরবী ও পূর্বাণী বাস ছাড়ে বান্দরবানের উদ্দেশে। জনপ্রতি ভাড়া নেয় ৯০ টাকা। ঝামেলা এড়াতে প্রাইভেট গাড়িতে কিংবা ভাড়া করা গাড়িতেও আসা যায়। কক্সবাজার কিংবা রাঙামাটি থেকেও সরাসরি বান্দরবান আসার বাস রয়েছে।
বেড়াবেন যেখানে
বান্দরবান বেড়াতে আসতে হলে অবশ্যই হাতে কয়েকটি দিন রাখতে হবে। তা না হলে এর সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করতে পারবেন না। যদি সময় না থাকে তবে শহরের আশপাশের স্পটগুলো ঘুরেই বিদায় নিতে হবে। অবশ্য শহরের স্পটগুলো এক দিনের মধ্যেই ঘুরে শেষ করা যাবে। অন্যদিকে যারা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় তারা ঘুরে আসতে পারেন দুর্গম থানচির বড় ও ছোট মদক, রেমাক্রি, নাফাখুম, রুমার কেওক্রাডং, তাজিংডং, বগা লেক, ঋজুক ঝরনা, রাইনক্ষ্যং পুকুর কিংবা আলীকদমের আলী সুড়ঙ্গে।
নীলাচল : শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের এ স্পটে যে মৌসুমেই যান না কেন সব সময় একটা শীতল হাওয়া পাবেন। এখান থেকে পুরো শহর দেখা যায়। রাতে এখান থেকে শহরের সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে যে কাউকে। শীতের সকালে ঘন কুয়াশায় ঢাকা থাকে নীলাচল। মেঘের ফাঁক গলিয়ে সূর্যের ঝিলিক দেখতে অপূর্ব লাগে। ভাগ্যদেবী পাশে থাকলে সকালে ছুঁতে পারেন মেঘও! এ কারণে নীলাচলকে বলা হয় বাংলার দার্জিলিং। দার্জিলিংয়ের মতো এখানেও হঠাৎ মেঘ এসে পুরো পাহাড় ঢেকে দেয়। শহর থেকে নীলাচল যাওয়ার জার্নিটাও বেশ উপভোগ্য।
স্বর্ণজাদি : স্বর্ণজাদির আসল নাম বুদ্ধধাতু চেতী। এমন সুন্দর কারুকাজে তৈরি এ মন্দির দর্শনেই মন পবিত্র হয়ে যায়। শহর থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার দূরের এ জাদিটি বৌদ্ধদের কাছে পবিত্র এক তীর্থস্থান। মন্দিরের আশপাশ থেকে সবাই এর সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারবেন। তবে পূজা কিংবা প্রণাম করার উদ্দেশ্যে যে কেউ যেতে পারবেন এর ভেতরেও। এ মন্দিরের পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে ঐতিহ্যবাহী এক পুকুর। বৌদ্ধরা এ পুকুরকে সম্মানের চোখে দেখে; কারণ এটি যে দেবতা পুকুর! ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াও পূর্ণিমায় এখানে জড়ো হন হাজার হাজার পুণ্যার্থী।
মেঘলা : সবার কাছে পরিচিত এক নাম মেঘলা। প্রতিবছর ঈদে ও শীতে এখানে পর্যটকের ঢল নামে। পার্বত্যাঞ্চলের প্রথম স্থাপিত কেবল কারও রয়েছে এখানে। এটিতে চড়তে কিংবা মেঘলায় প্রবেশের আগে অবশ্য টিকিট কাটতে হবে। এখানে ঝুলন্ত সেতর পাশাপাশি রয়েছে মিনি চিড়িয়াখানা। ইচ্ছে হলে উঠতে পারেন প্যাডেল বোটে। রাতযাপনের জন্য এখানে রয়েছে ছোট ছোট কটেজ। রয়েছে খাবারের ব্যবস্থাও।
শৈলপ্রপাত : প্রকৃতির আরেক সৌন্দর্য শৈলপ্রপাত। নীলগিরি যাওয়ার পথে পড়বে এটি। শহর থেকে এর দূরত্ব আট কিলোমিটার। এখানে এলে এর শীতল পানিতে শরীরটা এলিয়ে দিতে ইচ্ছে করবে। একটু সাবধানে শৈলপ্রপাতে নেমে আপনি সহজেই পূরণ করতে পারেন এ ইচ্ছে। শৈলপ্রপাতের পাশে বিক্রি হয় আদিবাসীদের তৈরি করা বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক। বম সম্প্রদায়ের মেয়েরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে তৈরি করে মনকাড়া এসব পোশাক।
প্রান্তিক লেক : মেঘলার মতো আরেক কৃত্রিম লেক প্রান্তিক লেক। শীতে এখানে অসংখ্য অতিথি পাখির আগমন ঘটে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ চারপাশের পরিবেশ মুখর করে রাখে। শহর থেকে এর দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের হলদিয়ার ভেতর দিয়ে সেখানে যেতে হয়। হলদিয়া বাজারের পাশে রয়েছে সেনাবাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জ। প্রান্তিক লেকের চারপাশ ঘিরে
আছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। নিরাপত্তা নিয়ে পর্যটকদের ভাবতে না হলেও এখানে রাতযাপনের সুব্যবস্থা নেই।
মিলনছড়ি : শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে নীলগিরি যাওয়ার পথে পড়ে মিলনছড়ি। ব্যক্তিমালিকানায় গড়ে তোলা এ পর্যটনকেন্দ্রে রাতযাপনের জন্য রয়েছে ছোট ছোট কটেজ। এর আগে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী রেস্টুরেন্ট সাকুরা। এখানেও রয়েছে রাতযাপনের ব্যবস্থা। তবে শীতকালে আগেভাগে বুকিং না দিলে এখানে রুম পাওয়া যায় না।
চিম্বুক : পর্যটকদের কাছে পরিচিত এক নাম চিম্বুক। দেশি-বিদেশি অসংখ্য পর্যটক প্রতিনিয়ত ভিড় করেন এখানে। সারাবছরই চিম্বুকে শীত-শীত অনুভব হয়। শহর থেকে এর দূরত্ব ২৭ কিলোমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় দুই হাজার ৮শ' ফুট। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পর্যটকদের জন্য এখানে রয়েছে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত হয়েছে একটি রেস্ট হাউসও। মেঘ ছোঁয়া যায় চিম্বুক পাহাড় থেকেও। এ পাহাড়ে জুমচাষিরা বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি গাঁদা ফুলের চাষ করেন।
নীলগিরি : বান্দরবান ঘুরে গেছেন কিন্তু নীলগিরি যাওয়া হয়নি, তবে নিশ্চিত থাকুন আপনার বেড়ানোর অর্ধেকই অপূর্ণ রয়ে গেছে। এককথায় অসাধারণ এক পর্যটন স্পট নীলগিরি। শহর থেকে এর দূরত্ব ৪৭ কিলোমিটার। উঁচু-নিচু দীর্ঘ পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে তবেই এখানে পেঁৗছতে হবে। যদি চালক ভালো পান তবে সর্পিল এ পথের পুরোটাই আপনি দারুণভাবে উপভোগ করতে পারবেন। আমাদের দেশটা কত সুন্দর নীলগিরি না এলে তা জানতেই পারবেন না।
পাহাড় বেয়ে গাড়ি কখনও উঠবে, আবার কখনও নামতে থাকবে। গাড়ি যতদূর এগোবে সৌন্দর্য যেন ততই বাড়তে থাকবে। দু'চোখ যেদিকে যায় শুধু সবুজ আর সুবজ। গাড়ি থেকে সামনে তাকালে দেখতে পাবেন গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ। বুঝি এগুলো ধরা যাবে! কিন্তু সেখানে গেলে দেখবেন মেঘগুলো যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ভাদ্রের তালপাকা গরমেও শীত শীত অনুভূতি দিয়ে মেঘ জানান দেবে_ সে হাওয়ায় হারিয়ে যায়নি, এখানেই আছে। পেছনে তাকাতেই চোখে পড়বে মেঘের গুচ্ছ। এ যেন প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাখেলা।
নীলগিরি যাওয়ার পথেই দেখবেন আদিবাসী নারী-পুরুষ পাহাড়ের ওপর বসে বিক্রি করছে কলা, পেঁপে, পেয়ারাসহ তাদের ক্ষেতের বিভিন্ন ফল। গাড়ি থামিয়ে একেবারে সস্তায় কিনে নিতে পারেন এসব ফল। দাম কম হলেও এসব ফলের স্বাদ কিন্তু কম নয়। টাটকা ফল খাওয়ার মজাটা নিতে পারবেন এখান থেকে। দুর্গম পাহাড়ের দীর্ঘ ভ্রমণপথে এসব ফল মনে হবে অমৃত।
সূর্য মামা ভালোভাবে নিজেকে মেলে ধরার আগে যদি নীলগিরি পেঁৗছতে পারেন তবে নিশ্চিত থাকুন আপনার জন্য অপেক্ষা করছে সারাজীবন স্মরণে রাখার মতো এক মুহূর্ত_ সবুজ পাহাড়টা ভরে আছে সাদা মেঘে। যেখানেই তাকান মেঘ আর মেঘ। মেঘের কারণে দূরের পাহাড়গুলোতেও সবুজের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে পেঁৗছতে যদি একটু দেরি হয় তাহলেও মন খারাপ করার কারণ নেই। তখনও দেখা যাবে, হঠাৎ একদল মেঘ এসে ঢেকে দিয়েছে পুরো নীলগিরি। আবার কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে সেই মেঘ। এভাবে মেঘের দলবেঁধে আসা-যাওয়ার খেলা মুহূর্তেই আপনাকে নিয়ে যাবে স্বপ্নের এক জগতে।
নীলগিরিতে এক রাত যদি থাকতে পারেন তবে নিশ্চিতভাবেই সেটি হবে আপনার জীবনের স্মরণীয় এক রাত হবে। তবে এ স্বপ্ন পূরণ করাটা কিন্তু খুবই কঠিন। কারণ এখানে থাকতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার। একে তো পর্যটকের ভীষণ আগ্রহ, তার ওপর এখানে রয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি রুম। পর্যটকদের জন্য গড়ে তোলা মেঘদূত, নীলাতানা ও আকাশ নীলাই বছরজুড়েই বুকিং থাকে। তাই বান্দরবান আসতে হলে আগে নীলগিরিতে রুম বুকিং দিয়ে তবেই আসতে হবে। যদি রুম পেয়ে যান তবে নিশ্চিন্তে চলে আসুন নীলগিরি। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকায় এখানে নিরাপত্তা নিয়ে এতটুকু চিন্তাও করতে হবে না। রাতের বেলা এখানে শুনতে পাবেন বন্য হরিণ, শেয়াল, বানরসহ বিভিন্ন পশু-পাখির শব্দ।
জীবননগর : নীলগিরি থেকে জীবননগরের দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। তবে শহর থেকে এর দূরত্ব ৫২ কিলোমিটার। থানচি যাওয়ার পথে পড়বে জীবননগর। জেলার পাকা সড়কের মধ্যে জীবননগর সড়কটি সবচেয়ে খাড়া ও ঢালু। সমতলে চলাচলে অভ্যস্ত পর্যটকদের কাছে এটি হতে পারে অন্যরকম এক জার্নি। এখানে এসে আপনি নিজেকে ঢেকে দিতে পারেন ঘন মেঘের চাদরে। ঘন কুয়াশার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের হাসি আপনাকে নির্মল আনন্দ দেবে।
রিজুক ঝরনা : রুমা বাজার থেকে নৌকায় কিংবা হেঁটে রিজুক ঝরনা যাওয়া যায়। হেঁটে গেলে সময় লাগবে আধঘণ্টা; নৌকায় যেতে লাগবে পৌনে এক ঘণ্টা। এ ঝরনায় সারাবছর পানি থাকে। প্রায় ৬০-৭০ ফুট উঁচু থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় এখানে পর্যটক খুব বেশি হয় না। তবে কষ্ট করে যদি সেখানে যান তাহলে এতটুকু নিশ্চিত, ঝরনার সৌন্দর্য নিমিষেই ভুলিয়ে দেবে পথের সব কষ্ট। ঝরনার সৌন্দর্য আপনাকে এতটাই বিমোহিত করবে, শীতের মধ্যেও শরীরটা এলিয়ে দিতে ইচ্ছে হবে এর হিম শীতল পানিতে।
বড় মদক ও ছোট মদক : থানচি বাজার থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করে মদক যেতে হবে। সময় লাগবে সাত ঘণ্টা। তাই খুব ভোরে রওনা দিতে হবে। সাঙ্গু নদীর উৎপত্তিস্থলের দিকে নৌকা এগুতে থাকবে। নদীর দু'ধারে চোখে পড়বে ছোট-বড় অসংখ্য পাথর। খরস্রোতা পানি ডিঙিয়ে উজানের দিকে যত এগোতে থাকবেন ততই মুগ্ধ হবেন। বান্দরবানে এমন সুন্দর জায়গা আছে কল্পনাই করতে পারবেন না। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্যটকদের জন্য এটি আনন্দের এক ভ্রমণ। তবে এ ভ্রমণে সাধারণ পর্যটকদের সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। নৌকা চলার সময় হঠাৎ পাথরের সঙ্গে ধাক্কা লাগতে পারে। যদি সতর্ক না থাকেন তবে নৌকা থেকে পড়ে আহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া নদীর স্রোতে পরিধেয় পোশাকও ভিজে যেতে পারে। তাই যাওয়ার আগে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
ছোট ও বড় মদকের আগে পড়বে রেমাক্রি। রেমাক্রি পেঁৗছার আগে দেখতে পাবেন বড় একটি পাথর। যা স্থানীয়দের কাছে পরিচিত দেবতার পাথর হিসেবে। মারমা ভাষায় বিশালাকার ওই পাথরটিকে বলা হয় 'ভংড'।
এ ভ্রমণে সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে পাহাড়ি পিচ্ছিল পথে পা ফেলার সময়। কারণ একটু অসতর্ক হলেই আপনার আনন্দের ভ্রমণটা মুহূর্তেই ছেয়ে যাবে বিষাদে।
কেওক্রাডং : বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কেওক্রাডং। এর উচ্চতা প্রায় চার হাজার ৩৩২ ফুট। তাজিংডং আবিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত এর অবস্থান ছিল প্রথমে। যারা বগা লেকে রাতযাপন করবেন তারা কেওক্রাডং ঘুরে আসতে পারেন। বগা লেক থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। রুমা বাজার থেকে দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। রুমা বাজার থেকে পায়ে হেঁটেও সেখানে যাওয়া যায়। তবে তা খুব কষ্টসাধ্য। কেওক্রাডং যাওয়ার আগে সঙ্গে স্থানীয় একজন গাইড থাকা জরুরি।
বগা লেক : প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে অনেক কিছু সৃষ্টি করে, যা মানুষের পক্ষে সৃষ্টি করা কখনোই সম্ভব নয়। বগা লেক হচ্ছে প্রকৃতির এমনই এক সৃষ্টি। শীতে রুমা বাজার থেকে চাঁদের গাড়িতে বগা লেক যাওয়া যায়। লেকের পাড়ে কয়েকটি কটেজ নির্মাণ করেছেন স্থানীয়রা। কটেজের সামনে ছোট হোটেলে রয়েছে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না; পাশেই রয়েছে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। এ লেক সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন হাজার ফুট উঁচুতে। ১৫ একর জায়গা নিয়ে এ লেকের অবস্থান। বর্ষায় এ লেকের পানি ঘোলা হয় না, আবার গরমের দিনে শুকিয়েও যায় না। রুমা বাজার থেকে এর দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। যারা অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন তারা স্থানীয় একজন গাইড নিয়ে পাঁয়ে হেঁটে এখানে আসতে পারেন।
তাজিংডং (বিজয়) : দেশের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ তাজিংডং (বিজয়)। স্থানীয়দের কাছে এটি তজিডং নামেই বেশি পরিচিত। এর উচ্চতা প্রায় চার হাজার ৫শ' ফুট। রুমা থেকে এর দূরত্ব ২৭ কিলোমিটার।
রাইনক্ষ্যং পুকুর : রোয়াংছড়ি ও রুমা বাজার থেকে যাওয়া যায় রাইনক্ষ্যং পুকুর। রুমা থেকে পায়ে হেঁটে যেতে আট ঘণ্টা লাগবে। সঙ্গে অবশ্যই স্থানীয় একজন গাইড নিতে হবে। তা না হলে পথ হারিয়ে ফেলার শঙ্কা রয়েছে। আর একবার যদি পথ হারান তবে টের পাবেন বিপদ কাকে বলে।
রুমা বাজার থেকে রাইনক্ষ্যং পুকুর সবচেয়ে কাছে। তবে এর আগে একটি রাত আপনাকে রুমার কোনো বোর্ডিংয়ে কাটাতে হবে। পরদিন খুব ভোরে গাইড নিয়ে রওনা দিতে হবে। সঙ্গে ফাস্ট এইড, টর্চলাইট, মোম, দিয়াশলাই, শুকনো খাবার ও পানি নিতে হবে। ভারি কোনো জিনিসপত্র সঙ্গে রাখা সঙ্গত হবে না। বড়টলিপাড়ায় কোনো ত্রিপুরার বাড়িতে ম্যানেজ করে দুপুরের খাওয়া সেরে নিতে পারেন। এরপর আবার রওনা দিতে হবে। পাহাড়ের চূড়ায় রাইক্ষ্যং পুকুরের অবস্থান। এর দৈর্ঘ্য প্রায় এক কিলোমিটার।
অনন্য এক পর্যটন স্পট রাইনক্ষ্যং পুকুর। এ পুকুর থেকে বড় বড় তেলাপিয়া মাছ ধরে নিজেরাই রান্না করে খেতে পারবেন। পাড়ার কার্বারিকে (পাড়াপ্রধান) অথবা পাড়ার কোনো লোককে টাকা দিলে তিনিই রান্নার ব্যবস্থা করে দেবেন। বগা লেকের মতো এ পুকুর নিয়েও স্থানীয়দের কাছে অনেক কাহিনী শোনা যায়।
মিরিঞ্জা : লামা সড়কে এর অবস্থান। কক্সবাজারের চকরিয়া হয়ে মিরিঞ্জা যেতে হয়। এখানে রয়েছে টাইটানিক নামে একটি পাহাড়। মিরিঞ্জা পর্যটনকেন্দ্রের প্রায় এক হাজার ফুট নিচুতে রয়েছে একটি ঝরনা। মিরিঞ্জায় যেতে হলে প্রথমে চকরিয়াতে নামতে হবে। এরপর জিপ অথবা বাসে করে যেতে হবে। তবে বান্দরবান শহর থেকে সরাসরিও এখানে আসা যায়। মিরিঞ্জায়ও রয়েছে রাত যাপনের সুব্যবস্থা।
নাফাখুম জলপ্রপাত : থানচি বাজার থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে রেমাক্রি যেতে হবে। সেখানে রাতযাপন করে পরদিন ভোরে নাফাখুময়ের উদ্দেশে রওনা দিতে হবে। যাত্রা আরামদায়ক করতে স্যান্ডেল পরে রওনা দিতে হবে। কারণ যাওয়ার পথে অনেকবার পানি পার হতে হবে। আবার পাহাড়ের ঢাল বেয়ে যাওয়ার সময় সাবধান থাকতে হবে যাতে পা পিছলে না পড়েন। রেমাক্রি বাজার থেকে নাফাখুম পেঁৗছতে সময় লাগবে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। ভ্রমণটা কষ্টকর হলেও নাফাখুম জলপ্রপাত পেঁৗছলে এর সৌন্দর্যের কাছে কষ্টটা তুচ্ছ মনে হবে। নাফাখুম পরিচিত বাংলার নায়াগ্রা হিসেবে। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের মতো বিশাল না হলেও বাংলাদেশের জন্য এটি অনেক বড় জলপ্রপাত বলা যেতে পারে। প্রায় চলি্লশ ফুট উঁচু থেকে এখানে পানি গড়িয়ে পড়ে। এখানে প্রতি ঘণ্টায় প্রবাহিত হয় হাজার হাজার গ্যালন পানি। এটি প্রায় দেড়শ' ফুট চওড়া। বর্ষায় গেলে এর দেখা যাবে এর ভয়ানক রূপ।
খাওয়া-দাওয়া
বান্দরবানের পর্যটন স্পটের বেশিরভাগই দুর্গম এলাকায়। তাই পথিমধ্যেই যা পাওয়া যায় তা দিয়ে সেরে নিতে হয় খাওয়া। যদি শহরে থাকেন তবে খেতে পারেন আয়েশ করে। এজন্য মেঘলা পর্যটনের পাশেই রয়েছে হলিডে ইন রিসোর্ট (০১৫৫৬৯৮০৪৩২ ও ০৩৬১-৬২৮৯৬)। এখানে দেশি খাবারের পাশাপাশি পাওয়া যায় চাইনিজও। ঐতিহ্যবাহী রাজার মাঠ ও সিনেমা হলের সামনে রয়েছে রী সংসং চাইনিজ রেস্টুরেন্ট (০৩৬১-৬২৯১৭), দি কিং অফ বান্দরবান (০৩৬১-৬২৮৮৭), হোটেল আমিরাবাদ ও হোটেল খাওয়া-দাওয়া। এছাড়া শহরের ভেতর মাঝারি মানের আরও অনেক হোটেল রয়েছে।
থাকতে পারেন যেখানে
বান্দরবান শহরের স্পটগুলো ঘুরতে হলেও এখানে একটি রাত থাকতে হবে। বাজেট অনুযায়ী পছন্দ করতে হবে হোটেল। এ জন্য যোগাযোগ করতে পারেন পর্যটন মোটেল মেঘলা (০১৮১৭৭১৬৯১৬, ০১৫৫৬৫৪৫৭৪৬, ০৩৬১-৬২৩৩২,৬২৭৪১), হোটেল পূরবী (০১১৯৯৭৬১৪৮৫ ও ০৩৬১-৬২৫৩১), হোটেল গ্রীন হিল (০১৫৫৬৫৩৩০৩৫ ও ০৩৬১-৬২৫৭৪), হোটেল ফোর স্টার (০৩৬১-৬২৪৬৬), হোটেল হিলবার্ড (০১১৯৯৭৬১৪৮৫ ও ০৩৬১-৬২৪৪১), হোটেল রয়েল (০৩৬১-৬২৯২৬), হোটেল বিলকিছ (০৩৬১-৬২০৬১), হোটেল সারওয়ার (০১৫৫৩৫৮৮৩৮৯ ও ০১৫৫৬৫৩৩১৫৫), হোটেল অতিথি (০১৫৫৬৩৯১৬৪৭ ও ০৩৬১-৬২৫৩৫), হোটেল শাওন (০১৭১৩৬১৭১২৯ ও ০৩৬১-৬২৪৪৯), হোটেল রাজু (০১৮২০২৫৪৬৮ ও ০৩৬১-৬২৮৯১), হোটেল হিরু (০৩৬১-৬২১৪০), হোটেল আল-আমিন (০১৮১২৬৮৪৭৪৯ ও ০৩৬১-৬২৪৩১), হোটেল কামাল (০১১৯০৭৮০০৮৩), হোটেল আজমীর (০১৫৫৬৩৯১৬৪৭), হোটেল প্রু আবাসিক (০৩৬১-৬২২৫৭) কিংবা হোটেল হাবিবে (০১৮২০২৪০৪১৪)। এ ছাড়াও সরকারিভাবে এলজিইডি, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, বন বিভাগ কিংবা জেলা পরিষদের রেস্ট হাউসেও থাকতে পারেন।
No comments