বেগম রোকেয়াঃ নারী শিক্ষা ও নারী জাগরণ by লতিফা নিলুফার পাপড়ি
পুরুষ শাসিত এই সমাজ ব্যবস্থায় একটা শিশু জন্মলগ্নের শুরু থেকেই লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে। জন্মের পর পরই লিঙ্গ ভেদে শিশুটির বেড়ে ওঠার প্রতিটা পদক্ষেপে চাপিয়ে দেওয়া হয় সমাজের নানা রকম নিয়ম-কানুন। তার হাতে পায়ে সুকৌশলে পরিয়ে দেওয়া হয় লিঙ্গ বৈষম্যের কঠিন শিকল। প্রকৃতির সঙ্গে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা এই শিশুটি একদিন হঠাৎ বুঝতে পারে, সে ছেলে না মেয়ে।
যে শিশু মেয়ে অর্থাৎ নারী হয়ে জন্ম নেয়; সেই শিশুটির চাল-চলনে, আচার-আচরণে, হাসি-ঠাট্টায়, চিন্তায় সর্বক্ষণ পুরুষ সমাজ লাগাম পরিয়ে দেয়। তাকে টিপ পরিয়ে, পুতুল খেলিয়ে প্রমাণ করা হয়, সে নারী। ইচ্ছে করলেই সে পুরুষের মতো বেড়ে উঠতে পারবে না। ছেলে শিশুর মতো জোরে কথা বলতে তাকে বারণ করা হয়। তার পোষাক ভিন্ন, খেলনাও ভিন্ন।
বাঙালি মুসলমান সমাজের এই যে নারী-পুরুষের অসঙ্গতি- এর বিরুদ্ধে প্রথম যে কণ্ঠটি আওয়াজ করেছিলো সেটি বেগম রোকেয়া। নারী স্বাধীনতার পক্ষে প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরও বেগম রোকেয়াকেই আমরা গণ্য করতে পারি। তিনি বাঙালি মুসলমানদের নব জাগরণের সূচনা লগ্নে নারী শিক্ষা ও নারী জাগরণে নেতৃত্ব দেন।
আজ ৯ ডিসেম্বর সেই সাহিত্যিক, শিক্ষানুরাগী, সমাজ-সংস্কারক বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। মাত্র বায়ান্ন বছর বয়সে নারী জাগরণের অগ্রদূত এই মহিয়সী নারী ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের ইতিহাসে বেগম রোকেয়ার অবদান চিরস্মরণীয়। সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও বাড়িতে বড় ভাইদের সহায়তায় পড়ালেখার সুযোগ লাভ করেন। শুধু তাই নয়, সাহিত্য চর্চা করার যথেষ্ঠ উপযুক্ত পরিবেশও বেগম রোকেয়া ছোটবেলা থেকেই পেয়েছিলেন। আর তাই সামাজিক পশ্চাৎপদতা আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, নারী সমাজের বহুমাত্রিক অধিকার আদায় ও নারী শিক্ষার পথ নির্দেশক হতে পেরেছিলেন বেগম রোকেয়া।
১৮৯৭ সালে বিহারের ভাগলপুরের এক খানদানি ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম পরিবারের কীর্তিমান ও মহাত্মা পুরুষ সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেন রোকেয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সাখাওয়াৎ হোসেন ছিলেন নিজের যোগ্যতা ও গুণেই সমাজে পরিচিত হওয়ার মতো মানুষ। তার কর্মজীবন ছিলো নানা বৈচিত্র্যে ম-িত। সাখাওয়াতের পতœী প্রেমও ছিলো প্রগাঢ়। বেগম রোকেয়ার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তিনি সম্ভাব্য সব কিছুই করেছিলেন।
বেগম রোকেয়ার মনের গঠন, শিক্ষা ও সাহিত্য চর্চায় স্বামীর ভূমিকার কথা বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয়। স্বামীর যতেœ তিনি ভালো ইংরেজি শিখেছিলেন। রোকেয়ার ভেতরে যে সুপ্ত প্রতিভা ছিলো তার আবিষ্কার ও প্রকাশেও স্বামী সাখাওয়াৎ হোসেনের যথেষ্ঠ ভূমিকা ছিল।
রোকেয়ার নারী মুক্তির যে ভাবনা-চিন্তা তারও সমর্থক ছিলেন সাখাওয়াৎ। এ বিষয়ে বেগম রোকেয়া নিজেও বলেছেন, ‘আমার শ্রদ্ধেয় স্বামী অনুকূল না হইলে আমি কখনোই প্রকাশ্য সংবাদপত্রে লিখিতে সাহসী হইতাম না’।
সাখাওয়াৎ হোসেন একজন অত্যন্ত দিলখোলা প্রাণবন্ত মানুষও ছিলেন। তিনি নারী শিক্ষার একান্ত পক্ষপাতী ছিলেন। নিঃসন্তান রোকেয়া যাতে মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে তাঁর নিঃসঙ্গতা ঘোঁচাতে পারেন, সেই সাথে সমাজের কল্যাণমূলক কাজের সঙ্গেও যুক্ত থাকতে পারেন সেই ব্যবস্থাই করেছিলেন স্বামী সাখাওয়াৎ।
অথচ বর্তমান সময়ে পৃথিবী যখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে, তখনও দেখি স্বামীদের উদার মন-মানসিকতার অভাবে নারীদের সুপ্ত প্রতিভা আবিষ্কার ও প্রকাশ হয় না। নারীরা তাই পারছে না, তাদের চিন্তার স্বাধীনতার আত্মপ্রকাশ ঘটাতে। এদিক দিয়ে সাখাওয়াৎ হোসেন ব্যতিক্রম ছিলেন বলেই বেগম রোকেয়ার নামের সাথে তাঁর স্বামীর নামটি নারী মুক্তির আন্দেলনের যুক্ত হয়ে গেছে।
বাঙালি মুসলমান সমাজে নারী-জাগরণ ও নারী-অধিকার আন্দোলনের অন্যতম পৃথিকৃৎ অবশ্যই বেগম রোকেয়া। তিনি প্রথমবারের মতো বাঙালি মুসলিম সমাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমান অধিকারের দাবি তুলে ধরেন, নারী স্বাধীনতার পক্ষে নিজের মতবাদ প্রচার করেন, অবরোধ প্রথার শিকল ভাঙেন।
বেগম রোকেয়ার ছিলো অদম্য সাহস ও প্রবল আত্মবিশ্বাস। স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর প্রদত্ত অর্থে মাত্র পাঁচ জন ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ স্থাপন করেন। পরবর্তীতে পারিপার্শ্বিক কারণে ভাগলপুর ছেড়ে বেগম রোকেয়া কলকাতায় মাত্র আট জন ছাত্রী নিয়ে নতুন উদ্যমে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন।
নানা প্রতিবন্ধকতাকে অগ্রাহ্য করে তিনি এই প্রতিষ্ঠানটিকে সে যুগের মুসলমান মেয়েদের শিক্ষা লাভের অন্যতম বিদ্যাপীঠে পরিণত করেন। এ যেন ছিল তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন।
সাহিত্যিক হিসেবে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে রোকেয়া ছিলেন এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা। তার সাহিত্য কর্মের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে সমাজের কুসংস্কার ও অবরোধ প্রথার কুফল, নারী শিক্ষার প্রতি তার নিজস্ব মতামত, নারীদের প্রতি সামাজিক অনাচার ও অপমানের কথা। নারীর অধিকার ও নারী জাগরণ সম্পর্কে তাঁর দুরদর্শী চিন্তাভাবন তাঁর সাহিত্যে বার বার উঠে এসেছে। বাল্য-বিবাহ ও বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধেও তার লেখনী ছিল সোচ্চার।
রোকেয়ার উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে মতিচুর, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী প্রভৃতি। এছাড়া রয়েছে অসংখ্য প্রবন্ধ, ছোটগল্প, কবিতা, ব্যঙ্গাতœক রচনা ও অনুবাদ।
১৯৩০ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে বেগম রোকেয়া বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন, যা সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে ছিলো দুঃসাহসিক কাজ। তার লক্ষ্য ছিলো, নারী শিক্ষার প্রসার, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি এবং মুসলমান সমাজের অবরোধ প্রথার অবসান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শিক্ষা ছাড়া নারী জাতির অগ্রগতি ও মুক্তি সম্ভব নয়। এ সত্য অনুধাবন করেই তিনি নারী শিক্ষা প্রসারের কাজে ব্রতী হন। নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা প্রদানের স্বীকৃতির লক্ষ্যেই পরিচালিত হয় তার সকল চেষ্টা।
মুসলমান মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য ১৯১৬ সালে বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠা করেন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম বা মুসলিম মহিলা সমিতি’।
এই সমিতি বিধবা নারীকে অর্থ সাহায্য প্রদান করতো। দরিদ্র মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা হতো, অভাবী মেয়েরা সমিতির অর্থে শিক্ষালাভের সুযোগ পেতেন। এক কথায় বলা যায়, বেগম রোকেয়াই সেই নারী, যার প্রয়াসের কারণে আজকে নারীরা এই অবস্থানে আসার ভিতটা পেয়েছেন।
বেগম রোকেয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছেন রোকেয়ার সম-সাময়িক ও রোকেয়া পরবর্তী নারী সমাজ।
কিন্তু আজও যখন দেখি, শিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়েও অনেক নারী নিজের অধিকার টুকুও আদায় করতে পারছেন না, তখন ভীষণ কষ্ট হয়। নারীরা আজো মানুষ হয়ে বেড়ে উঠতে পারছে না। নারীর উপর থেকে কি অনাচার, অবিচার আদৌ বন্ধ হয়ে গেছে?
সত্যি বলতে কি, নারীরা এখনো পুরুষতান্ত্রিকতার পাতানো ফাঁদে আটকা পড়ে আছে। শিক্ষিত হয়েও নারীরা নিজেদের আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে না। পুরুষতান্ত্রিকতার গোলক ধাঁধার মধ্যে আটকে আছে তাদের জীবন। নারী নিজেও জানে না, কিসে তার মুক্তি?
নারীবাদ বলতে পুরুষরা নারীকে এটাই বোঝাতে পেরেছে যে, ‘তুমি স্বাধীন, তুমি মুক্ত, তুমি ইচ্ছে করলেই আমার সাথে বিছানায় যেতে পারো’। আর এই ফাঁদে আটকা পড়ে যায় অসংখ্য নারী। আজকে দেশের সর্ব্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতেও এসবই হচ্ছে। অজস্র মেয়েরা অল্পতেই জালে আটকা পড়ে। এক সময় তার জীবনটাকে নিয়ে খেলতে শুরু করা পুরুষ সরে পড়ে। এই ছলনায় যে মেয়েরা পা ফেলে তারা কেউ কেউ মেনে নেয়, কেউবা আত্মহত্যা কিংবা জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।
অথচ এটার নামতো নারী স্বাধীনতা নয়।
বিজ্ঞাপনের নামে নারীকে নেয়া হচ্ছে পণ্য হিসাবে। গার্মেন্টস কর্মী আর গৃহকর্মীরাও কোনোভাবেই পুরুষদের হাত থেকে নিরাপদ নয়। একমাত্র পুরুষদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই তাকে নিতে হয় নানা নিরাপদমূলক ব্যবস্থা।
আজ যদি বেগম রোকেয়া বেঁচে থাকতেন তাহলে নারীর এ অবমাননায় কতো দুঃখই না পেতেন। তিনি তো চেয়েছিলেন, মেয়েরা ছোট বেলা থেকেই বড় হবে একজন মানুষের মর্যাদা নিয়ে। নিজেকে তৈরি করবে মানবিক গুণ সম্পন্ন, উচ্চতর মূল্যবোধ বিশিষ্ট, সকল প্রকার কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস থেকে দূরে সরে আসা একজন আদর্শ মানুষ হয়ে।
আমরা কি পেরেছি, বেগম রোকেয়ার স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিতে? হয়তো কিছুটা পেরেছি, বাকিটা পারিনি। এই ব্যর্থতার দায়ভার কিন্তু সবটুকু আমাদের এই সমাজের।
লতিফা নিলুফার পাপড়ি: কবি, গল্পকার, শিক্ষক
ই- মেইল: lnpapri@gmail.com
আজ ৯ ডিসেম্বর সেই সাহিত্যিক, শিক্ষানুরাগী, সমাজ-সংস্কারক বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। মাত্র বায়ান্ন বছর বয়সে নারী জাগরণের অগ্রদূত এই মহিয়সী নারী ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের ইতিহাসে বেগম রোকেয়ার অবদান চিরস্মরণীয়। সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও বাড়িতে বড় ভাইদের সহায়তায় পড়ালেখার সুযোগ লাভ করেন। শুধু তাই নয়, সাহিত্য চর্চা করার যথেষ্ঠ উপযুক্ত পরিবেশও বেগম রোকেয়া ছোটবেলা থেকেই পেয়েছিলেন। আর তাই সামাজিক পশ্চাৎপদতা আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, নারী সমাজের বহুমাত্রিক অধিকার আদায় ও নারী শিক্ষার পথ নির্দেশক হতে পেরেছিলেন বেগম রোকেয়া।
১৮৯৭ সালে বিহারের ভাগলপুরের এক খানদানি ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম পরিবারের কীর্তিমান ও মহাত্মা পুরুষ সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেন রোকেয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সাখাওয়াৎ হোসেন ছিলেন নিজের যোগ্যতা ও গুণেই সমাজে পরিচিত হওয়ার মতো মানুষ। তার কর্মজীবন ছিলো নানা বৈচিত্র্যে ম-িত। সাখাওয়াতের পতœী প্রেমও ছিলো প্রগাঢ়। বেগম রোকেয়ার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তিনি সম্ভাব্য সব কিছুই করেছিলেন।
বেগম রোকেয়ার মনের গঠন, শিক্ষা ও সাহিত্য চর্চায় স্বামীর ভূমিকার কথা বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয়। স্বামীর যতেœ তিনি ভালো ইংরেজি শিখেছিলেন। রোকেয়ার ভেতরে যে সুপ্ত প্রতিভা ছিলো তার আবিষ্কার ও প্রকাশেও স্বামী সাখাওয়াৎ হোসেনের যথেষ্ঠ ভূমিকা ছিল।
রোকেয়ার নারী মুক্তির যে ভাবনা-চিন্তা তারও সমর্থক ছিলেন সাখাওয়াৎ। এ বিষয়ে বেগম রোকেয়া নিজেও বলেছেন, ‘আমার শ্রদ্ধেয় স্বামী অনুকূল না হইলে আমি কখনোই প্রকাশ্য সংবাদপত্রে লিখিতে সাহসী হইতাম না’।
সাখাওয়াৎ হোসেন একজন অত্যন্ত দিলখোলা প্রাণবন্ত মানুষও ছিলেন। তিনি নারী শিক্ষার একান্ত পক্ষপাতী ছিলেন। নিঃসন্তান রোকেয়া যাতে মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে তাঁর নিঃসঙ্গতা ঘোঁচাতে পারেন, সেই সাথে সমাজের কল্যাণমূলক কাজের সঙ্গেও যুক্ত থাকতে পারেন সেই ব্যবস্থাই করেছিলেন স্বামী সাখাওয়াৎ।
অথচ বর্তমান সময়ে পৃথিবী যখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে, তখনও দেখি স্বামীদের উদার মন-মানসিকতার অভাবে নারীদের সুপ্ত প্রতিভা আবিষ্কার ও প্রকাশ হয় না। নারীরা তাই পারছে না, তাদের চিন্তার স্বাধীনতার আত্মপ্রকাশ ঘটাতে। এদিক দিয়ে সাখাওয়াৎ হোসেন ব্যতিক্রম ছিলেন বলেই বেগম রোকেয়ার নামের সাথে তাঁর স্বামীর নামটি নারী মুক্তির আন্দেলনের যুক্ত হয়ে গেছে।
বাঙালি মুসলমান সমাজে নারী-জাগরণ ও নারী-অধিকার আন্দোলনের অন্যতম পৃথিকৃৎ অবশ্যই বেগম রোকেয়া। তিনি প্রথমবারের মতো বাঙালি মুসলিম সমাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমান অধিকারের দাবি তুলে ধরেন, নারী স্বাধীনতার পক্ষে নিজের মতবাদ প্রচার করেন, অবরোধ প্রথার শিকল ভাঙেন।
বেগম রোকেয়ার ছিলো অদম্য সাহস ও প্রবল আত্মবিশ্বাস। স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর প্রদত্ত অর্থে মাত্র পাঁচ জন ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ স্থাপন করেন। পরবর্তীতে পারিপার্শ্বিক কারণে ভাগলপুর ছেড়ে বেগম রোকেয়া কলকাতায় মাত্র আট জন ছাত্রী নিয়ে নতুন উদ্যমে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন।
নানা প্রতিবন্ধকতাকে অগ্রাহ্য করে তিনি এই প্রতিষ্ঠানটিকে সে যুগের মুসলমান মেয়েদের শিক্ষা লাভের অন্যতম বিদ্যাপীঠে পরিণত করেন। এ যেন ছিল তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন।
সাহিত্যিক হিসেবে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে রোকেয়া ছিলেন এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা। তার সাহিত্য কর্মের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে সমাজের কুসংস্কার ও অবরোধ প্রথার কুফল, নারী শিক্ষার প্রতি তার নিজস্ব মতামত, নারীদের প্রতি সামাজিক অনাচার ও অপমানের কথা। নারীর অধিকার ও নারী জাগরণ সম্পর্কে তাঁর দুরদর্শী চিন্তাভাবন তাঁর সাহিত্যে বার বার উঠে এসেছে। বাল্য-বিবাহ ও বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধেও তার লেখনী ছিল সোচ্চার।
রোকেয়ার উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে মতিচুর, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী প্রভৃতি। এছাড়া রয়েছে অসংখ্য প্রবন্ধ, ছোটগল্প, কবিতা, ব্যঙ্গাতœক রচনা ও অনুবাদ।
১৯৩০ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে বেগম রোকেয়া বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন, যা সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে ছিলো দুঃসাহসিক কাজ। তার লক্ষ্য ছিলো, নারী শিক্ষার প্রসার, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি এবং মুসলমান সমাজের অবরোধ প্রথার অবসান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শিক্ষা ছাড়া নারী জাতির অগ্রগতি ও মুক্তি সম্ভব নয়। এ সত্য অনুধাবন করেই তিনি নারী শিক্ষা প্রসারের কাজে ব্রতী হন। নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা প্রদানের স্বীকৃতির লক্ষ্যেই পরিচালিত হয় তার সকল চেষ্টা।
মুসলমান মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য ১৯১৬ সালে বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠা করেন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম বা মুসলিম মহিলা সমিতি’।
এই সমিতি বিধবা নারীকে অর্থ সাহায্য প্রদান করতো। দরিদ্র মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা হতো, অভাবী মেয়েরা সমিতির অর্থে শিক্ষালাভের সুযোগ পেতেন। এক কথায় বলা যায়, বেগম রোকেয়াই সেই নারী, যার প্রয়াসের কারণে আজকে নারীরা এই অবস্থানে আসার ভিতটা পেয়েছেন।
বেগম রোকেয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছেন রোকেয়ার সম-সাময়িক ও রোকেয়া পরবর্তী নারী সমাজ।
কিন্তু আজও যখন দেখি, শিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়েও অনেক নারী নিজের অধিকার টুকুও আদায় করতে পারছেন না, তখন ভীষণ কষ্ট হয়। নারীরা আজো মানুষ হয়ে বেড়ে উঠতে পারছে না। নারীর উপর থেকে কি অনাচার, অবিচার আদৌ বন্ধ হয়ে গেছে?
সত্যি বলতে কি, নারীরা এখনো পুরুষতান্ত্রিকতার পাতানো ফাঁদে আটকা পড়ে আছে। শিক্ষিত হয়েও নারীরা নিজেদের আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে না। পুরুষতান্ত্রিকতার গোলক ধাঁধার মধ্যে আটকে আছে তাদের জীবন। নারী নিজেও জানে না, কিসে তার মুক্তি?
নারীবাদ বলতে পুরুষরা নারীকে এটাই বোঝাতে পেরেছে যে, ‘তুমি স্বাধীন, তুমি মুক্ত, তুমি ইচ্ছে করলেই আমার সাথে বিছানায় যেতে পারো’। আর এই ফাঁদে আটকা পড়ে যায় অসংখ্য নারী। আজকে দেশের সর্ব্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতেও এসবই হচ্ছে। অজস্র মেয়েরা অল্পতেই জালে আটকা পড়ে। এক সময় তার জীবনটাকে নিয়ে খেলতে শুরু করা পুরুষ সরে পড়ে। এই ছলনায় যে মেয়েরা পা ফেলে তারা কেউ কেউ মেনে নেয়, কেউবা আত্মহত্যা কিংবা জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।
অথচ এটার নামতো নারী স্বাধীনতা নয়।
বিজ্ঞাপনের নামে নারীকে নেয়া হচ্ছে পণ্য হিসাবে। গার্মেন্টস কর্মী আর গৃহকর্মীরাও কোনোভাবেই পুরুষদের হাত থেকে নিরাপদ নয়। একমাত্র পুরুষদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই তাকে নিতে হয় নানা নিরাপদমূলক ব্যবস্থা।
আজ যদি বেগম রোকেয়া বেঁচে থাকতেন তাহলে নারীর এ অবমাননায় কতো দুঃখই না পেতেন। তিনি তো চেয়েছিলেন, মেয়েরা ছোট বেলা থেকেই বড় হবে একজন মানুষের মর্যাদা নিয়ে। নিজেকে তৈরি করবে মানবিক গুণ সম্পন্ন, উচ্চতর মূল্যবোধ বিশিষ্ট, সকল প্রকার কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস থেকে দূরে সরে আসা একজন আদর্শ মানুষ হয়ে।
আমরা কি পেরেছি, বেগম রোকেয়ার স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিতে? হয়তো কিছুটা পেরেছি, বাকিটা পারিনি। এই ব্যর্থতার দায়ভার কিন্তু সবটুকু আমাদের এই সমাজের।
লতিফা নিলুফার পাপড়ি: কবি, গল্পকার, শিক্ষক
ই- মেইল: lnpapri@gmail.com
No comments