এগোনোর পথ সুগম করছে ভারত by সনৎ বাবলা

সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ড্র, মালয়েশিয়াকে হারানো দেখে ধারণা তৈরি হয়েছিল_ভারতীয় ফুটবল বুঝি দুর্দান্ত গতিতে এগোচ্ছে। আবার বিশ্বকাপে পেঁৗছানোর স্বপ্নও দেখছে তারা। শুনতে ভালোই লাগে, কিন্তু মুখ টিপে হাসেন সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের এক কর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ বাঙালি ফুটবলকর্তা বলেই দিলেন, 'ওসব বাজে কথা। মিডিয়ার বাড়াবাড়ি, বিশ্বকাপ কী ছেলের হাতের মোয়া!' আই লিগের প্রধান নির্বাহী সুনন্দ ধর আরো সহজ করে


বলে দিলেন, 'ভারতের ফুটবলের অবস্থা এখনো তেমন ভালো নয়। কমবেশি ওই বাংলাদেশের মতোই। টাকা-পয়সার টানাটানির মধ্য দিয়েই একটু একটু এগোনোর চেষ্টা হচ্ছে_এই আর কি!'
গুটি গুটি পায়েই এগোনো, তাতে যে বেগ যোগ হয়নি সেটা বোঝা গেছে দিল্লি শহর থেকে অনেক দূরে দোয়ারকায় সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনে যেতে যেতেই। প্রথমত ফুটবলের লোকজনও ওই অফিস চেনে না। ওখানে বসেই যে দেশের ফুটবলের চিন্তামণিরা উন্নতির পরিকল্পনা করেন, সেটা তো আম-জনতারও জানা দরকার। তা ছাড়া সবার নাগালের মধ্যেই তো থাকা উচিত এ রকম প্রতিষ্ঠানের। ফুটবলের প্রাতিষ্ঠানিক কাজ সারতে যানজটহীন রাস্তায় গাড়িতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগলে সেটাও তো অনেক বেশি। এমনিতে সাধারণ্যে ফুটবলের তেমন জনপ্রিয়তা নেই_এটা বোঝা গেল পরিষ্কার। জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে সাফে খেলছে ভারত, অথচ স্বাগতিক দর্শক বড়জোর হাজার দুয়েক। তবে অনেকের দাবি, নেহরুতে না হয়ে দিল্লির আম্বেদকার স্টেডিয়ামে এ খেলা হলে জায়গা দেওয়া যেত না দর্শকদের। গোল ডটকম ইন্ডিয়ার প্রধান সম্পাদক রাহুল বালিও তা-ই মনে করেন, 'সাধারণত ওখানে ফুটবলের সমথর্ক বেশি। নেহরুতেও দর্শক আসত, যদি স্টেডিয়ামের অবকাঠামো ওরকম হতো। এখানে খেলার সঙ্গে পিৎজা পাওয়া না গেলে দিল্লির মানুষ আসবে কেন? দর্শক কম হওয়ার আরেকটা বড় কারণ হলো ফুটবলের মানটা কোথায় তা সবাই জানে। তাই খেলার মান, ফুটবল অবকাঠামো এবং ফুটবলের বাণিজ্যিকীকরণে পরিবর্তন না এলে খেলাটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন হবে।'
এগোনোর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবেই রব বানকে নিয়ে এসেছে তারা নেদারল্যান্ডস থেকে। এই ডাচ টেকনিক্যাল ডিরেক্টরকে দিয়েই তারা সাজিয়ে নেবে ফুটবল অবকাঠামো এবং দেশব্যাপী ফুটবলের প্রাতিষ্ঠানিক এক কারিকুলাম। সাংবাদিক রাহুলের বিশ্বাস, 'ফুটবল-বিশ্বে ডাচ ফুটবল মেথডটা খুব চালু এবং এর কার্যকারিতাও ভালো। তাই রবকে ঠিকমতো ব্যবহার করা গেলে ভারতের ফুটবলে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যেতে পারে।' রব টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন অস্ট্রেলিয়ায়, জড়িয়ে আছেন পিএসভি আইন্দহোফেনের সঙ্গেও। এখন ভারতের মিজোরামে গেছেন স্থানীয় কয়েকটি একাডেমীর ফুটবল চর্চা দেখতে। ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন চাইছে তাঁকে দিয়ে তৃণমূল পর্যায় থেকে ফুটবলের একটা একাডেমিক কারিকুলাম তৈরি করতে। আগামী মার্চের মধ্যে ভারতে চারটি একাডেমী চালু হবে। সেই একাডেমীগুলোতে কিভাবে ফুটবল প্রশিক্ষণ এবং আনুষঙ্গিক কাজগুলো হবে তা ঠিক করার পুরো দায়িত্ব রব বানের। 'সেই একাডেমী থেকে শুরু করে বয়সভিত্তিক দল এবং এরপর সিনিয়র দলের খেলার স্টাইল হবে একই', জানালেন সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের মিডিয়া ম্যানেজার নিরঞ্জন দত্ত। চারটি একাডেমী তৈরি হচ্ছে দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা ও বেঙ্গালুরুতে। এভাবে আগামী দুই বছরের মধ্যে ১৬টি একাডেমী খুলে ফুটবলটাকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় রূপ দিতে চাইছে।
এ জন্য ডাচ ফুটবল প্রমোটার অরেঞ্জ স্পোর্টস ও ফিফার ব্যাপক সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছে ভারত। ফিফা খুব করে চাইছে ভারতীয় ফুটবলের পালে আধুনিকতার হাওয়া লাগাতে। ভারত উন্নত হলে তার হাওয়া গিয়ে লাগবে উপমহাদেশের অন্য দেশগুলোতেও। তাই সিনিয়র দল নিয়ে তাদের সে রকম আগ্রহ নেই। ফেডারেশনের লক্ষ্য বয়সভিত্তিক দলগুলো। নিরঞ্জন দত্ত যেমন বলেছেন, 'সিনিয়র দল নিয়ে আমাদের ফেডারেশনের তেমন ভাবনা নেই, কারণ ২৫-২৬ বছরের কোনো ফুটবলারকে আর নতুন করে শেখানো যায় না। এএফসির টুর্নামেন্ট বাদ দিলে তাদের জন্য প্রতিবছর দেশের বাইরে আটটা প্রীতি ম্যাচ খেলার সুযোগ থাকবে। কিন্তু এদের চেয়ে আমাদের যুব দলের সম্ভাবনা অনেক বেশি। অনূর্ধ্ব-১৬ ও ২৩ দলকে নিয়ে আমরা খুব সিরিয়াস। ভারতীয় ফুটবলে বড় ধরনের পরিবর্তন হলে তাদের দিয়েই হবে।' সেই পরিবর্তনের আশায় ভারত আগামী ২০১৭ সালে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ নিয়ে এখনো দ্বিধায় আছে। আই লিগের প্রধান নির্বাহী সুনন্দ জানিয়েছেন, '২০১৭ সালের অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপটা এখনো আমাদের হাতে আছে। ফিফা বলছে আমাদের আয়োজন করতে, নিজেদের দল একটা পর্যায়ে ভালো না খেললে আয়োজন করে লাভ নেই। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা চলছে, বয়সভিত্তিক দলগুলোর ভালো লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখলেই ভারত রাজি হয়ে যাবে।'
কারণ তাদের উপলব্ধি, ক্রিকেটের জোয়ারে মানুষকে ফুটবলমুখী করতে গেলে একটা ফুটবলীয় হাওয়া দরকার; যা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ কিংবা নেহরু কাপ দিয়ে হবে না, হতে পারে বয়সভিত্তিক কোনো ফুটবল বিশ্বকাপ দিয়ে। সেটার হাওয়ায় ক্রিকেটের পেটে ঢুকে যাওয়া ফুটবল আবার গণমানুষের খেলায় পরিণত হতে পারে। ওরকম সফল একটা আসর হলে ফুটবল-বিশ্বও চিনবে 'ইমার্জিং' ভারতকে।
আবার শুরুর কথায় আসা যাক। ভারত তেমন কিছু এগোয়নি, তবে তৈরি করছে এগোনোর রাস্তা। আর বাংলাদেশের ফুটবল এখনো দিকভ্রান্ত, উদ্ভ্রান্ত। আমাদের ফুটবল-কর্তারা শুধুই একাডেমীর গল্প শোনান।

No comments

Powered by Blogger.