অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট-শোষণ বঞ্চনার আয়না by আদিত্য শাহীন
অকুপাই ওয়ালস্ট্রিটের বিক্ষোভকারীদের দুই মাস পর তাড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ। তার পরপরই অকুপাই ওয়ালস্ট্রিটের ওয়েবসাইটে চোখ রাখি। বড় একটি স্লোগান সেখানে_ 'আমরা সরে যাইনি আমাদের ধারণা থেকে, সময় এসেছে, আমরা ৯৯ শতাংশ, আমরা সবখানে।' সত্যি সত্যি পৃথিবীর ৮২ দেশের হাজারখানেক শহরে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনের গোড়া ওই জুকুত্তি পার্ক হলেও, সব জায়গা থেকে কি বিক্ষোভকারীদের সরাতে
\পারবে পুলিশ? সাবওয়ে ট্রেন থেকে আমরা নেমেছি গ্রাউন্ড জিরো স্টেশনে। ওয়ালস্ট্রিট হাঁটা পথ। প্রথম নিউইয়র্ক শহরে আসা। সঙ্গে মিয়া মুস্তাফিজ। যেদিকে তাকাই মনে হয় সেদিকেই ওয়ালস্ট্রিট। যে হারে মানুষ এদিক-সেদিক দৌড়াচ্ছে, হাঁটছে; তাতে সবাইকেই মনে হয় মিছিলের সঙ্গে অগ্রসর জনতার একজন। ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধা, নাম রিভিরেন্ড শ্যারন ডেলগ্যাডো। তিনি প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আর্থ জাস্টিস মিনিস্ট্রিজ। ধর্মীয় কমিউনিটির একজন। 'সব সৃষ্টির জন্য সুবিচার'_ এই স্লোগান নিয়ে তিনি পথ চলছেন বহু দিন। তিনি যাচ্ছেন ওয়ালস্ট্রিটে। বললেন, এখানে যারা আছে সবার দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের জন্যই এসেছি।
চারদিকে পুলিশি নিরাপত্তা। একদিকে সিএনএনের ওবি ভ্যান। ক্যামেরা ঘুরেফিরে চিত্র ধারণ করছে। বহু মানুষের হাতে ক্যামেরা। বলা যায়, অর্ধেক বিক্ষোভকারী আর অর্ধেক ভিডিওচিত্র ও তথ্য সংগ্রহকারী। আগে মনে করেছিলাম, তুমুল বিক্ষোভ-স্লোগান ও হুড়োহুড়ির দৃশ্য হয়তো পাব। কিছুই না। ঠাণ্ডা প্রতিবাদ। কেউ তাঁবু টাঙিয়েছে সপরিবারে। খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে। কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে, কেউ হেঁড়ে গলায় ধরেছে গান। কাছে গেলে ওয়ালস্ট্রিটের বিক্ষোভ কেন্দ্রটিকে মনে হতে পারে বিশেষ কোনো মিলনমেলা। লাইন ধরে কয়েকজন দাঁড়ানো। তাদের হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা 'ব্যাংকারদের গ্রেফতার করুন'। কেউ বলছে, 'আমার চাকরি চাই', কেউ ব্যানারে লিখেছে 'হেল্প আস অকুপাই দ্য ন্যাশন_ ফুড, ব্লাঙ্কেট, মানি'। মাঝখানে কবরের মতো একটি জায়গা। সেখানে হেলান দেওয়া একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা 'অকুপাই আর্থ'। বড় একটি পেঙ্গুইনের পাপেটের বুকে লেখা 'অকুপাই নর্থপোল'। একটি মেয়ে প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে মুখে উচ্চারণ করছিল 'ডোন্ট বি গ্রিডি'। সব প্রতিবাদের মূল সুর হচ্ছে 'উই আর দ্য নাইনটি নাইন পার্সেন্ট'। এখানেই কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে চিন্তা। ঠিক তাই। এমন চিন্তা বাংলাদেশে বসেও আমরা করেছি। পেশাগত জীবনে যিনি আদর্শ তিনি হচ্ছেন চ্যানেল আইর পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ। তার মুখে বারবারই এ কথা শুনেছি_ মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে সবকিছু। সেই মুষ্টিমেয় মানুষের সংখ্যা বা পরিমাণ যা-ই বলি; ১ শতাংশের বেশি হবে না। উন্নত বিশ্বও এখন ওই ১ শতাংশের বিপক্ষে লড়ছে। বলা যায়, সারা পৃথিবীই লড়ছে। ১ শতাংশ মানুষই হচ্ছে করপোরেট পুঁজির হর্তাকর্তা। তারা পৃথিবীকে সাজাচ্ছে ওদের মতো করে, ওদের স্বার্থে।
সরকারের নিকটতম মানুষেরা কীভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে জাতীয় সম্পদকে নিজের করছে, কোটি কোটি ডলার বিদেশে পাচার করে বিশ্বায়নের সমুদ্রে সাঁতার কাটছে_ এই চিত্রগুলো, এই ভাষাগুলো অনায়াসেই খুঁজে পাওয়া যায় ওয়ালস্ট্রিটের ওই বিক্ষোভে। এক তরুণী কালো কাপড়ে নিজের চোখ বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার প্রতিবাদটি ছিল অন্যরকম। কোনো প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন কিছুই ছিল না তার হাতে। আমি বললাম, তোমার চাওয়া কী? বলল, 'কিছুই না। আমি আর দেখতে চাই না অনাচার'_ স্রেফ এটুকুই। বললাম, কোন অনাচারের কথা বলছ? সে বলল, 'এখনও তুমি বোঝোনি? পাহাড়সমান যে ভবনগুলোর নিচে দাঁড়িয়ে আছো, এগুলোর দিকে তাকাও। দেখ, ঘাড় একেবারে বাঁকিয়েও দেখতে পার কি-না। ওই ভবনগুলোতে আমাদের নেই প্রবেশাধিকার। অথচ এগুলো আমাদের সম্পদ কুক্ষিগত করেই তৈরি হচ্ছে। শুধু বেঁচে থাকাই যদি জীবনের ব্রত হয়, তাহলে আমার চোখের আর দরকার নেই। আমি অন্ধ হয়ে যেতে চাই।'
আমি যেন রীতিমতো ঢুকে পড়ছি ওদের চিন্তার জায়গাগুলোতে। মনে হলো, আমাদের দেশে মানুষের কষ্টের ক্ষত আরও অনেক গভীর, আরও দগদগে। অথচ আমার দেশের মানুষের ভাষা নেই। নেই গঠনমূলক প্রতিবাদের 'স্লোগান'। শুরুতে যে বৃদ্ধ মহিলা আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিলেন ওয়ালস্ট্রিটে, তিনি বলেছিলেন, 'ওখানে কোনো দাবি নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। কোনো কিছু মনে না রাখলেও চলবে। ওখানে গেলেই তোমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে তুমি কতটা বঞ্চিত, কতটা শোষিত।' এক আমেরিকান পরিবার ওয়ালস্ট্রিটের মাঝামাঝি একটি জায়গায় তাঁবু গেড়েছে। মা যত্ন করে কিশোরী মেয়ের মুখে উল্কি আঁকছেন। চেহারা দেখে মনে হয় বাংলাদেশি অথবা ভারতীয়। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। দেশের কথা বলল না। শুধু বলল, আমরা আরব বংশোদ্ভূত। দাবি-দাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করতেই বলল, 'আরব বিশ্বের অনেক দেশে প্রেম পর্যন্ত নিষিদ্ধ। মেয়েরা পারে না নিজের চেহারাটি দেখাতে। এই যে মেয়ের মুখে উল্কি আঁকছি; প্রকাশ্যে আমাদের দেশে এটি কঠিন অপরাধ।' মনে পড়ল সদ্য শেষ হওয়া গ্গ্নোবাল ফুড সিকিউরিটি রিপোর্টিং ট্যুরে অংশ নেওয়া আঠাশটি দেশের সাংবাদিকের মধ্যে ইরাকি সাংবাদিক সহকর্মী নিসরিন আলী হাসানউইর কথা। মেয়েটি ওয়াশিংটনে এসে শর্ট স্কার্ট পরেছিলেন। বাস ধরার জন্য দৌড়াচ্ছিলেন, বন্ধুদের সঙ্গে দারুণ খোলামেলা হয়ে মিশতে চাইছিলেন। একসময় খাবার টেবিলে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি তো দারুণ আনন্দপ্রিয়! তোমার দেশেও কি সাংবাদিক বন্ধুদের মাঝে তুমি এমন? সে বলল, প্রশ্নই ওঠে না। এই দিনগুলো আমার জীবনে স্বপ্নের মতো। আমি কখনোই ইরাকে এমন পোশাক পরতে পারিনি। আমাদের দেশে কোনো মেয়ে যদি হিজাব না পরে তাহলে তাকে নিম্নবর্ণের, অচ্ছুৎ গণ্য করা হয়। তার প্রতি সরকার ও প্রশাসনের কঠোর দৃষ্টি পড়ে। অনেক পরিবারের স্বাধীনচেতা মেয়েকে চরম নির্যাতিত হতে হয়। হত্যার শিকারও হতে হয়।
এক যুবক দাঁড়িয়ে, পাশে ট্রলি বেবি-ক্যারিয়ারের মধ্যে ঘুমন্ত একটি শিশু। তার প্ল্যাকার্ডে লেখা 'সিঙ্গেল ফাদার'। কেন চলে গেছে শিশুটির মা? নিশ্চয় অর্থের কারণেই অর্থহীন এই সম্পর্কচ্ছেদ। পাশে দাঁড়ানো এক বিদেশি সাংবাদিক খোলাসা করলেন পুরো তথ্য। বললেন, এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। সন্তান জন্ম দিয়ে মেয়ে বন্ধুটি পালিয়েছে অন্য যুবকের সঙ্গে। শিশুটির দায়ভার বাবার ওপর। কিন্তু নবজাতকটির কী হবে? ওর বাবা কি পারবে স্বাভাবিকভাবে ওকে বড় করতে? রাষ্ট্র আর করপোরেট পুঁজির পাহাড় তো দায়িত্ব নেবে না। দায়িত্ব নিলে তো পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ মার্কিন সাম্রাজ্যের রাস্তায় রাস্তায় 'হোমলেস'-এর মিছিল দিনের পর দিন দীর্ঘ হতো না। আছে নারীদের আরও স্বাধীন, আরও খোলামেলা হওয়ার দাবিও।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার আগুনে ভাষায় গেয়েছিলেন সাম্যের গান। চিহ্নিত করেছিলেন ধনী-গরিবের ব্যবধান। কিন্তু তা আমাদের আজকের সমাজ-বাস্তবতায় শুধুই গান, শুধুই কবিতা। অথচ এগুলোর আবেদন এখনও সারাবিশ্বের কোটি কোটি মানুষের অন্তরে বাজছে। সারাবিশ্বের সাধারণ মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে মধ্যবিত্তের মধ্যে ক্ষমতার রাজনীতি নেই এখন। তারা একটি ধারাবাহিক আন্দোলনের মিছিলে মিলিয়ে চলেছে পা। অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যার সুর এখন পেঁৗছে গেছে বিশ্বব্যাপী। বিশ্লেষকরা বলছেন, আরব বিশ্বের সাম্প্রতিকতম বিপ্লব-বিদ্রোহ আর বহু বছরের দুঃশাসনের একের পর এক অবসানের যে চিত্র আজ দৃশ্যমান, তা ওয়ালস্ট্রিটের এই বিক্ষোভ মিছিলকে করেছে বেগবান। কারও কারও মতে, এর উৎপত্তিও সেখানে। গত ১৫ অক্টোবর সারাবিশ্বের ৮২টি দেশের ৯৫১টি শহরে বিক্ষোভ হয়েছে করপোরেট শোষণের বিরুদ্ধে। আমাদের দেশে হয়নি। অনেক বিশ্লেষক বিষয়টিকে দেখেছেন ইতিবাচকভাবে। কারও কারও মতে, এটিই সবচেয়ে হতাশার কথা, মানুষ আন্দোলনের ভাষা হারিয়ে ফেলছে। আন্দোলনের সূত্রমুখ খুঁজে পাচ্ছে না।
বিশ্বমোড়ল দাবিবার আমেরিকার মধ্যবিত্তদের সব দাবির সঙ্গেই মিলে যায় বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের না-পাওয়াগুলো। আমেরিকায় বেকারত্ব বাড়ছে; অফিস-আদালতে কর্মী ছাঁটাই চলছে; পুঁজিপতিদের দৌরাত্ম্য ও পুঁজির থলে দিনের পর দিন বড় হচ্ছে; ব্যাংকগুলো করপোরেট সংস্কৃতিকে তেল-কাজল মাখিয়ে প্রতিনিয়তই উস্কে দিচ্ছে। এই সংকটগুলো কি আমাদের নয়? প্রশ্নগুলো নিয়েই ফিরে এসেছি ওয়ালস্ট্রিট থেকে। ছিলাম সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা অবধি। মনে হয়েছে, ওয়ালস্ট্রিট দেখতে যাইনি; গিয়েছিলাম শরিক হতে। বাংলাদেশের একজন হিসেবে। এই লেখাটি যখন শেষ করছি, ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় খবর পেলাম, গত ১৭ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের লিবার্টি প্লাজা পার্ক বা জুকুত্তি পার্কে শুরু হওয়া অকুপাই ওয়ালস্ট্রিটের বিক্ষোভকারীদের দুই মাস পর তাড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ। তার পরপরই অকুপাই ওয়ালস্ট্রিটের ওয়েবসাইটে চোখ রাখি। বড় একটি স্লোগান সেখানে_ 'আমরা সরে যাইনি আমাদের ধারণা থেকে, সময় এসেছে, আমরা ৯৯ শতাংশ, আমরা সবখানে।' সত্যি সত্যি পৃথিবীর ৮২ দেশের হাজারখানেক শহরে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনের গোড়া ওই জুকুত্তি পার্ক হলেও, সব জায়গা থেকে কি বিক্ষোভকারীদের সরাতে পারবে পুলিশ? নেভাতে পারবে কি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়া এই বিক্ষোভের আগুন?
আদিত্য শাহীন : সাংবাদিক
চারদিকে পুলিশি নিরাপত্তা। একদিকে সিএনএনের ওবি ভ্যান। ক্যামেরা ঘুরেফিরে চিত্র ধারণ করছে। বহু মানুষের হাতে ক্যামেরা। বলা যায়, অর্ধেক বিক্ষোভকারী আর অর্ধেক ভিডিওচিত্র ও তথ্য সংগ্রহকারী। আগে মনে করেছিলাম, তুমুল বিক্ষোভ-স্লোগান ও হুড়োহুড়ির দৃশ্য হয়তো পাব। কিছুই না। ঠাণ্ডা প্রতিবাদ। কেউ তাঁবু টাঙিয়েছে সপরিবারে। খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে। কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে, কেউ হেঁড়ে গলায় ধরেছে গান। কাছে গেলে ওয়ালস্ট্রিটের বিক্ষোভ কেন্দ্রটিকে মনে হতে পারে বিশেষ কোনো মিলনমেলা। লাইন ধরে কয়েকজন দাঁড়ানো। তাদের হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা 'ব্যাংকারদের গ্রেফতার করুন'। কেউ বলছে, 'আমার চাকরি চাই', কেউ ব্যানারে লিখেছে 'হেল্প আস অকুপাই দ্য ন্যাশন_ ফুড, ব্লাঙ্কেট, মানি'। মাঝখানে কবরের মতো একটি জায়গা। সেখানে হেলান দেওয়া একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা 'অকুপাই আর্থ'। বড় একটি পেঙ্গুইনের পাপেটের বুকে লেখা 'অকুপাই নর্থপোল'। একটি মেয়ে প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে মুখে উচ্চারণ করছিল 'ডোন্ট বি গ্রিডি'। সব প্রতিবাদের মূল সুর হচ্ছে 'উই আর দ্য নাইনটি নাইন পার্সেন্ট'। এখানেই কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে চিন্তা। ঠিক তাই। এমন চিন্তা বাংলাদেশে বসেও আমরা করেছি। পেশাগত জীবনে যিনি আদর্শ তিনি হচ্ছেন চ্যানেল আইর পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ। তার মুখে বারবারই এ কথা শুনেছি_ মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে সবকিছু। সেই মুষ্টিমেয় মানুষের সংখ্যা বা পরিমাণ যা-ই বলি; ১ শতাংশের বেশি হবে না। উন্নত বিশ্বও এখন ওই ১ শতাংশের বিপক্ষে লড়ছে। বলা যায়, সারা পৃথিবীই লড়ছে। ১ শতাংশ মানুষই হচ্ছে করপোরেট পুঁজির হর্তাকর্তা। তারা পৃথিবীকে সাজাচ্ছে ওদের মতো করে, ওদের স্বার্থে।
সরকারের নিকটতম মানুষেরা কীভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে জাতীয় সম্পদকে নিজের করছে, কোটি কোটি ডলার বিদেশে পাচার করে বিশ্বায়নের সমুদ্রে সাঁতার কাটছে_ এই চিত্রগুলো, এই ভাষাগুলো অনায়াসেই খুঁজে পাওয়া যায় ওয়ালস্ট্রিটের ওই বিক্ষোভে। এক তরুণী কালো কাপড়ে নিজের চোখ বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার প্রতিবাদটি ছিল অন্যরকম। কোনো প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন কিছুই ছিল না তার হাতে। আমি বললাম, তোমার চাওয়া কী? বলল, 'কিছুই না। আমি আর দেখতে চাই না অনাচার'_ স্রেফ এটুকুই। বললাম, কোন অনাচারের কথা বলছ? সে বলল, 'এখনও তুমি বোঝোনি? পাহাড়সমান যে ভবনগুলোর নিচে দাঁড়িয়ে আছো, এগুলোর দিকে তাকাও। দেখ, ঘাড় একেবারে বাঁকিয়েও দেখতে পার কি-না। ওই ভবনগুলোতে আমাদের নেই প্রবেশাধিকার। অথচ এগুলো আমাদের সম্পদ কুক্ষিগত করেই তৈরি হচ্ছে। শুধু বেঁচে থাকাই যদি জীবনের ব্রত হয়, তাহলে আমার চোখের আর দরকার নেই। আমি অন্ধ হয়ে যেতে চাই।'
আমি যেন রীতিমতো ঢুকে পড়ছি ওদের চিন্তার জায়গাগুলোতে। মনে হলো, আমাদের দেশে মানুষের কষ্টের ক্ষত আরও অনেক গভীর, আরও দগদগে। অথচ আমার দেশের মানুষের ভাষা নেই। নেই গঠনমূলক প্রতিবাদের 'স্লোগান'। শুরুতে যে বৃদ্ধ মহিলা আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিলেন ওয়ালস্ট্রিটে, তিনি বলেছিলেন, 'ওখানে কোনো দাবি নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। কোনো কিছু মনে না রাখলেও চলবে। ওখানে গেলেই তোমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে তুমি কতটা বঞ্চিত, কতটা শোষিত।' এক আমেরিকান পরিবার ওয়ালস্ট্রিটের মাঝামাঝি একটি জায়গায় তাঁবু গেড়েছে। মা যত্ন করে কিশোরী মেয়ের মুখে উল্কি আঁকছেন। চেহারা দেখে মনে হয় বাংলাদেশি অথবা ভারতীয়। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। দেশের কথা বলল না। শুধু বলল, আমরা আরব বংশোদ্ভূত। দাবি-দাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করতেই বলল, 'আরব বিশ্বের অনেক দেশে প্রেম পর্যন্ত নিষিদ্ধ। মেয়েরা পারে না নিজের চেহারাটি দেখাতে। এই যে মেয়ের মুখে উল্কি আঁকছি; প্রকাশ্যে আমাদের দেশে এটি কঠিন অপরাধ।' মনে পড়ল সদ্য শেষ হওয়া গ্গ্নোবাল ফুড সিকিউরিটি রিপোর্টিং ট্যুরে অংশ নেওয়া আঠাশটি দেশের সাংবাদিকের মধ্যে ইরাকি সাংবাদিক সহকর্মী নিসরিন আলী হাসানউইর কথা। মেয়েটি ওয়াশিংটনে এসে শর্ট স্কার্ট পরেছিলেন। বাস ধরার জন্য দৌড়াচ্ছিলেন, বন্ধুদের সঙ্গে দারুণ খোলামেলা হয়ে মিশতে চাইছিলেন। একসময় খাবার টেবিলে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি তো দারুণ আনন্দপ্রিয়! তোমার দেশেও কি সাংবাদিক বন্ধুদের মাঝে তুমি এমন? সে বলল, প্রশ্নই ওঠে না। এই দিনগুলো আমার জীবনে স্বপ্নের মতো। আমি কখনোই ইরাকে এমন পোশাক পরতে পারিনি। আমাদের দেশে কোনো মেয়ে যদি হিজাব না পরে তাহলে তাকে নিম্নবর্ণের, অচ্ছুৎ গণ্য করা হয়। তার প্রতি সরকার ও প্রশাসনের কঠোর দৃষ্টি পড়ে। অনেক পরিবারের স্বাধীনচেতা মেয়েকে চরম নির্যাতিত হতে হয়। হত্যার শিকারও হতে হয়।
এক যুবক দাঁড়িয়ে, পাশে ট্রলি বেবি-ক্যারিয়ারের মধ্যে ঘুমন্ত একটি শিশু। তার প্ল্যাকার্ডে লেখা 'সিঙ্গেল ফাদার'। কেন চলে গেছে শিশুটির মা? নিশ্চয় অর্থের কারণেই অর্থহীন এই সম্পর্কচ্ছেদ। পাশে দাঁড়ানো এক বিদেশি সাংবাদিক খোলাসা করলেন পুরো তথ্য। বললেন, এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। সন্তান জন্ম দিয়ে মেয়ে বন্ধুটি পালিয়েছে অন্য যুবকের সঙ্গে। শিশুটির দায়ভার বাবার ওপর। কিন্তু নবজাতকটির কী হবে? ওর বাবা কি পারবে স্বাভাবিকভাবে ওকে বড় করতে? রাষ্ট্র আর করপোরেট পুঁজির পাহাড় তো দায়িত্ব নেবে না। দায়িত্ব নিলে তো পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ মার্কিন সাম্রাজ্যের রাস্তায় রাস্তায় 'হোমলেস'-এর মিছিল দিনের পর দিন দীর্ঘ হতো না। আছে নারীদের আরও স্বাধীন, আরও খোলামেলা হওয়ার দাবিও।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার আগুনে ভাষায় গেয়েছিলেন সাম্যের গান। চিহ্নিত করেছিলেন ধনী-গরিবের ব্যবধান। কিন্তু তা আমাদের আজকের সমাজ-বাস্তবতায় শুধুই গান, শুধুই কবিতা। অথচ এগুলোর আবেদন এখনও সারাবিশ্বের কোটি কোটি মানুষের অন্তরে বাজছে। সারাবিশ্বের সাধারণ মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে মধ্যবিত্তের মধ্যে ক্ষমতার রাজনীতি নেই এখন। তারা একটি ধারাবাহিক আন্দোলনের মিছিলে মিলিয়ে চলেছে পা। অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যার সুর এখন পেঁৗছে গেছে বিশ্বব্যাপী। বিশ্লেষকরা বলছেন, আরব বিশ্বের সাম্প্রতিকতম বিপ্লব-বিদ্রোহ আর বহু বছরের দুঃশাসনের একের পর এক অবসানের যে চিত্র আজ দৃশ্যমান, তা ওয়ালস্ট্রিটের এই বিক্ষোভ মিছিলকে করেছে বেগবান। কারও কারও মতে, এর উৎপত্তিও সেখানে। গত ১৫ অক্টোবর সারাবিশ্বের ৮২টি দেশের ৯৫১টি শহরে বিক্ষোভ হয়েছে করপোরেট শোষণের বিরুদ্ধে। আমাদের দেশে হয়নি। অনেক বিশ্লেষক বিষয়টিকে দেখেছেন ইতিবাচকভাবে। কারও কারও মতে, এটিই সবচেয়ে হতাশার কথা, মানুষ আন্দোলনের ভাষা হারিয়ে ফেলছে। আন্দোলনের সূত্রমুখ খুঁজে পাচ্ছে না।
বিশ্বমোড়ল দাবিবার আমেরিকার মধ্যবিত্তদের সব দাবির সঙ্গেই মিলে যায় বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের না-পাওয়াগুলো। আমেরিকায় বেকারত্ব বাড়ছে; অফিস-আদালতে কর্মী ছাঁটাই চলছে; পুঁজিপতিদের দৌরাত্ম্য ও পুঁজির থলে দিনের পর দিন বড় হচ্ছে; ব্যাংকগুলো করপোরেট সংস্কৃতিকে তেল-কাজল মাখিয়ে প্রতিনিয়তই উস্কে দিচ্ছে। এই সংকটগুলো কি আমাদের নয়? প্রশ্নগুলো নিয়েই ফিরে এসেছি ওয়ালস্ট্রিট থেকে। ছিলাম সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা অবধি। মনে হয়েছে, ওয়ালস্ট্রিট দেখতে যাইনি; গিয়েছিলাম শরিক হতে। বাংলাদেশের একজন হিসেবে। এই লেখাটি যখন শেষ করছি, ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় খবর পেলাম, গত ১৭ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের লিবার্টি প্লাজা পার্ক বা জুকুত্তি পার্কে শুরু হওয়া অকুপাই ওয়ালস্ট্রিটের বিক্ষোভকারীদের দুই মাস পর তাড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ। তার পরপরই অকুপাই ওয়ালস্ট্রিটের ওয়েবসাইটে চোখ রাখি। বড় একটি স্লোগান সেখানে_ 'আমরা সরে যাইনি আমাদের ধারণা থেকে, সময় এসেছে, আমরা ৯৯ শতাংশ, আমরা সবখানে।' সত্যি সত্যি পৃথিবীর ৮২ দেশের হাজারখানেক শহরে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনের গোড়া ওই জুকুত্তি পার্ক হলেও, সব জায়গা থেকে কি বিক্ষোভকারীদের সরাতে পারবে পুলিশ? নেভাতে পারবে কি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়া এই বিক্ষোভের আগুন?
আদিত্য শাহীন : সাংবাদিক
No comments