২০১৫ সালের মধ্যে সর্বসম্মত চুক্তি-ইইউর নেতৃত্বে ডারবানে রোডম্যাপ ঘোষণা

শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নেতৃত্বে গৃহীত হলো ডারবান রোডম্যাপ। টানা তিন দিন ও তিন রাতের আলোচনার পর ইইউর নেতৃত্বে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। সম্মেলনের সময়সীমা এক দিন বাড়িয়ে গতকাল শনিবার দিনভর আলোচনা শেষে রাতে ডারবান রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়। কয়েকদিন ধরে কয়েকটি দেশের তীব্র বিরোধিতাকে পাশ কাটিয়ে শিল্পোন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জোট শেষ পর্যন্ত সমঝোতায় পেঁৗছতে একমত হয়।


ডারবান সম্মেলনে বিরোধপূর্ণ অবস্থানে থাকা চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, রাশিয়া, জাপান, সৌদি আরব এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও এ প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। প্রস্তাব অনুযায়ী আগামী ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্ব কার্বন নিঃসরণ কমাতে একটি সর্বসম্মত চুক্তি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। সম্মেলনে শিল্পোন্নত দেশের জোট অ্যানেক্স-১, উদীয়মান অর্থনীতির জোট বেসিক, স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর জোট এলডিসি, ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জোট এওসিস ও আফ্রিকান ইউনিয়নের সম্মিলিত জোটও খসড়া নিয়ে তেমন দ্বিমত করেনি। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা ও জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের দফায় দফায়
বৈঠকের পর এ সিদ্ধান্ত হয়। সম্মেলনে অংশ নেওয়া একাধিক পর্যবেক্ষক জানিয়েছেন, শুধু ভারতের বিরোধিতার কারণে সম্মেলনে একটি সমঝোতায় আসতে বিলম্ব হয়েছে।
ডারবানে কিয়োটো প্রটোকলের প্রাণ ফিরে মেয়াদ বৃদ্ধি ও গ্রিন ফান্ড গঠন হলেও কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে একটি বড় সমস্যা রয়েই গেছে। রোডম্যাপ অনুযায়ী ২০১২ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণ কমাবে (ইইউ)। যুক্তরাষ্ট্র ইইউর প্রস্তব সমর্থন করে তারাও কার্বন কমানোর ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমনকারী দেশ। আর ইইউ কার্বন নির্গমন করে বিশ্বের ১১ শতাংশ। তারপরও বিক্ষোভকারীরা খুশি ডারবানে একটি মোটামুটি সমঝোতায় পেঁৗছানোয়। গত ১২ দিন ধরে বিক্ষোভ করছেন জুবলি সাউথের আফ্রিকান কর্মী হিল মিরান। তিনি জানান, তাদের বিক্ষোভ আর অব্যাহত চাপ বিশ্বনেতারা অনুভব করে একটি চুক্তিতে পেঁৗছায় তারা কিছুটা খুশি। একটি গ্রহণযোগ্য সমঝোতায় পেঁৗছাতে পারায় আয়োজক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকাও সন্তোষ প্রকাশ করেছে। সম্মেলনের সভাপতি মেইতে এনকোয়ানে মাসাবেনে এক সংবাদ সম্মেলনে ডারবানকে একটি সফল সম্মেলন হিসেবে ঘোষণা করেন। তবে পরিবেশবাদীরা বলছেন, কার্বন নিঃসরণের বিষয়টি দীর্ঘ না করে আরও স্বল্প সময়ের জন্য করলে তারা বেশি খুশি হতেন। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরিব দেশগুলোর তহবিল নিয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার সুযোগে শিল্পোন্নত দেশগুলো কার্বন নির্গমনের সময়সীমা বেশ পিছিয়ে নিয়েছে।
ডারবানে কিয়োটো প্রটোকলের দ্বিতীয় দফার মেয়াদ ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে বাড়িয়ে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত রাখা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ২০২০ সাল পর্যন্ত বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের গ্রিন ফান্ড গঠনের বিষয়ে একমত হয়েছে শিল্পোন্নত দেশগুলো। ৪০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে গ্রিন ফান্ডের যাত্রা শুরু হবে। ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসি) ও জাতিসংঘ ফান্ডের ব্যবস্থাপনায় থাকবে। তবে এ ফান্ড ব্যবস্থাপনার জন্য প্রধান অফিস মেক্সিকো, সুইজারল্যান্ড, জার্মানিতে করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এদিকে এ ফান্ডের ব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্বব্যাংকও তদবির করছে।
২০০৭ সালে বালি সম্মেলনে কিয়োটোতে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কোন দেশ কতটুকু হ্রাস করবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। ২০১২ সালে কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তাই স্বল্পোন্নত দেশগুলো একটি নতুন চুক্তি করতে মরিয়া ছিল। শুরুতে জাপান, চীন, ভারত ও রাশিয়া এ প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। এদিকে আমেরিকা, ভারত ও চীন এ প্রটোকলে স্বাক্ষর করেনি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলো যতটা না বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দরিদ্র দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে অনেক বেশি। কিয়োটো প্রটোকলে অ্যানেক্স-১ এ উলি্লখিত উন্নত ধনী দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের হার ৫১ ভাগ। বিশ্বের জিডিপির ৭৫ ভাগ তাদের, অথচ লোকসংখ্যা মাত্র ১৯ ভাগ। অন্যদিকে গ্রুপ-৭৭ (১৩০টি দেশ) একত্রে তাদের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ৪২ ভাগ। বিশ্ব জিডিপির মাত্র ১৯ ভাগ তাদের, অথচ লোকসংখ্যা ৭৬ ভাগ। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর কার্বন নিঃসরণের হার মাত্র ১ ভাগ। তারা বিশ্ব জিডিপির ১ ভাগের অধিকারী ও লোকসংখ্যাও বিশ্বের মাত্র ১ ভাগ। আফ্রিকান ইউনিয়নভুক্ত ৩৯টি দেশের কার্বন নিঃসরণের হার মাত্র ৩ ভাগ। তারা বিশ্ব জনসংখ্যার ১৩ ভাগ হলেও বিশ্ব জিডিপির মাত্র ২ ভাগের অধিকারী। মাথাপিছু কার্বন নির্গমনের পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের বেশি। চীনের ৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন ও ভারতের ২ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ২০২০ সালে তা বেড়ে ৯ মিলিয়ন মেট্রিক টনে (চীন) উন্নীত হবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বন্দর নগর ডারবানে গত ২৮ নভেম্বর শুরু হয়ে এ সম্মেলন ৯ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর নেতারা একমত না হওয়ার কারণে সম্মেলনের সময় একদিন বাড়ানো হয়।

No comments

Powered by Blogger.