যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হলে সাম্প্রদায়িকতা বন্ধ হবে না

মাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ করার মতো। তারা তাদের অবস্থান থেকে সাধ্য অনুযায়ী কাজ করেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। আবার যুদ্ধের নয়টি মাস পাকিস্তানি বর্বর সেনা এবং এদেশে তাদের দোসর রাজাকারদের দ্বারা বীভৎস নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ঘৃণিত এই রাজাকারদের অর্থাৎ যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এবং যুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণ নিয়ে কথা বলেছেন তিন নারী


মুক্তিযোদ্ধা । গ্রন্থনা করেছেন শিরিন আক্তার\ ডা. ফওজিয়া মোসলেম বরাবর নিভৃতচারিণী। মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহণ সে সময়ের দাবি বলেই মনে করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন এটা তার সারা জীবনের গর্ব। এখনও দেশের সার্বিক মঙ্গলের জন্য নিবেদিতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। স্মৃতিচারণ করলেন এভাবে_ ২৫ মার্চ যুদ্ধ শুরু হলো। আমি ২৭ তারিখ গ্রিন রোডের সৈয়দা ফিরোজা বেগমের ক্লিনিকে ভর্তি হলাম। কিন্তু সেখানেও পরিবেশ ততটা নিরাপদ নয় দেখে আমি মিটফোর্ডে চলে আসি। ২ এপ্রিল আমার প্রথম সন্তান জন্ম নিল। আমি অসুস্থ, পুরো হাসপাতালে তেমন কোনো লোকজন ছিল না। তাছাড়া মিটফোর্ডের ছাদ থেকে নদীর ওপার কেরানীগঞ্জের সামনে বোমা ফেলছে পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধবিমান। সব মিলিয়ে একটা মহা আতঙ্কিত পরিবেশ। তার স্বামী বামপন্থি জননেতা সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক তখন যুদ্ধে গেছেন। বাড়ির দিকে আশপাশের যুদ্ধবিরোধীদের শ্যেনদৃষ্টি। শ্বশুর-শাশুড়ি আতঙ্কে চুপসে গেছেন। এর মধ্যে ছেলের বউ সন্তানসহ বাড়িতে আসবে_ সেটাকে নিরাপদ মনে করছিলেন না তারা। নবজাত শিশুকে নিয়ে তখন এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে ওঠেন তিনি। কোনো রকমে দিন কয় পার করে মে মাসের ৫ তারিখে আগরতলায় চলে যান। সেখানে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র ইউনিয়নে গেরিলা দলের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকালীন পুরোটা সময় কাজ করেন। বললেন, যুদ্ধে পাঠানোর জন্য যেসব কিশোর-তরুণরা আসত, তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতাম। সেখানে ছোট বাচ্চা নিয়ে আছি, খাওয়ার অসুবিধা ছিল। বাচ্চার শরীর-স্বাস্থ্য যে কোনো সময় খারাপ হতে পারে কিন্তু এসব কথা মাথায় আসত না। বরং তরুণ যোদ্ধাদের যুদ্ধে যাওয়ার আগ্রহ, উদ্দীপনায় নিজেও উদ্দীপিত হতাম। কী করে ওদের সেবা করব তাতে ব্যস্ত হয়ে উঠতাম। আমাদের সবারই একমাত্র উদ্দেশ্য দেশকে স্বাধীন করা। তবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে ওরা যুদ্ধে যাচ্ছে, এ কথা ভেবে মাঝে মধ্যে মন খারাপও হতো। এভাবেই ক্যাম্পে কেটে গেল সাত মাস। দেশ স্বাধীন হলো ১৬ ডিসেম্বর। ফিরে আসি ৩১ ডিসেম্বর। স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রেখে আনন্দে কেঁদেছি বহুক্ষণ।
স্বাধীনতার ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে, আপনি দেশকে যেমন দেখতে চেয়েছিলেন, তেমনটা পেয়েছেন কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে বললেন , আমরা ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন একটি দেশ চেয়েছিলাম। কিন্তু তেমনটি আমরা পাইনি। তবে আমাদের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধে বলীয়ান হয়ে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে ক্ষমতায় এনেছে গত নির্বাচনে এটা আশার কথা। তরুণরা যথেষ্ট সচেতন। রাজনীতিতে মেধাসম্পন্ন তরুণদের আসতে হবে। পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যারা রাজনীতি করে তাদের রুখতে হবে, আর তরুণরাই এখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে তিনি বললেন, খুব দ্রুত এর বিচার হওয়া উচিত। যুদ্ধ-পরবর্তী সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দীন আহমদকে বের করে ষড়যন্ত্রকারী মোস্তাক আহমেদ যখন ক্ষমতায় বসল, তখনই ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি সফল হয়ে গিয়েছিল। দিন দিন তাদের শক্তি পোক্ত হয়েছে। তাই দ্রুত বিচার করে এদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া খুবই জরুরি। না হলে সাম্প্রদায়িকতা বন্ধ হবে না। ধর্মনিরপেক্ষ থাকব না।

No comments

Powered by Blogger.