ঢাকা সিটি করপোরেশন না ঢাকার বিভক্তি by এ এম এম শওকত আলী

ঢাকা মহানগরীতে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ নামে দুটি সিটি করপোরেশন স্থাপনের আইনে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করেছেন। সরকারের এ উদ্যোগের বিষয়ে বিতর্ক হয়েছে প্রচুর। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদও জানানো হয়েছিল। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। সরকার তার অবস্থানে অনড়। নাগরিক সমাজ এ উদ্যোগ থেকে বিরত থাকার জন্য যথেষ্ট যুক্তি প্রদর্শন করেছিল। সরকারের অবস্থান প্রথমে সংসদে এবং পরবর্তী সময়ে অন্যান্য অনুষ্ঠানে ব্যাখ্যাও দেওয়া


হয়। সেসবের বিশদ আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। কারণ মিডিয়ায় উভয় পক্ষের যুক্তি যথাসময়ে প্রকাশ করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সংক্ষুব্ধ মেয়র হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন। আইনসংক্রান্ত প্রশ্নে দুই বিচারপতির মতভেদের কারণে বিষয়টি এখন প্রধান বিচারপতি কর্তৃক নির্ধারিত তৃতীয় বেঞ্চে শুনানি ও সম্ভবত নিষ্পত্তি হবে। নাগরিক সমাজের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রধানত দুটি যুক্তি দিয়েছিলেন। এক. এ ধরনের পদক্ষেপ অসাংবিধানিক। অর্থাৎ সরকার সংবিধান লংঘন করেছে। দুই. একই শহরে দুটি সিটি করপোরেশনের কোনো নজির নেই। প্রথম যুক্তির বিষয়ে বলা যায়, সাংবিধানিক কি অসাংবিধানিক, সে প্রশ্নটি নিষ্পত্তি হবে উচ্চ আদালতে। এখন সেটাই হয়েছে। উৎকণ্ঠা শুধু চূড়ান্ত নিষ্পত্তির। বিষয়টি নিঃসন্দেহে সময়সাপেক্ষ। দ্বিতীয় যুক্তি অর্থাৎ পদক্ষেপটি নজিরবিহীনের বিষয়ে বলা যায়, সরকার এ যুক্তি খণ্ডন করার চেষ্টা করেছে। বলা হয়েছে, নাগরিক সমাজ না জেনেই এমন কথা বলছে। এ প্রসঙ্গে লন্ডন ও সুইডেনের উদাহরণও সরকার উল্লেখ করে। এ বিষয়টিই এখন মূল প্রশ্ন। সরকারের পক্ষ থেকে এ যুক্তিও দেখানো হয়েছে যে লন্ডনে দুটি সিটি করপোরেশন ছাড়াও একাধিক (Borrough) কাউন্সিল বিদ্যমান। এর সঙ্গে সুইডেনের বিষয়েও দুটি সিটি করপোরেশনের অস্তিত্বের যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে। লন্ডন ও সুইডেনের নগরভিত্তিক স্থানীয় সরকারের কাঠামো ও কার্যভিত্তিক স্থানীয় সরকারের কাঠামো ও কার্যপরিধি কি ঢাকার জন্য প্রযোজ্য?
লন্ডনের স্থানীয় সরকারব্যবস্থার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। প্রথমেই বলা দরকার, পৃথিবীর একেক দেশে একেক ধরনের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা নগরে ও পল্লী অঞ্চলে সৃষ্টি হয়। এর মূল কারণ হলো ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এরা কখনো একই ধরনের হয় না। লন্ডনে যে দুটি করপোরেশনের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর গঠন ও কার্যপরিধি ভিন্নতর। লন্ডনকে উত্তর-দক্ষিণে ভাগ করে একই ধরনের দুটি অভিন্ন করপোরেশন সৃষ্টি করা হয়নি। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, লন্ডনের স্থানীয় সরকারব্যবস্থার দুটি কাঠামো। আলোচনার খাতিরে একটিকে বলা হয় উচ্চতর স্তর (Upper tier), যার বিস্তৃতি বৃহত্তর লন্ডন। দ্বিতীয় স্তরকে বলা হয় নিম্নস্তর (Lower tier)।
উচ্চতর স্তরের প্রথমে নাম ছিল বৃহত্তর লন্ডন কাউন্সিল (Greater London Council)। ১৯৮৬ সালে এর বিলুপ্তি ঘটে। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বৃহত্তর লন্ডন কর্তৃপক্ষ (Greater London Authority)। এর কার্যাবলি ভিন্নতর। লন্ডনের দুই স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার কার্যাবলি সমন্বয় করে বৃহত্তর লন্ডন কর্তৃপক্ষ। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, কৌশলগত পরিকল্পনা (Strategic Planning), আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ফায়ার ব্রিগেড-সংক্রান্ত কাজ, পরিবহন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সিংহভাগ কাজ। এর প্রধান নির্বাহী হলো লন্ডনের মেয়র। নিম্নস্তরে ৩৩টি নির্বাচিত স্থানীয় কর্তৃপক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে ৩২টি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, যা লন্ডন বোরো পরিষদ বলে (Borough Council) পরিচিত এবং অন্যটি হলো সিটি অব লন্ডন করপোরেশন। অতএব, একই শহরে অভিন্ন দুটি সিটি করপোরেশনের অস্তিত্ব নেই। অতীতের বৃহত্তর লন্ডন কাউন্সিলকে কখনো সিটি করপোরেশন বলা হয়নি। এর বিলুপ্তির পর বৃহত্তর লন্ডন কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়। একেও বৃহত্তর লন্ডন করপোরেশন বলা হয়নি। অন্যদিকে সিটি অব লন্ডন করপোরেশন মধ্যযুগে সৃষ্টি হলেও এর কার্যপরিধি ও কাঠামো মূলত অপরিবর্তিত। সিটি অব লন্ডন করপোরেশনের প্রধান লর্ড মেয়র অব সিটি অব লন্ডন নামে অভিহিত। অর্থাৎ উত্তর বা দক্ষিণের লর্ড মেয়র বলা হয়নি। অন্যদিকে ৩২টি বোরো পরিষদের অস্তিত্ব ও ক্ষমতা বিপন্ন বা খর্ব করা হয়নি। সিটি অব লন্ডন করপোরেশনসহ ৩২টি বোরো পরিষদের কাজ হলো স্থানীয় পর্যায়ে সেবা নিশ্চিত করা, যা বৃহত্তর লন্ডন কর্তৃপক্ষের আওতাভুক্ত নয়। সিটি অব লন্ডনের জন্য পৃথক পুলিশবাহিনী রয়েছে। এরা মেট্রোপলিটন পুলিশ সার্ভিসের অধীন নয়। মেট্রোপলিটন পুলিশের অধিক্ষেত্র বৃহত্তর লন্ডন। অতএব, দেখা যায় যে মেয়র অব লন্ডন এবং লর্ড মেয়র অব সিটি অব লন্ডন দুটি পৃথক ব্যবস্থাপনা এবং সার্বিকভাবে ৩২টি বোরো পরিষদও পৃথক অস্তিত্ব। এদের দায়িত্ব হলো ওইসব ক্ষেত্রে সেবা প্রদান, যা বৃহত্তর লন্ডন কর্তৃপক্ষের আওতাধীন নয়। যেমন স্থানীয় পরিকল্পনা, স্কুল ও সমাজসেবা। স্থানীয় রাস্তাঘাট ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। আগেই বলা হয়েছে, সিটি অব লন্ডনের জন্য লন্ডন সিটি করপোরেশন রয়েছে। অন্যদিকে ৩২টির মধ্যে একটিকে বলা হয় সিটি অব ওয়েস্ট মিনস্টার। তবে এর জন্য কোনো পৃথক লর্ড মেয়র নেই। কারণ ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত।
এখন সুইডেনের বিষয়টি আলোচনা করা যায়। সুইডেনের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম মিউনিসিপ্যালিটি। তা গ্রামেই হোক বা শহরে হোক। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম। এ শহরের স্থানীয় সরকার কাঠামোকে স্টকহোম মিউনিসিপ্যালিটি বা সিটি অব স্টকহোম বলা হয়। সংশ্লিষ্ট আইনের দৃষ্টিকোণে এর নাম মিউনিসিপ্যালিটি। সুইডিশ ভাষায় Stockholm Kommune। মিউনিসিপ্যাল পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী Stockholm stad (City of Stockholm) প্রয়োজনবোধে ইংরেজিতে বলা যাবে। সুইডেনের স্থানীয় সরকার আইন ১৮৬৩ সালে প্রণীত হয়। ওই সময় স্টকহোমসহ ৮৯টি শহর ছিল। স্টকহোমের বিস্তৃতি ছিল সীমিত। ১৯১৩, ১৯১৬ এবং ১৯৪৯ সালে এর এলাকার অধিকতর বিস্তৃতি ঘটে। ১৯৭১ সালে গৃহীত স্থানীয় সরকার সংস্কারের মাধ্যমে স্টকহোম একটি একক (Unitary) মিউনিসিপ্যালিটি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুইডেনের অন্যান্য মিউনিসিপ্যালিটিও একই ধরনের। অতএব দেখা যায়, এলাকার বিস্তৃতি হওয়া সত্ত্বেও এর একক কাঠামো কখনো খণ্ডিত করা হয়নি।
সার্বিক বিবেচনায় একদিকে বাংলাদেশ, অন্যদিকে যুক্তরাজ্য এবং সুইডেনের নগরভিত্তিক স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ড নামে অভিহিত অঞ্চলের প্রধান শহর লন্ডন, যা সিটি অব লন্ডন নামে পরিচিত। এর উৎপত্তি মধ্যযুগে। সিটি অব লন্ডনকে কখনো ভাগ করা হয়নি। আশপাশে স্থাপিত হয়েছে সিটি অব ওয়েস্ট মিনস্টারসহ ৩৩টি বোরো পরিষদ। এগুলোর অস্তিত্বও অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে ঐতিহ্যগত কারণে। সময়ের প্রয়োজনে প্রথমে বৃহত্তর লন্ডন কাউন্সিল ও পরে বৃহত্তর লন্ডন কর্তৃপক্ষ গঠিত হলেও সিটি অব লন্ডনসহ অন্য ৩৩টি বোরো কাউন্সিলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়নি। এদের কার্যাবলি ও দায়িত্ব পরিধিও অভিন্ন। বাংলাদেশের এ ক্ষেত্রে ইতিহাস সম্পূর্ণ বিপরীত। অধিকতর নাগরিকসেবা প্রদানের অজুহাতে প্রথমে মিউনিসিপ্যালিটির অস্তিত্ব বিলোপ করে করপোরেশন এবং পরবর্তী সময়ে একটি একক করপোরেশনের বিভক্তি। ভবিষ্যতে হয়তো আরো বিভক্তি হবে। সরকারি নীতিনির্ধারকদের মতে, ভবিষ্যতে আরো হবে। পক্ষান্তরে সুইডেনের বিষয়ে বলা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে নগরভিত্তিক স্থানীয় সরকারব্যবস্থা মিউনিসিপ্যালিটি নামে অভিহিত ছিল এবং এখনো আছে। স্টকহোম মিউনিসিপ্যালিটি বা সিটি অব স্টকহোমের এলাকা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেলেও এর জন্য একে কখনো খণ্ডিত করা হয়নি। সুইডেনের পল্লী অঞ্চলের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নামও মিউনিসিপ্যালিটি। ১৯৪৩ সালে গৃহীত সংস্কারব্যবস্থায় পল্লী অঞ্চলের দুই হাজার ২৮১টি মিউনিসিপ্যালিটির সংখ্যা হ্রাস করে ৮১৬ করার সুপারিশ ছিল। কিন্তু ওই সময়ের নগরভিত্তিক ১৩৩টি মিউনিসিপ্যালিটির বিষয়ে কোনো তারতম্য হয়নি।
পল্লী অঞ্চলের সংস্কারমূলক সুপারিশের বিষয়ে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। ১৯৫৯ সালে সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠিত হয়। একে বলা হয়, বিভক্তিসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ (Subdivision experts of 1959)। এদের সুপারিশ ছিল, পরবর্তী সংস্কারের আওতায় নগর ও পল্লী অঞ্চলে নতুন মিশ্র মিউনিসিপ্যালিটি স্থাপন করার। ১৯৬২ সালে সুইডেনের পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত নেয়, এ ধরনের সংস্কার বাস্তবায়িত হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। অর্থাৎ নতুন এলাকাভুক্তি বা বিভক্তি চাপিয়ে দেওয়া হবে না। এ ধরনের গণতান্ত্রিক মনোবৃত্তি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কখনো দৃশ্যমান হয়নি। এ দেশে সব কিছুই হয় নির্বাহী সিদ্ধান্তে, যা পরবর্তীকালে আইন প্রণয়নের সময় সংসদে একতরফাভাবে গৃহীত হয়। সুইডেনের সংস্কারের ক্ষেত্রে এও দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রেই একীভূত বৃহৎ মিউনিসিপ্যালিটি পরবর্তী সময়ে পুরনো অবস্থানে ফিরে গেছে। অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় বিভক্তি হয়েছে।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.