কৃষক এবার আলুর বাম্পার ফলনের অপেৰায়- ঘন কুয়াশা ও দরপতনে- চাষীরা শঙ্কিত by কাওসার রহমান
মুন্সীগঞ্জ থেকে ফিরে চাষীরা এবার আলুর বাম্পার ফলনের অপেক্ষায়। কিনত্মু শেষ মুহূর্তে এসে ঘন কুয়াশা এবং মূল্যের দরপতন আলু চাষীদের শঙ্কিত করে তুলেছে। সফলভাবে আলু ফসল ঘরে তুলতে নিয়মিত ছত্রাকনাশক স্প্রে করে যাচ্ছে।
সারের দাম কম থাকলেও চড়া দামে জমি লিজ নিয়ে এবং বীজ কিনে চাষীরা এবার আলু চাষ করেছে। এই অবস্থায় কোন রোগ বালাই দেখা দিলে চাষীদের সর্বস্বানত্ম হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। চাষীদের শঙ্কা আলুর দাম নিয়েও। বাজারে আলুর দাম ক্রমেই কমে যাওয়ায় তারা শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তারা বলছে, জমির ভাড়া, বীজ, সেচ ও শ্রমিকের মজুরি এবার বেশি। এতে প্রতি মণ আলুর উৎপাদন খরচ সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা গিয়ে পড়বে। এই অবস্থায় প্রতি মণ (৪০ কেজি) আলু ছয় শ' টাকা দরে বিক্রি করতে না পারলে লোকসান গুনতে হবে।মঙ্গলবার মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, যেদিকে চোখ যায় মাঠজুড়ে শুধু আলু আর আলু। শুধু মাঠেই নয়, বাড়ি ঘরের আনাচে কানাচে পরিত্যক্ত জমিতে আলু চাষ হয়েছে। কৃষক যেখানেই জায়গা পেয়েছে সেখানেই আলু চাষ করেছে। ফলে এবার মুন্সীগঞ্জের আবাদকৃত অর্ধেকেরও বেশি জমিতে আলু চাষ হয়েছে। কিনত্মু বৈরী আবহাওয়ার কারণে প্রায় প্রতিদিনই ঘন কুয়াশা পড়ছে। কোন কোন দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যনত্ম আবার কখনও কখনও সারাদিনও সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। যা চাষীদের শঙ্কার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তারা প্রাণানত্ম চেষ্টা করছে আলু গাছকে রোগবালাই থেকে মুক্ত রাখতে। প্রতি সপ্তাহেই আলুর ক্ষেত্রে ছত্রাকনাশক স্প্রে করছে যাতে ঘন কুয়াশার কারণে 'লেট ব্রাইট' নামক মড়করোগ আলুর গাছকে আক্রানত্ম করতে না পারে। ইতোমধ্যে আলুর বয়স অধেক পেরিয়ে গেছে। আরও দেড় মাস অপেক্ষা করতে হবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসল আলু ঘরে তুলতে। সবুজ গাছের মূলে থোকায় থোকায় আলু ধরেছে। ক্রমেই আলুর আকার বড় হচ্ছে। মাঠজুড়ে আলু গাছের যে চেহারা তাতে এবার আলুর বাম্পার ফলনই ইঙ্গিত করছে।
চাষীরা জানান, বীজ বপন থেকে শুরম্ন করে আলু উঠতে তিন মাস সময় লাগে। ইতোমধ্যে গাছের বয়স দেড় মাস অতিক্রম করে গেছে। আর দেড় মাস পরই আলু উঠবে। এই সময়টাই খুব 'ক্রুসিয়াল'। এ সময়ে আলু গাছ লেট ব্রাইটসহ নানা রোগে আক্রানত্ম হয়। বিশেষ করে লেট ব্রাইট রোগ খুবই মারাত্মক। টানা ঘন কুয়াশা থেকে এ রোগ দেখা দেয় এবং মুহূর্তের মধ্যেই তা ছড়িয়ে পড়ে। এটা নিয়েই চাষীরা শঙ্কার মধ্যে রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নিজের আলু ক্ষেত্রেই কথা হয় টুঙ্গিবাড়ি উপজেলার আউটশাহী গ্রামের চাষী মোহাম্মদ ইব্রাহিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, যত বেশি ঠা-া পড়বে তত আলুর ফলন ভাল হবে। এবার আবহাওয়া আলু চাষের উপযোগী। কিনত্মু ঘন কুয়াশা আলুর জন্য ক্ষতিকর। এ কুয়াশা থেকে আলুর জন্য মহামারী হিসাবে পরিচিত 'লেট ব্রাইট' রোগে আক্রানত্ম হতে পারে। তাই আগাম সতর্ক ব্যবস্থা হিসাবে আমরা জমিতে ছত্রাকনাশক ছিটিয়ে যাচ্ছি। কুয়াশার মাঝেমধ্যে রোদ ওঠায় এখন পর্যনত্ম আলু গাছ সুস্থ আছে। এ অবস্থা শেষ পর্যনত্ম অব্যাহত থাকলে আলুর বাম্পার ফলন ঘরে তুলতে পারব বলে আশা করছি।
গত বছর চাষীরা আলুর ভাল দাম পেয়েছে। এ কারণেই এবার আলু চাষে তাদের আগ্রহ বেড়ে গেছে। চাষীদের ব্যাপক আগ্রহের কারণে জমির ভাড়া বেড়ে গেছে। তা সত্ত্বেও বেশি মুনাফার আশায় চড়া দামে জমি লিজ নিয়েই চাষীরা এবার আলু আবাদ করেছে। গত বছর যেখানে প্রতি গ-া (সাড়ে সাত শতাংশ) জমির ভাড়া ছিল দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা। এবার সেখানে জমির মালিককে প্রতি গ-া জমির জন্য চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে। তাও সেটা এই আলুর মৌসুমের জন্যই। আলু ওঠার পর আবার জমি মালিককে ফেরত দিতে হবে।
জমি ছাড়াও এবার বীজের দাম ছিল অনেক বেশি। মূলত বেশি কৃষক এবার আলু চাষে আগ্রহী হওয়ায় বীজের চাহিদা বেড়ে যায়। ফলে দাম বৃদ্ধি পায়। বিএডিসির বীজ এবার ১৬ শ' টাকা বসত্মা (৪০ কেজি) কিনতে হয়েছে। ব্র্যাকের ৫০ কেজির বসত্মা বীজ বিক্রি হয়েছে ছয় হাজার টাকা দরে। আর হল্যান্ড থেকে আসা বীজ বিক্রি হয়েছে সাত হাজার টাকা দরে। এবার ব্র্যাকের আলু বীজের চাহিদা ছিল বেশি। এ বীজের আলু আগামী বছরও বীজ হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। এ কারণে চাষীরা ব্র্যাকের বীজ বেশি ব্যবহার করেছে। বীজের মধ্যে এবার ডায়মন্ড জাত সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়া ভেনিলা ও কার্ডিনাল বীজও ব্যবহার করেছে।
এবার সারের দাম কম থাকায় চাষীদের মধ্যে স্বসত্মি ছিল। গত বছর যেখানে চার টাকা করে টিএসপি সারের ব্যাগ (৫০ কেজি) কিনতে হয়েছে, সেখানে এবার টিএসপি সারের দাম ছিল ১৪শ' ৭০ টাকা (দেশী) ও ১১শ' টাকা (চীনা)। পটাশ সারের দাম ছিল প্রতি ব্যাগ ৯৫০ টাকা এবং ইউরিয়া ৬২৫ টাকা। সারের পেছনে খরচ কমে গেলেও জমি ভাড়া, বীজ ও শ্রকিকের মজুরি বেড়ে গেছে। গত বছর যেখানে শ্রমিকের মজুরি ছিল ১৫০ টাকা। এবার সেখানে মজুরি দিতে হচ্ছে ২০০ টাকা। সেচ খরচও এবার বেশি নিচ্ছে। এসব কারণে এবার কানি (২০ গ-া) আলুর উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে সোয়া দুই লাখ টাকা। প্রতি কানিতে ৪০০ থেকে ৫০০ মণ আলু পাওয়া যাবে। চাষীরা আশা করছে ফলন ভাল হলে খরচ বেশি হলেও তা পুষিয়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে টুঙ্গিবাড়ি থানার মির্জানগর গ্রামের কৃষক এসাহাক শেখ বলেন, গত বছর আলুর ক্ষেত্রে মড়ক লেগেছিল। ফলে আলুর ভাল ফলন পাওয়া যায়নি। প্রতি গ-ায় আলু পাওয়া গেছে ১৮ থেকে ২০ মণ। এবার গাছের যে ভাল অবস্থা তাতে গ-ায় ২৫ মণ আলু পাব বলে আশা করছি। তবে আমরা আলুর দাম নিয়ে চিনত্মিত। যেভাবে আলুর দাম পড়ে যাচ্ছে তাতে শেষ পর্যনত্ম আলু বেচে লোকসান না গুনতে হয়, সেটা নিয়েই আমরা শঙ্কিত। এ বছর প্রতি মণ আলুর উৎপাদন খরচ ৪৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে। সেক্ষেত্রে প্রতি মণ আলুর দাম ৬০০ টাকা না পেলে আমাদের লোকসান গুনতে হবে।
আলু ফসলকে সফল করে তোলার জন্য কৃষি বিভাগও তৎপর রয়েছে। আলু গাছে যাতে পোকার আক্রমণ না করে সেজন্য কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক এ কে এম আমিনুর রহমান বলেন, গত বছর দাম বেশি পাওয়ায় কৃষক এবার মুন্সীগঞ্জ জেলায় বেশি আলু আবাদ করেছে। এখন পর্যনত্ম আবহাওয়া অনুকূলে রয়েছে। ফলে ভাল ফলন হবে বলে আশা করছি। কুয়াশায় যাতে পোকার আক্রমণ না হয় আলু ক্ষেতে ছত্রাকনাশক ব্যবহারের জন্য কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি।
আলুর ফলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'গত বছর এ জেলায় হেক্টর প্রতি আলুর ফলন পাওয়া গেছে ৩০ টন। এবার আবহাওয়া ভাল আছে। তাই হেক্টর প্রতি ফলন ৩০ টন হবে বলে আশা করছি।'
মুন্সীগঞ্জ জেলায় এবার অর্ধেকেরও বেশি জমিতে আলু চাষ হয়েছে। এ জেলায় মোট আবাদকৃত জমি ৬৪ হাজার হেক্টর। আলু আবাদ হয়েছে ৩৬ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি জমিতে এবার আলু আবাদ হয়েছে। এ জেলায় আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫ হাজার হেক্টর। এ জেলা থেকে এ বছর সাড়ে ১১ লাখ টন আলু উৎপাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
No comments