বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস- ঐ মহামানব আসে... by তোফায়েল আহমেদ
১০ জানুয়ারি বাঙালির জীবনে চিরস্মরণীয় এক অনন্য-ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ হানাদারমুক্ত হলেও বিজয় আমাদের পরিপূর্ণ হয় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি।
এদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাঙালি বিজয়ের পরিপূর্ণতা অর্জন করেছিল। পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ৮ জানুয়ারি পিআইএর একটি বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধু লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছান। সেখানে পৌঁছে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘বাংলার মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এই মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে, তখন আমি রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দিজীবন কাটাচ্ছি।’ তিনি বাংলার জনগণের কাছে ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।’ জনগণের আরাধ্য প্রিয় নেতার মানসজগতে বাংলার মানুষের জন্য ছিল অপরিসীম ভালোবাসা।
মনে পড়ে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ট্রেনিং সমাপ্ত করে শপথ গ্রহণ করতাম এই বলে যে, ‘বঙ্গবন্ধু মুজিব, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ, আমরা জানি না। কিন্তু যতক্ষণ তোমার স্বপ্নের বাংলাদেশকে আমরা হানাদারমুক্ত করতে না পারব, ততক্ষণ আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’ যেদিন বঙ্গবন্ধুর মুক্তির সংবাদ জানলাম, সেদিন যে কী আনন্দ, ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না! সমগ্র দেশ অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে কখন প্রিয় নেতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করবেন। যেদিন মাহেন্দ্রক্ষণটি এল, সেদিন ছিল সোমবার। সকাল থেকেই লাখ লাখ মানুষ ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে দশ দিক মুখরিত করে মিছিল নিয়ে বিমানবন্দর অভিমুখে যাচ্ছে। কোটি কোটি হূদয় রুদ্ধবাক মুহূর্ত গুনছে, প্রতি নিঃশ্বাসে অধীর আগ্রহে কালক্ষেপণ করছে—কখন, কখন আসবেন প্রিয় নেতা? কী দিয়ে তারা বরণ করে নেবে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে, বাঙালির হূদয়ের শ্রেষ্ঠ গর্বকে।
ঢাকায় যখন আমরা নেতার আগমন-প্রতীক্ষায়, তখন সকালে দিল্লির জনসাধারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে এক অভূতপূর্ব রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ সরকারের উচ্চপদস্থ নেতারা। ব্রিটেনের রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট জেটটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অবতরণ করলে তাঁর সম্মানে ২১ বার তোপধ্বনি করা হয়। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলেন, ‘আপনার জন্য আমি গর্বিত। ভারত ও বাংলাদেশের মানুষ আপনার জন্য গর্ব অনুভব করে। শেখ মুজিবকে আমাদের মধ্যে পেয়ে ভারতের জনগণ আজ আনন্দে আত্মহারা। শেখ মুজিব তাঁর জনগণকে নতুন জীবন দান করেছেন। তাঁর স্বাধীনতার স্বপ্ন আজ সার্থক। শারীরিকভাবে তিনি বন্দী ছিলেন; কিন্তু তাঁর স্বপ্ন ও সাধকে বাস্তবায়ন করতে বাংলার জনগণ তাঁরই অনুপ্রেরণায় স্বাধীনতার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।’ সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতিকালে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে ভারতবাসীর উদ্দেশে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বলেন, ‘আমার জন্য এটা পরম সন্তোষের মুহূর্ত। বাংলাদেশে যাবার পথে আমি আপনাদের মহতী দেশের ঐতিহাসিক রাজধানীতে যাত্রাবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ কারণে যে, আমাদের জনগণের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারতের জনগণ এবং আপনাদের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, যিনি কেবল মানুষের নন, মানবতারও নেতা। তাঁর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের কাছে এর মাধ্যমে আমি আমার ন্যূনতম ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারব।...অবশেষে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের, অপ্রকৃতিস্থতার বিরুদ্ধে প্রকৃতিস্থতার, ভীরুতার বিরুদ্ধে সাহসিকতার, অবিচারের বিরুদ্ধে সুবিচারের এবং অশুভর বিরুদ্ধে শুভর বিজয় হয়েছে।’
এরপর অবসান ঘটে আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার। দিল্লি থেকে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটেনের রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট বিমানটি ঢাকার আকাশসীমায় দেখা দিতেই জনসমুদ্র উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। বেলা একটা ৫১ মিনিটে বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণ করে। বিমানে সিঁড়ি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্য নেতারা, কেন্দ্রীয় স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারা এবং আমরা মুজিব বাহিনীর চার প্রধান ছুটে যাই নেতাকে অভ্যর্থনা জানাতে। আমার হাতে ছিল পুষ্পমাল্য। জাতির জনককে মাল্যভূষিত করার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সংযমের সব বাঁধ ভেঙে যায়, তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। সে এক অবিস্মরণীয় ক্ষণ, অভূতপূর্ব মুহূর্ত! বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু জনতার মহাসমুদ্রের উদ্দেশে হাত নাড়েন। তাঁর চোখে তখন স্বজন হারানোর বেদনা-ভারাক্রান্ত অশ্রুর নদী; আর জ্যোতির্ময় দ্যুতি ছড়ানো মুখাবয়বজুড়ে বিজয়ী বীরের পরিতৃপ্তির হাসি। বঙ্গবন্ধুর অভিব্যক্তির এরূপ প্রকাশ যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলা মায়ের প্রতিফলিত বিশুদ্ধ প্রতিচ্ছবির এক হিরণ্ময় প্রকাশ। বিমানের সিঁড়ি বেয়ে জাতির জনক তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার তোপধ্বনি করে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি সম্মান জানানো হয়।
এরপর রেসকোর্স ময়দানে যাওয়ার জন্য জাতীয় নেতারাসহ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অপেক্ষমাণ ট্রাকে উঠে রওনা দিই। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপিত মঞ্চে উঠে ডায়াসের সামনে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালেন বঙ্গবন্ধু এবং রুমালে চোখ মুছলেন। দীর্ঘ কারাবাসের ক্লান্তিতে মলিন মুখটি তবু সমুজ্জ্বল। উন্নত ললাট, প্রশান্ত বদন, দুই চোখ তখনো অশ্রুসিক্ত, কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ! সে অবস্থায়ই চিরাচরিত ভঙ্গিতে ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে উপস্থিত জনসমুদ্রের উদ্দেশে নিবেদন করলেন তাঁর ঐতিহাসিক বক্তৃতা। হূদয়ের সবটুকু অর্ঘ্য ঢেলে আবেগমথিত ভাষায় বলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ আমি তখন ভাবছি, দীর্ঘ নয় মাস ১৪ দিন নির্জন কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গোনা একজন মানুষ কী করে এ রকম উদ্বেলিত পরিস্থিতিতেও স্থিরপ্রতিজ্ঞ থেকে বলছেন, ‘ভাইয়েরা, তোমাদের একদিন বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। আজকে আমি বলি, আজকে আমাদের উন্নয়নের জন্য আমাদের ঘরে ঘরে কাজ করে যেতে হবে।’ এমন পরিস্থিতিতেও সব কথার মধ্যে তিনি বলেন, ‘সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ।’ এটাও একটি ইঙ্গিতবাহী কথা। বক্তৃতায় তিনি আরও বলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।’ ৩০ লাখ মানুষের আত্মদান স্মরণ করে বেদনা-ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বাংলায় আজ বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ৩০ লাখ লোক মারা গেছে। আপনারাই জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা।’ ভারতবর্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি চিনি। তাঁকে জানাই আমার শ্রদ্ধা। তাঁর রক্তে মিশে রয়েছে রাজনীতি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বের সব রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমার মুক্তির জন্য আবেদন করেছেন। আমার সাথে দিল্লিতে শ্রীমতী গান্ধীর আলাপ হয়েছে। আমি যখনই বলব, ভারতীয় সেনাবাহিনী তখনই দেশে ফেরত যাবে।’
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে বলেন, ‘গত পঁচিশে মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এসব কুকীর্তির বিচার করতে হবে।’
পরিশেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে তাঁকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘“সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।” কবিগুরু, তুমি এসে দেখে যাও, তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ কী অসাধারণ রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তৃতা। রাষ্ট্রের আশু করণীয় কী হবে তা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত, ইঙ্গিতবহ অথচ তাৎপর্যপূর্ণ নীতি-নির্ধারণী বক্তৃতা দিলেন। লাখ লাখ মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছে এবং পরম পরিতৃপ্ত হয়েছে এই ভেবে যে আজ থেকে আমরা প্রকৃতই স্বাধীন।
তোফায়েল আহমেদ: আওয়ামী লীগ নেতা, সাংসদ, সভাপতি, শিল্প মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
tofailahmed69@gmail.com
মনে পড়ে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ট্রেনিং সমাপ্ত করে শপথ গ্রহণ করতাম এই বলে যে, ‘বঙ্গবন্ধু মুজিব, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ, আমরা জানি না। কিন্তু যতক্ষণ তোমার স্বপ্নের বাংলাদেশকে আমরা হানাদারমুক্ত করতে না পারব, ততক্ষণ আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’ যেদিন বঙ্গবন্ধুর মুক্তির সংবাদ জানলাম, সেদিন যে কী আনন্দ, ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না! সমগ্র দেশ অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে কখন প্রিয় নেতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করবেন। যেদিন মাহেন্দ্রক্ষণটি এল, সেদিন ছিল সোমবার। সকাল থেকেই লাখ লাখ মানুষ ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে দশ দিক মুখরিত করে মিছিল নিয়ে বিমানবন্দর অভিমুখে যাচ্ছে। কোটি কোটি হূদয় রুদ্ধবাক মুহূর্ত গুনছে, প্রতি নিঃশ্বাসে অধীর আগ্রহে কালক্ষেপণ করছে—কখন, কখন আসবেন প্রিয় নেতা? কী দিয়ে তারা বরণ করে নেবে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে, বাঙালির হূদয়ের শ্রেষ্ঠ গর্বকে।
ঢাকায় যখন আমরা নেতার আগমন-প্রতীক্ষায়, তখন সকালে দিল্লির জনসাধারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে এক অভূতপূর্ব রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ সরকারের উচ্চপদস্থ নেতারা। ব্রিটেনের রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট জেটটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অবতরণ করলে তাঁর সম্মানে ২১ বার তোপধ্বনি করা হয়। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলেন, ‘আপনার জন্য আমি গর্বিত। ভারত ও বাংলাদেশের মানুষ আপনার জন্য গর্ব অনুভব করে। শেখ মুজিবকে আমাদের মধ্যে পেয়ে ভারতের জনগণ আজ আনন্দে আত্মহারা। শেখ মুজিব তাঁর জনগণকে নতুন জীবন দান করেছেন। তাঁর স্বাধীনতার স্বপ্ন আজ সার্থক। শারীরিকভাবে তিনি বন্দী ছিলেন; কিন্তু তাঁর স্বপ্ন ও সাধকে বাস্তবায়ন করতে বাংলার জনগণ তাঁরই অনুপ্রেরণায় স্বাধীনতার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।’ সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতিকালে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে ভারতবাসীর উদ্দেশে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বলেন, ‘আমার জন্য এটা পরম সন্তোষের মুহূর্ত। বাংলাদেশে যাবার পথে আমি আপনাদের মহতী দেশের ঐতিহাসিক রাজধানীতে যাত্রাবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ কারণে যে, আমাদের জনগণের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারতের জনগণ এবং আপনাদের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, যিনি কেবল মানুষের নন, মানবতারও নেতা। তাঁর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের কাছে এর মাধ্যমে আমি আমার ন্যূনতম ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারব।...অবশেষে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের, অপ্রকৃতিস্থতার বিরুদ্ধে প্রকৃতিস্থতার, ভীরুতার বিরুদ্ধে সাহসিকতার, অবিচারের বিরুদ্ধে সুবিচারের এবং অশুভর বিরুদ্ধে শুভর বিজয় হয়েছে।’
এরপর অবসান ঘটে আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার। দিল্লি থেকে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটেনের রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট বিমানটি ঢাকার আকাশসীমায় দেখা দিতেই জনসমুদ্র উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। বেলা একটা ৫১ মিনিটে বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণ করে। বিমানে সিঁড়ি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্য নেতারা, কেন্দ্রীয় স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারা এবং আমরা মুজিব বাহিনীর চার প্রধান ছুটে যাই নেতাকে অভ্যর্থনা জানাতে। আমার হাতে ছিল পুষ্পমাল্য। জাতির জনককে মাল্যভূষিত করার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সংযমের সব বাঁধ ভেঙে যায়, তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। সে এক অবিস্মরণীয় ক্ষণ, অভূতপূর্ব মুহূর্ত! বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু জনতার মহাসমুদ্রের উদ্দেশে হাত নাড়েন। তাঁর চোখে তখন স্বজন হারানোর বেদনা-ভারাক্রান্ত অশ্রুর নদী; আর জ্যোতির্ময় দ্যুতি ছড়ানো মুখাবয়বজুড়ে বিজয়ী বীরের পরিতৃপ্তির হাসি। বঙ্গবন্ধুর অভিব্যক্তির এরূপ প্রকাশ যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলা মায়ের প্রতিফলিত বিশুদ্ধ প্রতিচ্ছবির এক হিরণ্ময় প্রকাশ। বিমানের সিঁড়ি বেয়ে জাতির জনক তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার তোপধ্বনি করে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি সম্মান জানানো হয়।
এরপর রেসকোর্স ময়দানে যাওয়ার জন্য জাতীয় নেতারাসহ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অপেক্ষমাণ ট্রাকে উঠে রওনা দিই। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপিত মঞ্চে উঠে ডায়াসের সামনে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালেন বঙ্গবন্ধু এবং রুমালে চোখ মুছলেন। দীর্ঘ কারাবাসের ক্লান্তিতে মলিন মুখটি তবু সমুজ্জ্বল। উন্নত ললাট, প্রশান্ত বদন, দুই চোখ তখনো অশ্রুসিক্ত, কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ! সে অবস্থায়ই চিরাচরিত ভঙ্গিতে ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে উপস্থিত জনসমুদ্রের উদ্দেশে নিবেদন করলেন তাঁর ঐতিহাসিক বক্তৃতা। হূদয়ের সবটুকু অর্ঘ্য ঢেলে আবেগমথিত ভাষায় বলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ আমি তখন ভাবছি, দীর্ঘ নয় মাস ১৪ দিন নির্জন কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গোনা একজন মানুষ কী করে এ রকম উদ্বেলিত পরিস্থিতিতেও স্থিরপ্রতিজ্ঞ থেকে বলছেন, ‘ভাইয়েরা, তোমাদের একদিন বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। আজকে আমি বলি, আজকে আমাদের উন্নয়নের জন্য আমাদের ঘরে ঘরে কাজ করে যেতে হবে।’ এমন পরিস্থিতিতেও সব কথার মধ্যে তিনি বলেন, ‘সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ।’ এটাও একটি ইঙ্গিতবাহী কথা। বক্তৃতায় তিনি আরও বলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।’ ৩০ লাখ মানুষের আত্মদান স্মরণ করে বেদনা-ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বাংলায় আজ বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ৩০ লাখ লোক মারা গেছে। আপনারাই জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা।’ ভারতবর্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি চিনি। তাঁকে জানাই আমার শ্রদ্ধা। তাঁর রক্তে মিশে রয়েছে রাজনীতি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বের সব রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমার মুক্তির জন্য আবেদন করেছেন। আমার সাথে দিল্লিতে শ্রীমতী গান্ধীর আলাপ হয়েছে। আমি যখনই বলব, ভারতীয় সেনাবাহিনী তখনই দেশে ফেরত যাবে।’
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে বলেন, ‘গত পঁচিশে মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এসব কুকীর্তির বিচার করতে হবে।’
পরিশেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে তাঁকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘“সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।” কবিগুরু, তুমি এসে দেখে যাও, তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ কী অসাধারণ রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তৃতা। রাষ্ট্রের আশু করণীয় কী হবে তা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত, ইঙ্গিতবহ অথচ তাৎপর্যপূর্ণ নীতি-নির্ধারণী বক্তৃতা দিলেন। লাখ লাখ মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছে এবং পরম পরিতৃপ্ত হয়েছে এই ভেবে যে আজ থেকে আমরা প্রকৃতই স্বাধীন।
তোফায়েল আহমেদ: আওয়ামী লীগ নেতা, সাংসদ, সভাপতি, শিল্প মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
tofailahmed69@gmail.com
No comments