শ্রদ্ধাঞ্জলি- বিপ্লবী বিনোদ বিহারী: শতবর্ষের অগ্নিশিখা by ওমর কায়সার
যুদ্ধ, মহামারি, মন্বন্তর, দাঙ্গা, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধসহ হাজারো ঘটনা একজন মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন এক জীবনে। বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে সমান্তরালভাবে বয়ে চলেছে যেন তাঁর জীবন।
তিনি বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। কালের সাক্ষী এই মানুষটি এখনো সমকালীন অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সমানভাবে সক্রিয়। বয়সকে তুচ্ছ করে কারও কাঁধে ভর না দিয়ে এখনো তিনি প্রতিবাদ সমাবেশে হাজির হন মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য। ১০ জানুয়ারি এই শতবর্ষী বিপ্লবীর ১০৩তম জন্মদিন তাই চট্টগ্রামবাসীর জন্য অন্য রকম উদ্যাপনের দিন।
১৯২১ সাল। বিনোদ বিহারী তখন ১১ বছরের এক দুরন্ত কিশোর। তাঁর বাবা আইনজীবী কামিনী কুমার চৌধুরী ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। বাবার সংগ্রামী চেতনা খুব স্বাভাবিকভাবে কিশোর বিনোদ বিহারীর মধ্যে সঞ্চারিত হয়। বাবার মতো বিলেতি কাপড় ছেড়ে খদ্দেরের কাপড় পরতে শুরু করেন তিনি। বাহুল্যবর্জিত অনাড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন বেছে নেন। রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ নিয়ে জনপ্রতিনিধি হলেও কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। বহু প্রলোভন ও হাতছানি উপেক্ষা করেছেন। ছাত্র পড়িয়ে সংসার চালিয়েছেন। প্রায় এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে একরকম সন্তসুলভ জীবনযাপন করছেন তিনি।
১৯১১ থেকে ২০১৩ সাল—এই ১০২ বছরে গ্রহজুড়ে, বাঙালির জনজীবনে ঘটে গেল কত উত্থান-পতন। কত যুগের অবসান আর উন্মেষ ঘটল। ইতিহাসের এই বিচিত্র ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি হয়ে গেছেন ইতিহাসেরই অংশ। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিনোদ বিহারীসহ তরুণ বিপ্লবীরা সর্বপ্রথম ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। চট্টগ্রামকে একপর্যায়ে মুক্তাঞ্চলও ঘোষণা করেছিলেন তাঁরা। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, ব্রিটিশ সেনাদের সঙ্গে জালালাবাদ পাহাড়ে যুদ্ধসহ অসংখ্য অগ্নিগর্ভ মুহূর্তের সাক্ষী বিনোদ বিহারী।
চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়ে ঐতিহাসিক সম্মুখযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বিনোদ বিহারী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘হঠাৎ একটা গুলি আমার গলার বাঁ দিকে ঢুকে ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। ঘণ্টা খানেক অচেতন ছিলাম। লোকনাথ দা, শান্তি নাগ, বনহরি দত্তের ডাকে সংবিৎ ফিরে পেলাম। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম সৈন্যসামন্ত নেই। গলায় তখন অসহ্য যন্ত্রণা। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে। বিপ্লবীরা লেঙ্গুট ছিঁড়ে আমার গলায় ব্যান্ডেজ করে দিলেন। আমাদের এক ক্লাসফ্রেন্ড রজত সেন। সে বলল, “তোর কষ্ট হচ্ছে খুব, না? তোকে তাহলে গুলি করে মেরে দিই?” তখন শুনছি রজতকে উদ্দেশ করে লোকদা (বিপ্লবী লোকনাথ বল) বলছেন—“না, ও বাঁচবে। ওকে গুলি করতে হবে না। ওকে আমরা নিয়ে যাব”।’ এভাবে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে বহুবার প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি।
জালালাবাদ পাহাড়ের সম্মুখযুদ্ধে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেও দমে যাননি তিনি। বেশ কিছুদিন গোপনে চিকিৎসা চালিয়ে সুস্থ হন। এরপর তিন বছর আত্মগোপনে ছিলেন। এ সময় তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার ৫০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। পরে ধরাও পড়েছেন। কারাবরণ করতে হয়েছে তাঁকে তিন-তিনবার। কিন্তু যে মানুষ একবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন, তিনি আর কিছুকে ভয় করেননি। মানুষের মুক্তির দাবিকে নিজের জীবনেরও ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন বারবার। এ দেশের মানুষের কাছে তাই তিনি আজ জীবন্ত কিংবদন্তি।
এই দীর্ঘ জীবনে ব্যক্তিগত দুঃখ-দুর্দশা ও নানা ঝড়ঝাপটা পার করেছেন তিনি। তবু দেশের জন্য ভাবনা এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়েননি। গত শুক্রবার ৪ জানুয়ারি মোমিন রোডের বাসভবনে গেলে তিনি ব্যথাতুর কণ্ঠে বললেন, ‘অক্টোবরের ২৪ তারিখে আমার বুকটা ভেঙে গেছে। আমার ছেলে বিবেকানন্দ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।’ দীর্ঘদিন দুরারোগ্য ক্যানসার রোগে ভুগে মারা যান বিনোদ বিহারীর ছেলে বিবেকানন্দ। তবু পুত্রশোকে কাতর বিপ্লবী স্বদেশের সমসাময়িক ঘটনার খোঁজখবর নিতে ভোলেননি। রামুর সহিংস ঘটনার পর প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন। সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বললেন, ‘রামুতে মানুষের ঘর পুড়িয়ে, ভগবান বুদ্ধের মূর্তি ভেঙে কার লাভ হলো? যারা এসব কাণ্ড করেছে তারা কি মানুষ? শুধু দুইটা পা থাকলে তো আর মানুষ হয় না। দেশটা কি অমানুষে ভরে গেছে? মানুষ হতে হলে থাকতে হবে হূদয়, যা অপরকে ভালোবাসতে সাহায্য করবে; থাকতে হবে হাতের মতো হাত, যা দিয়ে অপরের জন্য কাজ করা যাবে। যারা রামুতে মানবতাবিরোধী এমন ঘটনা ঘটাল তাদের এসব কিছু ছিল বলে মনে হলো না। সবকিছু যেন এলোমেলো করে দিতে তৎপর হয়েছে কোনো শক্তি, কেউ কারও কথা শুনতে চাইছে না।’
মৃত্যুর কথা ভাবেন না এই শতবর্ষী বিপ্লবী। বরং যত দিন বাঁচবেন তত দিন মানুষের কাজে লাগবেন, তাদের সঙ্গে থাকবেন, এই তাঁর শেষ ইচ্ছে। বললেন, ‘যুদ্ধ করে করে মরে মরে দেশকে রক্ষা করার শিক্ষা নিয়েছি আমি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা আমি ছাড়তে পারব না। ভালোবাসা ছাড়া দেশ এগিয়ে যেতে পারে না। দেশকে ভালোবাসতে শিখতে হবে।’
ওমর কায়সার: সাংবাদিক।
১৯২১ সাল। বিনোদ বিহারী তখন ১১ বছরের এক দুরন্ত কিশোর। তাঁর বাবা আইনজীবী কামিনী কুমার চৌধুরী ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। বাবার সংগ্রামী চেতনা খুব স্বাভাবিকভাবে কিশোর বিনোদ বিহারীর মধ্যে সঞ্চারিত হয়। বাবার মতো বিলেতি কাপড় ছেড়ে খদ্দেরের কাপড় পরতে শুরু করেন তিনি। বাহুল্যবর্জিত অনাড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন বেছে নেন। রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ নিয়ে জনপ্রতিনিধি হলেও কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। বহু প্রলোভন ও হাতছানি উপেক্ষা করেছেন। ছাত্র পড়িয়ে সংসার চালিয়েছেন। প্রায় এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে একরকম সন্তসুলভ জীবনযাপন করছেন তিনি।
১৯১১ থেকে ২০১৩ সাল—এই ১০২ বছরে গ্রহজুড়ে, বাঙালির জনজীবনে ঘটে গেল কত উত্থান-পতন। কত যুগের অবসান আর উন্মেষ ঘটল। ইতিহাসের এই বিচিত্র ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি হয়ে গেছেন ইতিহাসেরই অংশ। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিনোদ বিহারীসহ তরুণ বিপ্লবীরা সর্বপ্রথম ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। চট্টগ্রামকে একপর্যায়ে মুক্তাঞ্চলও ঘোষণা করেছিলেন তাঁরা। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, ব্রিটিশ সেনাদের সঙ্গে জালালাবাদ পাহাড়ে যুদ্ধসহ অসংখ্য অগ্নিগর্ভ মুহূর্তের সাক্ষী বিনোদ বিহারী।
চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়ে ঐতিহাসিক সম্মুখযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বিনোদ বিহারী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘হঠাৎ একটা গুলি আমার গলার বাঁ দিকে ঢুকে ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। ঘণ্টা খানেক অচেতন ছিলাম। লোকনাথ দা, শান্তি নাগ, বনহরি দত্তের ডাকে সংবিৎ ফিরে পেলাম। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম সৈন্যসামন্ত নেই। গলায় তখন অসহ্য যন্ত্রণা। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে। বিপ্লবীরা লেঙ্গুট ছিঁড়ে আমার গলায় ব্যান্ডেজ করে দিলেন। আমাদের এক ক্লাসফ্রেন্ড রজত সেন। সে বলল, “তোর কষ্ট হচ্ছে খুব, না? তোকে তাহলে গুলি করে মেরে দিই?” তখন শুনছি রজতকে উদ্দেশ করে লোকদা (বিপ্লবী লোকনাথ বল) বলছেন—“না, ও বাঁচবে। ওকে গুলি করতে হবে না। ওকে আমরা নিয়ে যাব”।’ এভাবে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে বহুবার প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি।
জালালাবাদ পাহাড়ের সম্মুখযুদ্ধে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেও দমে যাননি তিনি। বেশ কিছুদিন গোপনে চিকিৎসা চালিয়ে সুস্থ হন। এরপর তিন বছর আত্মগোপনে ছিলেন। এ সময় তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার ৫০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। পরে ধরাও পড়েছেন। কারাবরণ করতে হয়েছে তাঁকে তিন-তিনবার। কিন্তু যে মানুষ একবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন, তিনি আর কিছুকে ভয় করেননি। মানুষের মুক্তির দাবিকে নিজের জীবনেরও ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন বারবার। এ দেশের মানুষের কাছে তাই তিনি আজ জীবন্ত কিংবদন্তি।
এই দীর্ঘ জীবনে ব্যক্তিগত দুঃখ-দুর্দশা ও নানা ঝড়ঝাপটা পার করেছেন তিনি। তবু দেশের জন্য ভাবনা এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়েননি। গত শুক্রবার ৪ জানুয়ারি মোমিন রোডের বাসভবনে গেলে তিনি ব্যথাতুর কণ্ঠে বললেন, ‘অক্টোবরের ২৪ তারিখে আমার বুকটা ভেঙে গেছে। আমার ছেলে বিবেকানন্দ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।’ দীর্ঘদিন দুরারোগ্য ক্যানসার রোগে ভুগে মারা যান বিনোদ বিহারীর ছেলে বিবেকানন্দ। তবু পুত্রশোকে কাতর বিপ্লবী স্বদেশের সমসাময়িক ঘটনার খোঁজখবর নিতে ভোলেননি। রামুর সহিংস ঘটনার পর প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন। সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বললেন, ‘রামুতে মানুষের ঘর পুড়িয়ে, ভগবান বুদ্ধের মূর্তি ভেঙে কার লাভ হলো? যারা এসব কাণ্ড করেছে তারা কি মানুষ? শুধু দুইটা পা থাকলে তো আর মানুষ হয় না। দেশটা কি অমানুষে ভরে গেছে? মানুষ হতে হলে থাকতে হবে হূদয়, যা অপরকে ভালোবাসতে সাহায্য করবে; থাকতে হবে হাতের মতো হাত, যা দিয়ে অপরের জন্য কাজ করা যাবে। যারা রামুতে মানবতাবিরোধী এমন ঘটনা ঘটাল তাদের এসব কিছু ছিল বলে মনে হলো না। সবকিছু যেন এলোমেলো করে দিতে তৎপর হয়েছে কোনো শক্তি, কেউ কারও কথা শুনতে চাইছে না।’
মৃত্যুর কথা ভাবেন না এই শতবর্ষী বিপ্লবী। বরং যত দিন বাঁচবেন তত দিন মানুষের কাজে লাগবেন, তাদের সঙ্গে থাকবেন, এই তাঁর শেষ ইচ্ছে। বললেন, ‘যুদ্ধ করে করে মরে মরে দেশকে রক্ষা করার শিক্ষা নিয়েছি আমি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা আমি ছাড়তে পারব না। ভালোবাসা ছাড়া দেশ এগিয়ে যেতে পারে না। দেশকে ভালোবাসতে শিখতে হবে।’
ওমর কায়সার: সাংবাদিক।
No comments