হয় এখন, অথবা আর নয় by মহসীন হাবিব
টেলিভিশন টক-শোতে দেশের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে আসেন ভারী পদবিধারী কিছু মানুষ। আসেন রাজনীতিবিদ, আইনবিদ, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীসহ সব পেশায় নিয়োজিত মানুষ।
নিশ্চয়ই তাঁরা যাঁর যাঁর ক্ষেত্রে সফল এবং যাঁর যাঁর নিজস্ব বিষয়টির ওপর তাঁদের জানাশোনার পরিধি অন্তত সাধারণ মানুষের চেয়ে ঢের বেশি। তবে সমস্যা হলো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, টেলিভিশনের হোস্টরা রাজনীতিবিদের কাছে প্রকৌশল বিষয়ে এবং চিকিৎসকের কাছে রাজনীতি বিষয়ে প্রশ্ন তুলে ধরছেন। টক-শোতে অংশগ্রহণকারী অতিথি জানেন, অবিরাম বলে যেতে হবে, না হলে কেউ জ্ঞানের স্বল্পতার কথা ভাবতে পারে অথবা টেলিভিশনগুলো অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণের আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। তাই সমস্যা চিহ্নিত করতে গিয়ে কেউ কেউ উঁচুস্বরে অবিরাম কথা বলছেন, হাস্যকর সমাধান তুলে ধরছেন জাতির সামনে। সেই সঙ্গে বিব্রত (কনফিউজ) করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকদের (এ ত্রুটি শুধু টেলিভিশনের টক-শোর নয়, দেশের অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়। বহু আগে থেকে আমরা দেখে আসছি, মন্ত্রিপরিষদ গঠনের সময় চিকিৎসক হন শিক্ষামন্ত্রী, প্রকৌশলী হন সংস্কৃতিমন্ত্রী। অর্থাৎ কামারকে দিয়ে হাঁড়ি-পাতিল তৈরি আর পালকে দিয়ে দা-কুড়াল বানানোর সিদ্ধান্ত আর কি। এর মাজেজা আজও বোঝা গেল না। তবে শোনা যায়, সব সরকারের সময়ই এসব মন্ত্রণালয় বণ্টন নাকি দেন-দরবারের ওপর হয়ে থাকে। সেটা ভিন্ন আলোচনা।)।
প্রায়ই লক্ষ করা যাচ্ছে, দেশের জনসংখ্যা একটি সমস্যা কি না, তা নিয়ে আলোচনা করতে টেলিভিশনে আসছেন আইনে লেখাপড়া করা অথবা প্রকৌশলী ধরনের অতিথি-ভাষ্যকার। তাঁরা উঁচুস্বরে ঘোষণা করছেন, 'দেশের জনসংখ্যা কোনো সমস্যা নয়। এ জনসংখ্যাকে কর্মের হাতে পরিণত করতে হবে, কর্মশক্তিতে পরিণত করতে হবে।'
কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ জানি, এমন উক্তি যাঁরা করছেন তাঁরা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন। জনসংখ্যার চাপ না থাকা সত্ত্বেও খোদ অত বড় শক্তিশালী অর্থকড়ির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারেনি তার জনসংখ্যাকে কর্মশক্তিতে রূপান্তর করতে। প্রায় ৫০ লাখ কর্মক্ষম মানুুষ যুক্তরাষ্ট্রে বেকার। এ হিসাব শুধু নথিপত্রের। প্রকৃত সংখ্যা আরো অধিক বলে অনেক বিশেষজ্ঞদের মত। জনসংখ্যা ভারী না হওয়া সত্ত্বেও ইউরোপের ধনী দেশগুলোকে অদক্ষ, এমনকি দক্ষ নাগরিকদের কাজ দিতে না পারার কারণে একটি বিরাট অঙ্কের সোশ্যাল মানি গুনতে হচ্ছে। আর জনসংখ্যা বিস্ফোরিত এ দেশে আমাদের কিছু টেলিভিশনের মুখ বুঝে বা না বুঝে বলে দিচ্ছে কর্মশক্তিতে রূপান্তরের কথা! এ বক্তারা কাটমোল্লাদের সঙ্গে সমানতালে দেশের ক্ষতি করছেন বলে মনে করার কারণ আছে।
একটি দেশ কতটা জনসংখ্যার ভার বইতে পারে? বিশাল যুক্তরাষ্ট্রের অথবা ইউরোপের কৃষি অঞ্চলে গেলে মানুষ চোখে পড়ে না। দেখা যায়, একটি বা দুটি ট্রাক্টর বিস্তীর্ণ মাঠ চষে বেড়াচ্ছে। সে কৃষি ক্ষেতগুলোর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে গাছগাছালিকে দূরের কোনো ছবি মনে হয়। অথচ সে দেশেরই বিখ্যাত ফিজিসিস্ট হেনরি ডাবি্লউ কেনডাল আজ থেকে আরো ১৫ বছর আগে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, 'আমরা যদি আর এক বা দুই দশকের ভেতরে জনসংখ্যা কমিয়ে আনতে না পারি, তাহলে প্রকৃতি এমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠবে যে আমাদের কিছু করার থাকবে না। অথচ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশের চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত মানুষের পদভারে ভারী হয়ে উঠেছে। দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কৃষিজমি। প্রাকৃতিক মাছ ইতিমধ্যেই প্রায় উধাও হয়ে গেছে। ছোট ভূমির এ দেশে প্রাকৃতিক ফলফলাদির স্থান দ্রুত দখল করে নিচ্ছে বাণিজ্যিক উৎপাদন। অথচ কেউ কেউ ভয়ানক এক মরণঘাতী স্লোগান তুলতে চাচ্ছেন_জনসংখ্যা কোনো সমস্যা নয়! একি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও প্রকৃতিকে ধ্বংস করার মতো উপদেশ নয়?
চেয়ে দেখুন ঢাকা শহরের দিকে। অসংখ্য বস্তির দিকে তাকালে দেখা যায়, শুধু শীর্ণ পা আর পা। অসংখ্য শিশু পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কে জোগাবে দরিদ্র রাষ্ট্রের এত বড় একটি পেটের খাবার? বিশ্ব পরিস্থিতি যেকোনো সময় এমন হতে পারে যে এক বা দুই বছর টাকা দিয়েও খাবার কেনা সম্ভব হবে না। আইলার পরপর আমাদের কিছুটা হলেও অভিজ্ঞতা হয়েছে। কোন দল এখন দেশ চালাচ্ছে সেটা বিবেচনা নাইবা করলাম; সরকার এ বছর এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার অধিক কৃষিঋণের ব্যবস্থা করেছে, ২৩ কোটি বিনা মূল্যের বই ছাপাতে হয়েছে শিক্ষা খাতের জন্য। সর্বক্ষেত্রে সরকারকে এমন মোটা অঙ্কের ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। কোথায়, কিভাবে সরকার এই অগণিত মানুষের কর্মসংস্থান করবে? হাইপোথেটিক কথা নয়, বাস্তবসম্মত কোনো পথ কারো জানা থাকলে উঁচুস্বরে সরকারকে বাতলে দিক।
অর্থনৈতিক কারণে নয়, শুধু জনসংখ্যার কারণে মানুষের মানবিক গুণাবলি নষ্ট হয়ে গেছে। মাত্র ২০ বছর আগে দেশের গ্রামাঞ্চলে কোনো অপরিচিত বাড়িতে ঢুকে এক গ্লাস পানি খেতে চাইলে যত দরিদ্রই হোক খালি পানি সামনে দিত না। ঘরে কিছু না থাকলে একটুখানি গুড় বিনয়ের সঙ্গে সামনে এনে ধরত বাড়ির কেউ। এটি ছিল সংস্কার। এখন শুধু পানিও পাওয়া যায় না। আবার পথিকও নিরাপদ পানি কি না সেই ভয়ে কারো বাড়িতে পানি পান করতে চায় না। এসবের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক মুখ্য ছিল না। বরং তখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এখনকার চেয়ে কম ছিল। এ পরিবর্তনের একমাত্র কারণ, এই মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা মানুষের প্রতি মানুষের বোধকে কমিয়ে দিয়েছে।
জনসংখ্যার ভারে অগণিত মানুষ দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে পড়েছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষ যে যেখানে কর্মসংস্থানের কথা শুনছে, সেদিকে ছুটছে। ফলে ভারতীয় নিষিদ্ধ পল্লী, পাকিস্তানের নিষিদ্ধ পল্লী বাংলাদেশের হতভাগ্য মেয়ে দিয়ে ছেয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের তথাকথিত নাইট ক্লাবে অভিশপ্ত রাত কাটাচ্ছে আমাদের মেয়েরা। ভাষ্যকাররা কি একেই কর্মশক্তি বলতে চান?
দেশের খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠীর ভেতর এক শ্রেণীর গোঁড়া মানসিকতার লোক ছড়িয়ে দিয়েছে, 'মুখ দিয়াছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি।' এ ধারণা এমনকি হাদিস-কোরআনবিরোধী। দেশের সম্মানিত মানুষদের কাছে অনুরোধ, গোঁড়াদের মতো গায়ের জোরে কথা না বলে আসন্ন জনসংখ্যাজনিত বিপর্যয় থেকে কী করে দেশ রক্ষা পাবে সে পথ নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা করুন।
সরকারকে কিছু বিষয়ের দিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে। দেশে পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি-বেসরকারি বহু প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পের অনেক সফলতার কথা খাতা-কলমেও আছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র কী? লক্ষ করলেই দেখা যাবে, এত সেবামূলক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থাকতেও চড়া দামে দেশের সাধারণ মানুষকে জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণ দোকান থেকে কিনে নিতে হয়। অত্যন্ত নিম্নমানের কিছু পিল-জাতীয় ওষুধ গ্রামেগঞ্জে বিনা পয়সায় বিতরণ করা হয়, যা খেলে নারীদের মাথা ঘোরে। পুরুষদের কিছু নিম্নমানের উপকরণ বিতরণ করা হয়, যেগুলোর প্রতি তাদের আগ্রহ নেই, কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণ তাঁরা চান। কেন দেশের বিভিন্ন এলাকায় ওভাস্ট্যাটের মতো কনট্রাসেপটিভ বিতরণ করা হয় না? তাহলে কোথায় যায় জন্মনিয়ন্ত্রণের অর্থ? কোথায় সঠিক ব্যবস্থাপনা, কোথায় বাস্তব সাফল্য?
পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে সরকারের প্রকল্প চালু আছে। সে প্রকল্পগুলোতে নতুন অর্থ বরাদ্দ হলেও নতুন উদ্যম নেই। যেমন_মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০ বছর আগে যে গানটি বাঁধা হয়েছিল, একইভাবে তা এখনো বেজে চলছে।
সরকারকে এ বিষয়টির প্রতি অবশ্যই কঠোর নজর দিতে হবে। ভোটের দিকে তাকালে চলবে না, এখন বাংলাদেশের কল্যাণ চাইলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে চীনের গৃহীত উদ্যোগগুলোকে অনুসরণ করতে হবে। কেউ হয়তো যুক্তি দিতে পারেন, চীন এখন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বয়স্কদের ভারে নুয়ে পড়ছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, চীনের এ সমস্যা সাময়িক। একটি দেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ১০ বা ২০ বছর মাথায় রেখে করলে চলে না। আমাদের ফকির লালনের বাণী অনুসারে দেশভেদে বিচার শিখতে হবে। বিশ্বের বেশ কিছু দেশ জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য জনগণকে উৎসাহী করে থাকে। তাদের উদাহরণ বাংলাদেশ গ্রহণ করলে চলবে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ে ভারতবর্ষে জনসংখ্যা ছিল ৩০ কোটি এবং বাংলায় (পূর্ব বাংলা-পশ্চিম বাংলা মিলে) ছিল সাড়ে পাঁচ কোটি। এই সেদিন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশে ছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষ। এখন হিসাব মতে, ১৬ কোটি ৪৪ লাখ মানুষ। আমরা এখন ডু অর ডাই পর্যায়ে অবস্থান করছি। এখনই এ সমস্যার মোকাবিলা না করা হলে শুধু অথনৈতিক নয়, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে দেশ এক কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়বে।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com
প্রায়ই লক্ষ করা যাচ্ছে, দেশের জনসংখ্যা একটি সমস্যা কি না, তা নিয়ে আলোচনা করতে টেলিভিশনে আসছেন আইনে লেখাপড়া করা অথবা প্রকৌশলী ধরনের অতিথি-ভাষ্যকার। তাঁরা উঁচুস্বরে ঘোষণা করছেন, 'দেশের জনসংখ্যা কোনো সমস্যা নয়। এ জনসংখ্যাকে কর্মের হাতে পরিণত করতে হবে, কর্মশক্তিতে পরিণত করতে হবে।'
কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ জানি, এমন উক্তি যাঁরা করছেন তাঁরা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন। জনসংখ্যার চাপ না থাকা সত্ত্বেও খোদ অত বড় শক্তিশালী অর্থকড়ির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারেনি তার জনসংখ্যাকে কর্মশক্তিতে রূপান্তর করতে। প্রায় ৫০ লাখ কর্মক্ষম মানুুষ যুক্তরাষ্ট্রে বেকার। এ হিসাব শুধু নথিপত্রের। প্রকৃত সংখ্যা আরো অধিক বলে অনেক বিশেষজ্ঞদের মত। জনসংখ্যা ভারী না হওয়া সত্ত্বেও ইউরোপের ধনী দেশগুলোকে অদক্ষ, এমনকি দক্ষ নাগরিকদের কাজ দিতে না পারার কারণে একটি বিরাট অঙ্কের সোশ্যাল মানি গুনতে হচ্ছে। আর জনসংখ্যা বিস্ফোরিত এ দেশে আমাদের কিছু টেলিভিশনের মুখ বুঝে বা না বুঝে বলে দিচ্ছে কর্মশক্তিতে রূপান্তরের কথা! এ বক্তারা কাটমোল্লাদের সঙ্গে সমানতালে দেশের ক্ষতি করছেন বলে মনে করার কারণ আছে।
একটি দেশ কতটা জনসংখ্যার ভার বইতে পারে? বিশাল যুক্তরাষ্ট্রের অথবা ইউরোপের কৃষি অঞ্চলে গেলে মানুষ চোখে পড়ে না। দেখা যায়, একটি বা দুটি ট্রাক্টর বিস্তীর্ণ মাঠ চষে বেড়াচ্ছে। সে কৃষি ক্ষেতগুলোর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে গাছগাছালিকে দূরের কোনো ছবি মনে হয়। অথচ সে দেশেরই বিখ্যাত ফিজিসিস্ট হেনরি ডাবি্লউ কেনডাল আজ থেকে আরো ১৫ বছর আগে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, 'আমরা যদি আর এক বা দুই দশকের ভেতরে জনসংখ্যা কমিয়ে আনতে না পারি, তাহলে প্রকৃতি এমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠবে যে আমাদের কিছু করার থাকবে না। অথচ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশের চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত মানুষের পদভারে ভারী হয়ে উঠেছে। দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কৃষিজমি। প্রাকৃতিক মাছ ইতিমধ্যেই প্রায় উধাও হয়ে গেছে। ছোট ভূমির এ দেশে প্রাকৃতিক ফলফলাদির স্থান দ্রুত দখল করে নিচ্ছে বাণিজ্যিক উৎপাদন। অথচ কেউ কেউ ভয়ানক এক মরণঘাতী স্লোগান তুলতে চাচ্ছেন_জনসংখ্যা কোনো সমস্যা নয়! একি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও প্রকৃতিকে ধ্বংস করার মতো উপদেশ নয়?
চেয়ে দেখুন ঢাকা শহরের দিকে। অসংখ্য বস্তির দিকে তাকালে দেখা যায়, শুধু শীর্ণ পা আর পা। অসংখ্য শিশু পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কে জোগাবে দরিদ্র রাষ্ট্রের এত বড় একটি পেটের খাবার? বিশ্ব পরিস্থিতি যেকোনো সময় এমন হতে পারে যে এক বা দুই বছর টাকা দিয়েও খাবার কেনা সম্ভব হবে না। আইলার পরপর আমাদের কিছুটা হলেও অভিজ্ঞতা হয়েছে। কোন দল এখন দেশ চালাচ্ছে সেটা বিবেচনা নাইবা করলাম; সরকার এ বছর এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার অধিক কৃষিঋণের ব্যবস্থা করেছে, ২৩ কোটি বিনা মূল্যের বই ছাপাতে হয়েছে শিক্ষা খাতের জন্য। সর্বক্ষেত্রে সরকারকে এমন মোটা অঙ্কের ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। কোথায়, কিভাবে সরকার এই অগণিত মানুষের কর্মসংস্থান করবে? হাইপোথেটিক কথা নয়, বাস্তবসম্মত কোনো পথ কারো জানা থাকলে উঁচুস্বরে সরকারকে বাতলে দিক।
অর্থনৈতিক কারণে নয়, শুধু জনসংখ্যার কারণে মানুষের মানবিক গুণাবলি নষ্ট হয়ে গেছে। মাত্র ২০ বছর আগে দেশের গ্রামাঞ্চলে কোনো অপরিচিত বাড়িতে ঢুকে এক গ্লাস পানি খেতে চাইলে যত দরিদ্রই হোক খালি পানি সামনে দিত না। ঘরে কিছু না থাকলে একটুখানি গুড় বিনয়ের সঙ্গে সামনে এনে ধরত বাড়ির কেউ। এটি ছিল সংস্কার। এখন শুধু পানিও পাওয়া যায় না। আবার পথিকও নিরাপদ পানি কি না সেই ভয়ে কারো বাড়িতে পানি পান করতে চায় না। এসবের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক মুখ্য ছিল না। বরং তখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এখনকার চেয়ে কম ছিল। এ পরিবর্তনের একমাত্র কারণ, এই মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা মানুষের প্রতি মানুষের বোধকে কমিয়ে দিয়েছে।
জনসংখ্যার ভারে অগণিত মানুষ দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে পড়েছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষ যে যেখানে কর্মসংস্থানের কথা শুনছে, সেদিকে ছুটছে। ফলে ভারতীয় নিষিদ্ধ পল্লী, পাকিস্তানের নিষিদ্ধ পল্লী বাংলাদেশের হতভাগ্য মেয়ে দিয়ে ছেয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের তথাকথিত নাইট ক্লাবে অভিশপ্ত রাত কাটাচ্ছে আমাদের মেয়েরা। ভাষ্যকাররা কি একেই কর্মশক্তি বলতে চান?
দেশের খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠীর ভেতর এক শ্রেণীর গোঁড়া মানসিকতার লোক ছড়িয়ে দিয়েছে, 'মুখ দিয়াছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি।' এ ধারণা এমনকি হাদিস-কোরআনবিরোধী। দেশের সম্মানিত মানুষদের কাছে অনুরোধ, গোঁড়াদের মতো গায়ের জোরে কথা না বলে আসন্ন জনসংখ্যাজনিত বিপর্যয় থেকে কী করে দেশ রক্ষা পাবে সে পথ নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা করুন।
সরকারকে কিছু বিষয়ের দিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে। দেশে পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি-বেসরকারি বহু প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পের অনেক সফলতার কথা খাতা-কলমেও আছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র কী? লক্ষ করলেই দেখা যাবে, এত সেবামূলক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থাকতেও চড়া দামে দেশের সাধারণ মানুষকে জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণ দোকান থেকে কিনে নিতে হয়। অত্যন্ত নিম্নমানের কিছু পিল-জাতীয় ওষুধ গ্রামেগঞ্জে বিনা পয়সায় বিতরণ করা হয়, যা খেলে নারীদের মাথা ঘোরে। পুরুষদের কিছু নিম্নমানের উপকরণ বিতরণ করা হয়, যেগুলোর প্রতি তাদের আগ্রহ নেই, কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণ তাঁরা চান। কেন দেশের বিভিন্ন এলাকায় ওভাস্ট্যাটের মতো কনট্রাসেপটিভ বিতরণ করা হয় না? তাহলে কোথায় যায় জন্মনিয়ন্ত্রণের অর্থ? কোথায় সঠিক ব্যবস্থাপনা, কোথায় বাস্তব সাফল্য?
পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে সরকারের প্রকল্প চালু আছে। সে প্রকল্পগুলোতে নতুন অর্থ বরাদ্দ হলেও নতুন উদ্যম নেই। যেমন_মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০ বছর আগে যে গানটি বাঁধা হয়েছিল, একইভাবে তা এখনো বেজে চলছে।
সরকারকে এ বিষয়টির প্রতি অবশ্যই কঠোর নজর দিতে হবে। ভোটের দিকে তাকালে চলবে না, এখন বাংলাদেশের কল্যাণ চাইলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে চীনের গৃহীত উদ্যোগগুলোকে অনুসরণ করতে হবে। কেউ হয়তো যুক্তি দিতে পারেন, চীন এখন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বয়স্কদের ভারে নুয়ে পড়ছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, চীনের এ সমস্যা সাময়িক। একটি দেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ১০ বা ২০ বছর মাথায় রেখে করলে চলে না। আমাদের ফকির লালনের বাণী অনুসারে দেশভেদে বিচার শিখতে হবে। বিশ্বের বেশ কিছু দেশ জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য জনগণকে উৎসাহী করে থাকে। তাদের উদাহরণ বাংলাদেশ গ্রহণ করলে চলবে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ে ভারতবর্ষে জনসংখ্যা ছিল ৩০ কোটি এবং বাংলায় (পূর্ব বাংলা-পশ্চিম বাংলা মিলে) ছিল সাড়ে পাঁচ কোটি। এই সেদিন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশে ছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষ। এখন হিসাব মতে, ১৬ কোটি ৪৪ লাখ মানুষ। আমরা এখন ডু অর ডাই পর্যায়ে অবস্থান করছি। এখনই এ সমস্যার মোকাবিলা না করা হলে শুধু অথনৈতিক নয়, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে দেশ এক কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়বে।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com
No comments