গণমাধ্যম- সংখ্যার সঙ্গে বেড়ে চলেছে আস্থাও by গোলাম রহমান
চার দশকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মূল্যায়ন করতে গেলে সংখ্যাগত পরিবর্তন অবশ্যই বিবেচনায় থাকবে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি করে সামনে আসবে দায়িত্বশীলতা ও আস্থার বিষয়টি।
সমাজের নানা অংশ এবং এমনকি প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেও ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন জবাবদিহিতার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আমাদের জাতীয় সংসদ রাজনীতি-অর্থনীতির আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারছে না। বিরোধী কণ্ঠ সংসদে শোনা যায় কালেভদ্রে। এ অবস্থায় সংবাদপত্র এবং বেতার ও টেলিভিশন বহুত্ববাদের ধারণা জনগণের কাছে তুলে ধরার দায়িত্ব পালন করে
প্রশংসিত হচ্ছে
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পটভূমি সৃষ্টিতে সংবাদপত্র অনন্য ভূমিকা রেখেছে, এটা সর্বজনস্বীকৃত। পঞ্চাশের দশকে ভাষা আন্দোলনে সংবাদপত্র জনমত সংগঠিত ও প্রভাবিত করেছে। এমনকি শাসক দল মুসলিম লীগের সমর্থক পত্রিকাও নিজেকে উপস্থাপন করেছে আন্দোলনকারী জনগণের পক্ষে। এ ক্ষেত্রে আজাদ পত্রিকার কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। ষাটের দশকে গণতন্ত্রের পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। এ সময় প্রধান প্রধান সংবাদপত্র এ আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সংহতি ব্যক্ত করে। রাজবন্দিদের মুক্তির ইস্যুটি তখন গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে আটক রেখে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানো হয়। তখন বেতার ও টেলিভিশন ছিল পাকিস্তান সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। অপরদিকে সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যা ছিল তুলনামূলক সীমিত। কিন্তু তারপরও সংবাদপত্রই জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পেরেছে সাহসী অবস্থান ও বস্তুনিষ্ঠতার গুণে। তাদের ভাষ্যে থাকত সত্যের প্রতিফলন। আর এ কারণেই সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতার যন্ত্র ও টেলিভিশন হয়ে পড়ে একঘরে। স্বাধীনতার পথে দেশ যত এগিয়ে যেতে থাকে, সংবাদপত্র ততই যেন জনগণের আরও কাছে চলে আসে। সঙ্গত কারণেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পুলিশ ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস সদর দফতর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষ্ঠুর অভিযান চালানোর পাশাপাশি কয়েকটি সংবাদপত্র অফিসেও অগি্নসংযোগ করে। কারণ তাদের বিবেচনায় এগুলোও ছিল বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের প্রেরণা এবং অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রতিরোধের কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগী আলবদর বাহিনীর তালিকায় কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকের নাম সংযুক্ত করার কারণ সহজেই বোধগম্য।
স্বাধীনতার পর সংবাদপত্রের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। সামরিক শাসনের সময় স্বাধীন মতপ্রকাশ বিঘি্নত হয়। কিন্তু সাংবাদিকরা মুক্ত সাংবাদিকতার পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেন। আমরা দেখেছি, কঠিন সময়েও এ দেশের গণমাধ্যম জনগণের কাছে নিজের আস্থার অবস্থানটি ধরে রাখায় সচেষ্ট ছিল। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে সম্পূরক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি মুখর বা 'ভাইব্র্যান্ট' মিডিয়া হিসেবেও তারা স্থান করে নিতে পেরেছে। প্লুরালিস্টিক বা বহুমুখী গণমাধ্যম দেশের সাম্প্রতিক অবাধ ও স্বাধীন গণমাধ্যমেরই আরেক পরিচিতি।
স্বাধীনতার আগে গণমাধ্যমের যে সংগ্রাম আমরা দেশের পূর্বাঞ্চলে লক্ষ্য করেছি, বিশেষ করে পূর্ব ও পশ্চিমের বৈষম্য উত্থাপন করে এবং রাজনীতিতে বক্তব্য-প্রধান লেখা প্রকাশ করে সংবাদপত্র যে ভূমিকা পালন করছে তা একটি বিশেষ অধ্যায় হিসেবে পরিচিত। স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন সমর্থন করায় পাকিস্তানি শাসকরা দৈনিক ইত্তেফাক স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয় এবং সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে নিক্ষেপ করা হয় কারাগারে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি বামপন্থিদের প্রতি সহানভূতিশীল দৈনিক সংবাদও তাদের কাছে ছিল চক্ষুশূল এবং বারবার এ পত্রিকাটিও তাদের রোষের শিকার হয়েছে। তুচ্ছ কারণে পত্রিকাটি একবার বন্ধও করে দেওয়া হয় এবং হাইকোর্টের নির্দেেশর কারণেই কেবল তা পুনঃপ্রকাশের সুযোগ পায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এক গৌরবময় ভূমিকা পালন করে অবিস্মরণীয় একটি অধ্যায় রচনা করেছে। এই ভূমিকা জাতির ইতিহাসে উজ্জ্বল। ওই সময়ে দেশের মধ্যে থেকেও চরম ঝুঁকি নিয়ে সাইক্লোস্টাইল করে পত্রিকা প্রকাশ ও বিতরণ করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একটি নতুন অধ্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
গত চার দশকে সংবাদপত্র সংখ্যা বাড়ছে। প্রচারও বেড়ে চলেছে। এখন দেখা যাচ্ছে যোগাযোগ প্রযুক্তি বিকাশ লাভ করছে, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যাপকতর হচ্ছে, যোগাযোগব্যবস্থা সম্প্রসারিত হচ্ছে; মানুষের যোগাযোগ চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। টেলিভিশনে সর্বক্ষণ থাকছে ব্রেকিং নিউজ। বৃদ্ধি পাচ্ছে তথ্যপ্রাপ্তি ও তথ্য ব্যবহারের সুযোগ। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এই বাস্তবতায় মুদ্রিত সংবাদপত্রের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে, অপরপক্ষে বাংলাদেশে একই সময়ে মুদ্রিত সংবাদপত্রের সার্কুলেশন বৃদ্ধি পাচ্ছে; যদিও অন্যান্য সূত্রেও তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরের মতো গ্রামেও সংবাদপত্রের চাহিদা যথেষ্ট। এ বিষয়টি থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে যে, দেশের মানুষের তথ্য চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যান্য উন্নয়নের সহায়ক প্রবৃদ্ধি হিসেবে। আমরা তথ্য-সমাজ (ইনফরমেশন সোসাইটি) গড়তে চাই, তথ্যের শক্তিতে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে চাই। তথ্য যে অনেক শক্তিমান তা আমাদের জনগণ বুঝতে শিখেছে, দুই টাকা থেকে আট টাকা খরচ করে তারা পত্রিকা কিনছে। সপ্তাহের কোনো কোনোদিন পত্রিকার দাম ধরা হয় প্রতি কপি ১০ টাকা এবং তারও ক্রেতা সংখ্যা বিপুল। সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ পত্রিকা পড়ছে, সেই সঙ্গে বেতার যন্ত্র-টিভিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। একইসঙ্গে এটাও লক্ষণীয়, তারা নিরপেক্ষতা পছন্দ করছে। দামি কাগজে বহু রঙের পত্রিকা যদি বিশেষ কোনো দলের প্রতি ঝোঁক দেখায় এবং বস্তুনিষ্ঠতা থেকে সরে থাকার চেষ্টা করে, তাহলে পাঠকরাও তাদের দূরে সরিয়ে রাখে। এমনটি দেখা যায় টেলিভিশন ও বেতারের সংবাদের ক্ষেত্রেও। এ বাস্তবতায় আমাদের জেগে থাকা সময়ের উল্লেখযোগ্য অংশ তাই কেড়ে নিচ্ছে আমাদের গণমাধ্যম। গণমাধ্যমের এই যোগ্যতা অর্জনের ইতিবাচক মূল্যায়ন করতেই হবে।
দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে, আর এ অবস্থা বিরাজমান রাখার পেছনে গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতিশ্রুতি ও আচরণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এর পরিচয় মেলে যখন দেখি নানা মতের পত্রপত্রিকা ভিন্ন ভিন্ন মতামতের প্রচার করছে। নতুন নতুন টিভি চ্যানেল সংযুক্ত হচ্ছে সম্প্রচারে। প্রাইভেট টিভি তাদের মালিকানার সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও নানা মতের বিচিত্র সমাহার ঘটিয়ে চবি্বশ ঘণ্টা প্রচার করে যাচ্ছে সংবাদ, আলোচনা আর নানা বিনোদন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি ব্যক্ত হচ্ছে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুতে দেশব্যাপী যে জাগরণ তার পেছনে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। গণমাধ্যমগুলো শুধু সংবাদ আলোচনাতেই মুখর নয়; একই সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত ও সচেতন করে আমাদের ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে বেগবান করায় অবদান রাখছে।
'সিটিজেন জার্নালিজম' বা জনসাংবাদিকতা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারের এবং প্রশাসনের বিপক্ষে এক ধরনের জনমত সৃষ্টি করে থাকে। বাংলাদেশে, আমার মনে হয় 'ভাইব্র্যান্ট মিডিয়া' বিদ্যমান থাকার কারণে এবং দায়িত্বশীল ও স্বাধীন গণমাধ্যম কার্যকর থাকার কারণে 'সিটিজেন জার্নালিজম'-এর তৎপরতা ততখানি প্রয়োজন হয়নি। তথ্যের অধিকারে জনগণের প্রবেশ নিশ্চিত করে সম্প্রতি তথ্য অধিকার আইন চালু হয়েছে। দীর্ঘ সংগ্রামের স্বীকৃতি দিয়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালনে সরকার ধন্যবাদ পেয়েছে, সেই সঙ্গে সাংবাদিকতায় পেশাদারি ভূমিকা পালনে সাংবাদিকরা যে কোনো তথ্য সহজে পাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তথ্যপ্রবাহে অবাধ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার সুযোগ সৃষ্টি অবশ্যই সাংবাদিকতায় দায়িত্বশীলতার কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, দলীয় সমর্থক পত্রপত্রিকা ছাড়াও মূলধারার পত্রিকাও এই দায়িত্ব এড়িয়ে যায়।
গত ২১ জানুয়ারি জেএসএস এবং ইউপিডিএফের মধ্যে সহিংস ঘটনায় চারজন পাহাড়ি প্রাণ হারায়। তারা রাঙামাটি পার্বত্য জেলার জুরাছড়ি এবং কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী উপজেলার অধিবাসী। দেশের সব জাতীয় দৈনিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে এই সংবাদ পরিবেশিত হয়। কোনো কোনো পত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রাণহানির সংখ্যা নিয়ে অতিরঞ্জিত খবর প্রচার করা হয়। তাতে আটজন পাহাড়িকে হত্যা করার কথা উল্লেখ করা হয় (মিডিয়া ওয়াচ, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১, পৃ. ২৫ দ্রষ্টব্য)। উলি্লখিত প্রবন্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মিডিয়া কাভারেজ নিয়ে দায়িত্বশীলতার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এই আলোচনায় প্রবন্ধকার সোহান খান লিখেছেন, 'একটি পত্রিকায় প্রথম পাতায় হেডলাইন করা হয়েছে পার্বত্য জেলা আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে। আসলে কি তাই? বাস্তবতা কিন্তু অন্য রকম।' গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে সেই সুফল মিডিয়ার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। আমরা যখন স্বাধীন গণমাধ্যম নিয়ে গর্ব করি তখন দায়িত্বশীলতার প্রশ্নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতেই হবে, নইলে শাসকশ্রেণীর আচার-আচরণে উদাসীনতার প্রতিফলন হতে পারে।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের বিকাশ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেতার-টেলিভিশন-সংবাদপত্রে ব্যক্তি পুঁজির উন্মেষ হয়েছে, করপোরেট কালচার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। পুঁজিবাদী উন্নত দেশগুলোর অনুকরণে গণমাধ্যম শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উন্নত দেশের হুবহু অনুকরণে আমরা শিল্পের উন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং এই অনুকরণে আমাদের গণমাধ্যমের বিষয়বস্তু বা কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এই কনটেন্ট তৈরির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে অডিয়েন্সকে বিনোদন সরবরাহ করা। কখনও কখনও গণমাধ্যমে পরিবেশিত খবরাখবরও বিনোদন পণ্য হিসেবে পরিবেশিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন, সম্যক উপলব্ধি অবশ্যই থাকা চাই। জনসাধারণকে তথ্যসমাজের সক্রিয় সদস্য হিসেবে অংশীদার হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করতে হবে। প্রত্যেকটি মানুষের উন্নত জীবনব্যবস্থায় যার যার জায়গা থেকে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা চাই। বহুমুখী গণমাধ্যমের চরিত্র পরিষ্কারভাবে নির্দিষ্ট হতে হবে। তাহলে হুবহু অনুকরণ থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব। সেক্ষেত্রে আমরা উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেদের উন্নততর লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারব।
ধরা যাক, আজকের নতুন প্রজন্মের কথা, যারা যুক্তি দিয়ে বুদ্ধি দিয়ে নিজেকে গড়তে চায়। চারপাশের পরিবেশ এমনকি বৈরী থাকলেও তারা জানে কী করে নিজেকে এগিয়ে নিতে হয়। তারা নিজেদের বিশ্ব সংস্কৃতির অংশীদার মনে করছে। ব্যস্ত থাকছে তারা আত্মানুসন্ধানে। গণমাধ্যমের একটি দায়িত্ব হচ্ছে তাদের জাতীয় দায়িত্ব ও মূল্যবোধের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। তারা যেন জাতীয় মূল্যবোধ থেকে ছিটকে পড়ে না যেতে পারে। আজকের ইন্টারনেট চর্চা, বিদেশি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের আগ্রাসন এসবের ব্যবহারে তরুণ প্রজন্ম যথেষ্ট উৎসাহী। তাদের এসব ব্যবহারে সাবধানতা বিশেষভাবে অবলম্বন করতে হবে। এই এজেন্ডায় গণমাধ্যমের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। শুধু রাজনৈতিকভাবে সচেতনতা থাকাই শেষ কথা নয়, কিংবা চাঞ্চল্যকর বিষয়াবলির উপস্থাপন করাই গণমাধ্যমের একমাত্র বিষয় নয়। বহুমুখী গণমাধ্যম হিসেবে সমাজের বহুত্ববাদী ভূমিকাকে উপস্থাপন করতে হবে অত্যন্ত সচেতনভাবে ও সতর্কতার সঙ্গে। মিডিয়া কনটেন্ট যারা তৈরি করেন তাদের সমাজের বিভিন্ন স্তর, বিভিন্ন জাতিসত্তা, নৃতাত্তি্বক গোষ্ঠী, প্রান্তিক জনগণ_ সবাইকে বিবেচনায় আনতে হবে। দেশের বৃহৎ অংশ যারা দেশের প্রধান উৎপাদনে অবদান চোখে চলেছেন তাদের গণমাধ্যমের বিষয়বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন রাখলে আমাদের জাতির মৌলিক শক্তিকে অস্বীকার করা হয়। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিষয়বস্তু এলিট শ্রেণীর একরোখা বিষয়বস্তুর জাঁতাকলে বন্দি হয়ে আছে, সেখানে নগরকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা এবং জীবনবোধই মূল। এই ঘেরাটোপ থেকে মিডিয়া কনটেন্টকে অবমুক্ত করা প্রয়োজন।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়, রাজনীতি এবং অপরাধ এই দুটি বিষয় গণমাধ্যমের অতি আদরের। মূল স্রোতধারার কোনো মাধ্যমের বিষয়বস্তু হিসেবে এই বিষয়গুলো বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। তাই আমাদের গণমাধ্যমের বিষয়বস্তুকে চটকদার বিষয় থেকে বেরিয়ে এসে বহুমুখী সমাজের কথা বিবেচনা করে আরও বাস্তবানুগ বিষয়বস্তু ও আরও জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়াবলি গণমাধ্যমে সনি্নবেশিত করতে হবে। এতে আমাদের ঐতিহ্যের শিকড় যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে চলমান বিশ্বে নিজেদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার আধুনিক চিন্তা ও চেতনা। আমাদের গৌরব মুক্তিযুদ্ধ যেমন থাকবে, তেমনি আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রকৌশলমুখর হয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে এটাই প্রত্যাশা।
চার দশকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মূল্যায়ন করতে গেলে সংখ্যাগত পরিবর্তন অবশ্যই বিবেচনায় থাকবে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি করে সামনে আসবে দায়িত্বশীলতা ও আস্থার বিষয়টি। সমাজের নানা অংশ এবং এমনকি প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেও ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, সংবাদপত্র ও টেলিভিশন জবাবদিহিতার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আমাদের জাতীয় সংসদ রাজনীতি-অর্থনীতির আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারছে না। বিরোধী কণ্ঠ সংসদে শোনা যায় কালেভদ্রে। এ অবস্থায় সংবাদপত্র এবং বেতার ও টেলিভিশন বহুত্ববাদের ধারণা জনগণের কাছে তুলে ধরার দায়িত্ব পালন করে প্রশংসিত হচ্ছে। এ অবস্থান ধরে রাখতে এবং একইসঙ্গে তা বাড়িয়ে যেতে হবে। সমাজের আরও গণতন্ত্রায়ন এবং দেশের সার্বিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য এর বিকল্প নেই। একইসঙ্গে গণমাধ্যমকেও তার দায়িত্বশীলতার অবস্থানটি ভুললে চলবে না। নিজের জন্যও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার একটি সুস্পষ্ট স্থান নির্দিষ্ট করে রাখা চাই।
ড. গোলাম রহমান :অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও
সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রশংসিত হচ্ছে
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পটভূমি সৃষ্টিতে সংবাদপত্র অনন্য ভূমিকা রেখেছে, এটা সর্বজনস্বীকৃত। পঞ্চাশের দশকে ভাষা আন্দোলনে সংবাদপত্র জনমত সংগঠিত ও প্রভাবিত করেছে। এমনকি শাসক দল মুসলিম লীগের সমর্থক পত্রিকাও নিজেকে উপস্থাপন করেছে আন্দোলনকারী জনগণের পক্ষে। এ ক্ষেত্রে আজাদ পত্রিকার কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। ষাটের দশকে গণতন্ত্রের পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। এ সময় প্রধান প্রধান সংবাদপত্র এ আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সংহতি ব্যক্ত করে। রাজবন্দিদের মুক্তির ইস্যুটি তখন গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে আটক রেখে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানো হয়। তখন বেতার ও টেলিভিশন ছিল পাকিস্তান সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। অপরদিকে সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যা ছিল তুলনামূলক সীমিত। কিন্তু তারপরও সংবাদপত্রই জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পেরেছে সাহসী অবস্থান ও বস্তুনিষ্ঠতার গুণে। তাদের ভাষ্যে থাকত সত্যের প্রতিফলন। আর এ কারণেই সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতার যন্ত্র ও টেলিভিশন হয়ে পড়ে একঘরে। স্বাধীনতার পথে দেশ যত এগিয়ে যেতে থাকে, সংবাদপত্র ততই যেন জনগণের আরও কাছে চলে আসে। সঙ্গত কারণেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পুলিশ ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস সদর দফতর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষ্ঠুর অভিযান চালানোর পাশাপাশি কয়েকটি সংবাদপত্র অফিসেও অগি্নসংযোগ করে। কারণ তাদের বিবেচনায় এগুলোও ছিল বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের প্রেরণা এবং অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রতিরোধের কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগী আলবদর বাহিনীর তালিকায় কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকের নাম সংযুক্ত করার কারণ সহজেই বোধগম্য।
স্বাধীনতার পর সংবাদপত্রের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। সামরিক শাসনের সময় স্বাধীন মতপ্রকাশ বিঘি্নত হয়। কিন্তু সাংবাদিকরা মুক্ত সাংবাদিকতার পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেন। আমরা দেখেছি, কঠিন সময়েও এ দেশের গণমাধ্যম জনগণের কাছে নিজের আস্থার অবস্থানটি ধরে রাখায় সচেষ্ট ছিল। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে সম্পূরক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি মুখর বা 'ভাইব্র্যান্ট' মিডিয়া হিসেবেও তারা স্থান করে নিতে পেরেছে। প্লুরালিস্টিক বা বহুমুখী গণমাধ্যম দেশের সাম্প্রতিক অবাধ ও স্বাধীন গণমাধ্যমেরই আরেক পরিচিতি।
স্বাধীনতার আগে গণমাধ্যমের যে সংগ্রাম আমরা দেশের পূর্বাঞ্চলে লক্ষ্য করেছি, বিশেষ করে পূর্ব ও পশ্চিমের বৈষম্য উত্থাপন করে এবং রাজনীতিতে বক্তব্য-প্রধান লেখা প্রকাশ করে সংবাদপত্র যে ভূমিকা পালন করছে তা একটি বিশেষ অধ্যায় হিসেবে পরিচিত। স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন সমর্থন করায় পাকিস্তানি শাসকরা দৈনিক ইত্তেফাক স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয় এবং সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে নিক্ষেপ করা হয় কারাগারে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি বামপন্থিদের প্রতি সহানভূতিশীল দৈনিক সংবাদও তাদের কাছে ছিল চক্ষুশূল এবং বারবার এ পত্রিকাটিও তাদের রোষের শিকার হয়েছে। তুচ্ছ কারণে পত্রিকাটি একবার বন্ধও করে দেওয়া হয় এবং হাইকোর্টের নির্দেেশর কারণেই কেবল তা পুনঃপ্রকাশের সুযোগ পায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এক গৌরবময় ভূমিকা পালন করে অবিস্মরণীয় একটি অধ্যায় রচনা করেছে। এই ভূমিকা জাতির ইতিহাসে উজ্জ্বল। ওই সময়ে দেশের মধ্যে থেকেও চরম ঝুঁকি নিয়ে সাইক্লোস্টাইল করে পত্রিকা প্রকাশ ও বিতরণ করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একটি নতুন অধ্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
গত চার দশকে সংবাদপত্র সংখ্যা বাড়ছে। প্রচারও বেড়ে চলেছে। এখন দেখা যাচ্ছে যোগাযোগ প্রযুক্তি বিকাশ লাভ করছে, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যাপকতর হচ্ছে, যোগাযোগব্যবস্থা সম্প্রসারিত হচ্ছে; মানুষের যোগাযোগ চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। টেলিভিশনে সর্বক্ষণ থাকছে ব্রেকিং নিউজ। বৃদ্ধি পাচ্ছে তথ্যপ্রাপ্তি ও তথ্য ব্যবহারের সুযোগ। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এই বাস্তবতায় মুদ্রিত সংবাদপত্রের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে, অপরপক্ষে বাংলাদেশে একই সময়ে মুদ্রিত সংবাদপত্রের সার্কুলেশন বৃদ্ধি পাচ্ছে; যদিও অন্যান্য সূত্রেও তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরের মতো গ্রামেও সংবাদপত্রের চাহিদা যথেষ্ট। এ বিষয়টি থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে যে, দেশের মানুষের তথ্য চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যান্য উন্নয়নের সহায়ক প্রবৃদ্ধি হিসেবে। আমরা তথ্য-সমাজ (ইনফরমেশন সোসাইটি) গড়তে চাই, তথ্যের শক্তিতে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে চাই। তথ্য যে অনেক শক্তিমান তা আমাদের জনগণ বুঝতে শিখেছে, দুই টাকা থেকে আট টাকা খরচ করে তারা পত্রিকা কিনছে। সপ্তাহের কোনো কোনোদিন পত্রিকার দাম ধরা হয় প্রতি কপি ১০ টাকা এবং তারও ক্রেতা সংখ্যা বিপুল। সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ পত্রিকা পড়ছে, সেই সঙ্গে বেতার যন্ত্র-টিভিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। একইসঙ্গে এটাও লক্ষণীয়, তারা নিরপেক্ষতা পছন্দ করছে। দামি কাগজে বহু রঙের পত্রিকা যদি বিশেষ কোনো দলের প্রতি ঝোঁক দেখায় এবং বস্তুনিষ্ঠতা থেকে সরে থাকার চেষ্টা করে, তাহলে পাঠকরাও তাদের দূরে সরিয়ে রাখে। এমনটি দেখা যায় টেলিভিশন ও বেতারের সংবাদের ক্ষেত্রেও। এ বাস্তবতায় আমাদের জেগে থাকা সময়ের উল্লেখযোগ্য অংশ তাই কেড়ে নিচ্ছে আমাদের গণমাধ্যম। গণমাধ্যমের এই যোগ্যতা অর্জনের ইতিবাচক মূল্যায়ন করতেই হবে।
দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে, আর এ অবস্থা বিরাজমান রাখার পেছনে গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতিশ্রুতি ও আচরণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এর পরিচয় মেলে যখন দেখি নানা মতের পত্রপত্রিকা ভিন্ন ভিন্ন মতামতের প্রচার করছে। নতুন নতুন টিভি চ্যানেল সংযুক্ত হচ্ছে সম্প্রচারে। প্রাইভেট টিভি তাদের মালিকানার সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও নানা মতের বিচিত্র সমাহার ঘটিয়ে চবি্বশ ঘণ্টা প্রচার করে যাচ্ছে সংবাদ, আলোচনা আর নানা বিনোদন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি ব্যক্ত হচ্ছে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুতে দেশব্যাপী যে জাগরণ তার পেছনে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। গণমাধ্যমগুলো শুধু সংবাদ আলোচনাতেই মুখর নয়; একই সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত ও সচেতন করে আমাদের ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে বেগবান করায় অবদান রাখছে।
'সিটিজেন জার্নালিজম' বা জনসাংবাদিকতা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারের এবং প্রশাসনের বিপক্ষে এক ধরনের জনমত সৃষ্টি করে থাকে। বাংলাদেশে, আমার মনে হয় 'ভাইব্র্যান্ট মিডিয়া' বিদ্যমান থাকার কারণে এবং দায়িত্বশীল ও স্বাধীন গণমাধ্যম কার্যকর থাকার কারণে 'সিটিজেন জার্নালিজম'-এর তৎপরতা ততখানি প্রয়োজন হয়নি। তথ্যের অধিকারে জনগণের প্রবেশ নিশ্চিত করে সম্প্রতি তথ্য অধিকার আইন চালু হয়েছে। দীর্ঘ সংগ্রামের স্বীকৃতি দিয়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালনে সরকার ধন্যবাদ পেয়েছে, সেই সঙ্গে সাংবাদিকতায় পেশাদারি ভূমিকা পালনে সাংবাদিকরা যে কোনো তথ্য সহজে পাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তথ্যপ্রবাহে অবাধ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার সুযোগ সৃষ্টি অবশ্যই সাংবাদিকতায় দায়িত্বশীলতার কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, দলীয় সমর্থক পত্রপত্রিকা ছাড়াও মূলধারার পত্রিকাও এই দায়িত্ব এড়িয়ে যায়।
গত ২১ জানুয়ারি জেএসএস এবং ইউপিডিএফের মধ্যে সহিংস ঘটনায় চারজন পাহাড়ি প্রাণ হারায়। তারা রাঙামাটি পার্বত্য জেলার জুরাছড়ি এবং কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী উপজেলার অধিবাসী। দেশের সব জাতীয় দৈনিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে এই সংবাদ পরিবেশিত হয়। কোনো কোনো পত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রাণহানির সংখ্যা নিয়ে অতিরঞ্জিত খবর প্রচার করা হয়। তাতে আটজন পাহাড়িকে হত্যা করার কথা উল্লেখ করা হয় (মিডিয়া ওয়াচ, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১, পৃ. ২৫ দ্রষ্টব্য)। উলি্লখিত প্রবন্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মিডিয়া কাভারেজ নিয়ে দায়িত্বশীলতার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এই আলোচনায় প্রবন্ধকার সোহান খান লিখেছেন, 'একটি পত্রিকায় প্রথম পাতায় হেডলাইন করা হয়েছে পার্বত্য জেলা আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে। আসলে কি তাই? বাস্তবতা কিন্তু অন্য রকম।' গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে সেই সুফল মিডিয়ার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। আমরা যখন স্বাধীন গণমাধ্যম নিয়ে গর্ব করি তখন দায়িত্বশীলতার প্রশ্নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতেই হবে, নইলে শাসকশ্রেণীর আচার-আচরণে উদাসীনতার প্রতিফলন হতে পারে।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের বিকাশ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেতার-টেলিভিশন-সংবাদপত্রে ব্যক্তি পুঁজির উন্মেষ হয়েছে, করপোরেট কালচার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। পুঁজিবাদী উন্নত দেশগুলোর অনুকরণে গণমাধ্যম শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উন্নত দেশের হুবহু অনুকরণে আমরা শিল্পের উন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং এই অনুকরণে আমাদের গণমাধ্যমের বিষয়বস্তু বা কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এই কনটেন্ট তৈরির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে অডিয়েন্সকে বিনোদন সরবরাহ করা। কখনও কখনও গণমাধ্যমে পরিবেশিত খবরাখবরও বিনোদন পণ্য হিসেবে পরিবেশিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন, সম্যক উপলব্ধি অবশ্যই থাকা চাই। জনসাধারণকে তথ্যসমাজের সক্রিয় সদস্য হিসেবে অংশীদার হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করতে হবে। প্রত্যেকটি মানুষের উন্নত জীবনব্যবস্থায় যার যার জায়গা থেকে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা চাই। বহুমুখী গণমাধ্যমের চরিত্র পরিষ্কারভাবে নির্দিষ্ট হতে হবে। তাহলে হুবহু অনুকরণ থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব। সেক্ষেত্রে আমরা উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেদের উন্নততর লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারব।
ধরা যাক, আজকের নতুন প্রজন্মের কথা, যারা যুক্তি দিয়ে বুদ্ধি দিয়ে নিজেকে গড়তে চায়। চারপাশের পরিবেশ এমনকি বৈরী থাকলেও তারা জানে কী করে নিজেকে এগিয়ে নিতে হয়। তারা নিজেদের বিশ্ব সংস্কৃতির অংশীদার মনে করছে। ব্যস্ত থাকছে তারা আত্মানুসন্ধানে। গণমাধ্যমের একটি দায়িত্ব হচ্ছে তাদের জাতীয় দায়িত্ব ও মূল্যবোধের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। তারা যেন জাতীয় মূল্যবোধ থেকে ছিটকে পড়ে না যেতে পারে। আজকের ইন্টারনেট চর্চা, বিদেশি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের আগ্রাসন এসবের ব্যবহারে তরুণ প্রজন্ম যথেষ্ট উৎসাহী। তাদের এসব ব্যবহারে সাবধানতা বিশেষভাবে অবলম্বন করতে হবে। এই এজেন্ডায় গণমাধ্যমের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। শুধু রাজনৈতিকভাবে সচেতনতা থাকাই শেষ কথা নয়, কিংবা চাঞ্চল্যকর বিষয়াবলির উপস্থাপন করাই গণমাধ্যমের একমাত্র বিষয় নয়। বহুমুখী গণমাধ্যম হিসেবে সমাজের বহুত্ববাদী ভূমিকাকে উপস্থাপন করতে হবে অত্যন্ত সচেতনভাবে ও সতর্কতার সঙ্গে। মিডিয়া কনটেন্ট যারা তৈরি করেন তাদের সমাজের বিভিন্ন স্তর, বিভিন্ন জাতিসত্তা, নৃতাত্তি্বক গোষ্ঠী, প্রান্তিক জনগণ_ সবাইকে বিবেচনায় আনতে হবে। দেশের বৃহৎ অংশ যারা দেশের প্রধান উৎপাদনে অবদান চোখে চলেছেন তাদের গণমাধ্যমের বিষয়বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন রাখলে আমাদের জাতির মৌলিক শক্তিকে অস্বীকার করা হয়। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিষয়বস্তু এলিট শ্রেণীর একরোখা বিষয়বস্তুর জাঁতাকলে বন্দি হয়ে আছে, সেখানে নগরকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা এবং জীবনবোধই মূল। এই ঘেরাটোপ থেকে মিডিয়া কনটেন্টকে অবমুক্ত করা প্রয়োজন।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়, রাজনীতি এবং অপরাধ এই দুটি বিষয় গণমাধ্যমের অতি আদরের। মূল স্রোতধারার কোনো মাধ্যমের বিষয়বস্তু হিসেবে এই বিষয়গুলো বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। তাই আমাদের গণমাধ্যমের বিষয়বস্তুকে চটকদার বিষয় থেকে বেরিয়ে এসে বহুমুখী সমাজের কথা বিবেচনা করে আরও বাস্তবানুগ বিষয়বস্তু ও আরও জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়াবলি গণমাধ্যমে সনি্নবেশিত করতে হবে। এতে আমাদের ঐতিহ্যের শিকড় যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে চলমান বিশ্বে নিজেদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার আধুনিক চিন্তা ও চেতনা। আমাদের গৌরব মুক্তিযুদ্ধ যেমন থাকবে, তেমনি আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রকৌশলমুখর হয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে এটাই প্রত্যাশা।
চার দশকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মূল্যায়ন করতে গেলে সংখ্যাগত পরিবর্তন অবশ্যই বিবেচনায় থাকবে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি করে সামনে আসবে দায়িত্বশীলতা ও আস্থার বিষয়টি। সমাজের নানা অংশ এবং এমনকি প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেও ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, সংবাদপত্র ও টেলিভিশন জবাবদিহিতার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আমাদের জাতীয় সংসদ রাজনীতি-অর্থনীতির আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারছে না। বিরোধী কণ্ঠ সংসদে শোনা যায় কালেভদ্রে। এ অবস্থায় সংবাদপত্র এবং বেতার ও টেলিভিশন বহুত্ববাদের ধারণা জনগণের কাছে তুলে ধরার দায়িত্ব পালন করে প্রশংসিত হচ্ছে। এ অবস্থান ধরে রাখতে এবং একইসঙ্গে তা বাড়িয়ে যেতে হবে। সমাজের আরও গণতন্ত্রায়ন এবং দেশের সার্বিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য এর বিকল্প নেই। একইসঙ্গে গণমাধ্যমকেও তার দায়িত্বশীলতার অবস্থানটি ভুললে চলবে না। নিজের জন্যও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার একটি সুস্পষ্ট স্থান নির্দিষ্ট করে রাখা চাই।
ড. গোলাম রহমান :অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও
সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments