তুরাগ তীরে মানুষের ঢল, জুমার নামাজে লাখো মুসলিস্নত by ফিরোজ মান্না
মোসত্মাফিজুর রহমান টিটু/ নূরম্নল ইসলাম, টঙ্গী থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলিস্নদের স্রোত থামে শুক্রবার দুপুরে, তুরাগ তীরে। পরকালের প্রাপ্তি খুঁজতে মানুষের এ স্রোত সকাল থেকে শুরম্ন হয়েছিল। উদ্দেশ্য জুমার নামাজ আদায় করা।
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মানুষের এ এক মহামিলন মেলা। মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত বিশ্ব এজতেমায় ২০ লাখের বেশি মুসলিস্ন শরিক হয়েছেন। কঠোর নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা ছিল গোটা এজতেমা এলাকা। আয়োজক সংস্থা বিশ্ব তবলিগ জামাত ও সরকারী ব্যবস্থাপনার কিছুটা ত্রম্নটি থাকলেও বড় ধরনের কোন অপ্রীতিকর ঘটনার খবর মেলেনি। তবে সন্দেহভাজন কয়েকজনকে পুলিশ আটক করেছে। হৃদ রোগে আক্রানত্ম হয়ে মারা গেছে তিন মুসলিস্ন। ৪৫ মুসলিস্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন।এবাদত-বন্দেগিতে মুখরিত গোটা এজতেমা এলাকায় মুসলিস্নদের চাহিদামতো বিভিন্ন পণ্যের পসরা বসিয়েছে ুদে ব্যবসায়ীরা। বিক্রিও ভাল। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বদনায় অজু গোসলের পানি বিক্রি করছে। ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে শত শত টয়লেট। এগুলো ব্যবহার করতে নেয়া হচ্ছে বিনিময় মূল্য। এজতেমার ময়দানে মুসলিস্নদের ঠাঁই নেই অবস্থা। পথে পথে গায়ে গায়ে মানুষের চলা। মানুষের এ কাফেলা যেন অননত্মের প্রাপ্তি সন্ধান করছে।
লাখো মুসলিস্নর অংশগ্রহণে টঙ্গীর তুরাগতীরের প্রানত্মরজুড়ে কেবল মানুষ আর মানুষ। তবলিগ জামাতের সবচেয়ে বড় সমাবেশ বিশ্ব এজতেমাকে মুসলিস্নরা বর্ণনা করছেন দ্বিতীয় হজ হিসেবে। প্রথম দিন জুমার নামাজের আগেই বিশ্ব এজতেমা ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। পুরো এলাকা পরিণত হয় বিশাল জনসমুদ্রে। ভোর থেকেই এজতেমা মাঠের দিকে জনতার ঢল নামে। তাদের অধিকাংশেরই ল্য ছিল উপমহাদেশের বৃহত্তম জুমার নামাজের জামাতে শরিক হওয়া। বাস, ট্রেনের ছাদে, নৌকায়, ট্রলারে, হেঁটে যে যেভাবে পেরেছে ছুটে এসেছিল এজতেমা ময়দানে। দুপুর ১২টার আগেই ১৬০ একর জমির ওপর স্থাপিত প্যান্ডেল ভরে যায়। এক পর্যায়ে প্যান্ডেলে জায়গা না পেয়ে মুসলিস্নরা রাসত্মায় কাপড়, পাটি, হোগলার চাটাই, কাগজ, পলেথিন, জায়নামাজ বিছিয়ে জুমার নামাজে দাঁড়িয়ে যান। সড়কে বাস-ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহনের ফাঁকফোকরে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেছেন মুসলিস্নরা। তবে অনেক স্থানে মূল প্যান্ডেল থেকে পরিচালিত নামাজ আদায়ের শব্দ শুনতে না পেয়ে জুমার নামাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। কোন কোন স্থানে নির্দিষ্ট সময়ের আগে ও পরে নামাজ আদায় করেছে মুসলিস্নরা। অপ্রতুল মাইকের ব্যবস্থার কারণে হাজার হাজার মুসলিস্ন ােভ প্রকাশ করেছেন। অনেক মানুষ জায়গা না পেয়ে মনোকষ্ট নিয়ে ফিরে গেছেন। সৃষ্টিকর্তার দিদার লাভের আশায় মানুষ যে কত কষ্ট করে এজতেমায় এসেছেন তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। শক্রবার ছুটির দিন থাকায় চাকরিজীবীরাও এসেছিলেন জুমার নামাজ আদায় করতে। বিশ্বের এটাই সবচেয়ে বড় জুমার জামাত। এখানে শরিক হতে পারলে পাপমোচন করে পুণ্যের ভাগিদার হওয়া যাবে। আর এ পুণ্যই আখেরাতে তাদের মুক্তি দেবে_ এমন আশায়ই তাঁরা এসেছিলেন নানা ভোগানত্মি পার করে। তাঁদের অনেককেই আবার ভোগানত্মি নিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। যাঁরা তিন দিনের জন্য বিশ্ব এজতেমায় যোগদান করেছেন তাঁরা খিত্তা অনুযায়ী অবস্থান নিয়েছেন। এবার দেশের ৬৪ জেলা থেকে আগত মুসলিস্নদের ৩৩ খিত্তায় (জায়গা) এবং বিদেশী মেহমানদের জন্য ভিন্ন একটি খিত্তা করা হয়েছে। এজতেমা ময়দানে নিজ জেলার অবস্থান খুঁজে পাওয়ার সুবিধার্থে বিভিন্ন কোম্পানি ও সরকারীভাবে সড়কের মোড়ে মোড়ে ম্যাপসহ বিলবোর্ড দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রচারপত্র বিলি করা হচ্ছে। খিত্তায় অবস্থানকারী মুসলিস্নরা টয়লেট সমস্যা ছাড়া আর কোন অভিযোগ করেননি। পর্যাপ্ত পানি সরবরাহের জন্যও দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। গত বছরের তুলনায় এবারের ব্যবস্থাপনা কিছুটা ভাল। তবে প্রতিবছর যে পরিমাণ মুসলিস্ন বাড়ছে তাতে আরও উন্নতমানের ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন বলে মনে করেন মুসলিস্নরা।
হঠাৎ শীতের তীব্রতা কেটে গিয়ে সূর্যের উত্তাপ এজতেমা ময়দান ও তার আশপাশের এলাকায় গরম পড়ে যায়। গরমে বহু মুসলিস্ন অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৪৫ মুসলিস্নকে টঙ্গী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে। ১৬৫ মুসলিস্নকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। জুমার নামাজের সময় সেখানে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। রবিবার আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে ৪৪তম বিশ্ব এজতেমা।
এজতেমায় জানাজা
এজতেমায় আসা দুই মুসলিস্ন মারা যান। তাঁদের নামাজে জানাজা জুমার পরই অনুষ্ঠিত হয় এজতেমা ময়দানে। ১৫ নং খিত্তার বদিউজ্জামান (৬৫), পিতা আবুল কাশেম, সাং-সুনরং, টঙ্গীবাড়ি, মুন্সীগঞ্জ। বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ১০টার দিকে হৃদরোগে আক্রানত্ম হয়ে মারা গেছেন। ২৪ নং খিত্তার রিয়াজউদ্দিন (৬৫), সাং দাপুনিয়া, চকপাড়া, ময়মনসিংহ ভোর ৫টায় মারা যান। নূরম্নল বিশ্বাস (৭০) মারা যান। তাঁর বাড়ি মাগুরা সদর উপজেলার গুরম্নমারা গ্রামে।
বয়ানপর্ব
বিশ্ব এজতেমার মূল বয়ানপর্ব শুরম্ন হয়েছে শুক্রবার ফজর নামাজের পর। জুমার নামাজের আগ পর্যনত্ম টানা এ বয়ান চলেছে। জুমার নামাজ শেষ হওয়ার পর কিছুণ বিরতির দিয়ে আবার শুরম্ন হয় বয়ান। এ বয়ানে ইমান, আমল, আখলাক, দ্বীনের দাওয়াত এবং তবলিগের চিলস্নাসহ তবলিগের নিয়মকানুনের কথা বলা হয়। এজতেমার মূলমঞ্চে শনিবার বয়ানের পাশাপাশি আয়োজন করা হবে যৌতুকবিহীন গণবিয়ের আসর। এ বিয়েতে বর উপস্থিত হবেন ঠিকই, কিন্তু কনে উপস্থিতির প্রয়োজন থাকবে না। তবে কনের সম্মতি নিয়ে কনেপরে লোকজন উপস্থিত থাকবেন। বিয়ে শেষে উপস্থিত সকলকে খুরমা-খেজুর খাওয়ানো হয়। এজতেমার শুরম্ন থেকে এ রেওয়াজ চলে আসছে।
এদিকে জুমার জামাত এজতেমার মূল ময়দান ছাড়িয়ে পার্শ্ববতর্ী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও টঙ্গী-আশুলিয়া সড়কসহ আশপাশের এলাকায় বিসত্মৃত হয়। জামাতে মুসলিস্নদের উপচেপড়া ভিড় তুরাগ নদীর পশ্চিম তীরে গিয়ে পেঁৗছে। ফলে মূল ময়দানের বাইরেও লাখ লাখ মুসলিস্নর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে জুমার জামাতে ইমামের স্থান নির্ধারণ করা হয় তুরাগ নদীর পশ্চিম তীরে (উত্তরা অংশে) টঙ্গী-আশুলিয়া সড়ক সংলগ্নস্থানে। তুরাগ নদীর পন্টুন ব্রিজগুলোর মাধ্যমে ময়দানের মূল জামাতকে পশ্চিম তীরের জামাতের সাথে সংযুক্ত করা হয়। জামাত শেষে এজতেমাস্থল থেকে মুসলিস্নদের বহির্গমনের সময় আশপাশের এলাকায় মারাত্মক যানজটের সৃষ্টি হয়। এ যানজটের কারণে বিকেল ৫টা পর্যনত্ম টঙ্গীর প্রধান প্রধান সড়কে যানবাহন চলাচল স্থির হয়ে ছিল। বিশেষ করে দেিণ বিমানবন্দর থেকে উত্তরে জয়দেবপুর চৌরাসত্মা পর্যনত্ম পশ্চিমে আশুলিয়া সড়কের ধৌড় মোড় পর্যনত্ম এবং পূর্বপাশে টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের মিরেরবাজার পর্যনত্ম যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। প্রথম দিনেই বিশ্ব এজতেমার পুরো এলাকা কানায় কানায় ভরে যায় মুসলিস্নদের উপস্থিতিতে। শুক্রবার বাদ ফজর আ'ম বয়ান করেন দিলস্নীর মিয়াজী আজমত। এর তর্জমা করেন বাংলাদেশের নূর মোহাম্মদ। বাদ জুমা বয়ান করেন মাওলানা মোহাম্মদ মোশারফ, বাদ আছর ভারতের মাওলানা যোবায়েরম্নল হাসান এবং বাদ মাগরিব বয়ান করেন দিলস্নীর মাওলানা সা'দ। জুমার নামাজে ইমামতি করেন কাকরাইল মসজিদের ইমাম মাওলানা হাফেজ যুবায়ের। দেশ-বিদেশ থেকে আগত মুসলিস্নদের সুবিধার্থে বয়ানের সাথে সাথে ইংরেজী, আরবী, মালয়, তামিল, ফারসি, তুকর্ী ও থাই ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষাভাষীর নিজ নিজ ভাষায় তর্জমা করা হয়। ভারত ও পাকিসত্মানের মুরবি্বদের উর্দু ভাষায় প্রদত্ত বয়ান বাংলাদেশী মুসলিস্নদের সুবিধার্থ সাথে সাথে বাংলায় তর্জমা করা হচ্ছে। বয়ানে মুরবি্বরা তবলিগের ৬ উসুল যথা কালিমা, নামাজ, ইল্ম ও জিকির, ইকরামুল মুসলিমিন, তাসহিয়ে নিয়ত ও দাওয়াতে তবলিগ সম্পর্কে গুরম্নত্বপূর্ণ বয়ান হয়। বয়ানে তবলিগ মুরবি্বরা বলেন, মোহতারাম ভাই ও দোসত্ম আওর বুজুর্গ, আলস্নাহতায়ালা আপনাকে আমাকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। দুনিয়াতে যে একবার আসবে তাকে মৃতু্যবরণ করতে হবে। আলস্নাহর সত্তা চিরস্থায়ী। যার কোন শুরম্ন এবং শেষ নেই। রবিবার জোহর নামাজের আগে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এই বিশাল মুসলিম জমায়েত। পরে জোহর নামাজ আদায় হবে।
তুরাগ নদীর পানি পাহারা
কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে তুরাগ নদীর পানি ব্যবহারের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এই পানি যাতে কেউ ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য নদীতীরে র্যাব ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এজতেমার সার্বিক নিরাপত্তার জন্য মোতায়েনকৃত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরাট একটি অংশ নদীর পানি পাহারার কাজে নিয়োজিত থাকতে দেখা গেছে। অথচ এক সময় মুসলিস্নরা এই নদীর পানি অজু গোসলসহ নানা প্রয়োজনে ব্যবহার করতেন।
জুমার নামাজে ভিআইপিরা
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়া, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, গাজীপুরের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আকম মোজাম্মেল হক, সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, টঙ্গী পৌরসভার মেয়র আজমত উলস্নাহ খান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আনোয়ারম্নল ইকবাল নামাজে অংশ নেন।
ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প
মুসলিস্নদের স্ব্বাস্থ্যসেবা দিতে মন্নু ফাইন কটন মিলের ভেতরে মাঠে ৪৭টি ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প খোলা হয়েছে। গতকাল এসব মেডিক্যাল ক্যাম্পে রোগাক্রানত্ম মুসলিস্নদের ভিড় দেখা গেছে। চিকিৎসকরা জানান, অধিকাংশই ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, আমাশয়, চর্মরোগের চিকিৎসা নিতে আসছেন। একই কথা বলেন এজতেমায় আগত মুসলিস্নরা।
৭০ দেশের মেহমান
ইতোমধ্যে এজতেমা ময়দানে আমেরিকা, ভারত, পাকিসত্মান, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, মালদ্বীপ, সৌদি আরবসহ প্রায় ৭০ দেশের ২০ হাজারের বেশি বিদেশী মেহমান এসে পেঁৗছেছেন। তাঁদের জন্য এজতেমা ময়দানে আলাদা খিত্তা রয়েছে।
No comments