আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনে চড়াই-উতরাই by মুস্তাফা নূরউল ইসলাম
রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি স্মরণ করি, 'সহজ কথা যায় না বলা সহজে' নিয়ত উপলব্ধি করছি সেই সত্য। যথার্থই অতীব কঠিন যে সহজ করে বলা যায় না সহজ সত্যকে। দীর্ঘ জীবনের অন্তিম ক্ষণে সত্যদ্রষ্টা সেই আপন অভিজ্ঞতাটি জানিয়েছিলেন 'সত্য যে কঠিন'।
একটি সহজ ও স্বাভাবিক প্রসঙ্গ বুঝতে চাইছি। তাই থেকে ওই রবীন্দ্রবচনের অবতারণা। সংস্কৃতি ব্যাপারটি কী? বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের জন্য। মনে করি, প্রসঙ্গটি তলিয়ে জানবার রয়েছে। কেননা ওই সহজ সত্যকেই কখনো কখনো জটিল করে তোলা হয়ে থাকে এবং আমরা সাধারণ গভীরে ভাববার অবকাশ সন্ধান করি না।
সহজ কেন? মানুষের জন্যই তো সংস্কৃতি। তাই সহজ। পণ্ডিতরা অবশ্য নানাবিধ সংজ্ঞা ব্যাখ্যা দান করে থাকেন। তাঁদের পর্যালোচনার অন্ত নেই। সে পাড়ায় থাকুক পাণ্ডিত্যের যাবতীয় বিতর্ক-বিশ্লেষণ। বলা গেছে তো আমরা সহজ করে বুঝতে চাই। মানুষ 'মানুষ' বলেই আপন তার সংস্কৃতি। তার সমুদয় কর্মকাণ্ডটা নিশ্চিতই দেশনির্ভর, বহতা কালনির্ভর। এ আমদানি করে প্রবিষ্ট করিয়ে দেওয়া যায় না, ওপর থেকে ফরমান জারি করে নির্মাণ আদৌ সম্ভব নয়। মন্দভাগ্য আমরা বাংলাদেশের মানুষ, মাঝেমধ্যেই এমনতর বিরুদ্ধ প্রয়াস কম হয়নি। সাধারণকে বোকা বানিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছে।
এমন একটা সময় গেছে যখন 'পাকিস্তানি সংস্কৃতি', 'মুসলিম সংস্কৃতি'_মুরবি্বরা এই জাতীয় ধারণা বিশ্বাস অনুপ্রবেশ করিয়ে দেওয়ার ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
সূত্রপাত প্রাক-সাতচলি্লশ কাল থেকেই, তখন পাকিস্তানি জজবা-জিগির দানা বেঁধে উঠছে। সে আমলে কলকাতায় গঠিত হয়েছিল 'পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি,' ঢাকায় 'পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ। উভয়েরই লক্ষ্য 'জাতীয় তমদ্দুন' নির্মাণ। ধর্ম যেহেতু মূলে মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য, অতএব অবশ্যই তা সমগ্র সাংস্কৃতিক চেতনার অন্যতম উপকরণ বিশেষ। তবে কোনো ভৌগোলিক এলাকার অধিবাসী সব মানুষের জন্য কেবল ধর্মেরই লেবেল-আঁটা সাংস্কৃতিক পরিচিতি_এমন হয় না। হওয়াবার জোর খাটালে তা স্বাভাবিকত্বের বিরোধী হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে এসেছিল আরেক ভজকট কাণ্ড 'পাকিস্তানি সংস্কৃতি'। পূর্ব-পশ্চিম দুই পাকিস্তানি অংশের মধ্যে ফারাক বিচ্ছিন্নতা দেড়-দুই হাজার মাইলের, ভূপ্রকৃতি-আবহাওয়া সম্পূর্ণতই বিপরীতমুখী, উভয় অঞ্চলের মানুষের নৃতাত্তি্বক গঠনে ক্ষীণতম সাযুজ্যও নেই। এবং প্রাগৈতিহাসিক কালাবধি বেড়ে ওঠা মানুষরা কেউ কাউকে মোটেই চেনে না এবং ছিল ভাষার ক্ষেত্রে, আচার-আচরণের, সংস্কারের মূল্যবোধে ভিন্নতা যোজন যোজনব্যাপী। তার পরও রাষ্ট্রীয় ঘোষণা_Pakistan has come to stay, যুগপৎ 'এক অবিভাজ্য পাকিস্তানি সংস্কৃতি'র যৌক্তিকতার প্রচারণা তুঙ্গে উঠেছিল। চেষ্টা কম হয়নি। আমরাই মুখোমুখি হয়েছি রেডিও পাকিস্তান প্রচারিত বাংলা 'এলানে'র এবং সরকারি পত্রিকা 'পাকজমহুরিয়াৎ', 'মাহেনও'-এর আর 'দৈনিক আজাদে'র 'নওবাহারে'র। পাকিস্তানি বাংলা, পাকিস্তানি সংস্কৃতি শেখানোর প্রবল প্রয়াস করা হয়েছিল। উদ্ভট এক উত্তরাধিকার সম্পর্ক বন্ধনের প্রয়াস ছিল সিন্ধিকবি লতিফ ভিট্টি, পশ্তু কবি খুশহাল খান যাটকের সঙ্গে। সর্বোপরি বলা হতো, পাঞ্জাবি কবি দার্শনিক আল্লামা ইকবাল বাঙালি আমাদের প্রেরণার উৎস। আরো ছিল পাকিস্তান কাউন্সিল, ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন_এই জাতীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় কর্মকাণ্ড। যে করেই হোক, এতদঞ্চলের বাঙালিকে মানাতেই হবে 'Five thousand Years of Pakistan''-এর ঐতিহ্য-মহিমা। এভাবে শাসকমর্জিতে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া, বিশেষ করে তা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, কতটা বাস্তব সম্ভব? প্রচারণায় শেষ অবধি আমরা বিভ্রান্ত হইনি। ওদের বলপ্রয়োগে বশীভূত পরাস্ত হইনি। আমাদের দিক থেকে বরং প্রতিরোধ সংগঠিত হতে থাকে। আপন সন্ধানে আমরা অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠি। আপন সংস্কৃতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠি। জানা সত্যটা এখানে পুনর্বার স্মরণ করব_সংস্কৃতিবিষয়ক মৌল কর্মকাণ্ড প্রধানতই দেশজ, লোকজ এবং পুরুষ পরম্পরায় বহমান। কালে-কালান্তরে তাতে বহিরাগত নানা বিচিত্র উপকরণের সমাবেশ ঘটে। অতঃপর গ্রহণ-বর্জনের মিথস্ক্রিয়ায় এক সংস্কৃতির সৌধ নির্মিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে সংস্কৃতির ইতিহাস এই প্রচারের।
আরেকটা কথা। সাধারণত আমাদের ধারণা, কেবল সুকুমার শিল্পচর্চা নির্ভর কতিপয় কর্মকাণ্ডের বলয়েই যেন 'সংস্কৃতি'র চিহ্নিত অঙ্গনের অবস্থান। যথা_সংগীত, নৃত্য, অভিনয়, চারুকলা ইত্যাদি তাবৎ কৃতি। আসলে কি তাই? এ যে সহস্র সহস্র মানুষের দীর্ঘকালব্যাপী যাপিত জীবনের ব্যাপার, তার মানসভুবনে নানা আন্দোলনের ব্যাপার। সব কিছুর সমন্বয়েই সেই সৃজন। যাকে বলি সংস্কৃতির ফসল। তখন তা সুন্দরে রূপ নেয়। আফ্রিকার আদিবাসী রমণী তার নাক ফুঁড়ে কলক পরিয়ে দেয়, এই উপমহাদেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাঁওতাল কিশোরী যুবতীর কেশসজ্জা, কি বাংলাদেশের গ্রামীণ বধূর নকশিকাঁথা সেলাই, কাঁসা-পিতল কারিগরের হাতে তৈজস নির্মাণ_মূলে ক্রিয়া করে একই ব্যাপার, নানা রূপান্তরে। যখন বিচরণ পরিশীলিত সূক্ষ্মতায় কিংবা মহৎ বিশালতায়, কখনো তা বেঠোফেনের সিম্ফনি, বিসমিল্লা খানের সানাই, কি বরোবুদুরে স্থাপত্য, দিনাজপুরে কান্তজির মন্দির, যমুনাতীরে তাজমহল। এই প্রকারের নানা সম্ভার সৃজনশীল শিল্প-সংস্কৃতির নানা অঙ্গনে।
সংস্কৃতি বিষয়ে সহজ কথাটা কী? আপন বুঝটা বলি। ইংরেজিতে culture বাংলায় কৃষ্টি, সংস্কৃতি। এমনভাবে লক্ষ করা যেতে পারে, মানুষের আদি ও আসল প্রয়োজনই তো কাজ করা, বেঁচে থাকবার তাগিদেই। অতিদূর অস্বচ্ছ অতীতে এই মানুষ অরণ্যচারী পশুতুল্য ছিল, বর্বর প্রাণীর অধিক নয়। সভ্য হলো কবে থেকে? নৃবিজ্ঞানী ঐতিহাসিক জানাচ্ছেন, যবে থেকে আগুনের আবিষ্কার এবং যবে থেকে চাষাবাদের, কৃষির কর্ম। সূচনায় কৃষি। কী সরল জবাব, তাই থেকে চূড়ান্তে কৃষ্টি। এই ক্ষেত্রে এমন একটি ব্যাখ্যার সন্ধান করা যেতে পারে। সহজ কথাটা তাই। মুষ্টিমেয় কয়েকজন, তারা পরশ্রমনির্ভর, সামাজিক প্যারাসাইট, তাদের ছাড়া প্রাকৃত সাধারণ কোটি মানুষ, সবাই সম্পূর্ণত খেটে খাওয়া শ্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেই শ্রম উৎপাদনের কাজটি করে থাকে। তবে পশুরও তো ভূমিকা অনুরূপ। কিন্তু মানুষের বেলাতেই বিশেষ আরো থেকে যায়। তা হচ্ছে, সুন্দর করে বাঁচা, সুন্দর করতে চাই, সুন্দরকে পেতে চাই। মানুষের সহজাত প্রকৃতি এইখানে। অতএব আমার যত কিছু কাজ, যা কিছু ভাবনা শেষ অবধি সুন্দরে ধাবিত। তাকেই বলা হয়েছে, 'সভ্যতাজনিত উৎকর্ষ সাধন'। এখন 'কৃষ্টি'ই বলি আর 'সংস্কৃতি'ই বলি, কর্মভিত্তিক এই উভয় শব্দবাচক কাণ্ড সম্পাদন থেকে মানুষের অভিযাত্রা উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে।
ইতিপূর্বে আমাদের পাকিস্তানি অভিজ্ঞতার কথা বলা গেছে। সাম্প্রতিককালের আরেক অভিজ্ঞতা আশির দশকে স্বৈরশাসনের আমলে। সরকারি উদ্যোগে তখন সংস্কৃতি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। অর্থাৎ সরকারের বশংবদ ওই কমিশনই রচনা করে দেবে। সংস্কৃতির ব্যবস্থাপত্র, জারি করবে সংস্কৃতিবিষয়ক নির্দেশনামা। এটাকে কী বলব? হাজার বছর ধরে প্রজন্ম-পরম্পরায় হয়ে ওঠা যে কর্মকাণ্ড, স্বতোবিকাশের যে ধারা বিবর্তন, সেই 'সহজ'টাকে বিপর্যস্ত করে দেওয়ার এবং মর্জি মোতাবেক নিয়ন্ত্রণ করবার প্রাসাদ-কূট প্রয়াস ব্যতীত আর কী।
সাধারণের স্বার্থে সহজ সত্যকে অর্জন করে নেওয়ার জন্য সেই অশুভ প্রয়াসকে লড়তে হয়েছিল। সে কারণেই কঠিন। তবে শাশ্বত সত্য এই যে শেষ অবধি সেই 'সত্যে'র হার নেই।
লেখক : শিক্ষাবিদ
সহজ কেন? মানুষের জন্যই তো সংস্কৃতি। তাই সহজ। পণ্ডিতরা অবশ্য নানাবিধ সংজ্ঞা ব্যাখ্যা দান করে থাকেন। তাঁদের পর্যালোচনার অন্ত নেই। সে পাড়ায় থাকুক পাণ্ডিত্যের যাবতীয় বিতর্ক-বিশ্লেষণ। বলা গেছে তো আমরা সহজ করে বুঝতে চাই। মানুষ 'মানুষ' বলেই আপন তার সংস্কৃতি। তার সমুদয় কর্মকাণ্ডটা নিশ্চিতই দেশনির্ভর, বহতা কালনির্ভর। এ আমদানি করে প্রবিষ্ট করিয়ে দেওয়া যায় না, ওপর থেকে ফরমান জারি করে নির্মাণ আদৌ সম্ভব নয়। মন্দভাগ্য আমরা বাংলাদেশের মানুষ, মাঝেমধ্যেই এমনতর বিরুদ্ধ প্রয়াস কম হয়নি। সাধারণকে বোকা বানিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছে।
এমন একটা সময় গেছে যখন 'পাকিস্তানি সংস্কৃতি', 'মুসলিম সংস্কৃতি'_মুরবি্বরা এই জাতীয় ধারণা বিশ্বাস অনুপ্রবেশ করিয়ে দেওয়ার ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
সূত্রপাত প্রাক-সাতচলি্লশ কাল থেকেই, তখন পাকিস্তানি জজবা-জিগির দানা বেঁধে উঠছে। সে আমলে কলকাতায় গঠিত হয়েছিল 'পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি,' ঢাকায় 'পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ। উভয়েরই লক্ষ্য 'জাতীয় তমদ্দুন' নির্মাণ। ধর্ম যেহেতু মূলে মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য, অতএব অবশ্যই তা সমগ্র সাংস্কৃতিক চেতনার অন্যতম উপকরণ বিশেষ। তবে কোনো ভৌগোলিক এলাকার অধিবাসী সব মানুষের জন্য কেবল ধর্মেরই লেবেল-আঁটা সাংস্কৃতিক পরিচিতি_এমন হয় না। হওয়াবার জোর খাটালে তা স্বাভাবিকত্বের বিরোধী হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে এসেছিল আরেক ভজকট কাণ্ড 'পাকিস্তানি সংস্কৃতি'। পূর্ব-পশ্চিম দুই পাকিস্তানি অংশের মধ্যে ফারাক বিচ্ছিন্নতা দেড়-দুই হাজার মাইলের, ভূপ্রকৃতি-আবহাওয়া সম্পূর্ণতই বিপরীতমুখী, উভয় অঞ্চলের মানুষের নৃতাত্তি্বক গঠনে ক্ষীণতম সাযুজ্যও নেই। এবং প্রাগৈতিহাসিক কালাবধি বেড়ে ওঠা মানুষরা কেউ কাউকে মোটেই চেনে না এবং ছিল ভাষার ক্ষেত্রে, আচার-আচরণের, সংস্কারের মূল্যবোধে ভিন্নতা যোজন যোজনব্যাপী। তার পরও রাষ্ট্রীয় ঘোষণা_Pakistan has come to stay, যুগপৎ 'এক অবিভাজ্য পাকিস্তানি সংস্কৃতি'র যৌক্তিকতার প্রচারণা তুঙ্গে উঠেছিল। চেষ্টা কম হয়নি। আমরাই মুখোমুখি হয়েছি রেডিও পাকিস্তান প্রচারিত বাংলা 'এলানে'র এবং সরকারি পত্রিকা 'পাকজমহুরিয়াৎ', 'মাহেনও'-এর আর 'দৈনিক আজাদে'র 'নওবাহারে'র। পাকিস্তানি বাংলা, পাকিস্তানি সংস্কৃতি শেখানোর প্রবল প্রয়াস করা হয়েছিল। উদ্ভট এক উত্তরাধিকার সম্পর্ক বন্ধনের প্রয়াস ছিল সিন্ধিকবি লতিফ ভিট্টি, পশ্তু কবি খুশহাল খান যাটকের সঙ্গে। সর্বোপরি বলা হতো, পাঞ্জাবি কবি দার্শনিক আল্লামা ইকবাল বাঙালি আমাদের প্রেরণার উৎস। আরো ছিল পাকিস্তান কাউন্সিল, ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন_এই জাতীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় কর্মকাণ্ড। যে করেই হোক, এতদঞ্চলের বাঙালিকে মানাতেই হবে 'Five thousand Years of Pakistan''-এর ঐতিহ্য-মহিমা। এভাবে শাসকমর্জিতে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া, বিশেষ করে তা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, কতটা বাস্তব সম্ভব? প্রচারণায় শেষ অবধি আমরা বিভ্রান্ত হইনি। ওদের বলপ্রয়োগে বশীভূত পরাস্ত হইনি। আমাদের দিক থেকে বরং প্রতিরোধ সংগঠিত হতে থাকে। আপন সন্ধানে আমরা অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠি। আপন সংস্কৃতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠি। জানা সত্যটা এখানে পুনর্বার স্মরণ করব_সংস্কৃতিবিষয়ক মৌল কর্মকাণ্ড প্রধানতই দেশজ, লোকজ এবং পুরুষ পরম্পরায় বহমান। কালে-কালান্তরে তাতে বহিরাগত নানা বিচিত্র উপকরণের সমাবেশ ঘটে। অতঃপর গ্রহণ-বর্জনের মিথস্ক্রিয়ায় এক সংস্কৃতির সৌধ নির্মিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে সংস্কৃতির ইতিহাস এই প্রচারের।
আরেকটা কথা। সাধারণত আমাদের ধারণা, কেবল সুকুমার শিল্পচর্চা নির্ভর কতিপয় কর্মকাণ্ডের বলয়েই যেন 'সংস্কৃতি'র চিহ্নিত অঙ্গনের অবস্থান। যথা_সংগীত, নৃত্য, অভিনয়, চারুকলা ইত্যাদি তাবৎ কৃতি। আসলে কি তাই? এ যে সহস্র সহস্র মানুষের দীর্ঘকালব্যাপী যাপিত জীবনের ব্যাপার, তার মানসভুবনে নানা আন্দোলনের ব্যাপার। সব কিছুর সমন্বয়েই সেই সৃজন। যাকে বলি সংস্কৃতির ফসল। তখন তা সুন্দরে রূপ নেয়। আফ্রিকার আদিবাসী রমণী তার নাক ফুঁড়ে কলক পরিয়ে দেয়, এই উপমহাদেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাঁওতাল কিশোরী যুবতীর কেশসজ্জা, কি বাংলাদেশের গ্রামীণ বধূর নকশিকাঁথা সেলাই, কাঁসা-পিতল কারিগরের হাতে তৈজস নির্মাণ_মূলে ক্রিয়া করে একই ব্যাপার, নানা রূপান্তরে। যখন বিচরণ পরিশীলিত সূক্ষ্মতায় কিংবা মহৎ বিশালতায়, কখনো তা বেঠোফেনের সিম্ফনি, বিসমিল্লা খানের সানাই, কি বরোবুদুরে স্থাপত্য, দিনাজপুরে কান্তজির মন্দির, যমুনাতীরে তাজমহল। এই প্রকারের নানা সম্ভার সৃজনশীল শিল্প-সংস্কৃতির নানা অঙ্গনে।
সংস্কৃতি বিষয়ে সহজ কথাটা কী? আপন বুঝটা বলি। ইংরেজিতে culture বাংলায় কৃষ্টি, সংস্কৃতি। এমনভাবে লক্ষ করা যেতে পারে, মানুষের আদি ও আসল প্রয়োজনই তো কাজ করা, বেঁচে থাকবার তাগিদেই। অতিদূর অস্বচ্ছ অতীতে এই মানুষ অরণ্যচারী পশুতুল্য ছিল, বর্বর প্রাণীর অধিক নয়। সভ্য হলো কবে থেকে? নৃবিজ্ঞানী ঐতিহাসিক জানাচ্ছেন, যবে থেকে আগুনের আবিষ্কার এবং যবে থেকে চাষাবাদের, কৃষির কর্ম। সূচনায় কৃষি। কী সরল জবাব, তাই থেকে চূড়ান্তে কৃষ্টি। এই ক্ষেত্রে এমন একটি ব্যাখ্যার সন্ধান করা যেতে পারে। সহজ কথাটা তাই। মুষ্টিমেয় কয়েকজন, তারা পরশ্রমনির্ভর, সামাজিক প্যারাসাইট, তাদের ছাড়া প্রাকৃত সাধারণ কোটি মানুষ, সবাই সম্পূর্ণত খেটে খাওয়া শ্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেই শ্রম উৎপাদনের কাজটি করে থাকে। তবে পশুরও তো ভূমিকা অনুরূপ। কিন্তু মানুষের বেলাতেই বিশেষ আরো থেকে যায়। তা হচ্ছে, সুন্দর করে বাঁচা, সুন্দর করতে চাই, সুন্দরকে পেতে চাই। মানুষের সহজাত প্রকৃতি এইখানে। অতএব আমার যত কিছু কাজ, যা কিছু ভাবনা শেষ অবধি সুন্দরে ধাবিত। তাকেই বলা হয়েছে, 'সভ্যতাজনিত উৎকর্ষ সাধন'। এখন 'কৃষ্টি'ই বলি আর 'সংস্কৃতি'ই বলি, কর্মভিত্তিক এই উভয় শব্দবাচক কাণ্ড সম্পাদন থেকে মানুষের অভিযাত্রা উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে।
ইতিপূর্বে আমাদের পাকিস্তানি অভিজ্ঞতার কথা বলা গেছে। সাম্প্রতিককালের আরেক অভিজ্ঞতা আশির দশকে স্বৈরশাসনের আমলে। সরকারি উদ্যোগে তখন সংস্কৃতি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। অর্থাৎ সরকারের বশংবদ ওই কমিশনই রচনা করে দেবে। সংস্কৃতির ব্যবস্থাপত্র, জারি করবে সংস্কৃতিবিষয়ক নির্দেশনামা। এটাকে কী বলব? হাজার বছর ধরে প্রজন্ম-পরম্পরায় হয়ে ওঠা যে কর্মকাণ্ড, স্বতোবিকাশের যে ধারা বিবর্তন, সেই 'সহজ'টাকে বিপর্যস্ত করে দেওয়ার এবং মর্জি মোতাবেক নিয়ন্ত্রণ করবার প্রাসাদ-কূট প্রয়াস ব্যতীত আর কী।
সাধারণের স্বার্থে সহজ সত্যকে অর্জন করে নেওয়ার জন্য সেই অশুভ প্রয়াসকে লড়তে হয়েছিল। সে কারণেই কঠিন। তবে শাশ্বত সত্য এই যে শেষ অবধি সেই 'সত্যে'র হার নেই।
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments