পথচলা ও সখ্য চিত্রকলায় মেলবন্ধন- খুরশীদ পাটওয়ারী
'দেবে আর নেবে, মেলাবে মিলিবে' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আসত্ম উচ্চারণের সার্থকতা প্রতিনিয়তই উপলব্ধিতে অনুরণন তোলে। কিন্তু এটির ফলপ্রসূতা চূড়ানত্ম ব্যঞ্জনা পায় যখন নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের অনত্ম গত কলকাতার শিল্পী গোষ্ঠীর অংশগ্রহণে ঢাকায় আয়োজিত হয় কোন চিত্র প্রদর্শনীর।
অনাদি অতীতে থেকে সাংস্কৃতিক ঐকতান সমৃদ্ধ এই দুই জনপদের জনগোষ্ঠীর শেকড় আচার কৃষ্টি আর ঐতিহ্যের একটি মেলবন্ধন আছে। মাঝে মধ্যে এ রকম চিত্রপ্রদর্শনী, নাট্য আয়োজন এবং চলচ্চিত্র উৎসবে আমরা এ সত্যের কাছাকাছি এসে মিলিত হই।সম্প্রতি বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাই আর্টসের আয়োজনে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী শিল্পীগোষ্ঠী ক্যালকাটা পেইন্টারসের 'পথচলা ও সখ্য' শীর্ষক চিত্রকলা প্রদর্শনী হয়। শীতের কনকনে ঠা-া হাওয়ায় উদ্বোধনী মেলায় সন্ধ্যায় সমবেত হয়েছেন দুই বাংলার বরেণ্য সব শিল্পী আর শিল্পপিপাসুরা।
মূলত কলকাতা পেইন্টার্সের জন্ম হয়েছিল বিভিন্ন দেশের আর দশটা গোষ্ঠীর মতোই একটি দ্রোহ আর প্রতিবাদের ফলে। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঙ্গীকার আর দায়বদ্ধতা নিয়ে শিল্পীরা একই ছাতার নিচে এসে মিলেছে। মূলতই এ রকম গোষ্ঠীর এটি পৃথক দায় বা অঙ্গীকার থাকে। থাকে একটি সুরের ঐকতান, যা থেকে শিল্পীরা সৃজন করে যান নিজস্ব বৈচিত্র্য আর স্টাইলে। তবে বক্তব্য উপস্থাপনে থাকে হয়ত কোন যোগসূত্র কলকাতা পেইন্টার্সের শিল্পীরা চিত্রকলা অঙ্গনকে সকল প্রকার গতানুগতিকতা থেকে মুক্ত করায় দায় নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। সমকালীন বিষয় ভাবনা, প্রকরণ আর গতানুগতিক রোমান্টিসিজম, স্মৃতিকাতরতায় বুঁদ হয়ে থাকা, প্রকৃতি দর্শনে উদ্বেলিত হয়ে ছবি করাই যখন যথেষ্ট নয়, বরং ঘটে যাওয়া রাজনীত, অর্থনীতি আর জীবনাচরণের ব্যাপকতাকে শিল্পে উঠিয়ে আনাও শিল্পীর অন্যতম দায়িত্ব। এ কারণেই চিত্রশিল্পের অঙ্গনে প্রবহমান ধারাকে প্রথামুক্ত করার প্রয়াস নেন কলকাতা পেইন্টার্সের শিল্পীরা ১৯৬৪ সালে আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে।
প্রদর্শনী উপলৰে মুদ্রিত প্রকাশনায় যথার্থভাবেই উলিস্নখিত হয়েছে "ষাটের দশকের প্রারম্ভের পটভূমিতে কলকাতার শহরের সামাজিক-রাজনৈতিক আবহে ও বাসত্মবতায় এ গোষ্ঠীর জন্ম। মুগ্ধ রোমান্টিকতাকে পরিহার ছিল একদিকে প্রথা থেকে মুক্তি, গতানুগতিকতা থেকে মুক্তি, অন্যদিকে জীবনের নানা দিককে ক্যানভাসে ও সৃষ্টিতে প্রতিফলন, চিত্র শিল্পগুণ সংস্কার এবং রূপায়ণ ও সৃষ্টিতে আধুনিকতা বোধের উজ্জীবন। গোষ্ঠীসদস্যদের এ দায় ও অঙ্গীকারই তাঁদের দীর্ঘ পথচলায় প্রেরণা যুগিয়েছে।"
প্রদর্শনীর নামকরণ 'পথচলা ও সখ্য' অত্যনত্ম সার্থক হয়েছে। সৃষ্টিশীলতার অবিরাম বন্ধুর পথচলায় সখ্য থাকাটা কম কথা নয়। বাংলাদেশের আয়োজিত ও প্রদর্শনীর উদ্বোধনী পরিবেশে এটি আরও যথাযথ প্রতীয়মান। মোট ৫২টি শিল্পকর্ম নিয়ে আয়োজিত ও প্রদর্শনীতে ২৬ শিল্পীর কাজ উপস্থাপিত হয়েছে। তেল, এক্রিলিক, কালি, কলম, ব্রাশ এবং মিশ্র মাধ্যমে অধিকাংশ চিত্রকর্ম সৃজিত হয়েছে। বিষয় বৈচিত্র্য, ফর্ম এবং চিত্রকর্ম নির্বিশেষে করণ কৌশল ও ভিন্ন ভিন্ন। এসব বৈচিত্র্য নিয়েও গোষ্ঠীগত ঐক্য স্থাপিত হয়েছে।
শিল্পী অনিমেষ নন্দীর 'দি কনভারসেশন' শীর্ষক তেল রঙের ছবিতে দেখা যায় নীল আকাশে এক চিলতে, বোধ করি একদিন বয়েসী চাঁদ। নিচে নীলাভ শুভ্র মেঘ আর তার প্রতিছবি আছে জলে। গাঢ় আর হালকা নীলের সনি্নবেশে ছবিটি অনবদ্য হয়েছে। চাঁদ, মেঘ, জল সবকিছুর মিতালীতে যেন ভিন্ন এক সংলাপ রচিত হয়েছে।
শিরোনামহীন শিরোনামে প্রবীণ শিল্পী বিজন চৌধুরীর ক্যানভাসে আশ্রিয় হয়েছে পেশল এক মর্দমান পুরম্নষ নৌকার গুন টানছে। আকাশে পূর্ণচন্দ্র আর ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে পরীর রানী। জলাশয় আকাশ, স্থলের সবুজ ফসল সবকিছুর কম্পোজিশনে ছবিটি নান্দনিক আবহ পেয়েছে। ছবির ফর্ম বুনট এবং জ্যামিতিক কাজ অনুসরণীয়।
যোগেন চৌধুরী আর রবিন ম-ল দুজনই প্রাজ্ঞ শিল্পী। মুখমন্ডকে উপজীব্য করেই দু'জনে ছবি করেছেন। কিন্তু মাধ্যম কৌশল রং আর বিন্যাসে রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য। যোগেন চৌধুরী মোটা ব্রাশের অাঁচড়ে কয়েকটি মাত্র রেখায় আড়াআড়ি কাগজের ওপর মুখাবয়বের একপাশ এঁকেছেন। রবিন ম-লের মুখম-ল এক্রিলিকে সরাসরি ঋজু দেহ আর প্রখর দৃষ্টি সমেত উপস্থাপিত।
যৌথ প্রদর্শনীতে সচারচর যা হয়ে থাকে এখানেও গোষ্ঠীর সদস্যবৃন্দ অভিজ্ঞতা বয়স আর উপস্থাপনে ভিন্নতা নিয়ে ছবি সৃজন করেছেন। ত্রিশের দশকের শিল্পী যেমন আছেন তেমনি সত্তরের শিল্পীও এই গোষ্ঠীতে আছেন। প্রাজ্ঞতা, অভিজ্ঞতা, তারম্নণ্য সব কিছুর সনি্নবেশ ঘটেছে।
প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীবৃন্দ :
অমিতাভ সেনগুপ্ত, অনিমেষনন্দী, অনিতা রায় চৌধুরী, বিজন চৌধুরী, বিপিন গোম্বামী, দেবব্রত চক্রবর্তী, ধীরাজ চৌধুরী, দ্বিজেন গুপ্ত, গৌতম ভৌমিক, ইসা মোঃ যোগেন চৌধুরী, নিখিলেশ দাস, নীরেন সেনগুপ্ত, প্রদীপ ম-ল, প্রকাশ কর্মকার, রবীন ম-ল, শ্যামশ্রী বসু, শিবাপ্রসাদ কর চৌধুরী, সবুত ঘোষ, শুভব্রত নন্দী, সুদীপ ব্যানার্জি, সুশানত্ম চক্রবর্তী, তপন মিত্র এবং ওয়াসিম কাপুর।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশন শিল্পীদের শৈলী ও ভাবনা বিনিময়ের জন্য মধুমতি নদীর সনি্নকটে নড়াইলে 'অরম্ননিমা ক্যান্টি সাইড এ্যান্ড গলফ রিসট'-এ বাংলাদেশ ও কলকাতা পেইন্টারের শিল্পীগণের সমন্বয়ে মধুমতি আর্ট ক্যাম্প ২০১০ এর আয়োজন করেছে। এতে করে দু'দেশের শিল্পীগণের দেয়ানেয়ায় শিল্পের যা কিছু অর্জন হবে তা আমাদের আরও সমৃদ্ধ করবে।
No comments