আমিও ভাইয়ের সমান- আফসা পারভীন
১৯৯৭ সালের ৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করেছিলেন যা ছিল এদেশের নারী উন্নয়নের জন্য একটি উলেস্নখযোগ্য পদৰেপ। এ নীতি নারীর ব্যক্তি অধিকার প্রতিষ্ঠায় শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়।
নীতির ৭.২ নম্বর ধারায় নারীর অর্থনৈতিক মতায়নের জন্য উত্তরাধিকার, সম্পদসহ ভূমির ওপর অধিকারে পূর্ণ ও সমান সুযোগ এবং নিয়ন্ত্রণের অধিকার ঘোষণা করা হয়। সে ল্যে প্রয়োজনীয় নতুন আইন প্রণয়নের কথা বলা হয় যা খুবই ইতিবাচক ছিল এবং নারীদের আশাবাদী করেছিল। কিনত্মু পরবর্তী সরকারের উদাসীনতার কারনে এনীতির বাসত্মবায়ন হয়নি। তবে রোকেয়া পদক ২০০৯ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পত্তিতে সমান অধিকার বিষয়ে তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনার কথা বলেছেন। বলেছেন সময় হলেই তিনি তা প্রকাশ করবেন।সম্পত্তিতে সমান অধিকার ও উত্তরাধিকার আইন বিষয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলীর কাছে। তিনি তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্যে বলেন, "বর্তমান গণতান্ত্রিক এবং নারীবান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই নারীর সম্পত্তির অধিকারের সঙ্গে নারীর মতায়নের অত্যনত্ম যোগসূত্রতার বিষয়টি উপলব্ধি করেন। এ েেত্র নারী-পুরম্নষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা বর্তমান সময়ের একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ নারী-পুরম্নষ সমতাবিষয়ক আনত্মর্জাতিক দলিল সিডও (নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ) অনুস্বার করলেও এর পূর্ণ অনুমোদন আজও করেনি। ফলে নারীর সকল অধিকার বিশেষ করে সম্পত্তির েেত্র সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বেশ জটিল অবস্থায় রয়েছে।
প্রচলিত আইন, সামাজিক প্রথা এবং নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নারীর সম্পত্তির অধিকারকে বৈষম্যপূর্ণ করে রেখেছে। বাংলাদেশের উত্তরাধিকার সূত্রে নারীর অংশপ্রাপ্তি নির্ভর করে ব্যক্তিগত আইন বা ধর্মীয় আইনের ওপর। যেমন মুসলিম ধমর্ীয় নারীর সম্পত্তির অধিকার তার ব্যক্তিগত আইন অর্থাৎ মুসলিম (কোরানিক) আইনের ওপর নির্ভর করে। একজন মুসলমান মেয়ে তার উত্তরাধিকার হিসেবে পিতা-মাতার সম্পত্তি এক পুত্র সমান দুই কন্যা, একমাত্র মেয়ে হলে পিতার বা মাতার সম্পত্তির অর্ধেক বা দুই-এর একাংশ এবং একের অধিক মেয়ে হলে দুই-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি পায়। এ েেত্র পুত্র সনত্মান না থাকলে বা শুধুমাত্র কন্যা সনত্মান থাকলে কন্যা সনত্মান যা পাবে তার দ্বিগুণ অংশ মৃত ব্যক্তির সহোদর ভাইগণ পাবেন। কিনত্মু কন্যা সনত্মান না থাকলে পুত্র অবশিষ্টভোগী হিসেবে সম্পত্তির অংশ পাবেন। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, নারীর সম্পত্তির অধিকার অর্জনের েেত্র প্রচলিত আইনেই রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। স্ত্রীর েেত্র সনত্মান না থাকলে স্ত্রী চার-এর এক অংশ এবং সনত্মান না থাকলে স্ত্রী আটের এক অংশ সম্পত্তি পায়। তবে প্রচলিত আইনে সম্পত্তির যে অংশ বিধবা নারী পায় সে সম্পত্তি থেকেও তাকে বঞ্চিত করার নানা কৌশল অবলম্বন করে মৃত স্বামীর উত্তরাধিকারীগণ।
রাষ্ট্রীয় সংবিধানের ৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, দখল ও হসত্মানত্মরের অধিকার রয়েছে। এ েেত্র মুসলিম আইন অনুযায়ী দান, বিক্রয় এবং সম্পত্তি ভোগদখলের অধিকার মুসলিম মহিলার রয়েছে। এছাড়া একজন মুসলমান তার সম্পত্তি যে কাউকে হেবা বা দান করতে পারেন।
১৯৬১ সালে মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে কিছু সংশোধন আনা হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, পিতা বা মাতার জীবিত অবস্থায় কন্যা বা পুত্রের মৃতু্য হলে ঐ মৃত পুত্র বা কন্যার সনত্মানরা সম্পত্তির সেই অংশ পায় যা তার দাদা-দাদি বা নানা-নানির মৃতু্যর পর তার বাবা বা মা পেত। সুতরাং কোরানিক আইন হলেও ১৯৬১ সালে মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে কিছু সংশোধন এনে নজির স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশে এখনও প্রচলিত রয়েছে ১৯৩৭ সালের হিন্দু মহিলার সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন যেখানে সহোদর ভগি্নও উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির অংশীদার নয়। কেবলমাত্র বিধবা, কন্যা, মাতা, পিতামহী, প্রপিতামহী জীবনকাল পর্যনত্ম স্বত্ব এবং স্বত্ব হসত্মানত্মরের অধিকারহীনভাবে স্বামী বা পুত্রের ত্যক্ত সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পত্তি পায়। খ্রীস্টান নারীদের সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠায় খ্রীস্টান উত্তরাধিকার আইন অত্যনত্ম ইতিবাচক। এখানে তেমন বৈষম্য পরিলতি হয় না।
আমরা প্রত্যাশা করি, নারীর মতায়নের েেত্র সম্পত্তির প্রশ্নে বাংলাদেশের সকল ধর্মের সকল নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার সচেষ্ট হবে এবং কার্যকর পদপে গ্রহণ করবে।"
উবিনিগ নির্বাহী পরিচালক এবং নারী নেত্রী ফরিদা আক্তার বলেন, সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবি। যদিও এ বিষয়টি কেবল নারী উন্নয়ন নীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাসত্মবায়ন হয়নি। এটা কেবল আলাপ আলোচনার বিষয় নয়। সমাজে এই বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতা দেখা যায় না। কিনত্মু নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুসলিম আইন, হিন্দু আইন সংশোধন করে সকল ধর্মের জন্য একই আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। আমরা আশা রাখি সরকার এই বিষয়টি গুরম্নত্ব সহকারে দেখবে। অচিরেই বাসত্মবায়নে এগিয়ে আসবে।
এ বিষয়ে আরও মতামত প্রদান করেন আইনজীবী মাহদীন মালিক। তাঁর মতে, 'সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার এটা নীতিগতভাবে হওয়া উচিত। কিন্তু নতুন আইন প্রণয়ন করতে গেলে অনেক ধরনের আইনী জটিলতা রয়েছে। এই বিষয়টির সঙ্গে প্রথা জীবনধারার ব্যাপার জড়িত। সমাজের সর্বসত্মরে এর গ্রহণযোগ্যতা থাকা দরকার। তাই সরকারের উচিত হবে বিশদভাবে চিনত্মা-ভাবনা করে ব্যাপারটার সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া।' প্রকৃতপ েনারীর অর্থনৈতিক মতায়নের েেত্র সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় সমাজের সর্বসত্মরের মানুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। বিশেষ করে পুরম্নষতান্ত্রিক সমাজে পুরম্নষদের কাছে এই বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতা সবার আগে দরকার। কিনত্মু দুঃখজনক হলেও সত্য অনেকেই বিষয়টি মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না।
যেমন, মিরপুরে বসবাসকারী মোঃ আলম বলেন, 'বর্তমান আইনে নারীর জন্য যতটুকু অধিকার রয়েছে, তাই সঠিক। এর বাইরে চিনত্মা করা উচিত হবে না।' রেজাউল করিমের দায়সারা উত্তর, উত্তরাধিকার আইন সংশোধন হতে পারে। হলে মন্দ হবে না। কেউ কেউ বিষয়টি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেনি। অনেকেই মনত্মব্য করা থেকে বিরত থাকেন। পল্পবী জামে মসজিদের ইমাম সাহেবের মতে, 'মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক এবং পরিপূর্ণ আইন। এ আইন সংশোধন করা কখনই উচিত হবে না।' নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণায় মৌলবাদী গোষ্ঠী এই আইনের বিরোধী যে জবাব এবং ভাংচুর করে প্রতিবাদ করে তা নারী সমাজের কাম্য নয়। প্রতিবাদের বা বিরোধিতার ভাষা ভাংচুর হতে পারে না। তাই নারীর মতায়নের েেত্র পুরম্নষ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হওয়া দরকার। তবে কেউ কেউ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। তাদের মতে, নারী-পুরম্নষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং নারীকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার েেত্র সম্পত্তিতে সমান অধিকার হওয়া উচিত। নৈতিকভাবে এটা সমর্থন করা উচিত।
বাসত্মবিকপ েসম্পত্তিতে সমঅধিকার নারী সমাজের কাছে যতটা গুরম্নত্বপূর্ণ একজন পুরম্নষ মানুষের কাছে ততটি গুরম্নত্বপূর্ণ হওয়া উচিত এটাই নারী সমাজের কাম্য। কেননা, জীবনের সর্বেেত্র নারী-পুরম্নষের সম অংশীদারিত্ব ও সমঅধিকার ছাড়া কোন দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমরা যদি বিশ্বের বিভিন্ন নারী সম্মেলন এবং জাতিসংঘ ঘোষিত সিডও সনদসহ অন্যান্য কর্মসূচী ল্য করি তাহলে দেখব নারী-পুরম্নষের সমঅধিকারের কথা প্রাধান্য পেয়েছে। তাই দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে নারী-পুরম্নষের সমতার জন্য নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সরকার গৃহীত পদেেপর সঠিক বাসত্মবায়ন আশু প্রয়োজন।
No comments