উপমহাদেশ- বৈশাখে এসিড টেস্ট পশ্চিমবঙ্গে by অমিত বসু
বৈশাখের প্রখর তাপকে আরও বাড়িয়ে দেবে নির্বাচনী যুদ্ধ। রাজ্যজুড়ে প্রচারের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ভুল শোধরাতে বাম নেতাকর্মীরা মানুষের দরজায় দরজায় কড়া নাড়ছে। তৃণমূলও কম যায় না। তারাও ছুটছে গ্রামগঞ্জে
গরমের শত্রু রোদ শীতের মিত্র। তা হোক, কিন্তু রবিরশ্মিতে যে বিষ। তার তেজোদ্দীপ্ত শক্তিতে মিশে আছে অতি বেগুনি রশ্মি। যার প্রভাবে ত্বকে ক্যান্সারের শঙ্কা। তাকে ঠেকাতে পারে পৃথিবীর ত্রিশ কিলোমিটার ওপরের 'ওজোন স্তর'। যেটা ছাঁকনির কাজ করে। আধুনিক সভ্যতা সেটা ধ্বংস করছে। বিমান নিদ্বর্িধায় ওজোন স্তরে প্রবেশ করে বর্জ্য গ্যাস ছড়াচ্ছে। রাসায়নিক সার থেকে উৎপন্ন নাইট্রোজেন অক্সাইড ওজোন স্তরকে ছিন্নভিন্ন করছে। ছেঁড়া ছাঁকনি দিয়ে গলে পড়ছে হলাহল। দোষটা সূর্যের না পৃথিবীর তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। ঘটনাটা সত্যি। রাজনীতির অবস্থাও দিবাকরের মতো। প্রখর কিরণের সঙ্গে বিপদের আহ্বান। তার থেকে রক্ষা করতে পারত মূল্যবোধ। নৈতিক দূষণে ওজোন স্তরের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা তারও। ক্ষইতে ক্ষইতে নিঃশেষ। আতান্তরে সমাজ সংসার মানুষ। রাজনীতির কথা বললে লোকে শিউরে ওঠে। শহর-গ্রাম-গঞ্জে রক্তের বিভীষিকা টের পায়। কালো টাকার উল্লাসে মুহ্যমান হয়। বিস্ফোরিত নেত্রে প্রত্যক্ষ করে মূল্যবোধহীন রাজনীতির খেলা। ভোটের মুখে সেই সংকট পশ্চিমবঙ্গে।
কে হারবে কে জিতবে সে প্রশ্ন বাদ দিয়ে শুধু আর্ত জিজ্ঞাসা, মানুষ বাঁচবে তো। মাটি আর রক্তে ভিজবে না তো। উত্তর নেই। রক্তপাতের রাজনীতি বন্ধের গ্যারান্টি কেউ দিচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলো এ ওর ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। বিজ্ঞজনের অভিমত, নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত এরকম চলবেই। এক ইঞ্চি জমির জন্য যুদ্ধ। পাওয়ার গেমে রক্ত তুচ্ছ।
উদ্বেগে নির্বাচন কমিশন। দায় আপাতত তাদের। ভোটের কাঁটা উপড়াতে চেষ্টার কসুর নেই। পশ্চিমবঙ্গে একদিনে ভোট করা যাবে না ধরে নিয়ে ছ'দিনে শেষ করার আয়োজন। ভোট শুরু ১৮ এপ্রিল। সব থেকে আগে ভোট আসামে। সেখানে দু'দফায় ভোট। ৪ আর ১১ এপ্রিল। ১২৬ আসনে বিধানসভায় কংগ্রেস আধিপত্য প্রশ্নের মুখে। তামিলনাড়ূর ২৩৪, কেরালার ১৪০ এবং পুদুচেরির ৩০ আসনে ভোট ১৩ এপ্রিল। একদিনেই তিন রাজ্যের ভোট মিটবে। চার রাজ্যে ভোট শেষ হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের পালা। নির্বাচন কমিশনের দুশ্চিন্তা এই রাজ্যকে নিয়ে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশির অতিরিক্ত সচেতনতা। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ঘেরাটোপ। রাজ্য পুলিশের সঙ্গে থাকবে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী। অন্য চার রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার আসন বেশি। আসন সংখ্যা ২৯৪। ভোটার ৫ কোটি ৬০ লাখ। রাজ্যের ১৯টি জেলাতে হিংসার দাঁত ক্রমেই ধারালো হচ্ছে। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার আন্দোলনে দার্জিলিং অশান্ত। উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বারুদের গন্ধ। অন্ধ আক্রমণে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ছারখারে মরিয়া। পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া আর বীরভূমের একাংশে মাওবাদী নৃশংসতা অব্যাহত। তাদের হাত থেকে রক্ষা নেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা শিশুরও। যৌথ বাহিনীর তীব্র প্রতিবাদে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ এলেও তারা নিশ্চিহ্ন হয়নি। পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে তাদের আস্তানা। সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে নাশকতা চালিয়ে ফিরে যাচ্ছে। মাওবাদী শিবিরে মজুদ বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার। রকেট লঞ্চার থেকে একে ৪৭, কিছুই বাদ নেই। বুভুক্ষু মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির দাবিতে তারা লড়ছে। গণতন্ত্রে তাদের বিশ্বাস নেই। বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস বলে মনে করে। পিছিয়ে পড়া মানুষকে এগিয়ে আনার কোনো কর্মসূচি তারা পেশ করেনি বরং অস্ত্র কেনায় ব্যয় বাড়াচ্ছে। কোটি কোটি টাকা খোলামকুচির মতো উড়ছে। মাওবাদী শীর্ষনেতা কিষেণজীর ঘোষণা, তৃণমূল সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া অন্য কেউ মুখ্যমন্ত্রী হলে তিনি মানবেন না।
ধোঁয়াশা এখানেই। দক্ষিণপন্থি তৃণমূলের সঙ্গে চরম বামপন্থিদের আপস কীভাবে সম্ভব। এই জোটের কর্মসূচিই-বা কী? মাওবাদীরা তো ভোট মানে না। তবু তারা মমতার নির্বাচনী জয় আশা করছে কেন? মমতা ক্ষমতায় এলে কি তারা অস্ত্র ছেড়ে মূল স্রোতে ফিরে আসবে? নাকি এটা তাদের রাজনৈতিক কৌশল ক্ষমতার লোভে অন্ধ তৃণমূলকে টোপ দিয়ে বামফ্রন্টকে হটানোই লক্ষ্য। বাকি পাঁচ রাজ্যে মাওবাদীরা যেটুকু সুবিধা করতে পেরেছে পশ্চিমবঙ্গে ততটুকু পারেনি। বামদুর্গ ভাঙতে তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। তৃণমূলকে হাতে পেলে কাজটা সহজ। এ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে প্রধান বিরোধী দল তৃণমূল। ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে মহাকরণ দখলের স্বপ্ন তাদের তত বাড়ছে। মাওবাদীদের সিপিএম নেতাকর্মীদের খুনের বহরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবীণ শিক্ষকের মুণ্ডু কেটে রাস্তায় ফেলে রাখার ঘটনাও ঘটছে।
তৃণমূল-মাওবাদী ঘন ঘন বৈঠকে সমন্বয়ের চেষ্টা তীব্র। লাল সংকেত সেখানেই। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম মমতাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেন না। মমতা তার সহকর্মী রেলমন্ত্রী। চিদাম্বরমের দল কংগ্রেস আর মমতার পার্টি তৃণমূল জোট বেঁধে শুধু কেন্দ্রীয় সরকারই গড়েনি, পশ্চিমবঙ্গে মিলেমিশে ভোটে লড়ছে। গরজ বড় বালাই। নৈতিকতার দোহাই দিয়ে মমতাকে মাওবাদীদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে আনাটা রাজনৈতিকভাবে অসঙ্গত। আপাতত সিপিএম শুধু তৃণমূলের নয়, কংগ্রেসেরও শত্রু।
মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় বিধানসভায় ৪১টি আসন। সেগুলো সব সিপিএমের দখলে। কংগ্রেস-তৃণমূল যৌথভাবে চেষ্টা চালিয়েও কেড়ে নিতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ সেখানে তাদের সংগঠন নেই। একমাত্র মাওবাদীরাই সিপিএমকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। কংগ্রেস সিপিএমের ওপর রুষ্ট আরও একটা কারণে। ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস সরকার গড়েছিল সিপিএমের সমর্থনে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সিপিএম কংগ্রেস সংস্রব ত্যাগ করে। আমেরিকার সঙ্গে ভারতের পরমাণু চুক্তির শর্তে আপত্তি ছিল সিপিএমের। কংগ্রেস মানেনি। ফলে ফাটল। ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের পাশে থেকেছে তৃণমূল। তারা সরে গেলে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সরকারের পতন ঘটবে। অতএব, তৃণমূল যা করছে করুক। কংগ্রেসের সঙ্গে থাকলেই হলো।
সব দল মিলে যদি মাওবাদীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াত, তাহলে তারা পালাতে পথ পেত না। নিরাপত্তা বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে মরতে মরতেও তারা বেঁচে উঠছে। অক্সিজেন জোগাচ্ছে তৃণমূল। প্রশ্রয় কংগ্রেসেরও। উল্টো রাজনৈতিক প্রচারে আসামির কাঠগড়ায় তুলছে সিপিএমকে। তাদের অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গে আইন-শৃঙ্খলার চূড়ান্ত অবনতির জন্য দায়ী বামফ্রন্ট সরকার। শান্তি বজায় রাখতে তারা ব্যর্থ।
নির্বাচনী তফসিল জারি হওয়ার পর আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব আর বামফ্রন্ট সরকারের নয়। সবটাই নির্বাচন কমিশনের ঘাড়ে। তারাই ঠিক করবে রাজ্যে শান্তি কীভাবে বজায় রাখা যায়। নির্বাচনই-বা কীভাবে নির্বিঘ্নে হয়। দু'দফায় তাদের প্রতিনিধি দল দিলি্ল থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসেছে। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছে। সিপিএম-তৃণমূলের চাপান-উতোর শুনেছে। তারপর আলোচনা করে ছ'দফায় ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গতবার অর্থাৎ ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচন হয়েছিল পাঁচ দফায়। এবার একদফা বেড়েছে। আগে মাওবাদীদের উপদ্রব ছিল না। এবার আছে। সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষ নতুন মাত্রা পেয়েছে। ভোটের আগে এলাকা দখলের লড়াই অব্যাহত। দু'দলের নেতাকর্মীদের প্রাণ যাচ্ছে। বেশি সিপিএমের। কারণ মাওবাদীদের নিশানায় একমাত্র তারা। ভোটের ভূগোলে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। নির্বাচন কমিশন খুব সতর্কতায় পা ফেলছে। তাদের সাহস জোগাচ্ছে বিহারের নির্বাচন। বিহারের মতো সংঘাতবিধ্বস্ত রাজ্যে নির্বিঘ্নে নির্বাচন হয়েছে। মাফিয়ারা পর্যন্ত মাথা তুলতে পারেনি। ভোট প্রচারে কালো টাকার স্রোত বন্ধ করা গেছে; কিন্তু সেখানে শাসক এবং বিরোধীরা পশ্চিমবঙ্গের মতো হিংসাত্মক সংঘর্ষে জড়ায়নি। মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের উন্নয়নের ঢেউয়ে মানুষের ক্ষোভও অনেকটা ধুয়েমুছে গেছে। নিরাপত্তা বাহিনীকে রাজনৈতিক চাপান-উতোরে স্যান্ডউইচড হতে হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি বিপরীত। শাসক-বিরোধীদের মধ্যে কোনো সমঝোতা নেই। আইন-শৃঙ্খলা প্রশ্নে সরকার বিরোধীদের বৈঠকে ডাকলেও, সাফ জবাব, যাব না। তৃণমূল সবক্ষেত্রে সরকারকে বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উন্নয়নের প্রশ্নেও তারা বিরোধিতা করেছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মতো উন্নয়ন প্রকল্প ব্যর্থ বিরোধী চক্রান্তে। তৃণমূলের একমাত্র লক্ষ্য বামফ্রন্ট সরকারকে ব্যর্থতার কালি মাখিয়ে অপদার্থতার প্রতীক করে তোলা।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এসওয়াই কুরেশি স্বীকার করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। ১৮ এপ্রিল প্রথম দফায় তাই অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ এলাকায় ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহের ৫৪টি কেন্দ্রে ভোট নেওয়া হবে। ২৩ এপ্রিল দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোট। মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বীরভূমের ৫০টি আসনে। তৃতীয় দিনের ভোট ২৭ এপ্রিল। উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, কলকাতার ৭৫টি আসনে।
জেলার আয়তনে সব থেকে ছোট কলকাতা। কিন্তু লোকসংখ্যা সব থেকে বেশি। এক কোটি বিশ লাখ। নির্বাচনে কলকাতার তাৎপর্য অপরিসীম। কলকাতা কাকে চাইছে সেটা জানতে আন্তর্জাতিক মহলও অস্থির। কারণ রাজনীতি, সংস্কৃতির পীঠস্থান এই শহর। কলকাতা ক্রমশ বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে একদিন হয়তো সুন্দরবনকেও গ্রাস করবে। এবার বামফ্রন্টবিরোধী রাজনৈতিক ঝড়ের সূত্রপাত কলকাতাতেই। আন্দোলনের নেতৃত্বে তৃণমূল নয়। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় নাটকের কলাকুশলীরা। মমতা তাদের আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন। তারাও তার প্রতি নিখাদ আনুগত্য পথে নেমেছে। এর আগে রাজনীতির বাইরের লোক বামফ্রন্টের সমালোচনায় মুখর হয়নি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এতদিন যারা বামফ্রন্টের হয়ে প্রচার করেছে, তারাই মমতার পতাকা বহনের দায়িত্ব নিয়েছেন। কেন এমন হলো? বামেদের অবিবেচনায়। ছোট-বড় বাম নেতৃত্বের ঔদ্ধত্যে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে নাট্যকর্মীদের। তারা অভিনয়-দক্ষ তাই প্রচারে রঙ ধরতে বিলম্ব হয়নি। তাদের খোঁচায় সাধারণ মানুষের জমা ক্ষোভের বিস্ফোরণ। শহরে আটকে না থেকে তারা ছুটেছে গ্রামগঞ্জে। পরিণতিতে লোকসভা আর পঞ্চায়েত নির্বাচনে ডুবেছে বামফ্রন্ট। খুশিতে বামবিরোধী মিডিয়া নাটকের প্রতিবাদী গোষ্ঠীর মর্যাদা বাড়িয়েছে। বুদ্ধিজীবী বলে শিরোপা দিয়েছে।
এই পরাজয় কি বামফ্রন্টের প্রাপ্য ছিল? একদিক থেকে হ্যাঁ, অন্যদিকে না। ৩৫ বছর শাসন করে বামেদের ধারণা হয়েছিল তাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বাম কমান্ডই শেষ কথা। ভালোবাসার আবেগে নয়, কঠোর কর্তৃত্বে মানুষকে বেঁধে রাখা যাবে। রাজ্যজুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো বাম শিবির। সেখানে রাজা-উজিরের মতো রাজ্যপাট চালাচ্ছে ক্ষুদে নেতারা। মানুষ অসম্মান সইবে কেন? গণতন্ত্রের অস্ত্রে কাত করেছে বামফ্রন্টকে। মানুষের জন্য প্রচুর কাজ করা সত্ত্বেও জনপ্রিয়তা হারিয়েছে বামেরা।
বামেদের এই শাস্তি যারা মানে না, তাদের বক্তব্য বামফ্রন্ট তো ভুলের জন্য মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। তারা বলেছে, এমনটা আর হবে না। তবু মানুষ কেন বিরূপ হলো। এখানেও কথা আছে। দীর্ঘদিনের অপমান একদিনে ভোলা যায়? বিরোধীরা যতই ভয়ঙ্কর হোক রাগলে মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয় এবং তাদেরই সমর্থন করে বসে।
৩ মে চতুর্থ দফায় যে ৬৩ আসনে ভোট হচ্ছে সেই হাওড়া, হুগলী, পূর্ব মেদিনীপুর, বর্ধমান জেলা বামেদের দুর্ভেদ্য দুর্গ। পঞ্চম পর্যায়ে ৩৮ আসনে ভোট ৭ মে। পশ্চিম মেদিনীপুরের ১২, পুরুলিয়ার ৫, বাঁকুড়ার ৯, বর্ধমানের ১২ আসনের ভোট। এখানে বামেরা অনেকটা অগোছালো। ষষ্ঠ দফার ভোট ১০ মে। ভোট হবে পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার ১৪টি আসনে। এ অঞ্চলের ভোট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য সবশেষে হচ্ছে। মাওবাদীদের ভোট বয়কটের কঠিন চ্যালেঞ্জ ভেঙে এগোতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এ এলাকাতেই লালগড়। যেখানকার মাটি এখনও রক্তে লাল।
বৈশাখের প্রখর তাপকে আরও বাড়িয়ে দেবে নির্বাচনী যুদ্ধ। রাজ্যজুড়ে প্রচারের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ভুল শোধরাতে বাম নেতাকর্মীরা মানুষের দরজায় দরজায় কড়া নাড়ছে। তৃণমূলও কম যায় না। তারাও ছুটছে গ্রামগঞ্জে। সংগঠন আগের থেকে ভালো। তবুও তাদের একমাত্র ভরসা মমতা। কারণ মমতা মানেই তৃণমূল, তৃণমূলই মমতা। তৃণমূলের জোট শরিক কংগ্রেসের অবস্থা সুবিধার নয়। দিলি্লতে একের পর এক অর্থ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত। কংগ্রেসও চেয়ে আছে মমতার দিকে।
বামেরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিশোর-তরুণদের কাছ থেকে সাড়া পাচ্ছে। কলেজ নির্বাচনে তাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত। তৃণমূলের ছাত্রছাত্রীরা সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএসআইয়ের সামনে দাঁড়াতেই পারছে না। শেষ সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ২ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট সুইং করে বামেদের দিকে ফিরেছে। তৃণমূল চালিত পঞ্চায়েতে দুর্নীতির স্তূপ জমছে। তাদের নেতাকর্মীরা বামেদের ভুল ধার করছে। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেনই ধরে নিয়ে ছড়ি ঘোরাচ্ছে। একমাস আগেও মমতা পশ্চিমবঙ্গে নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের নামের তালিকা তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। এখন সে কাজ বন্ধ। নিজে প্রার্থী হননি। তার কৈফিয়ত, আমি প্রার্থী হলে নিজের কেন্দ্রে আটকে পড়ব। ভোট তো ২৯৪ আসনে। বাকি আসন সামলাবে কে? যদি জিতি তখন প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হবো। এই 'যদি' শব্দটার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বামেরা। তারা বলছে, যদি মানেই সংশয়। আগের মতো জোর দিয়ে মমতা বলতে পারছেন না জিতবই। তৃণমূলরা চিন্তিত। নেত্রী যদি জেতার গ্যারান্টি না দেন আর কে দেবে? ১৩ মে ভোটের ফল। পশ্চিমবঙ্গে এসিড টেস্টের নিষ্পত্তি সেদিনই।
অমিত বসু : ভারতীয় সাংবাদিক
কে হারবে কে জিতবে সে প্রশ্ন বাদ দিয়ে শুধু আর্ত জিজ্ঞাসা, মানুষ বাঁচবে তো। মাটি আর রক্তে ভিজবে না তো। উত্তর নেই। রক্তপাতের রাজনীতি বন্ধের গ্যারান্টি কেউ দিচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলো এ ওর ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। বিজ্ঞজনের অভিমত, নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত এরকম চলবেই। এক ইঞ্চি জমির জন্য যুদ্ধ। পাওয়ার গেমে রক্ত তুচ্ছ।
উদ্বেগে নির্বাচন কমিশন। দায় আপাতত তাদের। ভোটের কাঁটা উপড়াতে চেষ্টার কসুর নেই। পশ্চিমবঙ্গে একদিনে ভোট করা যাবে না ধরে নিয়ে ছ'দিনে শেষ করার আয়োজন। ভোট শুরু ১৮ এপ্রিল। সব থেকে আগে ভোট আসামে। সেখানে দু'দফায় ভোট। ৪ আর ১১ এপ্রিল। ১২৬ আসনে বিধানসভায় কংগ্রেস আধিপত্য প্রশ্নের মুখে। তামিলনাড়ূর ২৩৪, কেরালার ১৪০ এবং পুদুচেরির ৩০ আসনে ভোট ১৩ এপ্রিল। একদিনেই তিন রাজ্যের ভোট মিটবে। চার রাজ্যে ভোট শেষ হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের পালা। নির্বাচন কমিশনের দুশ্চিন্তা এই রাজ্যকে নিয়ে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশির অতিরিক্ত সচেতনতা। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ঘেরাটোপ। রাজ্য পুলিশের সঙ্গে থাকবে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী। অন্য চার রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার আসন বেশি। আসন সংখ্যা ২৯৪। ভোটার ৫ কোটি ৬০ লাখ। রাজ্যের ১৯টি জেলাতে হিংসার দাঁত ক্রমেই ধারালো হচ্ছে। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার আন্দোলনে দার্জিলিং অশান্ত। উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বারুদের গন্ধ। অন্ধ আক্রমণে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ছারখারে মরিয়া। পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া আর বীরভূমের একাংশে মাওবাদী নৃশংসতা অব্যাহত। তাদের হাত থেকে রক্ষা নেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা শিশুরও। যৌথ বাহিনীর তীব্র প্রতিবাদে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ এলেও তারা নিশ্চিহ্ন হয়নি। পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে তাদের আস্তানা। সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে নাশকতা চালিয়ে ফিরে যাচ্ছে। মাওবাদী শিবিরে মজুদ বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার। রকেট লঞ্চার থেকে একে ৪৭, কিছুই বাদ নেই। বুভুক্ষু মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির দাবিতে তারা লড়ছে। গণতন্ত্রে তাদের বিশ্বাস নেই। বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস বলে মনে করে। পিছিয়ে পড়া মানুষকে এগিয়ে আনার কোনো কর্মসূচি তারা পেশ করেনি বরং অস্ত্র কেনায় ব্যয় বাড়াচ্ছে। কোটি কোটি টাকা খোলামকুচির মতো উড়ছে। মাওবাদী শীর্ষনেতা কিষেণজীর ঘোষণা, তৃণমূল সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া অন্য কেউ মুখ্যমন্ত্রী হলে তিনি মানবেন না।
ধোঁয়াশা এখানেই। দক্ষিণপন্থি তৃণমূলের সঙ্গে চরম বামপন্থিদের আপস কীভাবে সম্ভব। এই জোটের কর্মসূচিই-বা কী? মাওবাদীরা তো ভোট মানে না। তবু তারা মমতার নির্বাচনী জয় আশা করছে কেন? মমতা ক্ষমতায় এলে কি তারা অস্ত্র ছেড়ে মূল স্রোতে ফিরে আসবে? নাকি এটা তাদের রাজনৈতিক কৌশল ক্ষমতার লোভে অন্ধ তৃণমূলকে টোপ দিয়ে বামফ্রন্টকে হটানোই লক্ষ্য। বাকি পাঁচ রাজ্যে মাওবাদীরা যেটুকু সুবিধা করতে পেরেছে পশ্চিমবঙ্গে ততটুকু পারেনি। বামদুর্গ ভাঙতে তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। তৃণমূলকে হাতে পেলে কাজটা সহজ। এ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে প্রধান বিরোধী দল তৃণমূল। ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে মহাকরণ দখলের স্বপ্ন তাদের তত বাড়ছে। মাওবাদীদের সিপিএম নেতাকর্মীদের খুনের বহরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবীণ শিক্ষকের মুণ্ডু কেটে রাস্তায় ফেলে রাখার ঘটনাও ঘটছে।
তৃণমূল-মাওবাদী ঘন ঘন বৈঠকে সমন্বয়ের চেষ্টা তীব্র। লাল সংকেত সেখানেই। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম মমতাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেন না। মমতা তার সহকর্মী রেলমন্ত্রী। চিদাম্বরমের দল কংগ্রেস আর মমতার পার্টি তৃণমূল জোট বেঁধে শুধু কেন্দ্রীয় সরকারই গড়েনি, পশ্চিমবঙ্গে মিলেমিশে ভোটে লড়ছে। গরজ বড় বালাই। নৈতিকতার দোহাই দিয়ে মমতাকে মাওবাদীদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে আনাটা রাজনৈতিকভাবে অসঙ্গত। আপাতত সিপিএম শুধু তৃণমূলের নয়, কংগ্রেসেরও শত্রু।
মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় বিধানসভায় ৪১টি আসন। সেগুলো সব সিপিএমের দখলে। কংগ্রেস-তৃণমূল যৌথভাবে চেষ্টা চালিয়েও কেড়ে নিতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ সেখানে তাদের সংগঠন নেই। একমাত্র মাওবাদীরাই সিপিএমকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। কংগ্রেস সিপিএমের ওপর রুষ্ট আরও একটা কারণে। ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস সরকার গড়েছিল সিপিএমের সমর্থনে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সিপিএম কংগ্রেস সংস্রব ত্যাগ করে। আমেরিকার সঙ্গে ভারতের পরমাণু চুক্তির শর্তে আপত্তি ছিল সিপিএমের। কংগ্রেস মানেনি। ফলে ফাটল। ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের পাশে থেকেছে তৃণমূল। তারা সরে গেলে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সরকারের পতন ঘটবে। অতএব, তৃণমূল যা করছে করুক। কংগ্রেসের সঙ্গে থাকলেই হলো।
সব দল মিলে যদি মাওবাদীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াত, তাহলে তারা পালাতে পথ পেত না। নিরাপত্তা বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে মরতে মরতেও তারা বেঁচে উঠছে। অক্সিজেন জোগাচ্ছে তৃণমূল। প্রশ্রয় কংগ্রেসেরও। উল্টো রাজনৈতিক প্রচারে আসামির কাঠগড়ায় তুলছে সিপিএমকে। তাদের অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গে আইন-শৃঙ্খলার চূড়ান্ত অবনতির জন্য দায়ী বামফ্রন্ট সরকার। শান্তি বজায় রাখতে তারা ব্যর্থ।
নির্বাচনী তফসিল জারি হওয়ার পর আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব আর বামফ্রন্ট সরকারের নয়। সবটাই নির্বাচন কমিশনের ঘাড়ে। তারাই ঠিক করবে রাজ্যে শান্তি কীভাবে বজায় রাখা যায়। নির্বাচনই-বা কীভাবে নির্বিঘ্নে হয়। দু'দফায় তাদের প্রতিনিধি দল দিলি্ল থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসেছে। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছে। সিপিএম-তৃণমূলের চাপান-উতোর শুনেছে। তারপর আলোচনা করে ছ'দফায় ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গতবার অর্থাৎ ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচন হয়েছিল পাঁচ দফায়। এবার একদফা বেড়েছে। আগে মাওবাদীদের উপদ্রব ছিল না। এবার আছে। সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষ নতুন মাত্রা পেয়েছে। ভোটের আগে এলাকা দখলের লড়াই অব্যাহত। দু'দলের নেতাকর্মীদের প্রাণ যাচ্ছে। বেশি সিপিএমের। কারণ মাওবাদীদের নিশানায় একমাত্র তারা। ভোটের ভূগোলে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। নির্বাচন কমিশন খুব সতর্কতায় পা ফেলছে। তাদের সাহস জোগাচ্ছে বিহারের নির্বাচন। বিহারের মতো সংঘাতবিধ্বস্ত রাজ্যে নির্বিঘ্নে নির্বাচন হয়েছে। মাফিয়ারা পর্যন্ত মাথা তুলতে পারেনি। ভোট প্রচারে কালো টাকার স্রোত বন্ধ করা গেছে; কিন্তু সেখানে শাসক এবং বিরোধীরা পশ্চিমবঙ্গের মতো হিংসাত্মক সংঘর্ষে জড়ায়নি। মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের উন্নয়নের ঢেউয়ে মানুষের ক্ষোভও অনেকটা ধুয়েমুছে গেছে। নিরাপত্তা বাহিনীকে রাজনৈতিক চাপান-উতোরে স্যান্ডউইচড হতে হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি বিপরীত। শাসক-বিরোধীদের মধ্যে কোনো সমঝোতা নেই। আইন-শৃঙ্খলা প্রশ্নে সরকার বিরোধীদের বৈঠকে ডাকলেও, সাফ জবাব, যাব না। তৃণমূল সবক্ষেত্রে সরকারকে বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উন্নয়নের প্রশ্নেও তারা বিরোধিতা করেছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মতো উন্নয়ন প্রকল্প ব্যর্থ বিরোধী চক্রান্তে। তৃণমূলের একমাত্র লক্ষ্য বামফ্রন্ট সরকারকে ব্যর্থতার কালি মাখিয়ে অপদার্থতার প্রতীক করে তোলা।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এসওয়াই কুরেশি স্বীকার করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। ১৮ এপ্রিল প্রথম দফায় তাই অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ এলাকায় ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহের ৫৪টি কেন্দ্রে ভোট নেওয়া হবে। ২৩ এপ্রিল দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোট। মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বীরভূমের ৫০টি আসনে। তৃতীয় দিনের ভোট ২৭ এপ্রিল। উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, কলকাতার ৭৫টি আসনে।
জেলার আয়তনে সব থেকে ছোট কলকাতা। কিন্তু লোকসংখ্যা সব থেকে বেশি। এক কোটি বিশ লাখ। নির্বাচনে কলকাতার তাৎপর্য অপরিসীম। কলকাতা কাকে চাইছে সেটা জানতে আন্তর্জাতিক মহলও অস্থির। কারণ রাজনীতি, সংস্কৃতির পীঠস্থান এই শহর। কলকাতা ক্রমশ বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে একদিন হয়তো সুন্দরবনকেও গ্রাস করবে। এবার বামফ্রন্টবিরোধী রাজনৈতিক ঝড়ের সূত্রপাত কলকাতাতেই। আন্দোলনের নেতৃত্বে তৃণমূল নয়। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় নাটকের কলাকুশলীরা। মমতা তাদের আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন। তারাও তার প্রতি নিখাদ আনুগত্য পথে নেমেছে। এর আগে রাজনীতির বাইরের লোক বামফ্রন্টের সমালোচনায় মুখর হয়নি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এতদিন যারা বামফ্রন্টের হয়ে প্রচার করেছে, তারাই মমতার পতাকা বহনের দায়িত্ব নিয়েছেন। কেন এমন হলো? বামেদের অবিবেচনায়। ছোট-বড় বাম নেতৃত্বের ঔদ্ধত্যে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে নাট্যকর্মীদের। তারা অভিনয়-দক্ষ তাই প্রচারে রঙ ধরতে বিলম্ব হয়নি। তাদের খোঁচায় সাধারণ মানুষের জমা ক্ষোভের বিস্ফোরণ। শহরে আটকে না থেকে তারা ছুটেছে গ্রামগঞ্জে। পরিণতিতে লোকসভা আর পঞ্চায়েত নির্বাচনে ডুবেছে বামফ্রন্ট। খুশিতে বামবিরোধী মিডিয়া নাটকের প্রতিবাদী গোষ্ঠীর মর্যাদা বাড়িয়েছে। বুদ্ধিজীবী বলে শিরোপা দিয়েছে।
এই পরাজয় কি বামফ্রন্টের প্রাপ্য ছিল? একদিক থেকে হ্যাঁ, অন্যদিকে না। ৩৫ বছর শাসন করে বামেদের ধারণা হয়েছিল তাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বাম কমান্ডই শেষ কথা। ভালোবাসার আবেগে নয়, কঠোর কর্তৃত্বে মানুষকে বেঁধে রাখা যাবে। রাজ্যজুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো বাম শিবির। সেখানে রাজা-উজিরের মতো রাজ্যপাট চালাচ্ছে ক্ষুদে নেতারা। মানুষ অসম্মান সইবে কেন? গণতন্ত্রের অস্ত্রে কাত করেছে বামফ্রন্টকে। মানুষের জন্য প্রচুর কাজ করা সত্ত্বেও জনপ্রিয়তা হারিয়েছে বামেরা।
বামেদের এই শাস্তি যারা মানে না, তাদের বক্তব্য বামফ্রন্ট তো ভুলের জন্য মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। তারা বলেছে, এমনটা আর হবে না। তবু মানুষ কেন বিরূপ হলো। এখানেও কথা আছে। দীর্ঘদিনের অপমান একদিনে ভোলা যায়? বিরোধীরা যতই ভয়ঙ্কর হোক রাগলে মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয় এবং তাদেরই সমর্থন করে বসে।
৩ মে চতুর্থ দফায় যে ৬৩ আসনে ভোট হচ্ছে সেই হাওড়া, হুগলী, পূর্ব মেদিনীপুর, বর্ধমান জেলা বামেদের দুর্ভেদ্য দুর্গ। পঞ্চম পর্যায়ে ৩৮ আসনে ভোট ৭ মে। পশ্চিম মেদিনীপুরের ১২, পুরুলিয়ার ৫, বাঁকুড়ার ৯, বর্ধমানের ১২ আসনের ভোট। এখানে বামেরা অনেকটা অগোছালো। ষষ্ঠ দফার ভোট ১০ মে। ভোট হবে পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার ১৪টি আসনে। এ অঞ্চলের ভোট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য সবশেষে হচ্ছে। মাওবাদীদের ভোট বয়কটের কঠিন চ্যালেঞ্জ ভেঙে এগোতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এ এলাকাতেই লালগড়। যেখানকার মাটি এখনও রক্তে লাল।
বৈশাখের প্রখর তাপকে আরও বাড়িয়ে দেবে নির্বাচনী যুদ্ধ। রাজ্যজুড়ে প্রচারের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ভুল শোধরাতে বাম নেতাকর্মীরা মানুষের দরজায় দরজায় কড়া নাড়ছে। তৃণমূলও কম যায় না। তারাও ছুটছে গ্রামগঞ্জে। সংগঠন আগের থেকে ভালো। তবুও তাদের একমাত্র ভরসা মমতা। কারণ মমতা মানেই তৃণমূল, তৃণমূলই মমতা। তৃণমূলের জোট শরিক কংগ্রেসের অবস্থা সুবিধার নয়। দিলি্লতে একের পর এক অর্থ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত। কংগ্রেসও চেয়ে আছে মমতার দিকে।
বামেরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিশোর-তরুণদের কাছ থেকে সাড়া পাচ্ছে। কলেজ নির্বাচনে তাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত। তৃণমূলের ছাত্রছাত্রীরা সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএসআইয়ের সামনে দাঁড়াতেই পারছে না। শেষ সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ২ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট সুইং করে বামেদের দিকে ফিরেছে। তৃণমূল চালিত পঞ্চায়েতে দুর্নীতির স্তূপ জমছে। তাদের নেতাকর্মীরা বামেদের ভুল ধার করছে। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেনই ধরে নিয়ে ছড়ি ঘোরাচ্ছে। একমাস আগেও মমতা পশ্চিমবঙ্গে নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের নামের তালিকা তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। এখন সে কাজ বন্ধ। নিজে প্রার্থী হননি। তার কৈফিয়ত, আমি প্রার্থী হলে নিজের কেন্দ্রে আটকে পড়ব। ভোট তো ২৯৪ আসনে। বাকি আসন সামলাবে কে? যদি জিতি তখন প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হবো। এই 'যদি' শব্দটার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বামেরা। তারা বলছে, যদি মানেই সংশয়। আগের মতো জোর দিয়ে মমতা বলতে পারছেন না জিতবই। তৃণমূলরা চিন্তিত। নেত্রী যদি জেতার গ্যারান্টি না দেন আর কে দেবে? ১৩ মে ভোটের ফল। পশ্চিমবঙ্গে এসিড টেস্টের নিষ্পত্তি সেদিনই।
অমিত বসু : ভারতীয় সাংবাদিক
No comments