উদ্ভাবক শতবর্ষী চয়েন বানু by নাজমুল হক ইমন

ধান বীজসহ বিভিন্ন বীজ সংরক্ষণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণসহ গবেষণা চলছে বহু সময় ধরে।
আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়াই সনাতন পদ্ধতিতে দীর্ঘদিন ধরে সফলভাবে বীজ সংরক্ষণ করে আসছেন বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার তালশন গ্রামের হাজী আবদুল কাদেরের স্ত্রী চয়েন বানু। মাটির তৈরি কুঠরিতে নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে বছরের পর বছর ধান, গম, যব, কলাইসহ যে কোনো শস্যবীজ নিপুণভাবে সংরক্ষণ করেন চয়েন বানু। চয়েন বানু কাছ থেকে মাটির কুঠরিতে বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি শিখে বর্তমানে তালশনসহ আশপাশের গ্রামের কৃষকরা এ পদ্ধতি অনুসরণ করছেন। বর্তমানে মাটির কুঠরিতে ধান সংরক্ষণ পদ্ধতির সুফল ভোগ করছেন আদমদীঘি উপজেলার হাজার হাজার কৃষক। চয়েন বানুর মাটির তৈরি এই কুঠরিতে সব ধরনের বীজ ছাড়াও যে কোনো ধরনের খাদ্যদ্রব্যও রাখা যায় দীর্ঘ সময় পর্যন্ত। এলাকার একাধিক কৃষকের কাছ থেকে জানা গেছে, চয়েন বানুর প্রযুক্তিতে তৈরি করা মাটির কুঠরিতে বীজ সংরক্ষণ করলে বীজের গুণগত মান ভালো থাকে। এই পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা বীজে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ সুস্থ চারা পাওয়া যায়।
চয়েন বানুর বর্তমান বয়স ১০২ বছর। এ বয়সেও থেমে নেই তার চলার গতি। কখনও বসে থাকেন না । শারীরিক গঠন দেখে তার বয়স অনুমান করা কঠিন। চয়েন বানু জানান, তার জন্ম ইংরেজি ১৯০৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। জন্মস্থান ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর জেলার তৎকালীন ইটাহার থানার গোড়াহার গ্রামে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে একই জেলার আবদুল কাদের সরকারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তার তিন ছেলে এবং দুই মেয়ে। ছেলেরা চাকরিজীবী এবং মেয়েরা গৃহিণী। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ইংরেজি ১৯৬৪ সালে বিনিময় সূত্রে সপরিবারে চলে আসেন বাংলাদেশের বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলা সদরের তালশন গ্রামে।
চয়েন বানু বীজ সংরক্ষণের নিরাপদ ব্যবস্থা মাটির তৈরি এই কুঠরি সম্পর্কে বলেন, মাটির কুঠরি তৈরি করা শিখেছেন তার মায়ের কাছ থেকে। মাটির কুঠরি তৈরি করতে তেমন কোনো খরচ নেই। কুঠরি তৈরির উত্তম সময় হলো কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত। প্রথমে কালো দোআঁশ মাটি ভিজিয়ে শোধন করে নিতে হয় টুথপেস্টের মতো করে। তারপর সেই মাটির সঙ্গে খড়ের কুচি, ধানের চিটা এবং সামান্য পরিমাণ তুষ মিশিয়ে নিতে হয়। তারপর প্রথমে কুঠরির তলদেশ তৈরি করতে হয়। তলদেশ তৈরির পর কমপক্ষে তিনদিন রোদে শুকাতে হয়। পরে কূপের পাটার মতো করে তিন-চারদিন পরপর পাটা তৈরি করে একটির ওপর আরেকটি বসাতে হয়। অবশেষে মুখের দিকে সরু করে আনতে হয় এবং মাপমতো ঢাকনা তৈরি করতে হয়। কুঠরি বিভিন্ন আকৃতির বানানো যায়। বীজ সংরক্ষণ ছাড়াও বড় আকৃতির একটি কুঠরিতে ৩০ থেকে ৪০ মণ চাল রাখা যায়। তিনি জানান, এ পদ্ধতিতে তৈরি করা কুঠরিতে সাধারণত বাতাস প্রবেশ করতে পারে না। এ কারণে দীর্ঘ সময় ধরে বীজ রাখলেও বীজের কোনো ক্ষতি হয় না।
চয়েন বানু বলেন, শুধু কুঠরিতে বীজ রাখলেই ভালো বীজ পাওয়া যাবে না। বীজ সংরক্ষণের জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। যেমন_ প্রথমে পুষ্ট ও দানাদার বীজ বেছে নিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে বীজ যেন ভেজা না হয়। এ কারণে কুঠরিতে রাখার আগে সব ধরনের বীজ ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। বীজে যেন পোকা না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বীজ সংরক্ষণের বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ভালো বীজ না হলে ভালো ফসল পাওয়া যাবে না।
বীজ সংরক্ষণের সুফল-কুফলের মতো নিজের জীবনের চলার পথে সুফল-কুফল সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন চয়েন বানু। অলসতা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি আজও। রাতে খাবার পর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন। ভোররাতে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় এবং কোরআন তিলাওয়াত করেন। তারপর ঘর ঝাড়ূ দিয়ে শুরু হয় তার কর্মব্যস্ত দিন। এখনও কোনো রোগবালাই তাকে স্পর্শ করেনি।
 

No comments

Powered by Blogger.