কাদের মোল্লার যুদ্ধাপরাধের রায় যে কোনো দিন by জেসমিন পাঁপড়ি ও মেহেদী হাসান পিয়াস
মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের
সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের
মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আগামী যে কোনো দিন।
বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
বৃহস্পতিবার
আইনি পয়েন্টে যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন শেষ করেন আসামিপক্ষ। আর
রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন ও সমাপনী বক্তব্য উপস্থাপন সম্পন্ন হয়
বুধবার। উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হওয়ার প্রেক্ষিতে যে কোনো দিন মামলার রায়
দেওয়ার জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) বলে রেখে দেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল
হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
এ আদেশের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল এখন তার সুবিধা মতো সময়ে যে কোনো দিন রায় ঘোষণা করবেন বলে সাংবাদিকদের জানান রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রায় পৌনে ৩ বছরে দ্বিতীয় কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হলো। তবে দু’টি মামলার বিচারই শেষ হয়েছে গত বছরের ২২ মার্চ গঠিত দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে। এর আগে গত ২৬ ডিসেম্বর একই ট্রাইব্যুনাল মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত পলাতক জামায়াতের সাবেক রোকন (সদস্য) আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ করে যে কোনো দিন রায় দেবেন বলে জানান।
বৃহস্পতিবার কাদের মোল্লার প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আইনি পয়েন্টে সমাপনী দিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। আর বুধবার রাষ্ট্রপক্ষে আইনি পয়েন্টে শেষ পাল্টা যুক্তি ও সমাপনী বক্তব্য উপস্থাপন শেষ করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী।
উল্লেখ্য, আসামিপক্ষ মোট ৮ কার্যদিবসে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেছেন। এর মধ্যে কাদের মোল্লার প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ৪ দিন এবং অপর আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুস সোবহান তরফদার ৪ দিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। গত ৭ জানুয়ারি থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন তারা।
অন্যদিকে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী গত ১৭ থেকে ২৭ ডিসেম্বর ও বুধবার রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। সব মিলিয়ে রাষ্ট্রপক্ষও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে সময় নেন ৮ কার্যদিবস।
পুনর্বিচারে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ
গত ৭ জানুয়ারি শুনানি শেষে কাদের মোল্লার মামলা পুনর্বিচারে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। সে আদেশে পুনর্বিচারের আবেদন করার আগে মামলাটি যে পর্যায়ে ছিল, সেখান থেকেই শুরু করার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরুর মধ্য দিয়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলাটির বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে পৌঁছে।
উল্লেখ্য, মামলার রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়ে যাওয়ার পর গত ৩ জানুয়ারি মামলাটির পুনর্বিচারের আবেদন জানান কাদের মোল্লার আইনজীবী ব্যারিস্টার তানভীর আহমেদ আল আমীন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ বেলজিয়ামের ব্রাসেলস প্রবাসী বাংলাদেশি আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল-১ এর পদত্যাগী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপি কথোপকথনের সূত্র ধরে এ আবেদন করেন আসামিপক্ষ।
ওই স্কাইপি কথোপকথনের সূত্র ধরে বিচারাধীন জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী ও নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং ট্রাইব্যুনাল-২ এ জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা ৪টিরও পুনরায় শুরু করার আবেদন গত ৩ জানুয়ারি খারিজ করে দেন দু’টি ট্রাইব্যুনাল।
অন্যদিকে একই ঘটনার সূত্র ধরে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর পাশাপাশি পুনর্গঠিত হয় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালও। ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর প্রথম ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন আর তার স্থলাভিষিক্ত হন এ ট্রাইব্যুনালেরই বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
মামলার ধারাবাহিক কার্যক্রম
মুক্তিযুদ্ধকালে গোলাম মোস্তফা নামে এক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে কেরাণীগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। ওই মামলাটি করেছিলেন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এই মামলার প্রথম সাক্ষী মোস্তফার কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ খান। ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় আরো একটি মামলা হয় কাদের মোল্লাসহ আরো অনেকের বিরুদ্ধে। ওই মামলার অভিযোগে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে ট্রাইব্যুনাল-১ এ যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয় ২০১০ সালের ২১ জুলাই।
২০১১ সালের ১ নভেম্বর জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) তার বিরুদ্ধে হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়। ২৮ ডিসেম্বর এসব অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল-১।
গত বছরের ১৬ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে আব্দুল কাদের মোল্লার মামলাসহ তিনটি মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।
গত বছরের ২৮ মে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ষড়যন্ত্র ও উস্কানিসহ ৬টি অভিযোগ এনে কাদের মোল্লার বিরদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৩(১), ৩(২)(এ)(এইচ) অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল-২। গত বছরের ২০ জুন তার বিরুদ্ধে ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী ও সুলতান মাহমুদ। তারা ৯৬ পৃষ্ঠার এ সূচনা বক্তব্যে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ৬টি অভিযোগ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ৬টি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, কবি মেহেরুন্নেছাসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা, পল্লবীর আলোকদি গ্রামে ৩৪৪ জনকে হত্যা, আইনজীবী-সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে হত্যা, বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবসহ সাত জনকে হত্যা, কেরাণীগঞ্জের শহীদনগর গ্রামের ভাওয়াল খান বাড়ি ও ঘাটারচরসহ পাশের আরো দু’টি গ্রামের অসংখ্য লোককে হত্যার ঘটনা।
এর পর ৩ জুলাই থেকে শুরু করে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) আব্দুর রাজ্জাক খান ও মনোয়ারা বেগমসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১২ জন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাদেরকে জেরা করেন।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া রাষ্ট্রপক্ষের অন্য সাক্ষীরা হলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহম্মেদ খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মামা বাহিনীর প্রধান ও কমান্ডার শহিদুল হক খান মামা, কাদের মোল্লার হাতে ক্ষতিগ্রস্ত এক নারী সাক্ষী (ক্যামেরা ট্রায়াল), কবি কাজী রোজি, শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক ও আইনজীবী খন্দকার আবু তালেবের পুত্র সরকারি কর্মকর্তা খন্দকার আবুল আহসান, সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী সাফিউদ্দিন মোল্লা, আব্দুল মজিদ পালোয়ান, কেরাণীগঞ্জের ঘাটারচর গ্রামের শহীদ নবী হোসেন বুলুর স্ত্রী নূরজাহান বেগম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মোল্লা এবং সৈয়দ আব্দুল কাইয়ুম।
অন্যদিকে ১৫ নভেম্বর থেকে শুরু করে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত কাদের মোল্লা নিজেসহ ৬ জন সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন তার পক্ষে। এর আগে ৪ নভেম্বর সাফাই সাক্ষীর জন্য আসামীপক্ষের দাখিল করা ৯৬৫ জনের তালিকা থেকে ৬জন সাক্ষীকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য অনুমোদন করেন ট্রাইব্যুনাল। অন্য ৫ সাফাই সাক্ষী হচ্ছেন, সুশীল চন্দ্র মণ্ডল, মোসলেম উদ্দিন মাস্টার, সাহেরা খাতুন, আলতাফ উদ্দিন মোল্লা ও এ আই এম লোকমান। রাষ্ট্রপক্ষ তাদের জেরা সম্পন্ন করেন।
ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে আলবদর কমান্ডার!
মুক্তিযুদ্ধকালে ‘মিরপুরের কসাই’ বলে পরিচিত এই কাদের মোল্লার আগে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা। সেখান থেকে ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্রসংঘ আলবদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হলে তিনি মিরপুরে ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠন করেন এবং এ বাহিনীর একজন কমান্ডার হন।
একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে কাদের মোল্লা পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর ইঙ্গিতে ও জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গোপন নির্দেশে ঢাকার মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে বিহারিদের সঙ্গে নিয়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা শুরু করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ার উচ্চারণ করেন।
তবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাত থেকেই শুরু হয় তার নেতৃত্বে বিহারিদের যোগসাজশে ঢাকার মিরপুরে বাঙালি হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার দখলদার বাহিনী, সহযোগী বাহিনীসহ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের অধিনায়কের কাছে আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতেই কাদের মোল্লা মানবতাবিরোধী নানা অপরাধ সংঘটিত করেন।
ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামের মরহুম সানাউল্লা মোল্লার ছেলে আব্দুল কাদের মোল্লা ১৯৪৮ সালের ২ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকায় ৪৯৩ বড়মগবাজার গ্রিন ভ্যালি অ্যাপার্টমেন্টের ৮/এ ফ্ল্যাটে থাকতেন।
কাদের মোল্লা ১৯৬১ সালে আমিরাবাদ ফজলুল হক ইনিস্টিটিউশনে ৮ম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে বিএসসি প্রথম বর্ষে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগদান করেন। বিএসসি ২য় বর্ষের শেষের দিকে তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘের কলেজ শাখার সভাপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।
১৯৬৮ সালে সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করে ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন কাদের মোল্লা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে তিনি শহীদুল্লাহ হলে থাকতেন এবং ১৯৭০ সালের অক্টোবরে তিনি শহিদুল্লাহ হলের ছাত্রসংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন।
রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, কাদের মোল্লা মুক্তিযুদ্ধকালে মিরপুরে সংঘটিত অপরাধের অভিযোগে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে ফরিদপুরে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে ফের প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসেন তিনি।
১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইসলামী ছাত্রসংঘ ইসলামী ছাত্রশিবির নামে প্রতিষ্ঠিত হলে কাদের মোল্লা ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য হন। তিনি ১৯৭৭ সালের মে মাসে জামায়াতে যোগ দেন, যদিও জামায়াত তখনও প্রকাশ্যে রাজনীতিতে আসেনি।
১৯৭৮ সালে তিনি ঢাকার রাইফেল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়্ত্বি পালন করেন। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আব্দুল হামিদ আল খতিবের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও আর্থিক সহায়তায় দেশে মুসলমান ছেলে-মেয়েদের আন্তর্জাতিক মানের একটি ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে গুলশান ১ নম্বর মার্কেটের দক্ষিণ পাশে ‘মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে মানারাত ইউনিভার্সিটি হিসেবে পরিচিত। সেখানে তিনি প্রায় ১ বছর কাজ করেন।
১৯৮০ সালে দৈনিক সংগ্রাম-এর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। তখন তিনি ঢাকা মহানগর জামায়াতের কর্মপরিষদের সদস্য থেকে সহকারী সেক্রেটারি জোনারেল পদে নিয়োজিত হন। পরবর্তীতে আবদুল কাদের মোল্লা জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদে নিয়োজিত হন। তিনি ১৯৮৬ ও ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে ফরিদপুর-৪ (সদরপুর-চরভদ্রাসন) আসনে জামায়াত থেকে নির্বাচন করেন। কিন্তু উভয় নির্বাচনে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গঠন করা অভিযোগ, ৯৬ পৃষ্ঠার সূচনা বক্তব্য এবং ৩৮৫ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, ষড়যন্ত্র ও উস্কানিসহ ৬টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, কবি মেহেরুন্নেছাসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা, পল্লবীর আলুব্দী (আলোকদি) গ্রামে ৩৪৪ জনকে হত্যা, সাংবাদিক-আইনজীবী খন্দকার আবু তালেবকে হত্যা, বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবসহ সাত জনকে হত্যা, কেরাণীগঞ্জের শহীদনগর গ্রামের ভাওয়াল খান বাড়ি ও ঘাটারচরসহ পাশের আরো দু’টি গ্রামের অসংখ্য লোককে গণহত্যার ঘটনা।
অভিযোগপত্রে জানা গেছে, ঢাকার মিরপুর ১০ নং বাসস্ট্যান্ড, মিরপুর জল্লাদখানা, মিরপুরের শিয়ালবাড়ি ও রূপনগর, মিরপুর ৬নং সেকশন, মিরপুর ১২ নম্বর সেকশন, মিরপুরের কল্যাণপুর, ঢাকার মোহাম্মদপুর এবং ঢাকা জেলার কেরাণীগঞ্জের শহীদনগরে হাজার হাজার বাঙালি হত্যার প্রধান নায়ক ছিলেন আব্দুল কাদের মোল্লা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বিহারিদের যোগসাজশে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে মিরপুরে বাঙালি হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। স্বাধীনতার পর দেশের অন্যতম বৃহৎ গণকবর আবিষ্কৃত হয় মিপুরের শিয়ালবাড়ীতে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, আলবদর বাহিনীর নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা তার সহযোগী ও অবাঙালি বিহারিদের নিয়ে মিরপুরের বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে জোরপূর্বক ধরে এনে মিরপুর-১২ নম্বর থেকে ১ নম্বর এবং ১নং শাহ আলী মাজার থেকে হাতে দড়ি বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে পুনরায় মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনে ঈদগাহ মাঠে নিয়ে এসে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখেন। পল্লবের দেহ দু’দিন ঝুলিয়ে রেখে তার সহযোগী আলবদর বাহিনীর সদস্য ও অবাঙালি বিহারিদের দিয়ে পল্লবের আঙ্গুলগুলো কেটে ফেলেন। ৫ এপ্রিল কাদের মোল্লার নির্দেশে ও উপস্থিতিতে তার প্রধান সহযোগী আলবদর আক্তার গুণ্ডা পল্লবের বুকে পরপর ৫টি গুলি করে হত্যা করেন। এর দু’দিন পর পল্লবের লাশ মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনে কালাপানি ঝিলের পাশে আরও ৭ জনের সঙ্গে মাটি চাপা দেওয়া হয়।
জানা গেছে, মিরপুর-১১ নম্বর বি ব্লক তালতলা নিবাসী মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লব স্থানীয় বাঙালী ও অবাঙালীদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ সব কারণে স্বাধীনতাবিরোধীদের হত্যা পরিকল্পনায় তার নাম যোগ হয়।
কাদের মোল্লার নেতৃত্বে তার সহযোগী বিহারিরা ২৭ মার্চ মহিলা কবি মেহেরুন্নেছা মেহের ও তার পরিবারের সদস্যদের মিরপুরের বাড়ির ভেতরে ঢুকে নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যা করেন। জবাই করার পর কবি মেহেরুন্নেছা কল্লাটা চুল দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে লটকিয়ে দেন তারা। এই হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দেখে বাড়ির সিরাজ নামে এক ব্যক্তি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
২ এপ্রিল স্থানীয় আলবদর বাহিনীর নেতা কাদের মোল্লা তার সহযোগী আল বদর বাহিনীর সদস্য ও বিহারীদের নিয়ে ঢাকার কল্যাণপুর, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে নিরীহ নিরাপরাধ বাঙালিদের ঘরবাড়ি লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও স্বাধীনতাকামী অনেক বাঙালিকে হত্যা এবং নারীদের ধর্ষণ করেন। ওই এলাকাগুলোতে সেদিন এক বীভৎস-করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৪ এপ্রিল তার সহযোগী আলবদর বাহিনীর প্রায় ৫০ সদস্যকে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তায় আলুব্দী (আলোকদী) গ্রাম ঘিরে নির্বিচারে গুলি করে ৩৪৪ জনকে হত্যা করেন কাদের মোল্লা।
২৪ এপ্রিল ফজরের নামাজ পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী হেলিকপ্টারযোগে তুরাগ নদীর পাড়ে আলুব্দী গ্রামের পশ্চিম পাশে অবতরণ করে। পূর্বদিক থেকে আলবদর বাহিনীর নেতা আসামি আব্দুল কাদের মোল্লা তার সহযোগী আলবদর বাহিনীর প্রায় ৫০ জন সদস্য ও বেশ কয়েকজন অবাঙালি বিহারিদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় ও যোগসাজশে আলুব্দী গ্রাম ঘিরে ফেলে ও নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালান। এ গণহত্যায় বাসু মিয়া, জহিরুল হক ওরফে জোরা মোল্লা, জেরাত আলী, ফোয়াদ আলী, শুকুর মিয়া, আওয়াল মোল্লা, ছলে মোল্লা, রুস্তম আলী ব্যাপারী, করিম মোল্লা, জয়নাল মোল্লা, কাশেম মোল্লা, বদরউদ্দিন, বিষু মোল্লা, অজল হক, ফজল হক, রহমান ব্যাপারী, নবী মোল্লা, আলামত মিয়া, মোকলেচুর রহমান, ফুলচান, নওয়াব মিয়া, ইয়াছিন ভানু, লালুচান বেপারী, সুনু মিয়াসহ ৩৪৪ জনের অধিক লোককে হত্যা করা হয়।
অভিযোগপত্রে প্রকাশ, ২৬ মার্চ সন্ধ্যা আনুমানিক ৬টায় কাদের মোল্লা তার আলবদর বাহিনী নিয়ে শহীদ হযরত আলী লস্করের বাড়িতে ঢুকে মধ্যযুগীয় তাণ্ডব চালান। কাদের মোল্লার নির্দেশে হয়রত আলী লস্করকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার অন্ত্বঃসত্বা স্ত্রী আমেনা ও দুই শিশু মেয়ে খোদেজা (৯) ও তাছলিমাকে (৬) জবাই করে হত্যা করা হয়। ছোট ছেলে বাবু, যার বয়স ছিল মাত্র ২ বছর তাকে মাটিতে আছড়িয়ে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় মেয়ে আমেনাকে (১১) পালাক্রমে ১২ জন মিলে ধর্ষণ করেন।
ঘরের ট্রাঙ্কের পেছনে লুকিয়ে থেকে তার বোনকে ধর্ষণ করার ঘটনা দেখে লস্করের বড় মেয়ে মোমেনা (তখন তার বয়স ছিল ১২ বছর) জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এ ঘটনার আগেই মোমেনার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে উঠিয়ে নেয়নি। কেরাণীগঞ্জের জিঞ্জিরায় তার স্বামীর বাড়ি ছিল। তারা এ ঘটনার সংবাদ শুনে ঘটনার ৩/৪ দিন পর এ নির্মম রোমহর্ষক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভিকটিম মোমনাকে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যান। ওই ঘটনার কারণে মোমেনা প্রায় পাগল হয়ে যাওয়ায় শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তাকে ২/৩ মাস চিকিৎসা করে ভালো করান। স্বাধীনতার পর অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরের পর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মোমেনা তাদের বাড়িতে আসে কিন্তু তার মা বাবা ভাই বোন কারও লাশ পায়নি। ঘরে তখনও রক্তের দাগ ছিল। সারা এলাকায় শুধু লাশ আর লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখে। তাদের বাড়ির সব মালামাল লুট হয়ে যায়।
ওখানে গিয়ে মোমেনা বেগম স্থানীয় লোকদের কাছে জল্লাদখানার নাম শুনে জল্লাদখানায় যায় এবং সেখানে গিয়ে মাথার খুলি ও হাড় দেখতে পায়। জল্লাদখানায় যে নারীদের ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে তাদের অনেক শাড়ি চুরি ইত্যাদি পড়ে থাকতে দেখে। এর পর মোমেনা বেগম পাগল হয়ে যাওয়ায় তাকে ৩ বছর শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয়। অনেক চিকিৎসার পরে সে সুস্থ হয়ে ওঠে।
২৫ নভেম্বর কেরাণীগঞ্জের ভাওয়াল খানবাড়ি ও ঘাটারচর (শহীদনগর) এবং পাশ্ববর্তী দু’টি গ্রামে কাদের মোল্লা তার সহযোগী আলবদর বাহিনীর সদস্যসহ পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১১ জনকে হত্যা করেন। হত্যাকাণ্ডের পর আলবদর বাহিনীর সদস্যরা মোজাফফর আহম্মেদ খানের বাড়িসহ দু’টি গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেন।
সেখানে যাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছেন, ওসমান গনি, গোলাম মোস্তফা, দরবেশ আলী, আরজ আলী, রাজা মিয়া, আব্দুর রহমান, আব্দুল কাদির, সোহরাব হোসেন, আব্দুল লতিফ, নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলীসহ আরও অনেকে।
২৯ মার্চ বিকেল ৪টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ঢাকার মিরপুর ১০নং বাসস্ট্যান্ড ও মিরপুর জল্লাদখানায় হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক ও আইনজীবী খন্দকার আবু তালেবকে হত্যার অভিযোগও আনা হয়েছে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে। অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, খন্দকার আবু তালেব আইন পেশার পাশাপাশি সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ, দৈনিক আযাদ, সংবাদ, ইত্তেফাক, দ্য মর্নিং নিউজ, অবজারভার ও পয়গাম পত্রিকায় কাজ করেছেন। ২৯ মার্চ অফিস থেকে মিরপুরে ফেরার পথে ইত্তেফাকের তত্কালীন অবাঙালি চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট আবদুল হালিম তাকে তার গাড়িতে তুলে নিয়ে পরে কাদের মোল্লার কাছে হস্তান্তর করেন।
কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীরা মিরপুরের ১০ নম্বর জল্লাদখানায় খন্দকার আবু তালেবকে নিয়ে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন।
এ আদেশের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল এখন তার সুবিধা মতো সময়ে যে কোনো দিন রায় ঘোষণা করবেন বলে সাংবাদিকদের জানান রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রায় পৌনে ৩ বছরে দ্বিতীয় কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হলো। তবে দু’টি মামলার বিচারই শেষ হয়েছে গত বছরের ২২ মার্চ গঠিত দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে। এর আগে গত ২৬ ডিসেম্বর একই ট্রাইব্যুনাল মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত পলাতক জামায়াতের সাবেক রোকন (সদস্য) আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ করে যে কোনো দিন রায় দেবেন বলে জানান।
বৃহস্পতিবার কাদের মোল্লার প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আইনি পয়েন্টে সমাপনী দিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। আর বুধবার রাষ্ট্রপক্ষে আইনি পয়েন্টে শেষ পাল্টা যুক্তি ও সমাপনী বক্তব্য উপস্থাপন শেষ করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী।
উল্লেখ্য, আসামিপক্ষ মোট ৮ কার্যদিবসে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেছেন। এর মধ্যে কাদের মোল্লার প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ৪ দিন এবং অপর আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুস সোবহান তরফদার ৪ দিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। গত ৭ জানুয়ারি থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন তারা।
অন্যদিকে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী গত ১৭ থেকে ২৭ ডিসেম্বর ও বুধবার রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। সব মিলিয়ে রাষ্ট্রপক্ষও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে সময় নেন ৮ কার্যদিবস।
পুনর্বিচারে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ
গত ৭ জানুয়ারি শুনানি শেষে কাদের মোল্লার মামলা পুনর্বিচারে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। সে আদেশে পুনর্বিচারের আবেদন করার আগে মামলাটি যে পর্যায়ে ছিল, সেখান থেকেই শুরু করার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরুর মধ্য দিয়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলাটির বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে পৌঁছে।
উল্লেখ্য, মামলার রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়ে যাওয়ার পর গত ৩ জানুয়ারি মামলাটির পুনর্বিচারের আবেদন জানান কাদের মোল্লার আইনজীবী ব্যারিস্টার তানভীর আহমেদ আল আমীন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ বেলজিয়ামের ব্রাসেলস প্রবাসী বাংলাদেশি আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল-১ এর পদত্যাগী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপি কথোপকথনের সূত্র ধরে এ আবেদন করেন আসামিপক্ষ।
ওই স্কাইপি কথোপকথনের সূত্র ধরে বিচারাধীন জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী ও নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং ট্রাইব্যুনাল-২ এ জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা ৪টিরও পুনরায় শুরু করার আবেদন গত ৩ জানুয়ারি খারিজ করে দেন দু’টি ট্রাইব্যুনাল।
অন্যদিকে একই ঘটনার সূত্র ধরে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর পাশাপাশি পুনর্গঠিত হয় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালও। ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর প্রথম ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন আর তার স্থলাভিষিক্ত হন এ ট্রাইব্যুনালেরই বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
মামলার ধারাবাহিক কার্যক্রম
মুক্তিযুদ্ধকালে গোলাম মোস্তফা নামে এক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে কেরাণীগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। ওই মামলাটি করেছিলেন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এই মামলার প্রথম সাক্ষী মোস্তফার কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ খান। ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় আরো একটি মামলা হয় কাদের মোল্লাসহ আরো অনেকের বিরুদ্ধে। ওই মামলার অভিযোগে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে ট্রাইব্যুনাল-১ এ যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয় ২০১০ সালের ২১ জুলাই।
২০১১ সালের ১ নভেম্বর জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) তার বিরুদ্ধে হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়। ২৮ ডিসেম্বর এসব অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল-১।
গত বছরের ১৬ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে আব্দুল কাদের মোল্লার মামলাসহ তিনটি মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।
গত বছরের ২৮ মে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ষড়যন্ত্র ও উস্কানিসহ ৬টি অভিযোগ এনে কাদের মোল্লার বিরদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৩(১), ৩(২)(এ)(এইচ) অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল-২। গত বছরের ২০ জুন তার বিরুদ্ধে ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী ও সুলতান মাহমুদ। তারা ৯৬ পৃষ্ঠার এ সূচনা বক্তব্যে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ৬টি অভিযোগ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ৬টি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, কবি মেহেরুন্নেছাসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা, পল্লবীর আলোকদি গ্রামে ৩৪৪ জনকে হত্যা, আইনজীবী-সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে হত্যা, বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবসহ সাত জনকে হত্যা, কেরাণীগঞ্জের শহীদনগর গ্রামের ভাওয়াল খান বাড়ি ও ঘাটারচরসহ পাশের আরো দু’টি গ্রামের অসংখ্য লোককে হত্যার ঘটনা।
এর পর ৩ জুলাই থেকে শুরু করে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) আব্দুর রাজ্জাক খান ও মনোয়ারা বেগমসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১২ জন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাদেরকে জেরা করেন।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া রাষ্ট্রপক্ষের অন্য সাক্ষীরা হলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহম্মেদ খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মামা বাহিনীর প্রধান ও কমান্ডার শহিদুল হক খান মামা, কাদের মোল্লার হাতে ক্ষতিগ্রস্ত এক নারী সাক্ষী (ক্যামেরা ট্রায়াল), কবি কাজী রোজি, শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক ও আইনজীবী খন্দকার আবু তালেবের পুত্র সরকারি কর্মকর্তা খন্দকার আবুল আহসান, সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী সাফিউদ্দিন মোল্লা, আব্দুল মজিদ পালোয়ান, কেরাণীগঞ্জের ঘাটারচর গ্রামের শহীদ নবী হোসেন বুলুর স্ত্রী নূরজাহান বেগম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মোল্লা এবং সৈয়দ আব্দুল কাইয়ুম।
অন্যদিকে ১৫ নভেম্বর থেকে শুরু করে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত কাদের মোল্লা নিজেসহ ৬ জন সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন তার পক্ষে। এর আগে ৪ নভেম্বর সাফাই সাক্ষীর জন্য আসামীপক্ষের দাখিল করা ৯৬৫ জনের তালিকা থেকে ৬জন সাক্ষীকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য অনুমোদন করেন ট্রাইব্যুনাল। অন্য ৫ সাফাই সাক্ষী হচ্ছেন, সুশীল চন্দ্র মণ্ডল, মোসলেম উদ্দিন মাস্টার, সাহেরা খাতুন, আলতাফ উদ্দিন মোল্লা ও এ আই এম লোকমান। রাষ্ট্রপক্ষ তাদের জেরা সম্পন্ন করেন।
ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে আলবদর কমান্ডার!
মুক্তিযুদ্ধকালে ‘মিরপুরের কসাই’ বলে পরিচিত এই কাদের মোল্লার আগে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা। সেখান থেকে ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্রসংঘ আলবদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হলে তিনি মিরপুরে ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠন করেন এবং এ বাহিনীর একজন কমান্ডার হন।
একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে কাদের মোল্লা পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর ইঙ্গিতে ও জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গোপন নির্দেশে ঢাকার মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে বিহারিদের সঙ্গে নিয়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা শুরু করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ার উচ্চারণ করেন।
তবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাত থেকেই শুরু হয় তার নেতৃত্বে বিহারিদের যোগসাজশে ঢাকার মিরপুরে বাঙালি হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার দখলদার বাহিনী, সহযোগী বাহিনীসহ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের অধিনায়কের কাছে আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতেই কাদের মোল্লা মানবতাবিরোধী নানা অপরাধ সংঘটিত করেন।
ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামের মরহুম সানাউল্লা মোল্লার ছেলে আব্দুল কাদের মোল্লা ১৯৪৮ সালের ২ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকায় ৪৯৩ বড়মগবাজার গ্রিন ভ্যালি অ্যাপার্টমেন্টের ৮/এ ফ্ল্যাটে থাকতেন।
কাদের মোল্লা ১৯৬১ সালে আমিরাবাদ ফজলুল হক ইনিস্টিটিউশনে ৮ম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে বিএসসি প্রথম বর্ষে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগদান করেন। বিএসসি ২য় বর্ষের শেষের দিকে তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘের কলেজ শাখার সভাপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।
১৯৬৮ সালে সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করে ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন কাদের মোল্লা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে তিনি শহীদুল্লাহ হলে থাকতেন এবং ১৯৭০ সালের অক্টোবরে তিনি শহিদুল্লাহ হলের ছাত্রসংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন।
রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, কাদের মোল্লা মুক্তিযুদ্ধকালে মিরপুরে সংঘটিত অপরাধের অভিযোগে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে ফরিদপুরে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে ফের প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসেন তিনি।
১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইসলামী ছাত্রসংঘ ইসলামী ছাত্রশিবির নামে প্রতিষ্ঠিত হলে কাদের মোল্লা ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য হন। তিনি ১৯৭৭ সালের মে মাসে জামায়াতে যোগ দেন, যদিও জামায়াত তখনও প্রকাশ্যে রাজনীতিতে আসেনি।
১৯৭৮ সালে তিনি ঢাকার রাইফেল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়্ত্বি পালন করেন। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আব্দুল হামিদ আল খতিবের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও আর্থিক সহায়তায় দেশে মুসলমান ছেলে-মেয়েদের আন্তর্জাতিক মানের একটি ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে গুলশান ১ নম্বর মার্কেটের দক্ষিণ পাশে ‘মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে মানারাত ইউনিভার্সিটি হিসেবে পরিচিত। সেখানে তিনি প্রায় ১ বছর কাজ করেন।
১৯৮০ সালে দৈনিক সংগ্রাম-এর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। তখন তিনি ঢাকা মহানগর জামায়াতের কর্মপরিষদের সদস্য থেকে সহকারী সেক্রেটারি জোনারেল পদে নিয়োজিত হন। পরবর্তীতে আবদুল কাদের মোল্লা জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদে নিয়োজিত হন। তিনি ১৯৮৬ ও ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে ফরিদপুর-৪ (সদরপুর-চরভদ্রাসন) আসনে জামায়াত থেকে নির্বাচন করেন। কিন্তু উভয় নির্বাচনে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গঠন করা অভিযোগ, ৯৬ পৃষ্ঠার সূচনা বক্তব্য এবং ৩৮৫ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, ষড়যন্ত্র ও উস্কানিসহ ৬টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, কবি মেহেরুন্নেছাসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা, পল্লবীর আলুব্দী (আলোকদি) গ্রামে ৩৪৪ জনকে হত্যা, সাংবাদিক-আইনজীবী খন্দকার আবু তালেবকে হত্যা, বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবসহ সাত জনকে হত্যা, কেরাণীগঞ্জের শহীদনগর গ্রামের ভাওয়াল খান বাড়ি ও ঘাটারচরসহ পাশের আরো দু’টি গ্রামের অসংখ্য লোককে গণহত্যার ঘটনা।
অভিযোগপত্রে জানা গেছে, ঢাকার মিরপুর ১০ নং বাসস্ট্যান্ড, মিরপুর জল্লাদখানা, মিরপুরের শিয়ালবাড়ি ও রূপনগর, মিরপুর ৬নং সেকশন, মিরপুর ১২ নম্বর সেকশন, মিরপুরের কল্যাণপুর, ঢাকার মোহাম্মদপুর এবং ঢাকা জেলার কেরাণীগঞ্জের শহীদনগরে হাজার হাজার বাঙালি হত্যার প্রধান নায়ক ছিলেন আব্দুল কাদের মোল্লা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বিহারিদের যোগসাজশে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে মিরপুরে বাঙালি হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। স্বাধীনতার পর দেশের অন্যতম বৃহৎ গণকবর আবিষ্কৃত হয় মিপুরের শিয়ালবাড়ীতে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, আলবদর বাহিনীর নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা তার সহযোগী ও অবাঙালি বিহারিদের নিয়ে মিরপুরের বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে জোরপূর্বক ধরে এনে মিরপুর-১২ নম্বর থেকে ১ নম্বর এবং ১নং শাহ আলী মাজার থেকে হাতে দড়ি বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে পুনরায় মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনে ঈদগাহ মাঠে নিয়ে এসে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখেন। পল্লবের দেহ দু’দিন ঝুলিয়ে রেখে তার সহযোগী আলবদর বাহিনীর সদস্য ও অবাঙালি বিহারিদের দিয়ে পল্লবের আঙ্গুলগুলো কেটে ফেলেন। ৫ এপ্রিল কাদের মোল্লার নির্দেশে ও উপস্থিতিতে তার প্রধান সহযোগী আলবদর আক্তার গুণ্ডা পল্লবের বুকে পরপর ৫টি গুলি করে হত্যা করেন। এর দু’দিন পর পল্লবের লাশ মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনে কালাপানি ঝিলের পাশে আরও ৭ জনের সঙ্গে মাটি চাপা দেওয়া হয়।
জানা গেছে, মিরপুর-১১ নম্বর বি ব্লক তালতলা নিবাসী মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লব স্থানীয় বাঙালী ও অবাঙালীদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ সব কারণে স্বাধীনতাবিরোধীদের হত্যা পরিকল্পনায় তার নাম যোগ হয়।
কাদের মোল্লার নেতৃত্বে তার সহযোগী বিহারিরা ২৭ মার্চ মহিলা কবি মেহেরুন্নেছা মেহের ও তার পরিবারের সদস্যদের মিরপুরের বাড়ির ভেতরে ঢুকে নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যা করেন। জবাই করার পর কবি মেহেরুন্নেছা কল্লাটা চুল দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে লটকিয়ে দেন তারা। এই হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দেখে বাড়ির সিরাজ নামে এক ব্যক্তি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
২ এপ্রিল স্থানীয় আলবদর বাহিনীর নেতা কাদের মোল্লা তার সহযোগী আল বদর বাহিনীর সদস্য ও বিহারীদের নিয়ে ঢাকার কল্যাণপুর, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে নিরীহ নিরাপরাধ বাঙালিদের ঘরবাড়ি লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও স্বাধীনতাকামী অনেক বাঙালিকে হত্যা এবং নারীদের ধর্ষণ করেন। ওই এলাকাগুলোতে সেদিন এক বীভৎস-করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৪ এপ্রিল তার সহযোগী আলবদর বাহিনীর প্রায় ৫০ সদস্যকে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তায় আলুব্দী (আলোকদী) গ্রাম ঘিরে নির্বিচারে গুলি করে ৩৪৪ জনকে হত্যা করেন কাদের মোল্লা।
২৪ এপ্রিল ফজরের নামাজ পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী হেলিকপ্টারযোগে তুরাগ নদীর পাড়ে আলুব্দী গ্রামের পশ্চিম পাশে অবতরণ করে। পূর্বদিক থেকে আলবদর বাহিনীর নেতা আসামি আব্দুল কাদের মোল্লা তার সহযোগী আলবদর বাহিনীর প্রায় ৫০ জন সদস্য ও বেশ কয়েকজন অবাঙালি বিহারিদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় ও যোগসাজশে আলুব্দী গ্রাম ঘিরে ফেলে ও নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালান। এ গণহত্যায় বাসু মিয়া, জহিরুল হক ওরফে জোরা মোল্লা, জেরাত আলী, ফোয়াদ আলী, শুকুর মিয়া, আওয়াল মোল্লা, ছলে মোল্লা, রুস্তম আলী ব্যাপারী, করিম মোল্লা, জয়নাল মোল্লা, কাশেম মোল্লা, বদরউদ্দিন, বিষু মোল্লা, অজল হক, ফজল হক, রহমান ব্যাপারী, নবী মোল্লা, আলামত মিয়া, মোকলেচুর রহমান, ফুলচান, নওয়াব মিয়া, ইয়াছিন ভানু, লালুচান বেপারী, সুনু মিয়াসহ ৩৪৪ জনের অধিক লোককে হত্যা করা হয়।
অভিযোগপত্রে প্রকাশ, ২৬ মার্চ সন্ধ্যা আনুমানিক ৬টায় কাদের মোল্লা তার আলবদর বাহিনী নিয়ে শহীদ হযরত আলী লস্করের বাড়িতে ঢুকে মধ্যযুগীয় তাণ্ডব চালান। কাদের মোল্লার নির্দেশে হয়রত আলী লস্করকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার অন্ত্বঃসত্বা স্ত্রী আমেনা ও দুই শিশু মেয়ে খোদেজা (৯) ও তাছলিমাকে (৬) জবাই করে হত্যা করা হয়। ছোট ছেলে বাবু, যার বয়স ছিল মাত্র ২ বছর তাকে মাটিতে আছড়িয়ে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় মেয়ে আমেনাকে (১১) পালাক্রমে ১২ জন মিলে ধর্ষণ করেন।
ঘরের ট্রাঙ্কের পেছনে লুকিয়ে থেকে তার বোনকে ধর্ষণ করার ঘটনা দেখে লস্করের বড় মেয়ে মোমেনা (তখন তার বয়স ছিল ১২ বছর) জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এ ঘটনার আগেই মোমেনার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে উঠিয়ে নেয়নি। কেরাণীগঞ্জের জিঞ্জিরায় তার স্বামীর বাড়ি ছিল। তারা এ ঘটনার সংবাদ শুনে ঘটনার ৩/৪ দিন পর এ নির্মম রোমহর্ষক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভিকটিম মোমনাকে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যান। ওই ঘটনার কারণে মোমেনা প্রায় পাগল হয়ে যাওয়ায় শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তাকে ২/৩ মাস চিকিৎসা করে ভালো করান। স্বাধীনতার পর অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরের পর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মোমেনা তাদের বাড়িতে আসে কিন্তু তার মা বাবা ভাই বোন কারও লাশ পায়নি। ঘরে তখনও রক্তের দাগ ছিল। সারা এলাকায় শুধু লাশ আর লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখে। তাদের বাড়ির সব মালামাল লুট হয়ে যায়।
ওখানে গিয়ে মোমেনা বেগম স্থানীয় লোকদের কাছে জল্লাদখানার নাম শুনে জল্লাদখানায় যায় এবং সেখানে গিয়ে মাথার খুলি ও হাড় দেখতে পায়। জল্লাদখানায় যে নারীদের ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে তাদের অনেক শাড়ি চুরি ইত্যাদি পড়ে থাকতে দেখে। এর পর মোমেনা বেগম পাগল হয়ে যাওয়ায় তাকে ৩ বছর শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয়। অনেক চিকিৎসার পরে সে সুস্থ হয়ে ওঠে।
২৫ নভেম্বর কেরাণীগঞ্জের ভাওয়াল খানবাড়ি ও ঘাটারচর (শহীদনগর) এবং পাশ্ববর্তী দু’টি গ্রামে কাদের মোল্লা তার সহযোগী আলবদর বাহিনীর সদস্যসহ পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১১ জনকে হত্যা করেন। হত্যাকাণ্ডের পর আলবদর বাহিনীর সদস্যরা মোজাফফর আহম্মেদ খানের বাড়িসহ দু’টি গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেন।
সেখানে যাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছেন, ওসমান গনি, গোলাম মোস্তফা, দরবেশ আলী, আরজ আলী, রাজা মিয়া, আব্দুর রহমান, আব্দুল কাদির, সোহরাব হোসেন, আব্দুল লতিফ, নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলীসহ আরও অনেকে।
২৯ মার্চ বিকেল ৪টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ঢাকার মিরপুর ১০নং বাসস্ট্যান্ড ও মিরপুর জল্লাদখানায় হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক ও আইনজীবী খন্দকার আবু তালেবকে হত্যার অভিযোগও আনা হয়েছে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে। অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, খন্দকার আবু তালেব আইন পেশার পাশাপাশি সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ, দৈনিক আযাদ, সংবাদ, ইত্তেফাক, দ্য মর্নিং নিউজ, অবজারভার ও পয়গাম পত্রিকায় কাজ করেছেন। ২৯ মার্চ অফিস থেকে মিরপুরে ফেরার পথে ইত্তেফাকের তত্কালীন অবাঙালি চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট আবদুল হালিম তাকে তার গাড়িতে তুলে নিয়ে পরে কাদের মোল্লার কাছে হস্তান্তর করেন।
কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীরা মিরপুরের ১০ নম্বর জল্লাদখানায় খন্দকার আবু তালেবকে নিয়ে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন।
No comments