আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষাকারী নেতা
মাকসুদুল আলম:গত রোববার, ১৬ই ডিসেম্বর ছিল আমাদের মহান বিজয় দিবসের ৪১ বছরপূর্তি।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা-নিবেদনসহ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে সারা দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপিত হয় দিনটি। ঠিক একই দিনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জাপানের নিম্ন কক্ষের সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচনের ভোটের ফলাফলেই সাধারণত বিজয়ী দল থেকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে থাকেন। রোববারের নিম্নকক্ষের সাধারণ নির্বাচনে মোট ৪৮০টি আসনের মধ্যে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নোদার ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব জাপান (ডিপিজে) মাত্র ৫৭টি আসন পায়। পক্ষান্তরে, বিরোধী দল সাবেক প্রধানমন্ত্রী আবের লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি) ২৯৪টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এলডিপি জোটের অপর শরিক দল কওমেইতো এককভাবে পায় ৩১টি আসন। তার মানে হচ্ছে, এলডিপি ও কওমেইতো জোটবদ্ধভাবে এই নির্বাচনে ৩২৫টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। হবু প্রধানমন্ত্রী আবে ইতিমধ্যে জানিয়েছেন যে, এলডিপি ও কওমেইতো আগের মতোই জোটবদ্ধভাবে সরকার গঠন করবে। প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি আসনে বিজয়ী হয়ে জনাব আবে তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, ‘এতে করে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষা করতে আমাদের দায়িত্বও অনেক বেশি বেড়ে গেল’। উল্লেখ্য, কট্টরপন্থি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও এলডিপি নেতা আবে পার্শ্ববর্তী দেশ চীন ও কোরিয়ার সঙ্গে বিতর্কিত দ্বীপপুঞ্জ যথাক্রমে সেনকাকু দ্বীপ ও তাকেশিমা দ্বীপ প্রসঙ্গে কঠোর অবস্থানে অঙ্গীকারবদ্ধ রয়েছেন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও জাপানের মালিকানাধীন এই দ্বীপপুঞ্জ গুলো নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ চীন ও কোরিয়ার সঙ্গে জাপানের বিবাদ দীর্ঘদিনের। ২০০৯ সালে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন আবে। আগামী ২৬শে ডিসেম্বর সংসদের বিশেষ অধিবেশনের মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের কথা রয়েছে তার। অপরদিকে, নির্বাচনে দলের ভরাডুবির পর ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নোদা ডিপিজে প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।বলা যায়, বাংলাদেশ ও জাপান দুটি বিপরীতমুখী রাষ্ট্র। রাষ্ট্র দুটির মোট জনসংখা সমান না হলেও, মোটামুটি কাছাকাছি। উভয়ের প্রধান খাবার ভাত। জাতীয় পতাকায় রয়েছে অনেক মিল। অমিল শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়। ঐতিহাসিক কেলেঙ্কারি, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সীমাহীন দুর্নীতি, জনগণের ধনসম্পদ লুটপাট, অপশাসন ও জালিয়াতির কথা আজ না হয় বাদই দিলাম। রাজনৈতিক দিক থেকে বলা যায়, একেবারেই ভিন্ন দুটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। জাপানে নেই আমাদের মতো প্রতিহিংসার রাজনীতি, সংঘাতময় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হরতাল-ধর্মঘট। ক্ষমতাসীন সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে নেই কোন রাজনৈতিক সহিংসতা। একে অপরের শত্রু নয় তারা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নেই কোন ছাত্র রাজনীতি। ফলে স্বভাবতই চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিতে ডিগ্রিধারী দলীয় কোন ক্যাডারও নেই এখানে। জাতিগতভাবে জাপানিরা খুবই দয়ালু হলেও এখানে নেই আমাদের মতো দয়ালু কোন প্রেসিডেন্ট। যিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসী ও খুনিদের একে একে ক্ষমা করে দিয়ে দেশের জেলখানাগুলো ফাঁকা করে দেবেন। এখানে নেই কালা জাহাঙ্গীর, সুইডেন আসলাম, লেংড়া শাহীন, পিচ্চি হান্নান, চোখ তোলা শাজাহান, চাপাতি শাকিল কিংবা মদ খাওয়া আলমগীরও। এখানে আইন অনুযায়ী কিংবা আদালতের নির্দেশে কঠোর গোপনীয়তায় কখনও মুক্তি দেয়া হয় না বিকাশ কুমারের মতো নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরদের। পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসীর মুক্তিতে পর্দার আড়ালে ভূমিকা রাখে না ক্ষমতাসীন সরকারের প্রভাবশালী কোন মন্ত্রী। সংবিধানের অজানা কোন অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মাঝ রাতে জাতীয় সংসদের স্টিকার লাগানো গাড়িতে করে বস্তাভর্তি টাকা যায় না সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর বাসা-বাড়িতে। সাধারণ কর্মচারী থেকে অল্প সময়ে শ’ শ’ কোটি টাকার মালিক হয়ে ভূঁইফোড় ব্যবসায়ী বনে যাওয়া, নিজেকে নিরীহ, পরিচ্ছন্ন ও সৎ বলে প্রমাণের জন্য দেশের প্রথম সারির পত্রিকাগুলোয় লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিয়ে সততার সার্টিফিকেট জোগাড় করা কোন দেশপ্রেমিকের অপকর্মে সমগ্র জাতিকে খেসারত দিতে হয় না এখানে।
বাংলাদেশ ও জাপান বিপরীতমুখী এই দুটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গণমাধ্যমেও রয়েছে ব্যাপক অমিল। জাপানে দৈনিক পত্রপত্রিকাগুলোর পাশাপাশি রয়েছে সান্ধ্যকালীন ও সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড। যাদের মূল কাজই হচ্ছে রাজনীতিবিদ, প্রফেশনাল কোন স্পোর্টসের খেলোয়াড়, চিত্রজগত কিংবা টেলিভিশন ট্যালেন্টদের যে কোন অনিয়ম বা স্ক্যান্ডাল খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। বিখ্যাত সেলিব্রিটিদের ব্যক্তিগত প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা থেকে শুরু করে বিয়ে, সন্তান-প্রসব ইত্যাদি যে কোন গোপন সংবাদও বাদ যায় না এখানে। সেদিক থেকে আমাদের গণমাধ্যম কর্মীরা অনেকটা হাত-পা বাঁধা। ঝুঁকি নিয়ে রিপোর্ট করেন তারা। আমাদের দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হয় সব সরকারের আমলেই। অনুসন্ধানী যে কোন প্রতিবেদনের জন্য মাশুল দিতে হয় সাংবাদিকদের। নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে হয় সংবাদকর্মীদের। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে জুলুম, নির্যাতন ও মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করে থাকে ক্ষমতাসীন সরকার। সমপ্রতি বেলজিয়ামে অবস্থানরত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন প্রবাসী বাংলাদেশীর সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ সংলাপ প্রকাশের পর একটি দৈনিক পত্রিকার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, তা স্বাধীন-সার্বভৌম গণমাধ্যমের ওপর সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপেরই বহিঃপ্রকাশ। সত্য লেখার দায়ে দৈনিক পত্রিকাটির সম্পাদকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা মামলা ও তাকে অফিসে অবরুদ্ধ করে রাখা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য আচরণ হতে পারে না। জাপানে এ ধরনের নির্যাতন ও নিপীড়নের মতো ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই লেখকের। অন্তত বিগত ২১ বছরে সেরকম কিছু ঘটেনি।
জাপানিরা ভাল করেই জানে যে, তাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষা করতে এই মুহূর্তে প্রয়োজন শিনযো আবের মতো কট্টরপন্থি এলডিপি নেতার। যিনি বিতর্কিত দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ চীন ও কোরিয়ার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামপ্রতিক যে উত্তেজনা বিরাজ করছে তা প্রশমিত করে, ইতিবাচক পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবেন। যিনি পূর্ব এশিয়ার পারস্পরিক কল্যাণের জন্য কৌশলগত সম্পর্কের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবেন। দ্বিপক্ষীয় বা ত্রিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য উল্লিখিত দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখবেন। গত বছরের ভূমিকম্প ও সুনামি পরবর্তী জাপানের বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠিত করে, আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়টি জোরদার করবেন। যিনি জাপানের অর্থনীতিকে আবারও চাঙ্গা করে বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় ঋণ থেকে এই জাতিকে মুক্তির পথ দেখাবেন। সর্বোপরি, জনগণকে দেয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন। অথচ আমাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় আমাদের জাতীয় রাজনীতি হয়েছে দূষিত, কলুষিত ও সংঘাতময়। দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়েছে সারা দেশ। দলীয় ক্যাডারদের হাতে জিম্মি হয়ে আছে সাধারণ জনগণ। আমাদের সরকারি সংস্থাগুলোয় রয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব। মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে আমাদের। গুম ও খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও নিপীড়নের মতো ঘটনা আজ আমাদের দেশে নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাপানিরা না হয় তাদের সাধারণ নির্বাচনে শিনযো আবেকে পেয়েছে। আমাদেরকে কে রক্ষা করবে? আমাদের মুক্তির পথ দেখাবেন কে?
লেখক: জাপান প্রবাসী কলাম লেখক
১৮ ডিসেম্বর ২০১২, টোকিও
No comments