আনোয়ারা সৈয়দ হকের কলাম- একের পর এক ভুল কাজ
স্বাধীনতার পর থেকে আমরা একের পর এক ভুল কাজ করে যাচ্ছি। এমন সব ভুল যা আমাদের জাতীয় জীবনকে মাঝেমধ্যেই সঙ্কটে এবং দুরবস্থার ভেতরে ফেলে দিচ্ছে।
প্রথম কথা তো, দেশ স্বাধীনের পর পর জাতি যুদ্ধাবস্থার য়তি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাজনীতির অঙ্গনে লেগে গেল তুলকালাম কা-। ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের জন্য দেশের মানুষের ভেতরে শুরম্ন হলো মারামারি, হানাহানি। তারপর যুদ্ধাপরাধীরা কেমন করে যেন জাতির পিতার সামগ্রিক মার ভেতর দিয়ে ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে গেল। তারপর দেশের খোদ রাষ্ট্রপতি এবং জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর নেমে এলো ইচ্ছাকৃতভাবে বিপথগামী কিছু সেনা কর্মকর্তা এবং সেনা কর্মচারীর বিশ্বাসঘাতকতার উদ্যত খ্তগ, যা শুধু দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতিই হুমকি হয়ে দাঁড়াল না, আদর্শের প্রশ্নে দেশকে দ্বিধাবিভক্ত করতেও সম হলো। যদিও দেশের ভাল করার লেবাসে সবকিছু করা হয়েছে বলে প্রচার করা হলো, আদতে দেশের কোনই ভাল হলো না। বরং সম্পূর্ণ ব্যক্তিগতভাবে ভাল হলো সেই সব মানুষের, যারা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের হত্যার পেছনে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয়ভাবে সাবলীল ছিল। তাদের ব্যক্তিগত লাভ হলো খুব। তারা সবাই বড় বড় পোস্টে দেশে-বিদেশে আসন পেতে বসল। প্রচুর ধন-দৌলতের অধিকারী হলো।বস্তুতপ েএই সময় থেকে দেশে বাংলাদেশের মানুষের জীবনাদর্শ এবং সংবিধানের পরিপন্থী নকল ধর্মের রাজনীতি করা শুরম্ন হলো। সেই রাজনীতির ধারায় দেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হলো। সেই যে নকল ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ধর্মের ছোবলে দেশটির শরীরে বিষ ঢেলে দেয়া হলো, সেই বিষের পরিমাণ এখন পর্যনত্ম দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর পর থেকে যিনি যত বড় বুলি মুখে কপচিয়েই দেশের শাসনভার গ্রহণ করম্নন না কেন, ধর্মের ছোবল থেকে দেশের মানুষ মুক্ত আর হলো না। যে ধর্ম অনাদিকাল থেকে এখানে প্রতিটি মানুষের রক্তের ভেতরে মিশে আছে, তাকে খুঁড়ে তোলা হলো এমনভাবে, যেন এর আগে আমাদের বাঙালীর ভেতরে কোন ধর্মই ছিল না। রজনীতির তথাকথিত দিকপালদের কাছে নিতে হলো আমাদের ধর্মের পাঠ; একের পর এক। একজন দিকপাল সৈনিকের উর্দি ছেড়ে দেশ শাসন করতে বসে সংবিধানের মাথায় বসালেন পবিত্র কোরানের বাণী। আরেক দিকপাল তিনিও সৈনিকের লেবাস ছেড়ে দেশ শাসন করতে এসে বংলাদেশের সংবিধানে বসালেন ইসলাম ধর্ম। তিনি এমনও গর্ব করে জনসম েঘোষণা দিলেন যে, তিনি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার ফলে পৃথিবীর মানুষ বাংলাদেশটিকে ইসলামী দেশ বলে জানছে। তার আগে পৃথিবীর (সেই তথাকথিত নেতার মনে অবশ্য পৃথিবীর ম্যাপের অধিকাংশজুড়ে ছিল সৌদি আরব আর পাকিসত্মান) মানুষ নাকি আমাদের হিন্দু বলে জানত। বাঙালী জাতিকে এত বড় হেনস্থা এর আগে আর কে করেছে? আমরা কি কোনদিন ধর্মহীন জাতি ছিলাম? একজন স্বৈরশাসক জোর করে দেশ শাসন করতে এসে আমাদেরকে কি বেশি করে ধার্মিক করে তুলেছে? দেশবাসীকে একদিন এসব কথা অবশ্যই ভাবতে হবে। তাদের ভাবতে হবে কীভাবে ধর্মের দোহাই দিয়ে দেশের সাধারণ ও অজমূর্খ মানুষদের ঠকিয়ে এসব তথাকথিত রাজনীতিবিদ দেশের ভাল ভাল ফায়দা লুট করে নিয়েছে। একবার যখন দেখেছে যে ধর্মের ব্যাপারে সাধারণভাবে অজ্ঞ মানুষদের দুর্বলতা, তার পর থেকেই তারা শুধু প্রকৃত ধর্মের নাম করে ধর্মের ভ- খেলাই খেলে যাচ্ছে। যেখানেই তারা দেখছে সত্য ও ন্যায়ের প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে, পরমুহূর্তে তারা সেখানে ধর্মের ছোপ মেরে মানুষের মুখ বন্ধ করে ফেলছে। বিএনপি এবং জামায়াতের আমলেও আমরা এই নকল ধর্মের দাপটই শুধু চোখে দেখে গিয়েছি।
কিন্তু এখন আওয়ামী লীগ। আমাদের প্রশ্নটি এখানেই। নির্বাচনের আগে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মুখে সেস্নাগান শুনেছি_ যার নেই কোন কিছু, সেই নেয় আওয়ামী লীগের পিছু। অর্থাৎ দেশের খেটে খাওয়া মানুষদের স্বপ্ন দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ। যে লীগের কাছে ধর্ম প্রধান ফ্যাক্টর হিসাবে আসেনি, এসেছে মানুষের কষ্টের উদ্ধারকর্তা হিসাবে। দেশের মানুষ যখন না খেয়ে থেকেছে তখনও ধর্ম করে গেছে। না খেয়ে থাকার অজুহাতে তারা ধর্ম করা বন্ধ করে দেয়নি।
আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে তাই আমাদের অনুরোধ, তারা যেন কোনদিন জিয়া আনত্মর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পাল্টে হযরত শাহজালালের নামে না করেন। তাহলে এতে ধর্মের জয়গান তো হবেই না, বরং দেশকে নকল ধর্মের লেবাসে ঢেকে ফেলা হবে। প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখ বন্ধ করে ফেলার একটা কৌশল হবে। কিন্তু এতে দেশের মানুষকে আরও ধর্মান্ধ করে তোলা হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী দল ধর্মের যত্রতত্র ব্যবহার করে দেশের সাধারণ মানুষকে ধর্মান্ধ করে তোলার জন্য যুগের পর যুগ ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেশের মানুষকে তথাকথিত সেই ধর্মবীরদের হাতেই আবার তুলে দেয়া হবে।
আওয়ামী লীগ সরকারকে আমরা অনুরোধ করি, পুরো ব্যাপারটা সম্যকভাবে অনুধাবন করতে। এভাবে বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বীকে বেকায়দায় ফেলার জন্য যদি ধর্মের আশ্রয় নেন, তাহলে এই ভুল দিকনির্দেশনা বুমেরাং হয়ে তাদের বুকেই আবার ফিরে আসবে। জিয়া আনত্মর্জাতিক বিমানবন্দরকে অকেজো করার বহু পন্থা আছে। কিন্তু সেটা করলে আমাদের জাতি সম্মুখে এগিয়ে যেতে পারবে কি-না, সে বিষয়েও তাদের ভাবতে অনুরোধ করি।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, তুমি অধম হইলেও আমি উত্তম হইব না কেন ?
সেই ১৯৭১ সালে দেশের জনসাধারণের হাত ধরে দেশকে হানাদারমুক্ত করে দেশের স্বাধীনতা আনয়নকারী আওয়ামী লীগকে তাই আমরা এসব ুদ্র বিষয় ছেড়ে আরও বৃহত্তর বিষয়ের দিকে এগিয়ে যেতে অনুরোধ করি। সেই বৃহত্তর বিষয়ের একটি হলো সংবিধান থেকে ধর্মের সবকিছু মুছে ফেলা। ধর্মের জন্য আমাদের ঘরে ঘরে আছে পবিত্র কোরান শরীফ। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রতিটি বাঙালী মুসলমান তাকে স্পর্শ করেই তাদের দৈনিক জীবন শুরম্ন করে। তাই আলাদাভাবে আমাদের সংবিধানে ধর্মকে আনার কোন প্রয়োজন নেই।
দেশ চালাতে বসে তাই আগের স্বাধীনতাবিরোধী শাসকদের পদাঙ্ক অনুসরণ না করে এবং তাদের মতো একের পর এক ভুল কাজ না করতে এই সরকারকে আমরা আবারও অনুরোধ করি।
No comments