তলাবিহীন ঝুড়ি নয় খাদ্য বিপ্লবের দেশ বাংলাদেশ ॥ মজেনা
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজেনা এবার বাংলাদেশকে নিয়ে নিজ দেশের কূটনীতিকের দেয়া ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ উপমার সমালোচনা করলেন। শুধু তাই নয়, তাঁর ওই বক্তব্য খ-ন করে তিনি বাংলাদেশকে খাদ্য বিপ্লবের দেশ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
বুধবার খাদ্য নিরাপত্তা সমীক্ষার উপাত্ত ও ফলাফল বিশ্লেষণের জন্য আয়োজিত এক কর্মশালায় তিনি বলেন, ‘বহু আগে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি (সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার) বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু তা যদি সত্যি হতো, তাহলে কিভাবে এই ঝুড়ি এখন পরিপূর্ণ হয়ে শস্যে উপচে পড়ছে?ডব্লিউ মজেনা বলেন, বাংলাদেশের লাখ লাখ কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই বাংলাদেশ খাদ্য ঝুড়িতে পরিণত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ এখন খাদ্য বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবং বিপ্লবে জয়ী হতে চলেছে। তিনি বলেন, কিছু লোক একে অলৌকিক ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করলেও আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশ আগামী এক দশকের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে।
বুধবার রাজধানীর রূপসীবাংলা হোটেলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও ইউএসএআইডি যৌথভাবে এই কর্মশালার আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। বিশেষ অতিথি মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরে বলেন, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি এ তিনটি বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য অতি জরুরী। অথচ দেশে জনসংখ্যা বেড়ে চললেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদ কমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রতিবছর কমছে কৃষি জমির পরিমাণ। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং পুষ্টির নিশ্চয়তা বিধান করা বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন।
তিনি বলেন, কৃষক দ্রুত আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে খাপখাইয়ে নিচ্ছে। কিন্তু সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে কৃষকের দোরগোড়ায় কৃষির সব আধুনিক প্রযুক্তি পৌঁছে দেয়া যাচ্ছে না।
মতিয়া চৌধুরী বলেন, উত্তরবঙ্গে বোরো আবাদ করতে গিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। অথচ আমরা বোরো চাষে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার করতে পারছি না। আমাদের ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে বোরো ফসলকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নিয়ে যেতে হবে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে খাদ্যঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, নীতি সহায়তা ও যুতসই প্রযুক্তির অভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত লবণাক্ততা। সময় এসেছে এ লবণাক্ততার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার। ভবিষ্যত প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আমাদের এখনই এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা শুরু করতে হবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর অনুষ্ঠিত হয় তিনটি কারিগরি অধিবেশন। এসব অধিবেশনে গবেষণার ফল তুলে ধরে তা আলোচনার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয়। আইএফপিআরআইয়ের পলিসি রিসার্চ এবং স্ট্রাটেজি প্রোগ্রামের প্রধান ড. আখতার আহমেদ গবেষণালব্ধ তথ্য তুলে ধরে বলেন, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ৮০টি কর্মসূচী আছে। কিন্তু এর সবই কার্যকর নয়। কিছু কর্মসূচী আছে কার্যকর। ঘুরেফিরে সেগুলোই বাস্তবায়িত হচ্ছে। তবে এসব কর্মসূচী বাস্তবায়নে দক্ষতার অভাব রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এসব কর্মসূচীর ৩১ শতাংশ অতি দরিদ্র মানুষ পাচ্ছে। কিন্তু আট শতাংশ পাচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী মানুষরা।’
ড. আখতার আহমেদ বলেন, সামাজিক নিরাপত্তায় সরকারের সবচেয়ে ভাল কর্মসূচী হচ্ছে কর্মসৃজন কর্মসূচী। এ কর্মসূচীতে কাজের বিনিময়ে অতি দরিদ্র মানুষকে অর্থ প্রদান করা হচ্ছে। এটি একটি খুবই কার্যকর পদক্ষেপ। কিন্তু এ কর্মসূচীতে যে অবকাঠামো উন্নয়ন করা হচ্ছে তা তেমন টেকসই নয়।
তিনি বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তার এই কর্মসূচীগুলো লক্ষ্যপূর্ণ নয়। ফলে তা দারিদ্র্য নিরসনে খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না।’
দারিদ্র্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দৈনিক সোয়া এক ডলার আয়কে দারিদ্র্যের মানদ- ধরলে দেশের ৩৮ শতাংশ মানুষ দৈনিক সোয়া এক ডলারের নিচে অবস্থান করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষ হচ্ছে রংপুর এলাকায়। ওই এলাকায় দারিদ্র্যের হার ৬৫ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম চট্টগ্রাম বিভাগে। তবে দরিদ্রতার পাশাপাশি প্রকট আয় বৈষম্যও বিরাজ করছে।
শিক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষায় ৮০ শতাংশ শিশুই স্কুলে এনরোলমেন্ট হচ্ছে। এর মধ্যে আবার ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ভর্তির সংখ্যা বেশি। প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ বেশি।
No comments