শিক্ষিত অভিভাবকদের ধারণা, সরকারি বিদ্যালয়ে পড়াশোনার মান ভালো নয় তাই সন্তানদের কিন্ডারগার্টেনে পাঠান- এলাকা অভিজাত শিক্ষার্থীরা দরিদ্র
রাজধানীর পশ্চিম ধানমন্ডি এলাকার জাফরাবাদ আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বেশ খোলামেলা। একাধিক ভবন, বড়সড় মাঠ। বিদ্যালয়ের ১৯ জন শিক্ষকের সবাই প্রশিক্ষণ নেওয়া। ফলও মন্দ নয়।
তার পরও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন তাঁদের সন্তানদের এই বিদ্যালয়ে পড়ান না। এমনকি এই স্কুলের শিক্ষকেরাও তাঁদের সন্তানদের কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি স্কুলে পড়ান। ফলে বস্তিবাসী আর দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরাই এই স্কুলের শিক্ষার্থী।কেবল এই স্কুল নয়, ঢাকা মহানগরের ২৯৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব কটির চিত্রই কমবেশি একই রকম।
প্রথম আলোর ছয়জন প্রতিবেদক দুই সপ্তাহ ধরে রাজধানীর ১২টি প্রশাসনিক থানার অধীনে সব কটি স্কুল সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। এতে দেখা গেছে, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, গুলশান, রমনা ও মতিঝিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও অভিজাত এলাকায়ও দরিদ্র ছেলেমেয়েরাই সরকারি স্কুলগুলোতে পড়তে আসছে
শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষিত অভিভাবকদের ধারণা, সরকারি বিদ্যালয়ে পড়াশোনার মান ভালো নয়। তাই সন্তানদের কিন্ডারগার্টেনে পাঠান মোহাম্মদপুর থানার অধীন ১৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। শিক্ষার্থী সাড়ে ১২ হাজার।
মোহাম্মদপুর থানার জাফরাবাদ আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, স্কুলটিতে সুন্দর পরিবেশে ক্লাস হচ্ছে। প্রধান শিক্ষক কামালউদ্দিন জানান, নিম্নবিত্ত আর বস্তিবাসীর সন্তানেরাই মূলত এখানে পড়ে। প্রতিবছরই এই স্কুল থেকে একজন-দুজন করে বৃত্তি পায়।
সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে কারা পড়তে আসছে জানতে চাইলে কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে মোহাম্মদপুর থানা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহানা আহমেদ বলেন, এখন সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষকেরা অনেক যোগ্য। অনেক ভালো। কিন্তু শ্রমিক ও বস্তিবাসীদের সন্তানেরাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আসছে।
ধানমন্ডি থানার অধীন সরকারি প্রাথমিক বিদালয়ের সংখ্যা আটটি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে ছয় হাজার। শিক্ষক ১০৩ জন। ধানমন্ডি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শামসুন নাহার বলেন, ধানমন্ডির স্কুলগুলোর মধ্যে জিগাতলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি আবাসিক এলাকায় হওয়ায় এখানে মধ্যবিত্ত পরিবারের কিছু ছেলেমেয়ে পড়ে। বাকি সব কটিতেই লেখাপড়া করে দরিদ্র ও বস্তিবাসী পরিবারের ছেলেমেয়েরা।
শামসুন নাহার নিজেও তাঁর সন্তানকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেননি। কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘আসলে আমি ঘরের কাছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পাইনি। তাই পাঠাইনি।’
ধানমন্ডির একজন প্রধান শিক্ষক বলেন, কিন্ডারগার্টেনসহ অন্যান্য বেসরকারি বিদ্যালয়ে ইংরেজির ওপর জোর দেওয়া হয়। বেশ কিছু সহজ পাঠও পড়ানো হয়। আর সরকারি বিদ্যালয়ে পড়ানো হয় কেবল বোর্ডের বই। এ জন্য অনেক অভিভাবক সন্তানদের এগিয়ে রাখার জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করান।
গুলশানে মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৮টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৪ হাজার। শিক্ষক ৩৭৪ জন। এখানেও দরিদ্ররাই সরকারি স্কুলগুলোতে পড়তে আসছে বলে জানান গুলশান থানা শিক্ষা কর্মকর্তা জ্যোৎস্না খাতুন। তিনি বলেন, অভিজাত এলাকা হওয়ার পরও অধিকাংশ শিক্ষার্থী নিম্নবিত্ত ও বস্তিবাসী পরিবারের। তেজগাঁও থানার অধীনে মোট ১০টি সরকারি স্কুল আছে। এখানকার প্রায় সব স্কুলেই বস্তিবাসীর সন্তানেরা পড়ে।
মতিঝিল থানার অধীনে ২২টি সরকারি স্কুল আছে। এখানকার সরকারি স্কুলগুলো ঘুরে দেখা গেছে, অবকাঠামো মোটামুটি ভালো। কিন্তু মতিঝিল সরকারি আইডিয়াল স্কুল বাদে বাকিগুলোতে দরিদ্রদের সন্তানেরাই পড়তে আসছে।
রমনা এলাকায় নয়টি সরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই হাজার ৩০০ আর শিক্ষক ৭০ জন। এখানকার দিলকুশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজনীন বানু হতাশা নিয়ে বলেন, ‘আমার স্কুলের আয়াও তার নাতনিকে বেসরকারি স্কুলে পাঠাচ্ছে। সরকারি স্কুলে ছেলেমেয়েকে পাঠানো যেন এখন লজ্জার ব্যাপার।’
No comments