ফজল শাহাবুদ্দীন, একজন কবি একজন সম্পাদক by আমিনুর রহমান
অনেকদিন হলো কবি ফজল শাহাবুদ্দীনকে চিনি। প্রথম পরিচয় কবি আল মাহমুদ-এর মাধ্যমে হলেও সংস্পর্শে অনেক বেশি এসেছি কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের। মাহমুদ ভাই এবং ফজল ভাই, এই দুই কবির চরিত্র আমার কৈশোর পেরম্ননো জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছে।
বহু ঘটনা, বহু স্মৃতি, যা ভুলে যাবার নয়। বহু কবিতার জন্ম অথবা প্রথম শ্রোতার স্মৃতি তো আমার অনেকই আছে। যখনই স্মৃতি প্রবলভাবে বাতাসে গা এলিয়ে দেয়, তখনই বেজে ওঠে কবিতার ঘণ্টা যা সারাৰণ বেজেই চলে, নিরনত্মর। কবিতা থেকে নির্বাসন সম্ভব নয়, অনত্মত যাদের কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের সঙ্গে পরিচয় আছে। কবিতার ঘোরকে উপেৰা করা সম্ভব নয়, অনত্মত যাদের কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের সঙ্গে পরিচয় আছে। কবিতাজাত ঘনঘোর এক জীবনের অন্য নাম কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। যার একটি মুহূর্তও কবিতা কল্পনা থেকে বাইরে নয়। বাংলা ভাষায় আপন কবিতার ঘোরে চলমান দু'-চারজন শ্রেষ্ঠ কবির অন্যতম কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। বাংলাদেশের প্রথম কবিতা পত্রিকা কবিকণ্ঠ এবং এক সময়ের আলোড়ন সৃষ্টিকারী মাসিক পত্রিকা নান্দনিক-এর সম্পাদক হিসেবে কবি ফজল শাহাবুদ্দীনকে আমি চিনি। এ দুটো পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে আমি একেবারে কাছে থেকে ফজল ভাইকে দেখেছি, জেনেছি, শিখেছি। এ এক অন্য অভিজ্ঞতা। কবিকণ্ঠ একটি অনিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা। বছরে একটি সংখ্যা বেরোয় কিংবা কখনও তাও নয়। কিন্তু এই একটি সংখ্যা প্রকাশের আবহ থাকে সারা বছর। কবিতা পাঠের আসর, কবিতা উৎসব, স্মরণ, জন্মদিন কিংবা আলোচনাসভাও হয়ে যায় বেশ কিছু। অবশেষে কবিকণ্ঠ বেরোয়। যথারীতি সাহিত্য অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। আলোচনা সমালোচনার ধুম পড়ে যায়। এই ধারা চলে এসেছে বছরের পর বছর ধরে। কবিকণ্ঠ আত্মার গভীর থেকে সৃষ্টি এক কবির আনন্দ যা বহুকষ্টে বহু আদরে লালিত। সেই ১৯৫৬ সাল থেকে। কবিকণ্ঠ যখন প্রথম প্রকাশিত হয়।কবিকণ্ঠ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এ দেশের বৃহত্তম কবিতা আন্দোলন, যার পুরোধা কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। পত্রিকা প্রকাশের বহু আগে থেকে তৈরি হয় পত্রিকার ডামি। ডামি মাস্টার জেনারেল খ্যাতিপ্রাপ্ত এ কবি একাধিক ডামি নিয়ে কাজ করেন এর কারণ তৃপ্তির শেষটুকু যে অজানা। নিজ কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ অাঁকার মতো কবিকণ্ঠের প্রচ্ছদও তাঁরই হাতে করা। কাকে দিয়ে লেখাতে হবে এবং কিভাবে তা ছাপা হবে অর্থাৎ হেডিং বা সাব হেডিং স্ক্রীনে হবে, কিভাবে পেজ মেকআপ করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি নাড়ি নৰত্র নিজের হাতে করে তবে তার শানত্মি। মানুষ যখন নিজের সৃষ্টির আনন্দে নতুনভাবে জেগে ওঠে তখনই সার্থক সৃষ্টির স্রষ্টাকে ছোঁয়া যায় না। হয়ে ওঠেন গতানুগতিকতার অনেক উর্ধের মানুষ। ফজল শাহাবুদ্দীনের সৃষ্টি তাঁর একক সাফল্যে জ্যোতিতে ভাস্বর। সেখানে প্রবেশের সাধ্য কারও নেই। এ ভুবন আত্মার সঙ্গে ছলনা করে গড়ে ওঠা নয়, এ অতি আধ্যাত্মিকতার মোড়কে গড়া একজন বলিষ্ঠ মানুষের প্রতিকৃতি।
আমার খুব খেয়াল আছে, হারম্নন প্রিন্টার্স থাকাকালীন কবিকণ্ঠ নিয়ে কত যে পরীৰা-নিরীৰা কবি ফজল শাহাবুদ্দীন করেছেন তার কোন ইয়ত্তা নেই। কবিতা নির্বাচনে কঠোরতম ব্যবহার করতেও ফজল ভাইকে দেখেছি। অনেক প্রতিষ্ঠিত কবিকেও নির্মমভাবে ফিরিয়ে দিয়েছেন আরেকটি ভাল কবিতা দেয়ার কথা বলে। খারাপ কবিতা কবিকণ্ঠে স্থান পাবে না_এ যেন সম্পাদকের আজন্ম প্রতিজ্ঞা। কবিতাপ্রেমীদের কাছে এখনও কবিকণ্ঠ তাই বাংলা ভাষার একটি প্রধান কবিতা পত্রিকা। এ নিয়ে অন্যদাশঙ্কর রায় তাঁকে একটি চিঠিও লিখেছিলেন আশির দশকে। লিখেছিলেন, এমন পত্রিকা যে কোন ভাষার এবং দেশের গর্ব হতে পারে। অনেকদিন থেকেই কথা হচ্ছিল ফজল ভাই পত্রিকা বের করবেন। কলকাতার বিখ্যাত জ্যোতির্ময় দত্ত এবং ঢাকার ফজল শাহাবুদ্দীনের যৌথ সম্পাদনায় ঢাকা-কলকাতা কিংবা কলকাতা ২০০০ প্রকাশের আয়োজনও চলল বেশ কিছুদিন। যা হোক, পত্রিকা বেরম্নল না। অবশেষে ঢাকা থেকে মাসিক নান্দনিক নামের পত্রিকা বেরম্নল ফজল ভাইয়ের সম্পাদনায় ১৯৯১ সালে। এক বছর আয়ুষ্কালের এই পত্রিকা পাঠক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এ প্রসঙ্গে একটু ইতিহাস না টেনে আনলেই নয়। ১৯৬৮-৬৯ সালে মাসিক বিচিত্রা পরবতর্ীতে চিত্রিতা, বিনোদন এবং সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ফজল শাহাবুদ্দীনকে বাংলাদেশে সাময়িক পত্রিকার প্রধান স্রষ্টার সম্মান দেয়া হয়। পত্রিকা প্রকাশনায় বিচিত্রা যে বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল তা কারও অজানা নয়। স্বাধীনতার পূর্বে চিত্রিতা এবং পরে বিনোদন বাংলাদেশের মাটিতে সফল সৃষ্টি। বিনোদন দেখে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন বাংলা ভাষায় এত সুন্দর পত্রিকা তো আগে কখনও দেখিনি। বহুরঙা পত্রিকা এই উপমহাদেশে তখনও বেরোয়নি। অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, এত চমৎকার রেজিস্ট্রেশন রেখে বহুরঙা পত্রিকা ছাপা কি দুরূহ কাজই না ছিল সে সময়। সত্যি বিষয় বৈচিত্র্য, ছাপা, মেকআপ_ এই তিনে মিলে বিচিত্রা, চিত্রিতা কিংবা বিনোদনের তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই সময়ের তরম্নণ প্রজন্মের সাংবাদিক যাঁরা তাঁর সহকমর্ী ছিলেন আজ প্রায় তাঁরা সকলেই সাপ্তাহিক সাময়িকীর অঙ্গনে উলেস্নখযোগ্য নাম। যাক আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। নান্দনিকের একটি বছর আমার জীবনের একটি উলেস্নখযোগ্য সময়। ঐ সময়ের পত্রিকা প্রকাশ এবং এর আনুষঙ্গিক ঘটনাপ্রবাহ ছাড়া কোন স্মৃতিই যেন নেই। ফজল ভাই নিজে এই পত্রিকাকে ঘিরে এমন একটি প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন যে, সে সময়ের আমরা জনা পাঁচেক তরম্নণ অন্য সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম। কভারস্টোরি, সাৰাৎকার, এমনকি চিঠিপত্র নিয়ে নানা ধরনের পরীৰা আমরা করেছি। আমার বিশ্বাস, রিপোটিংয়ের হেডিং প্রদানে ফজল শাহাবুদ্দীনের সমকৰ খুব কম লোকই আছেন এই বাংলাদেশে। বিষয়বস্তুকে যথার্থভাবে উপস্থাপনের জন্য হেডিং যে কত গুরম্নত্বপূর্ণ তা পুরোপুরিভাবে পরে বুঝেছি। নান্দনিক এ কাজ করার জন্য তখন একটা ক্রেজ সাংবাদিক মহলে তৈরি হয়েছিল। নতুনভাবে পত্রিকা বাঁধাই কভারে লেমিনেশনের সৃষ্টি তো নান্দনিক করেছে এই বাংলাদেশে। মূলত টাকার অভাবের কারণে নান্দনিক বন্ধ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে ভাবি, বাংলাদেশ কি অদ্ভুত দেশ। ফজল শাহাবুদ্দীনের মতো প্রতিভাকে আমরাক কাজে লাগাতে পারলাম না। আমার বিশ্বাস, ছ'মাস সময়ের প্রয়োজন কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের যার হাতে আবার সৃষ্টি হতে পারে এ সময়ের শ্রেষ্ঠ সাপ্তাহিক পত্রিকা।
No comments