প্রসঙ্গ ইসলাম- স্মরণীয় এক শেষ বুধবার- অধ্যাপক by হাসান আবদুল কাইয়ূম
ফারসী ভাষায় শেষ বুধবারকে বলা হয় আখেরী চাহারশোম্বা। ইসলামের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে যে বুধবার সেটা হচ্ছে সফর মাসের শেষ বুধবার। তাই আখেরী চাহারশোম্বা বলতে বোঝায় সফর মাসের শেষ বুধবারকেই।
৬৩২ খ্রিস্টাব্দের সফর মাসের শেষ বুধবারে প্রিয়নবী সরকারে দোআলম নূরে মুজাস্সম পার্থিব জীবনে শেষবারের মতো সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। যে কারণে ঐ খাস বুধবারটি নবী প্রেমে আপস্নুত হবার দিন হিসেবে প্রতিবছর মুসলিম দুনিয়ায় পালিত হয়ে আসছে।প্রিয়নবী সালস্নালস্নাহু 'আলায়হি ওয়া সালস্নামের পবিত্র জীবন ইতিহাসের প্রতিটি গুরম্নত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো ধরে রাখবার জন্য বিভিন্ন অধ্যায় বিন্যাসিত হয়েছে তাঁর সামগ্রিক শিৰা ও আদর্শ অনুকরণ ও অনুসরণের মঞ্জিল নির্ধারণের সুবিধার্থে। আলস্নাহ জালস্না শানুহু নিজে তাঁর যিকরকে, তাঁর স্মরণকে, তাঁর খ্যাতি ও মর্যাদাকে, তাঁর শানকে সমুন্নত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে : ওয়া রাফা'আনা লাকা যিকরাক_ (হে রসূল) সমুন্নত করা হয়েছে আপনার খ্যাতিকে। (সূরা ইনশিরাহ্ : আয়াত ৪)।
সালাতের আহ্বানে বা আযানে তাঁর নাম উচ্চারিত হয়। তাঁর পৃথিবীতে আবির্ভাবের দিনটিতে পালিত হয় ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী এবং এই ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর আনুষ্ঠানিকতা সারা বছর মিলাদ মাহফিল আয়োজনে অব্যাহত থাকে। মিলাদ মাহফিলে সমবেত কণ্ঠে দরম্নদ শরীফ পাঠ, মিলাদ মাহফিলের শেষ পর্যায়ে প্রিয়নবী সালস্নালস্নাহু 'আলায়হি ওয়া সালস্নামের তাওযালস্নুদ শরীফ পাঠ শেষে দাঁড়িয়ে সমবেত কণ্ঠে সুমধুর ইল্হানে ইয়া নবী সালামু 'আলায়কা, ইয়া রসূল সালামু 'আলায়কা, ইয়া হাবীব সালামু 'আলায়কা সালাওয়াতুলস্নাহি 'আলায়কা উচ্চারণের মধ্যে নবী প্রেমের প্রকাশ ঘটে।
প্রিয়নবী সালস্নালস্নাহু আলায়হি ওয়া সালস্নাম ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা মুকাররমা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। হিজরতের সে স্মৃতি ধরে রেখেছে হিজরী সন। এসব ছাড়াও ইসরা ও মি'রাজ ঘটনা শব-ই-মি'রাজে অনুরণিত হয়, একইভাবে শব-ই-কদরে প্রথম অহী নাযিলের স্মৃতি উদ্ভাসিত হয় প্রতিবছর। তেমনি আখেরী চাহারশোম্বা প্রিয়নবী সরকারে দো আলম নূরে সুজাস্সম হযরত মুহম্মদ সালস্নালস্নাহু 'আলায়হি ওয়া সালস্নামের পার্থিব শেষ সুস্থতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
৬৩২ খ্রিস্টাব্দ মুতাবিক ১১ হিজরীর সফর মাসের শেষ বুধবারে সূর্য উদয়ের আগে ভাগেই মদীনা মনওয়ারা এবং এর আশপাশের বিশাল অঞ্চলে আনন্দ ঢেউ তরঙ্গায়িত হয়েছিল। এমনই আনন্দ ঢেউ প্রবাহিত হয়েছিল এর ১০ বছর আগে যেদিন প্রিয়নবী সালস্নালস্নাহু 'আলায়হি ওয়া সালস্নাম মক্কা থেকে মদীনা মনওয়ারায় হিজরত করে এসেছিলেন। সেদিন মিছিলে মিছিলে আনন্দ-উচ্ছ্বাস ধ্বনিত হচ্ছিল এই বলে : তালা'আল বাদরম্ন 'আলায়না/মিন ছানিয়াতিল বিদায়ী/ওয়াজবাশ শুক্রম্ন 'আলায়না/মাদা'আ লিলস্নাহি দায়ী।...
সেদিনকার সেই আনন্দধারায় সমসত্ম এলাকার আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়েছিল। বিশাল জনতা আনন্দ মুখরিত হয়ে উঠেছিল। উচ্চারিত হচ্ছিল সুললিত কোরাস কণ্ঠে : ইয়া আব্বাজা! মুহম্মাদিন মিনজারি_কি আনন্দ! কি মজা! মুহম্মদ (সা.) আমাদের প্রতিবেশী।
দশ বছর সেই আনন্দোচ্ছ্বাস আবার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল আহলে মদীনা অর্থাৎ মদীনাবাসীর মধ্যে ১১ হিজরীর সফর মাসের শেষ বুধবারে। সেই শেষ বুধবার নবতর ঈদ আনন্দ হয়ে ওঠে। সেই আনন্দ উচ্ছ্বাসের কয়েক আগে, সেদিন ছিল সফর মাসের ১৮ তারিখ। সেদিন রাতে প্রিয়নবী সরকারে দো আলম নূরে মুজাস্সম হযরত মুহম্মদ সালস্নালস্নাহু 'আলায়হি ওয়া সালস্নাম অভ্যাস মতো জান্নাতুল বাকীতে কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলেন। গভীর রাতে জিয়ারত শেষে ফেরার পথে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি তাঁর মসত্মক মুবারকে ভীষণ যন্ত্রণা অনুভব করেন। তাঁর দেহ মুবারকের তাপমাত্রা অতিশয় বৃদ্ধি পায়। পেট ব্যথায় তিনি অস্থির হয়ে পড়েন।
প্রিয়নবী সালস্নালস্নাহু 'আলায়হি ওয়া সালস্নাম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তা বিশ্বাস করাই দুরূহ হয়ে পড়েছিল। বিষণ্নতার ছায়া নেমে আসে। তিনি চলে যাবেন তাঁর রফীকুল আলার দরবারে_ এটা অভাবনীয় হয়ে ওঠে। সবাই এসে ভিড় জমায় মসজিদুন নববীতে। সবারই মুখে একই জিজ্ঞাসা : তিনি এখন কেমন আছেন? অনেকেই ডুক্রে ডুক্রে ক্রন্দনে ভেঙ্গে পড়েন। মা ফাতিমাতুয যাহরা রাদিআলস্নাহু তা'আলা আনহা তো পাগলিনীর মতো হয়ে যান। চারদিকে বিষাদ আর বিষাদ।
প্রিয়নবী সালস্নালস্নাহু 'আলায়হি ওয়া সালস্নাম বহু ঝড়-ঝঞ্ঝার মোকাবেলা করেছেন। মক্কী জীবনে কুরাইশ কাফির মুশরিকদের জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন, কুরাইশ কাফির-মুশরিকরা তাঁকে এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনকে বয়কট করেছে, খাদ্য ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। নানা পন্থায় তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে। মদীনা মনওয়ারায় হিজরত করে আসার পরও ষড়যন্ত্রের জাল বোনা অব্যাহত রয়েছে। ইয়াহুদী মুনাফিক ও মক্কার কুরাইশ কাফির-মুশফিকরা মিলে তাঁর বিরম্নদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, যুদ্ধের পর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, ওহূদ যুদ্ধে তাঁর দান্দান মুবারক শহীদ হয়েছে, দূর-দূরানত্মে মরম্নপথ পাড়ি দিয়ে যুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। এমনিতরো অনেক সঙ্কট তাঁকে অসুস্থতার মধ্যে ফেলতে পারেনি। এমনকি ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে খায়বার নামক স্থানে এক যুদ্ধ চলাকালে জয়নব নামক একই ইয়াহুদী নারী কৌশলে তাঁকে বিষ মেশানো একটি আসত্ম দুম্বার রোস্ট খেতে দিয়েও তাঁকে মেরে ফেলবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। বিষ তাঁর দেহ মুবারকে কোনরূপ প্রতিক্রিয়া সঞ্চারিত করতে পারেনি। দিনকে দিনকে তিনি অনাহারে কাটিয়েছেন, কিন্তু কোন অবস্থাতেই অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হননি। সেই প্রিয়নবী সরকারে দোআলম তাজেদারে মদীনা নূরে মুজাস্সম দারম্নণ অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়েছেন_ এটা যেন কেউ ভাবতেই পারছিলেন না।
১১ হিজরীর সেই শেষ বুধবারের সূর্য উদয়ের বেশ কিছু আগে তাঁর দেহ মুবারক থেকে জ্বরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়ে গেল, তাঁর সারা শরীর ঘেমে গেল, ব্যথা, বেদনা, যন্ত্রণা, অস্বসত্মি সব দূর হয়ে গেল। তাঁর স্ত্রী হযরত 'আয়িশা সিদ্দিকা রাদিআলস্নাহু তা'আলা আন্্হা ওড়না দিয়ে তাঁর দেহ মুবারক মুছে দিলেন। কয়েক ডোল পানি দিয়ে তাঁকে গোসল করানো হলো। প্রায় ১০ দিন পর তিনি তৃপ্তিসহকারে খাদ্য গ্রহণ করলেন। প্রিয় নাতী ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনকে (রা.) কোলে তুলে নিয়ে আদর করলেন। মসজিদে নববীতে সালাতে ইমামতী করলেন। মসজিদে নববীতে জনতার ঢল নামল। প্রিয় নবী সালস্নালস্নাহু 'আলায়হি ওয়া সালস্নাম সুস্থ হয়ে উঠেছেন_ এ খবরে অনেকেই শোকরানা সালাত আদায় করলেন, দরিদ্র জনদের মধ্যে অন্ন বিতরণ করলেন, অনেকেই প্রচুর দান-খয়রাত করলেন। নতুন এক ঈদের আনন্দ সবখানে পরিলৰিত হলো। কিন্তু দিন শেষে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অতঃপর ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার তিনি সবাইকে কাঁদিয়ে তাঁর রফীকুল 'আলার কাছে চলে গেলেন। রেখে গেলেন আলস্নাহ্্র কিতাব, রেখে গেলেন অনুপম আদর্শ, রেখে গেলেন মহান সুন্নাহ।
আখেরী চাহারশোম্বা সত্যিকার অর্থে নবী প্রেমে আপস্নুত হবার দিন।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আঞ্জুমানে তোয়াজিয়া, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.)
No comments