বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো মানুষ, ২৩৫ নতুন বই- বইমেলা প্রতিদিন
ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী...' আৰরিক অর্থেই শুক্রবার অমর একুশের বইমেলার অবস্থা হয়েছিল তেমন। ছুটির দিনে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো বইপ্রেমীদের সমাগম ঘটেছিল মেলায়। সন্ধ্যার পর টিএসসি ছাড়িয়ে গিয়েছিল মেলার লাইন।
দিন দিন বেড়ে যাওয়া বিপুলসংখ্যক গ্রন্থানুরাগীকে, মেলা চত্বর যে আর ধারণ করতে পারছে না, তা এখন সত্য। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে পায়ে পায়ে মেলা চত্বরে প্রবেশ করতে অনেক বইপ্রেমীরই প্রায় ২০ মিনিট সময় লেগেছে। আবার মেলায় প্রবেশ করেও যে স্বসত্মির সঙ্গে একটু মেলা ঘুরবে, বইপত্র দেখবে, যাচাই-বাছাই করবে, সে উপায় ছিল না। ভেতরে চলাচল করাই মুশকিল হয়ে পড়েছিল। নামকরা স্টলগুলোর সামনে ছিল ভিড়। বিশেষ করে অন্যপ্রকাশ, অনন্যা, দিব্য, সময়, আগামী, ঐতিহ্য_এসব স্টল থেকে তো বই কিনতে রীতিমতো মলস্নযুদ্ধ করতে হয়েছে পাঠকদের। মেলার স্থান বাড়ানোর যে দাবি উঠেছে লেখক, প্রকাশক ও পাঠকদের মধ্যে, তারই প্রতিফলন দেখা গেছে ছুটির দিনের মেলায়। এদিন মেলায় এসেছেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক, কবি আসাদ চৌধুরীসহ অনেকে। এদিন নতুন বই এসেছে ২৩৫টি।মেলায় চুরি
মেলার ৫টি স্টলে চুরি হয়েছে বৃহস্পতিবার রাতে। এতে মেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধরনের ফাঁক রয়েছে, তাই প্রমাণ হলো। যে স্টলগুলোতে চুরি হয়েছে সেগুলো হলো বিশাখা, খসরম্নজ, ইমন, শিলা ও আমীর প্রকাশন। এ প্রসঙ্গে আমীর প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী তৌহিদুল ইসলাম কনক বলেন, বিগত ১০ বছর যাবত একুশের বইমেলায় অংশ নিচ্ছি। এবারই প্রথম রাসত্মায় স্টল পড়েছে, নম্বর-৪৬৩। প্রতি দিনের মতোই বৃহস্পতিবার বেচা-বিক্রি শেষে স্টল বন্ধ করে যাই । শুক্রবার সকালে এসে দেখি স্টলে চুরি হয়েছে। কাপড় কেটে প্রায় ৫০ হাজার টাকার বই নিয়ে গেছে। ক্যাশে ২০৫০ টাকা ছিল সেটিও। এ ব্যাপারে থানায় জিডি ও মেলা কমিটির কাছে অভিযোগ করেছি এবং জরম্নরী পদৰেপ গ্রহণ করার অনুরোধ জানিয়েছি। অন্যথায় স্টল বন্ধ করে দেয়ার কথা চিনত্মা করছি। এ ব্যাপারে একাডেমীর সদস্য সচিব সাহিদা বেগম জানান অভিযোগ পেয়েছি। তবে তিনটি স্টলের, পাঁচটির নয়। ব্যাপারটি রমনা থানাকে অবহিত করেছি, তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা
আজ শনিবারও বইমেলা শুরম্ন হচ্ছে সকাল এগারোটা থেকে। প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলা একাডেমী আয়োজন করেছে শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার। বয়সভিত্তিক তিনটি শাখায় এ প্রতিযোগিতা শুরম্ন হবে সকাল ৯টায়, শেষ হবে সকাল ১১টায়। ৮ বছর পর্যনত্ম, ক শাখার শিশুদের অঙ্কনের বিষয়_ আমাদের গ্রামের বাড়ি, ১২ বছর পর্যনত্ম, খ শাখার শিশুদের বিষয়_ শহীদ মিনার এবং ১৫ বছর পর্যনত্ম, গ শাখার শিশুদের বিষয়- একজন বাউল। তিন শাখায় মোট ৯০০ শিশু অংশ নিচ্ছে এই প্রতিযোগিতায়। শিশুদের উৎসাহ দিতে এই উদ্বোধন করবেন বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান।
মেলা প্রসঙ্গে লেখকদের মতামত
লেখক সেলিনা হোসেন বলেন, প্রাণের এই বইমেলা এখন অনেকটাই স্পন্সর নির্ভর হয়ে গেছে, যা ভাল নয়। মনে হয় যেন কোন বিজ্ঞাপনের বাজারে এসে পড়েছি। যেদিকেই তাকাই ব্র্যাক ব্যাংকের লোগো ও নামটাই আগে চোখে পড়ে। এর থেকে বাংলা একাডেমীকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে বাজেট বাড়িয়ে নিজেদের কতর্ৃত্ব ধরে রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলা একাডেমীতে আমি ২৫ বছর কাজ করেছি, তাই মেলায় আসা কখনও মিস হয় না। মেলার যে জিনিসটা ইদানীং আমার চোখে পড়ে, তা হলো শিশুদের অধিক সংখ্যায় আগমন। এটা আমাদের জন্য খুব আশার কথা। বইয়ের প্রতি শিশুদের এই পান দেখে, এই জাতি নিয়েও আমি বেশ আশাবাদী। ইমদাদুল হক মিলনের এবার ৮টি বই এসেছে। সেগুলো হলো লিলিয়ান উপাখ্যান, চাই, বন্ধুবান্ধব, কাসের সবচেয়ে দুষ্ট ছেলেটি, সেই বিদেশী মেয়ে ইত্যাদি। কিভাবে এত লেখেন? এর জবাবে তিনি বলেন, আমার মনে হয় আমি একজন ব্যর্থ মানুষ- চাকরি করতে পারিনি, বিদেশ গিয়েছি থাকতে পারিনি, তাই লেখালেখি করি। এখন মনে হয় লেখালেখি ছাড়া আমার পৰে কোন কাজ পাড়া সম্ভব নয়। একজন ব্যক্তি অফিসে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা কাজ করেন, সে রকমই আমিও প্রতিদিন ৫ পাতা লিখি। এ হিসেবে বছরে ১৫০০ পাতা তো লেখা হয়েই যায়। তখন বছরে ৭/৮টা বই বের করা কষ্ট হয় না। আতিকুল হক চৌধুরী বলেন, ফেব্রম্নয়ারি মাস এলেই মনে হয় ভাষার মাস, অসাম্প্রদায়িকতার মাস এসেছে, সবাই মিলে একত্রিত হচ্ছে এখানে, এটা দেখে বেশ ভাল লাগে। বাবার কাঁধে যখন শিশু দেখি, তরম্নণ-বৃদ্ধের হাতে যখন বই দেখি, তখন বেশ আলোকিত হই, উদ্ভাসিত হই। এই বই-ই পারে আমাদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে, তা না হলে কেন যুদ্ধ করেছি। কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, তরম্নণ লেখকদের বই কেন কম আসছে বা কাটতি কেন কম, সে অনেক যুক্তিতর্কের কথা। তবে আমাদের তরম্নণরা ভাল লিখছে, তাঁদের মধ্যে মরালিটি ও এ্যাথিকস রয়েছে। তরম্নণ অবস্থায় কিন্তু জীবনানন্দ দাশের বইও ততটা চলেনি, এখন যতটা চলে। তাই আমাদের তরম্নণদের হতাশ হবার কিছু নেই। তাছাড়া ব্যবসায়িক চিনত্মা করে প্রকাশকরা একজন প্রতিষ্ঠিত লেখকের বই বের করতে যতটা আগ্রহী হয়, তরম্নণদের বেলায় ততটা হয়। এবারের মেলায় মুনতাসীর মামুনের বই এসেছে ১৪টি। এর মধ্যে আলোচিত বইটির নাম হলো পাকিসত্মানী জেনারেলদের মন, বাঙালী বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ। বইটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বইটি ২২/২৩ জন পাকিসত্মানী জেনারেলদের আত্মজীবনীর ওপর ভিত্তি করে লেখা। আমি খুব খেটে বইটি লিখেছি। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, আমাদের দেশের রাজাকার ও তাঁদের মনমানসিকতার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এই বইটির আগে আমি রাজাকারদের নিয়ে এ জাতীয় একটি বই লিখেছি। আমার এখন ইচ্ছা বাংলাদেশের জেনারেলদের নিয়ে একটি বই লেখার । তাহলে এই সম্পর্কিত আমার সিরিজ লেখা শেষ হবে।
মোড়ক উন্মোচন
এদিন নজরম্নল মঞ্চে প্রায় দু'ডজন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়। এর মধ্যে সেলিনা হোসেন মোড়ক উন্মোচন করেন মার্জিয়া লিপির স্মৃতিকথা আমার মেয়ে আত্মজার সঙ্গে কথোপকথন বইটি।
মেলায় অনিয়ম
মেলার অনিয়মগুলোই যেন নিয়ম হয়ে যাচ্ছে। বাংলা একাডেমী শুধু বড় বড় কথাই বলছে, কিন্তু অনিয়ম দূর করতে উদ্যোগী হচ্ছে না। মনে হয় কোথায় যেন তাদের হাত-পা বাঁধা। বাংলা একাডেমীর নীতিমালা অনুযায়ী মেলার প্রথম দিন থেকেই সব স্টলকেই পরিপাটিভাবে বই নিয়ে বসতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে স্টলের বরাদ্দ বাতিল করে দেবে একাডেমী। কিন্তু একাডেমী তা করছে না। এখনও ২০৯, ২২৩ ও ২২৬ নম্বরের স্টল ফাঁকা পড়ে আছে। আবার জিনিয়াস পাবলিকেশনের এক কর্মী জানান, ৭৬ নম্বর স্টলটি তাঁরা বুধবার বরাদ্দ পেয়েছেন। কিন্তু মেলা শুরম্ন হয়েছে সোমবার থেকে। এটা নীতিমালার চরম লঙ্ঘন। কারণ মেলা চলাকালীন স্টল বরাদ্দ দেয়ার নিয়ম নেই। এ বিষয়ে একাডেমীর একটি সূত্র অভিযোগ করে জানিয়েছেন, যে স্টলগুলো এখনও বন্ধ, সেগুলো ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। এ রকম গোটা পঞ্চাশেক স্টল তাঁরা নিয়েছেন। যেগুলো বিক্রি করতে পারেনি, সেগুলোর এ অবস্থা। এ কারণে একাডেমীও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না। মেলার বেশকিছু স্টলে নিজ প্রকাশনার বই ছাড়াও অন্য প্রকাশনার বইও বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া নেট বই, পাইরেটেড বই তো আছেই। এই অনিয়ম দূর করতে টাস্কফোর্স নেমেছিল বৃহস্পতিবার। ১২টি স্টলে এ জাতীয় অনিয়ম পেয়ে, তাদের মৌখিকভাবে সতর্ক করে দিয়েছে। পরেও তাদের বিরম্নদ্ধে এই অভিযোগ থাকলে তাদের স্টল বাতিল করে দেবে বলে জানায় একাডেমী। সতর্ক করার পরও অনেক স্টলই তা মানছে না।
নতুন বই
ছুটির দিন থাকায় এদিন মেলায় সবচেয়ে বেশি নতুন বই এসেছে, সে সংখ্যা ২৩৫টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উপন্যাস ৪২টি, কবিতা ৪০টি, গল্প ৩৬টি, জীবনী ১৮টি, প্রবন্ধ ১৫টি উলেস্নখযোগ্য। এদিনকার উলেস্নখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- জনকণ্ঠের সাংবাদিক মনিজা রহমানের অপ্সরার ওড়না, এটি তাঁর দ্বিতীয় বই, এনেছে জাগৃতি প্রকাশনী। কথা প্রকাশ এনেছে সরদার ফজলুল করিমের সেসব দার্শনিক। মাওলা ব্রাদার্স এনেছে কবীর চৌধুরীর আমার রবীন্দ্রনাথ। সৈয়দ আবুল মকসুদের সম্পাদনায় শুদ্ধস্বর এনেছে কাজী ইমদাদুল হক রচনাবলী। প্রজ্ঞালোক এনেছে শানত্মনু চৌধুরীর কথা প্রসঙ্গে। গ্রন্থকানন এনেছে নূরম্নল ইসলাম মামুনের অলকানন্দা, আকরাম হোসেনের মুক্তির ঘাটে প্রেম সমাধি, আহসান হাবিবের কৃষ্ণ মেকু অন্যান্য ঢেকুর ও শাহজাহান আবদালির ইয়াহু ডট টু টেলাপাথি। মাওলা ব্রাদার্স এনেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কালেক্টেড ওয়ার্কস ভোলু্যয়াম-১ ও রচনা সমগ্র-১ এবং মুনতাসীর মামুনের বই ঢাকার স্মৃতি-৯ ও ১০। বিভাস এনেছে পদ্মনাভ অধিকারীর মহর্ষি লালন সাঁই। অনিন্দ প্রকাশ এনেছে ড. মোহাম্মদ আদুর রশীদের বাংলাদেশের রাজনীতি : যুদ্ধাপরাধী জামায়াত ও জঙ্গীবাদ -এর ৩য় ও ৪র্থ খ-। মিজান এনেছে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর প্রবন্ধ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও ডা. সফিউদ্দিন আহমেদের সাহিত্যিক ও দার্শনিক সক্রেটিস থেকে সাত্রে, অনন্যা এনেছে শাহরিয়ার কবিরের যুদ্ধাপরাধীদের পৰ বিপৰ, মুক্তধারা এনেছে মৈত্রেয়ী দেবীর মংপুতে রবীন্দ্রনাথ, সময় কবি হাসান হাফিজের শিশুকালের জবাকুসুম, বিদ্যাপ্রকাশ এনেছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের মহব্বত আলীর একদিন, হাতেখড়ি এনেছে মোসত্মফা হুসাইনের গণহত্যা ও গণকবর, শোভা এনেছে আসাদুল হকের চলচ্চিত্রে নজরম্নল ও জাতীয় কবি নজরম্নল এবং মোনায়েম সরকারের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী ও স্বরোচিত সরকারের বাংলা সাহিত্যে সংস্কার চেতনা, উৎস এনেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সিপাহসালার বঙ্গবীর ওসমানী বইটি।
No comments