নির্দলীয় সরকার গঠনে একটি রূপরেখার প্রস্তাবনা
কাওসার আহমেদ: বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা, লাখো শহীদের রক্ত, মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভ করে সব দেশের সেরা আমার সোনার বাংলাদেশ। সংঘাত নয়, শান্তি চাই।
বিরোধ নয়, আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠু সমাধান চাই। আমাদের দেশের জনপ্রতিনিধিগণ নির্বাচিত হয়ে থাকেন দেশের সচেতন নাগরিকদের ভোটে। জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে দেশের জনগণকে সহযোগিতা করবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ। তারা জাতির সচেতন, বিবেকবান নাগরিক। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ কোন অন্যায়ের সঙ্গে আপস ও মাথা নত নয়, সাহসিকতার সঙ্গে, সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে সৎ ও ন্যায়ের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকবেন। আমাদের দেশের নির্বাচন করার জন্য বহির্বিশ্বের কোন রাষ্ট্র থেকে কেউ আসবে না। আমাদের নিজেদেরকেই তৈরি করতে হবে কিভাবে, কোন পদ্ধতিতে ও পরিবেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যদি বহির্বিশ্বের কোন রাষ্ট্রকে আমাদের দেশের নির্বাচন করার দায়িত্ব দেয়া হয় নির্বাচন শেষে দেখা যাবে, তখনও বিতর্ক রয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ যদি পার্শ্ববর্তী দেশ ‘ক’ কে দায়িত্ব দেয়া হয়, আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে তখন বিএনপির নেতৃবৃন্দকে বলতে শোনা যাবে আওয়ামী লীগ ‘ক’-এর সঙ্গে আঁতাত করে সরকার গঠন করেছে, আমরা এ প্রহসনের নির্বাচন মানি না। আবার যদি প্রভাবশালী রাষ্ট্র ‘খ’-কে দায়িত্ব দেয়া হয় বিএনপি সরকার গঠন করে, সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে বলতে শোনা যাবে, ‘খ’-এর সঙ্গে গোপন চুক্তি করে বিএনপি সরকার গঠন করেছে, আমরা এই নাটকের নির্বাচন মানি না। আমরা কারও দ্বারস্থ না হয়ে সকল দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে এদেশের নাগরিক দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয় কি? আমি মনে করি, সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ হিংসাত্মক মনোভাব পরিহার করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে তা পুরোপুরি সম্ভব। তার পাশাপাশি বিজয়কে উচ্ছৃঙ্খলতার মাধ্যমে নয়, সুশৃঙ্খলার মাধ্যমে ধরে রাখতে হবে এবং পরাজয়কে মেনে নেয়ার মনমানসিকতা তৈরি করতে হবে। একজন নাগরিকের যে কোন দলের প্রতি সমর্থন থাকতে পারে। যখন তিনি কোন দায়িত্ব পালন করবেন, তখন তাকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকতে হবে। তিনি একটি দলকে সমর্থন করেন বলে কি তার বিবেককে দংশন করে দলের সকল অন্যায় আবদার মেনে নেবেন? কোন ব্যক্তি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি কোন রাজনৈতিক দলের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে কাজ করে, তাহলে তিনি ওই দলের বাহবা পেতে পারেন কিন্তু দেশের কোটি কোটি জনগণের সমালোচনা ও ধিক্কারের পাত্র হবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা আজ অস্থিতিশীল। আন্তরিকতার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দেশ ও জনগণের স্বার্থে সুষ্ঠু সমাধান হওয়া একান্ত জরুরি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি মহোদয় খোলা মনে দেশ ও জাতির কথা চিন্তা করে যদি একটু উদ্যোগী হন, তাহলে সংলাপ পুরোপুরি ফলপ্রসূ হবে আমি বিশ্বাস করি। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলকে কোন বিতর্কে না গিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। সরকারি দল থেকে কমপক্ষে পাঁচজন, বিরোধী দল থেকে কমপক্ষে পাঁচজন, অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে যারা নির্বাচিত হয়ে সংসদের প্রতিনিধিত্ব করছেন সেসব দল থেকে দু’জন করে, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সমন্বয়ে কমিটি করে সংলাপ করা যেতে পারে। যার মূল নেতৃত্বে থাকবেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি মহোদয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ইচ্ছা করলে সংলাপকে সফল করার জন্য নির্দলীয়, বিতর্কিত নয় এমন কাউকেও সংলাপে আমন্ত্রণ জানাতে পারবেন। আমি আমার ক্ষুদ্র চিন্তা-চেতনা থেকে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার একটি রূপরেখা তৈরি করেছি। নির্দলীয় সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ কমপক্ষে ২১ সদস্য বিশিষ্ট বা তার ঊর্ধ্বে করা যেতে পারে। ১. সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত তিনজন প্রধান বিচারপতি, সেক্ষেত্রে যদি কাউকে পাওয়া না যায়, তাহলে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের নেয়া যেতে পারে। ২. সর্বশেষ অবসর গ্রহণ করা দু’জন সেনাবাহিনীর প্রধান, একজন নৌবাহিনীর প্রধান, একজন বিমানবাহিনীর প্রধান। যদি কারও কোন সমস্যা থাকে তাহলে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর যে সিনিয়র অফিসার অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাকে নেয়া যেতে পারে। ৩. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত সচিব, সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের আইজি, তাদের কারও কোন সমস্যা থাকলে তার আগে যিনি অবসর গ্রহণ করেছেন, যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে যিনি অবসর গ্রহণ করেছেন তাকে নেয়া যেতে পারে। ৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত ভিসি, যদি নিয়ম অনুযায়ী তিনি না আসেন, তাহলে তার আগে যিনি অবসর নিয়েছেন, তাও যদি পাওয়া না যায় তাহলে প্রো-ভিসি হিসেবে যিনি অবসর গ্রহণ করেছেন, তাকে নেয়া যেতে পারে। ৫. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত ভিসি, যদি নিয়মানুযায়ী তিনি না আসেন তাহলে তার আগে যিনি অবসর গ্রহণ করেছেন, তাও যদি না পাওয়া যায় তাহলে প্রো-ভিসি হিসেবে যিনি অবসর গ্রহণ করেছেন তাকে নেয়া যেতে পারে। ৬. গণমাধ্যম থেকে কমপক্ষে দু’জনÑ আবেদ খান, এবিএম মূসা, মতিউর রহমান চৌধুরী, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, নূরুল কবিরসহ আরও অনেক স্বনামধন্য সাংবাদিক রয়েছেন এদের মধ্যে বাছাই করে নেয়া যেতে পারে। ৭. সুজন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, টিআইবি, অধিকারসহ এরূপ আরও অন্যান্য সংস্থা থেকে চেয়ারম্যান, সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, নির্বাহী পরিচালক পদমর্যাদার ব্যক্তি থেকে বাছাই করে কমপক্ষে দু’জন নেয়া যেতে পারে।নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থায় এসব ব্যক্তিগণ মনোনীত হওয়ার পর তারা আলোচনার মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন। প্রধান উপদেষ্টার জন্য প্রাথমিকভাবে তিনটি নাম প্রস্তাব করবেন। তারপর সকল সদস্য আলোচনার মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন। মনোনীত ব্যক্তিগণ ইচ্ছা করলে গোপন বৈঠকের মাধ্যমে ভোটাভুটি করেও প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করতে পারেন। মনোনীত হওয়ার জন্য যোগ্যÑ ক. নির্বাচনের কমপক্ষে দু’বছর আগে অবসর গ্রহণ করেছেন। খ. কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট নয়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন সহযোগিতা করেন না। গ. দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় কোন বিতর্কিত হননি, সৎ ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। ঘ. রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা পরিপন্থি কোন কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেননি। ঙ. আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হননি। চ. ইতিপূর্বে সরকারের মন্ত্রিসভা বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের দায়িত্ব পালন করেননি। ছ. দুর্নীতিবাজ চিহ্নিত ও ঋণখেলাপি নন।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ দেশকে সংঘাতময় ও অস্থিতিশীল না করে আলোচনার মাধ্যমে আরও সংযোজন-বিয়োজন করে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার নীতিমালা তৈরি, সুষ্ঠুভাবে সমস্যা সমাধানে মনোযোগী হওয়া একান্ত অপরিহার্য। তা না হলে দেশ সংঘাতের দিকে চলে যেতে পারে। তাতে দেশের কোটি কোটি জনগণ দুঃসহ কষ্টের সাগরে ভেসে যেতে হবে। যে জনগণের জন্য রাজনীতি করেন, তাদের কষ্ট দেবেন কেন? ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সকল বিভেদ ভুলে এদেশকে সত্যিকার এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে একটি সফল সংলাপের মুখ চেয়ে আছে দেশের কোটি কোটি জনগণ।
লেখক: মানবজমিন এর পাঠক, চাঁদপুর
No comments