জৈব সারে বাড়ছে আলুর ফলন- মুক্তিযোদ্ধা বিজ্ঞানীর গবেষণার সাফল্য
কৃষি জমি বাঁচানোর জন্য এখন থেকেই জৈব সারের বেশি ব্যবহার নিশ্চিত হওয়া দরকার। জমিতে অনত্মত ২৫ শতাংশের ওপর জৈব সার থাকা বাঞ্ছনীয়। উত্তরাঞ্চলের জমিগুলোতে অরগানিক ম্যাটার (জৈব সার) অনেক েেত্রই ৫ শতাংশের নিচে নেমে গিয়েছে।
এ অবস্থায় ফসলের উৎপাদনও অনেক কমে যাচ্ছে। জিঙ্কের (দসত্মা) মাত্রাও কমেছে অনেক। জমিতে জৈব সার ও জিঙ্কের মাত্রা এখনই না বাড়ালে সামনের দিনে ভয়ানক পরিণতির মোকাবিলা করতে হবে। বগুড়ার একজন মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘদিন বিদেশের কয়েকটি দেশে কৃষি জমির মাটির ওপর গবেষণা করে এ ধারণা নিয়ে বর্তমানে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানের জমির মাটির উপাদান ও গুণাগুণ পরীা করে দেখছেন। নিজের বাড়িতেই তিনি মাটি পরীার গবেষণাগার বানিয়েছেন। গবেষণালব্ধ ফলাফল নিয়ে কোন আবাদের জন্য মাটিতে কি পরিমাণ কোন সার প্রয়োগ করতে হবে এই বিষয়ে কৃষকদের পরামর্শ দেন। মাঠের কৃষকও তার কথা শুনে আবাদ করে লাভবান হন। বগুড়া সদরের তেলীহারা দণিভাগ গ্রামের কৃষক শফিকুল ইসলাম ও আমজাদ হোসেন জানালেন, মাটি পরীা করে বিজ্ঞানী মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আব্বাস আলী (৫৫) যে পরামর্শ দিয়েছেন সেই অনুযায়ী ৩০ শতাংশ জমিতে ৫০ কেজি জৈব ও ৪০ কেজি গোবর এবং সামান্য পটাশ ও টিএসপি সার প্রয়োগ করে আলুর আবাদ করেন। ৬৪ দিনের মধ্যে আলু উৎপাদন হয়। প্রতি শতকে আলু উৎপাদিত হয় ৯০ কেজি করে। কৃষক শফিকুল বলেন, এর আগে এত বেশি আলু উৎপাদিত হয়নি। গ্রামের অনেক কৃষক এখন জমিতে জৈব সারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে আবাদ করছে এবং ভাল ফল পাচ্ছে। বাড়ছে উৎপাদন। একই জমিতে একাধিক আবাদও করতে পারছেন।এই বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা আব্বাস আলীর কথা নিজ উদ্যোগেই কৃষি জমির মাটির ওপর গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন ধরে। ১৯৭৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে মাস্টার্স করেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ৭ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। দেশ স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জনের পর তিনি মনে করেন এ দেশকে কৃষিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তখন থেকেই মাটির ওপর গবেষণা শুরম্ন। শিাজীবন শেষ করে তিনি বছর দশেক কৃষিভিত্তিক কাজই করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি যান বিদেশে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, জাপান ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়ে মৃত্তিকা ও আনুপাতিক হারে সার প্রয়োগের ওপর হাতে কলমে দীা নেন। '৮৬ সাল থেকে ২ হাজার ১ সাল পর্যনত্ম মালয়েশিয়ার একটি কোম্পানিতে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ও ফার্টিলাইজারের ওপর কাজ করার সময় বিভিন্ন দেশের মাটির সঙ্গে তার পরিচিতি পায়। ওইসব দেশে কিভাবে মাটির গুণাগুণ বাড়ানো হয়েছে তা দেখেন। বললেন ভিয়েতনামের কথা। মার্কিন আগ্রাসনে যুদ্ধবিধ্বসত্ম ওই দেশটি মাত্র ক' বছরের ব্যবধানে কৃষিতে এতটাই সাফল্য এনেছে যা বিশ্বে অনুকরণীয় দৃষ্টানত্ম হয়েছে। কৃষি শাস্ত্রে একটি কথা আছে মাটির ওএম (অরগ্যানিক ম্যাটার)। মাটির ওএম নিরিণ করে বলা যায় ফসল কতটা উৎপন্ন হবে। এই ওএমের পরিমাণ ২৫ শতাংশের ওপরে হলেই ফলন ভাল হয়। এর নিচে নেমে গেলে ফসল উৎপাদনের পরিমাণ অনেক কমে যায। উত্তরাঞ্চলে চলনবিল এলাকায় মাটির ওএম ২৫ শতাংশের ওপর পাওয়া গেছে। যে কারণে দেখা যায় চলনবিল এলাকায় প্রতিটি ফসলের উৎপাদন হয় বেশি এবং সময় লাগে কম। অনুসন্ধানেও দেখা যায়, এই চলনবিল এলাকায় প্রতি বছর নির্ধারিত সময়ের আগে বোরো আমন আলু ও শাকসবজিরসহ সব ফসলের আবাদ হয়। এই এলাকার কৃষক প্রতিটি ফসলের উৎপাদনে এগিয়ে গেছে। সেই তুলনায় কৃষি প্রধান উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য এলাকায় শুধু মাটির উর্বরতা কমে যাওয়ার কারণে আবাদেও দেরি হয়, ফলনও আশাতীত হয় না।
মোঃ আব্বাস আলীর অভিমত, মাটির উর্বরা বাড়াতে মাটি পরীা করে যে জমিতে যতটুকু রাসায়নিক সার প্রয়োজন ততটুকুই দেয়া দরকার। পরিমিত মাত্রার বাইরে গেলেই মাটির ারত্ব বেড়ে গিয়ে ফসলের উৎপাদন কমে দেবে। দেশের বিভিন্ন স্থানের মাটি পরীা করে তার উপলব্ধি হয়েছে বেশিরভাগ জমিতে জৈব সার ও জিঙ্কের বিসত্মর ঘাটতি রয়েছে। তিনি মনত্মব্য করেন বিদেশ থেকে যে জিঙ্ক সালফেট আমদানি করা হচ্ছে তার মান কতটা ভাল তা পরীা করে ব্যবহার করা দরকার। উদাহারণ দিয়ে বলেন, চীন থেকে যে দসত্মার সার আসছে তার মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, দেশের বিশিষ্ট মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ড. শহীদুল ইসলামের সঙ্গে গাজীপুর গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করেছেন। তখনও দেখেছেন এ দেশের মাটির গুণাগুন পরিবর্তন হচ্ছে। এই গুণাগুণ বাড়িয়ে জমিকে উর্বর করে তুলতে জৈব সার ব্যবহারের বিকল্প নেই। দিনে দিনে জৈব সারের মাত্রা এতটাই কমে যাচ্ছে যে সামনের দিনে কৃষককে আবাদ নিয়ে ভাবতে হতে পারে। এখনই উচিত জৈব সার ও মিশ্র সারের ব্যবহার বাড়িয়ে দেয়া। এক সময় জমিতে ধৈঞ্চা আবাদ করে জৈব সারের মোকাবিলা হতো। এই ধৈঞ্চা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার। এখনই বড় প্রয়োজন মাটি পরীা করে পরামর্শ নেয়া কী মাত্রায় কোন সার জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। বেশিরভাগ েেত্রই দেখা যায় কৃষক মাটির বাছ বিচার না করেই সার প্রয়োগ করছে। তারপর ফসল তুলতে গিয়ে যখন দেখে উৎপাদন কমেছে তখনও সে বুঝতে পারে না কী কারণে এই উৎপাদন কমল। পরের বছর সে আরও বেশি রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে জমিকে কার্যত পুড়ে ফেলে। জৈব সারের যে ঘাটতি তিনি ল্য করছেন তা দ্রম্নত নিরূপণ করতে না পারলে এর অশুভ প্রভাব গিয়ে পড়বে ফসল উৎপাদনের ওপর।
_সমুদ্র হক, বগুড়া
No comments