কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের জন্মদিনে- রেজা ফারম্নক
পঞ্চাশের কবি হয়েও যেন পঞ্চাশের নয়। সর্বদা এক তারম্নণ্যদীপ্ত আভা তাঁর জীবনাচরণে কিরণ ছড়ায়। তিনি_ পঞ্চাশের বিমুগ্ধ কবিতাস্রষ্টা ফজল শাহাবুদ্দীন।
তাঁর প্রতিটি কবিতায় যেন একজন নতুন ফজল শাহাবুদ্দীনের কিরণজ্বলা পোয়েটিক সেন্সকে পর্দার অনত্মরাল থেকে উন্মোচিত করে। ভাবনায় দর্শনে, উপস্থাপনায় সমকালীন রীতি, ভঙ্গি, প্রেৰাপট, অনুপুঙ্খ মাধুর্যে, নতুন আচ্ছাদনে আবৃত হয়ে যেন দাঁড়ায় এসে পাঠকের চোখের সীমায় তাঁর কবিতার হীরেজ্বলা ছায়া। আর ওই ছায়ার মৌনতা পাঠককে তীব্র এক আকর্ষণে করে তোলে আকুল আর হয়ে পড়েন কবিতাতেই অনত্মর্লীন। তৎকালীন প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা যখন অসংখ্য কবির পদভারে কম্পিত নয়, নয় মুখর সে সময়ে যারা আধুনিক বাংলা কবিতার ফ্রেসকো কাঁধে নিয়ে কবিতার টানে কবিতাকে ভালবেসে সকল মোহকে উপেৰা করে কবিতার কুঞ্ঝটিকায় ডুবে থাকতেন কবি ফজল শাহাবুদ্দীন ছিলেন সেই তাঁদেরই প্রধান সারির প্রতিনিধিত্বশীল কবি। তারপরে কেটে গেছে বহুকাল। কবিতার জন্য কবিতাকে একটা পরিণত রূপ ও বৈশিষ্ট্য প্রদানে করণীয় দায়িত্ব পালন করছেন অদ্যাবধি। আপাদমসত্মক রোমান্টিক ফেবার ফজল শাহাবুদ্দীনকে যেন অহর্নিশ সিক্ত করে রাখে। আর তাঁর ছবিটা প্রতিবিম্বিত হয় তারই কবিতার প্রতিটি বর্ণোজ্জ্বল পঙক্তিতে। বাংলাদেশের অভু্যদয়ের সাৰ্য বহন করছে এমন একাধিক নন্দিত কবিতা লিখেছেন কবি ফজল শাহাবুদ্দীন।তাঁর ভালবাসার কবিতা যেমন প্রবহমান নদীর মতো পাঠকের হৃদয়কে সমুদ্রের দিকে ধাবিত করে, তেমনি তাঁর কবিতাতে মুক্তিযুদ্ধের উপস্থিতিও পরিলৰিত হয়েছে বিপুলভাবে। স্বাধিকার, স্মৃতিমেদুর অতি, আত্মজৈবনিক রোমান্টিসিজমের গভীর শব্দপুঞ্জ নিবিড়ভাবে আশ্রয় লাভ করেছে তাঁর কবিতায়।
তুমি এলে মনে হয় ফিরে আসে যৌবনের কাল
সমুদ্রের পাখিরা ওড়ে রক্তকণিকাতে অস্থিরতা কাঁপায় কঙ্কাল
...
তুমি এলে মনে হয় যেতে চাই সেই খানে সেই প্রিয়
উপত্যকা প্রজাপতি আর পর্বতের কাছে যেখানে অচিনত্মনীয়
ঊষার শরীর আর স্বর্ণরঙ চন্দ্রিমার ছায়া আলো বেঁচে আছে
মানুষের নব প্রেম যেইখানে গোধূলির কাছে
একটি সূর্যাসত্ম হয়ে চিরকালে সমাপ্তি হয়_
তুমি এলে জন্ম নেয় সেই প্রেম সেই চিরকাল সেই চির পরম বিস্ময়
(তুমি, রাত্রিভেজা সংলাপের কাল)
উত্তর প্রজন্মের কবিদের জন্য একটি কবিতার জগত রচনার ৰেত্রে পঞ্চাশের অপরাপর উলেস্নখযোগ্য কবিদের মতো কবি ফজল শাহাবুদ্দীনেরও রয়েছে স্বণের্াজ্জ্বল অবদান। আর ওই অবদানের তরম্নতেই ফুটেছে থোকা থোকা চন্দ্রমলিস্নকা, গোলাপ, জুঁই প্রভৃতি ফুল। অনর্গল কবিতার মর্মানুভূতিকে স্পন্দনে জড়িয়ে নিয়ে অবিরল লিখে চলেছেন তিনি। কালপরিক্রমায় কবিতার বিষয়, বিন্যাস, আঙ্গিকগত পরিবর্তন হলেও একটা স্বাতন্ত্র্যবোধ তাঁর কবিতাকে চিনিয়ে দেয় মুহূর্তেই। প্রকৃতি, প্রেম, নারী, অনুতাপ, নির্জনবিষণ্ন্নতা, নৈঃসঙ্গের ঝর্ণার মতো বিবিধ অনুষঙ্গ ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতায় উপজীব্য হয়ে উঠেছে। গীতিময়তা তাঁর কবিতার প্রধান একটি ধরন।
আজ আকাশে আকাশে এ কেমন বৃষ্টি
পরিপূর্ণ উন্মত্ত আর বাতাসে বাতাসে অস্থির
এ কেমন বৃষ্টি আজ চারদিকে
এ পর্বতের সানুদেশে শিখরে এই অরণ্য শীর্ষে
বৃৰলোকের ওপারে এ কেমন মেঘমন্দ্রিত জলের বাতাস
নদীর তরঙ্গবিৰুব্ধ শরীরে সবুজ ঘাসের আত্মায়
আর আনন্দিত সব প্রজাপ্রতির ডানায় ডানায়
এ কেমন বৃষ্টি
এযে পৃথিবীভরা গোপন সব পুষ্পকলি
তাদের মুখম-লে এ কেমন সিক্তবসনা বৃষ্টির উত্তরীয়
(আজ বৃষ্টিতে)
নৈসর্গিক আবহ এবং সমকালীন বিষয় ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতার এক নিবিড় চারিত্র যা প্রাণোজ্জ্বল উপস্থাপনায় হয়ে ওঠে প্রবল ব্যঞ্জনাময়। পঞ্চাশের কবি ফজল শাহাবুদ্দীন আজীবন কবিতার কাছে সমর্পিত থেকে থেকে হয়ে উঠেছেন নিজেই আজ কবিতার গহন আকাশ। যে আকাশের জ্বলজ্বলে তারা জেগে থাকে কবিতার কোমল মেঘার্দ্র মর্নিংরোজ। আর ঐ নির্জন ঘ্রানে ভিজে ওঠে কবিতানুরাগীর পাঠকের মন। তিনি কবিতাকে তার তরম্নণ চুলের ফুরফুরে আবেশের মতো আকৈশোর জড়িয়ে রেখেছেন ভীষণ আদরে, খুব যত্নে। তিনি কবিতার পরিচর্যায় নিরনত্মর নিমগ্ন থাকেন গভীর মমতায়। তাঁর কবিতা সবসময় নিজস্বতা ধারণ করেই রচিত হয়। কখনও জলরঙ, কখনও তেলরঙ, কখনও বা শুধু ব্রাশের টানে তাঁর কবিতা হয়ে যায় একেকটি নিদারম্নণ চিত্রময় কাব্যগাথা। যে কাব্যগাথার মর্মে ভেসে যায় ছায়াচ্ছন্ন ছই নৌকোর ধুধু নিটোল মুখখানি। কখনও কখনও অরণ্য থেকে অরণ্যানত্মরের সবুজ পেলব মুগ্ধতাও ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতার শব্দ, পঙক্তি, স্টাইল ও ফর্মকে একটা নতুন মাত্রায় জড়িয়ে দেয়। যা তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতায় যেমন হৃদ্য করে তেমনি কবিও হয়ে ওঠেন নির্দ্বিধায় বিশিষ্টজন।
দূরাভাষের রহস্যময় কোন নারীর মায়াবী মিহিন স্বরের ধ্বনিপূঞ্জের মতো ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতা পাঠককে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় লাল ঝাউবনে। বৃষ্টির দিনের শেষ মাথায় তাঁর কবিতার বিলবোর্ডগুলো জ্যোৎস্নাঙ্কিত রাত্রির মতো জ্বলে ওঠে এভিনিউ থেকে এভিনিউতে। ঘুমনত্ম স্ট্রিটগুলো যেন তাঁর কবিতার অবৈতনিক ছাত্রের মতো রোজ ভোরে এসে বসে থাকে ঘাসের পাঠশালায়।
নাগরিক কবিতা যেমন ফজল শাহাবুদ্দীনের কাব্যকীর্তির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তেমনি নির্মল পকৃতিসি্নগ্ধ কবিতাও তিনি রচনা করেছেন অজস্র। যেন সি বিচের পাবে বসা কোন টু্যরিস্ট বিদেশিনীর মর্মরিত উজ্জ্বল ঘাড় ও গলার ভাঁজের মতো তরঙ্গায়িত তাঁর কবিতা ফুরিয়ে আসা সন্ধ্যার অন্ধকারজ্বলা মুহূর্তে চন্দ্রাতক দিগনত্মের মতো থমকে থাকে অবিশ্রাম।
নানা অলঙ্কারে কারম্নকার্যময় হয়ে ওঠা তাঁর কবিতাকে এখন আর কোন সীমায় অবরম্নদ্ধ রাখার যেমন অবকাশ নেই, একইভাবে তার কবিতা কোন নির্দিষ্ট বৃত্তেও আর আটকে নেই। ফেব্রিকোর নীলাকাশের মতোই তার কবিতার শরীর জড়িয়ে রেখেছে সর্বজনীন চিরায়ত আবহ।
No comments