অভিমত- প্রয়োজন বন্ধুত্ব বৈরিতা নয় by কুতুব উদ্দিন প্রধান
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পর্যনত্ম ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি চমৎকার সম্পর্ক ছিল, বিশেষ করে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর এদেশের রাষ্ট্রৰমতা পালাবদলে পররাষ্ট্রনীতি রাতারাতি পরিবর্তন হয়।
আমাদের ভারতীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক টানাপোড়েনে একেবারে শূন্যের কোঠায় চলে আসে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ৰমতার পালাবদল হয়। যদিও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ৰমতায় এসেছিলেন সেই সময়ে অর্থাৎ পাঁচ বছর ৰমতায় থাকা অবস্থায় সেই পূর্বের অবস্থায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। ২০০১ সালে জোট সরকার ৰমতায় এলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। একটি কথা বলে রাখা ভাল, আমাদের দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের ভারত প্রত্যৰ আশ্রয় দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধোপযোগী করে এবং রসদ জুগিয়ে মাত্র নয় মাসে শক্তিশালী পাক ফৌজকে যুদ্ধে হারিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে সহযোগিতা করে ছিল। এতে ভারত গভীর বন্ধুত্বের দাবিদার হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। জানা যায়, এ যুদ্ধে ভারতের প্রায় ১২ হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে। ভারতের এ উপকার বাংলাদেশের মানুষ চিরদিন স্বীকার করবে। তৎকালীন সময়ে যুদ্ধ বিধ্বসত্ম দেশটি যখন সমস্যায় জর্জরিত ঠিক সেই সময়ে দেশপ্রেমিক জনগণ মুক্তিযোদ্ধারা দেশটি গড়তে থাকে।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে বাকি সরকারগুলোর সময়ে ভারতবিরোধী মনোভাব প্রকাশ পেতে থাকে। এদেশের রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ রম্নশ-ভারতবিবোধী জনমত গঠনের নিমিত্তে যথেষ্ট প্রপাগান্ডা চালিয়েছিল। তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তারা তাদের গনত্মব্যে পেঁৗছেছে শুধু পিছিয়ে আছি আমরা। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে দু'দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপনের নতুন মাত্রা যোগ করেছেন এতে করে দু'দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে অবিশ্বাসের পালা কিছুটা দূর হয়েছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে সন্দেহ করে আসছে বাংলাদেশে ভারতীয় বিচ্ছিন্নবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। যা হোক ভারতীয় জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। ইতোমধ্যে এ দুশ্চিনত্মা তাদের মাথা হতে নেমেছে বলে আমার মনে হয়। শেখ হাসিনার এই সফরের মধ্য দিয়ে দু'দেশেই পরস্পর পরস্পরের প্রতি আস্থা অর্জিত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি পাহাড় পরিমাণ আলোচনা ব্যতীত এ ঘাটতি পূরণ হওয়ার নয়। দু'দেশেই সমপরিমাণ পণ্য শুল্ক মুক্তভাবে আমদানি-রফতানি করতে হবে। এতে করে বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসবে। আর এমন যদি হয় আমাদের দেশে যা নাই তা রফতানি সুবিধা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে তবে আর হবে না। প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরের মধ্য দিয়ে সীমানত্ম বাণিজ্য সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। সীমানত্মে হাট বসানোর আয়োজন করা হচ্ছে। তবে এতে খেয়াল রাখতে হবে চোরাচালান যাতে বৃদ্ধি না পায় সেই দিকে বিশেষ টিমের নজরদারি থাকতে হবে। বিগত সময়ে ভারতে ভূমি ব্যবহার করে সরাসরি নেপালের সঙ্গে একটি ট্রানজিট চুক্তি হয়েছিল যা কার্যকারিতা পায়নি। সেই চুক্তিটি পর্যালোচনা করে। কারণ নির্ধারণ করতে হবে। কেন চুক্তিটি বাসত্মবায়িত হয়নি। এ চুক্তিটি বাসত্মবায়িত হলে নেপাল থেকে ভারত হয়ে পণ্য সরাসরি মংলাবন্দরে এনে সমুদ্র পথে রফতানি করা যেত।
ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী দিলস্নী সফরে ভারতকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দর ব্যবহারের যে প্রতিশ্রম্নতি দেয়া হয়েছে তা বাসত্মবায়িত করার জন্য বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশের সড়ক ও রেলপথ ব্যবহার করে নেপাল, ভুটান, চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দর ব্যবহারের যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এতে বাধা হয়ে থাকতে পারে এমন বিষয়গুলো পরীৰা করে আগেই বাধ দেয়া উচিত এবং নেপাল, ভুটান, মিয়ানমারকেও আমাদের বন্দর ব্যবহার করতে দেয়া দরকার। বাংলাদেশের সড়ক ও রেলপথ ব্যবহারে ভারতে সুবিধা দেয়ার আগে অবশ্যই তাদের কাছ থেকে জেনে নেয়া উচিত তারা কি কি পণ্য আমাদের দেশের ওপর দিয়ে আনা-নেয়া করবে। এদেশের ৰতিকরণ এমন কোন পণ্য আনা-নেয়া করতে দেয়া যাবে না। শর্ত দিতে হবে, ভারত এদেশের ওপর দিয়ে কোন সমরাস্ত্র, সামরিক রসদ আনতে দেয়া হবে না। ভারতের অভ্যনত্মরীণ রাজনীতিতে আমরা জড়িত হতে চাই না। বিশেষ করে আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম ও পশ্চিমবঙ্গের বিচ্ছিন্নবাদীদের দমানোর জন্য আমাদের দেশকে ব্যবহার করা ঠিক হবে না। আমরা যদি তাদের দমানো ব্যবহারের সুযোগ দেই তবে ভারতীয় বিচ্ছিন্নবাদীদের টার্গেট আমরা হতে পারি। তাই বৈধ পণ্য আমদানি-রফতানির জন্য যৌথ ইশতেহারে কার্যকারিতা পাইলে দেশ ও জনগণের মঙ্গল হবে এবং এটাই এ সরকারের নীতি হওয়া উচিত। ভারত যদি তাদের দেশের উত্তর-পূর্ব সীমানত্মে অস্ত্র পরিবহনে আমাদের দেশের রাসত্মা ও পোর্টকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে চায় তবে আমাদের উত্তম সম্পর্ক চীনের সঙ্গে থাকবে না। কারণ ভারতের সঙ্গে নিচের সীমানত্ম সমস্যা রয়ে গেছে। চীনের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব অটুট রাখার স্বার্থে ভারতকে অস্ত্র পরিবহনে সুবিধা দেয়া যাবে না। যদি মিয়ানমার ও চীন ভারতের পাশাপাশি আমাদের বন্দর দুটি ব্যবহার করে তবে আমরা অধিক লাভবান হব। শুধু আমাদের ব্যবহারের উপযোগী করে দিতে হবে। কিছুদিন আগে চীনের একজন প্রতিমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। এতে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করার প্রসত্মাব আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে দিয়েছেন।
৫৪টি নদী ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভাটির দেশ বাংলাদেশে এসেছে। তার মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন, তিসত্মা চুক্তি, ফারাক্কা ও টিপাইমুখে বাঁধ এসব কারণে বাংলাদেশের বৃহত্তম নদীগুলো মরে যাচ্ছে। পানিশূন্য হয়ে ধু-ধু বালিচর সৃষ্টি হচ্ছে। শুধু পানির অভাবে বাংলাদেশের মৎস্য ভা-ার বিলুপ্তির পথে। কৃষি পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। জীববিচিত্র্য ও পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। এসব বিষয়গুলো উত্থাপিত হওয়া উচিত এবং দেশের স্বার্থে বিষয়গুলো ফয়সালা হওয়া দরকার। আমাদের নদীগুলো যথেষ্ট পরিমাণ পানি প্রবাহের প্রয়োজনে ভারতে উচিত আনত্মর্জাতিক নদী আইন মেনে চলা। ভারতের সঙ্গে আমাদের সীমানত্ম সমস্যাও সমুদ্র সীমানা বিরোধ এ বিষয়গুলো আলোচনায় এনে একটি চূড়ানত্ম লৰ্যে পেঁৗছা দরকার। যে কারণে সমুদ্রের নিচে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে কোন বাধাদান ভারতের উচিত নয়। এটা প্রকৃতই আমাদের সম্পদ। এদেশের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৬ কোটি। ২০৫০ সালে এদেশের জনসংখ্যা হবে ২৮ কোটি। এ বৃহত্তম জনসংখ্যার কর্মের লৰ্যে এখন থেকেই আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে করে সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সুবাদে সমুদ্র তলদেশে তেল-গ্যাস আহরণে ভারত যে প্রতিপৰ হয়ে না দাঁড়ায়। সে কারণে এখনই সমুদ্র সীমানা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সংস্কৃতি আদান-প্রদানে ভারতীয় অনেকগুলো চ্যানেল এদেশে টিভিতে দেখা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোন চ্যানেল ভারতীয় টিভিতে দেখা যায় না। যদিও দেখা যায় তা পর্যাপ্ত নয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে আমাদের ব্যবসায়ীরা রফতানির মাধ্যমে এদেশের উৎপাদিত পণ্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিনা শুল্কো পেঁৗছতে পারে সে সুযোগ ভারতের দেয়া উচিত। আমরা বাংলাদেশীরা ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের সার্বিক সহযোগিতায় ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণ চেষ্টায় ও ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন। বাংলাদেশের অধিবাসীরা আপনাদের উত্তম পরশী মনে করেন। বরাবরই আপনাদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক ছিল, ভবিষ্যতে আরও ভাল হবে। আমরা ভারতবিদ্বেষী নই। আমরা সামনের দিনগুলোতে শানত্মিপূর্ণভাবে পাশাপাশি রাষ্ট্রে বসবাস করব। সেই সুবাদে আপনাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব অটুট থাকবে।
No comments