পর্ব-১৩-'যাহোক, তবু নিজের বাড়ি'

আমরা অভয় দাস লেন ছেড়ে গেণ্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডে এলাম। আমাদের বাড়ির নম্বর ২৯, দীননাথ সেন রোড। সেটা উনিশ শ চুয়ান্ন। মাসটা ঠিক মনে নেই। তবে ঋতুটা ছিল শরৎ। এটা স্পষ্ট মনে আছে। আমার গায়ে তখনো মফস্বলের গন্ধ। কাজেই ঋতু বিষয়টি খুবই মনে থাকে। আর শরৎ আমার প্রিয় ঋতু। কাজেই মনে থাকারই কথা।


মনটা ভারী হয়ে ছিল। ওয়ারীতে ভাইবোনেরা আমার খুবই অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে পড়েছিল। শামীম ভাই, জামিল, বুরন, শোয়েব, শাবি্বর, লুলু। তাদের ছেড়ে এসে যেন অকুল পাথারে পড়েছিলাম। সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল এই ভেবে যে প্রাচীরের ওপরে বসে মেয়েদের সারিবদ্ধভাবে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসার সেই দৃশ্য আর দেখতে পাব না। এই মন কেমন করা অবস্থায় মায়ের একটি বচন আমাকে অনেক শান্তি দিয়েছিল। আমরা যখন নতুন বাড়িতে এলাম তখন বাড়ির আঙিনায় আগাছা ইত্যাদি পরিষ্কার করা হচ্ছিল। এরই মাঝে ঘরের ভেতর চুনকাম এবং নানাবিধ সংস্কারের কাজ হচ্ছিল। মা ঘুরে ঘুরে সব দেখছিলেন। দেখতে দেখতে তাঁর চেহারা কেমন বেদনাহত হয়ে পড়েছিল। সবকিছু দেখা হয়ে গেলে মা চেহারায় হাসি হাসি ভাব এঁকে বললেন, 'যাহোক, তবু নিজের বাড়ি।' আমারও সবকিছু দেখতে দেখতে কেমন মন খারাপ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মায়ের সেই কথা, 'যাহোক, তবু নিজের বাড়ি' সঞ্জীবনের মতো কাজ করল। মনে আছে, গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে বেশ কয়েকবার আওড়ালাম, 'যাহোক, তবু নিজের বাড়ি।' সামান্য একটি কথা, এক বাঙালি মায়ের কণ্ঠনিঃসৃত অতিসাধারণ বাণী, 'যাহোক, তবু নিজের বাড়ি', কী সুদূরপ্রসারী এর তাৎপর্য। আজ ভাবি, বাড়িটিকে যদি নিজের জীবনের কেন্দ্র হিসেবে কল্পনা করি, বিমূর্তভাবেই, তাহলে জীবনেরও কি একটা দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় না? নিজের মানুষ, নিজের সমাজ, নিজের গ্রাম, নিজের শহর, সর্বপোরি নিজের দেশ? 'যাহোক, তবু .....' এই অমোঘ কথাগুলো, আজ যদি বলি আমার সব সিদ্ধান্ত গ্রহণে নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করেছে, তাহলে বোধ হয় বাড়িয়ে বলা হবে না। আমার লেখাপড়া, রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা, কোনো দ্বিধা না করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া_এসব সিদ্ধান্তই মায়ের বাণী দ্বারা অনুপ্রাণিত।
যাহোক, ফিরে আসি সেই চুয়ান্নর গেণ্ডারিয়ায়। ২৯ দীননাথ সেন রোডের মালিক ছিলেন শ্রী অশোক কুমার ঘোষাল। পরে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র মোহিতের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। ঘোষাল বাবুর একটি ছবি তোলার স্টুডিও ছিল, খুব সম্ভবত ওয়াইজঘাট এলাকায়। তাঁরা নিজেদের বাড়ি বিক্রি করে গেণ্ডারিয়াতেই একটি বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে উঠে গেলেন। ছোটখাটো আকৃতির মোহিত খুব ভালো ক্রিকেট খেলত। আমরা যখন গেণ্ডারিয়ার বাড়িতে প্রবেশ করি তখন বাড়িটির সামনের উঠান ছিল ছোট ছোট গাছগাছালিতে ভরা। এর মধ্যে যেমন ছিল আকন্দ, ভাঁটফুল (হাজার বেলি), বন গাঁদা এ ধরনের সব বুনো গাছ, তেমনি ছিল জবা, গন্ধজবা, কামিনী। এসব গাছে বাড়ির সামনের এবং পেছনের উঠান ছেয়ে ছিল। আমি আগেই বলেছি, বাবা বাগান করতে ভালোবাসতেন। তবে তিনি খুব গোছানো বাগান করতে ভালোবাসতেন। যাকে ইংলিশ গার্ডেন বলা হতো। অনুমান করি যে ব্রিটিশ আমলের প্রশাসনসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ তাঁকে এ ধরনের বাগানের প্রতি আসক্ত করেছিল। বাগান সম্পর্কে আমার ধারণা ভিন্নতর। আমি জংলি বাগান ভালোবাসি। খুব একটা গুছিয়ে-গাছিয়ে বাগান করা আমার দ্বারা হয়ে ওঠে না। যাহোক, ওই ২৯ দীননাথ সেন রোডের বাগান পরিষ্কার করা হলো। বুনো গাছগুলোর সঙ্গে কামিনী গাছগুলোকেও আত্মাহুতি দিতে হলো। কামিনী সম্পর্কে মায়ের একটি কুসংস্কার ছিল। তাঁর ধারণা ছিল, কামিনী অমঙ্গল ডেকে আনে। তবে এর কোনো ব্যাখ্যা তিনি কখনো দেননি। বোধ হয় কোনো সময় কেউ তাঁকে বলেছিল, কামিনী ফুল দুর্ভাগ্যের প্রতীক। অথবা হতে পারে, বাংলায় কামিনী, কাঞ্চন_এ কথাগুলোর অর্থ খুব ভালো নয়, তাই তিনি ভয় পেতেন। আমি আবার কামিনী ফুল খুব ভালোবাসি। আমার গ্রামের বাড়ির সব জায়গায় কামিনীর ঝাড়। বাবা তাঁর পছন্দের কিছু গাছ তুলে রাখলেন পেছনে উঠানের বীজতলায়, পরে বাগানে বপন করবেন বলে। ওই গাছগুলো কেটে আমাদের দুই উঠানের ওপর ছড়িয়ে রাখা ছিল। যখন আমরা আমাদের নতুন বাড়িতে গৃহপ্রবেশ করলাম, সেদিন শেষ রাতে কী কারণে যেন আমার ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম, পূর্ণিমার চাঁদে চারদিক ভেসে যাচ্ছে। ছোট ছোট গাছ আর ঝোপঝাড়গুলো কঙ্কালের মতো উঠানের ওপর পড়ে থেকে চাঁদের আলো-ছায়ায় ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। বাল্যকালে, নিঃশব্দ নিশুতি রাতে এ দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে যাওয়ার কথা; কিন্তু আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকলাম। আমার কণ্ঠ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এল ,'যাহোক, তবু নিজের বাড়ি।' (চলবে...)

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.