চারদিক-আমবাগানের গৃহস্থালি
ঘুরতে ঘুরতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটা মস্ত আমবাগানের মধ্যে এসে পড়লাম। বাগানজুড়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সের প্রায় ৬০টি গাছ আছে। ছোট গাছ আছে আরও অনেক। ঝাঁকড়া মাথার আমগাছগুলোর ডালপালা চারদিকে ছাতার মতো ছড়িয়ে পড়েছে। মোটাসোটা ডাল কোথাও কোথাও নুয়ে মাটির কাছাকাছি চলে এসেছে।
গাছের ডালে ডালে সবুজ ডিমের মতো কাঁচা আম ঝুলছে। আমবাগানের মধ্যে গড়ে উঠেছে পাহারাদারদের অস্থায়ী ঘর-গৃহস্থালি। বাঁশ-খুঁটি দিয়ে একচালা টিনের ঘরের ভেতরে তিনটে দড়ির খাটিয়া। ঘরের একপাশে লাগোয়া একটা পাকের ঘর, সামনে উঠানের মতো একটা ফাঁকা জায়গা, উত্তর পাশে একটা অফিসঘরের মতো কামরা। সে কামরার ভেতর একটা চেয়ার ও টেবিল পাতা। তার পাশে ভেড়া ও ছাগলের ঘর, গরুর গোয়াল ও রাজহাঁসের খোঁয়াড়। একটা মস্ত আমগাছে হেলান দেওয়া একটা বাঁশের মই। উঠানে কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার, ঝুড়ি ইত্যাদি। উঠানে চেয়ার পেতে একজন মানুষ বসে আছেন। হাঁটতে হাঁটতে তাঁর কাছাকাছি যেতেই লম্বা স্বরে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম।’
আমিও উত্তর দিয়ে বললাম, ‘কেমন আছেন?’
‘ভালো।’
‘নাম কী?’
‘ছিরাজুল।’ চাঁপাইয়ের লোকজন আঞ্চলিক ভাষার টানে স-কে ছ বলে। তাই বুঝতে অসুবিধা হলো না যে লোকটার নাম সিরাজুল। আলাপে জানা গেল, তাঁর বাড়ি পলশাবাড়ি। তিনিসহ ছয়জন একদলে আমবাগানে চৌকি দেওয়ার কাজ করেন। বছরের এই একটা মৌসুমে তাঁরা পরিবার-পরিজন ছেড়ে কোনো না-কোনো আমবাগানে ঘর তুলে পড়ে থাকেন। সেখানেই গড়ে তোলেন আমবাগানের মৌসুমি গৃহস্থালি। এ সময় চাঁপাইয়ের কি ছোট কি বড় প্রতিটি আমবাগানেই চৌকি বসে। কোনো কোনো আমবাগান এক থেকে দুজন পাহারা দেন, কোনো কোনো আমবাগানে ১০ জনও থাকেন। গুটি বড় হওয়ার পর থেকে আম পুরোপুরি না পাড়া পর্যন্ত বাগানেই ওঁদের থাকতে হয়। সিরাজুল, এব্বর ও মিলনকে ওই আমবাগানে পাওয়া গেল পাহারাদার হিসেবে। তাঁরা জানালেন, জনৈক আমীর ১৬ লাখ টাকায় এক বছরের জন্য এ বাগান কিনে নিয়েছেন। আমবাগানে সার-পানি দেওয়া, স্প্রে করা, পাহারা দেওয়া ইত্যাদি বাবদ প্রায় ২৫ লাখ টাকা পড়ে যাবে। জিজ্ঞেস করি, ‘পাহারার জন্য আপনাদের মালিক কী দেয়?’
‘মাসিক বেতন দেয়। প্রত্যেকে আমরা মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে মাইনে পাই। এ বাগানে যদি আশ্বিনা জাতের আমগাছ থাকে তবে আমরা শ্রাবণ মাস পর্যন্ত কাজে থাকতে পারব, না হলে জ্যৈষ্ঠের পরই ছুটি।’
‘তার মানে এরপর আপনারা সবাই বেকার হয়ে যাবেন?’
‘বেকার কেন হব? এরপর আষাঢ়-শ্রাবণে আবার আমন ধানের খেতে পাইট (দিনমজুর) দেওয়ার কাজে লেগে যাব। দিন বা বিঘা চুক্তিতে তখন কাজ করব। ধানের আগাছা সাফ করা পর্যন্ত কাজের কোনো অভাব নেই।’
‘এখানে কী কী কাজ করতে হয়?’
‘শুধু পাহারা দিলে তো চলে না, পুরো বাগানই দেখাশোনা করতে হয়, ঝরে পড়া আম কুড়াতে হয়, এমনকি ঝরা পাতাও কুড়াতে হয়।’
‘ঝরা পাতা? ওটা কেন সাফ করতে হয়?’
‘বাগানের ঝরা পাতাও বিক্রি হয়, প্রতি বস্তা ৩০ টাকা। শুকনো পাতা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হয়।’
‘আর কী কাজ করতে হয়?’
মিলন বললেন, ‘কি না করতে হয়? মালিকের ফাইফরমাশ খাটা থেকে শুরু করে আম বিক্রির ব্যবস্থা করা পর্যন্ত সবই করতে হয়। তবে মহাজন আমাদের খাওয়ান, আমাদের কোনো খাওয়া খরচ নেই। দেখছেন না, পাল ধরে রাজহাঁস পুষছি। মালিক ওগুলো দিয়ে গেছেন, মনে হয় ৬০-৭০টা হবে। আমরা একটা করে রাজহাঁস জবাই করি আর তার গোশত রেঁধে ভাত খাই। তবে গরু দুটো এনেছি কোরবানির হাটে মোটা করে বেচব বলে, ও দুটো মালিক দেয়নি, আমাদের। দিনের বেলায় রাঁধি-বাড়ি খাই আর বাগান পরিচর্যার টুকিটাকি কাজ করি, রাত হলে আমরা পালাক্রমে শক্তিশালী টর্চ হাতে বাগান চষে বেড়াই।’
মিলনের কথা শুনে কিছুটা হোঁচট খেলাম। যত দূর শুনেছি, চাঁপাইয়ের লোকজনের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, তারা কখনো অন্য কারও আমগাছের আম ছেঁড়ে না। হাতের কাছে থোকা ধরে যতই আম ঝুলতে থাকুক, কেউ তার গায়ে একটু হাত দেবে না। এ রকম যেখানকার অবস্থা, সেখানে আবার আমবাগান পাহারা দিতে হয় নাকি? কথাটা ওঁদের জিজ্ঞেস করে ফেললাম।
‘কথা মিছা না। ইচ্ছে করে এখন কেউ গাছ থেকে আম ছিঁড়ে না। কিন্তু রাত হলে আমচোরদের উপদ্রব বাড়ে। এক মণ আম সরাতে পারলেই তো দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। আমগাছের ডালে একটা বস্তা নিয়ে উঠলেই ওটা ১০ মিনিটের মধ্যে যেকোনো পাকা আমচোর কাজ সেরে পালাতে পারে। তাই বাগান পাহারা না দিয়ে করব কী?’
না আর গল্প নয়, তাহলে হয়তো ওঁদের আজ আর সকালে খাওয়াই জুটবে না। অতএব উঠে চললাম অন্য আমবাগানের দিকে, বালিয়াঘাটার পথে। সেখানে পৌঁছেও দেখলাম একই চিত্র। আমবাগানের মধ্যে বাঁশের একটা মাচাংয়ের নিচে একটা হারিকেন ঝুলছে, মাচাংয়ের ওপর একজন লোক শুয়ে মাঝেমধ্যে হাঁক ছেড়ে তাঁর সজাগ দৃষ্টির কথা জানান দিচ্ছেন ‘ওঁই হেঁ রেঁ...কেঁ ওঁই হে...হই।’
মৃত্যুঞ্জয় রায়
আমিও উত্তর দিয়ে বললাম, ‘কেমন আছেন?’
‘ভালো।’
‘নাম কী?’
‘ছিরাজুল।’ চাঁপাইয়ের লোকজন আঞ্চলিক ভাষার টানে স-কে ছ বলে। তাই বুঝতে অসুবিধা হলো না যে লোকটার নাম সিরাজুল। আলাপে জানা গেল, তাঁর বাড়ি পলশাবাড়ি। তিনিসহ ছয়জন একদলে আমবাগানে চৌকি দেওয়ার কাজ করেন। বছরের এই একটা মৌসুমে তাঁরা পরিবার-পরিজন ছেড়ে কোনো না-কোনো আমবাগানে ঘর তুলে পড়ে থাকেন। সেখানেই গড়ে তোলেন আমবাগানের মৌসুমি গৃহস্থালি। এ সময় চাঁপাইয়ের কি ছোট কি বড় প্রতিটি আমবাগানেই চৌকি বসে। কোনো কোনো আমবাগান এক থেকে দুজন পাহারা দেন, কোনো কোনো আমবাগানে ১০ জনও থাকেন। গুটি বড় হওয়ার পর থেকে আম পুরোপুরি না পাড়া পর্যন্ত বাগানেই ওঁদের থাকতে হয়। সিরাজুল, এব্বর ও মিলনকে ওই আমবাগানে পাওয়া গেল পাহারাদার হিসেবে। তাঁরা জানালেন, জনৈক আমীর ১৬ লাখ টাকায় এক বছরের জন্য এ বাগান কিনে নিয়েছেন। আমবাগানে সার-পানি দেওয়া, স্প্রে করা, পাহারা দেওয়া ইত্যাদি বাবদ প্রায় ২৫ লাখ টাকা পড়ে যাবে। জিজ্ঞেস করি, ‘পাহারার জন্য আপনাদের মালিক কী দেয়?’
‘মাসিক বেতন দেয়। প্রত্যেকে আমরা মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে মাইনে পাই। এ বাগানে যদি আশ্বিনা জাতের আমগাছ থাকে তবে আমরা শ্রাবণ মাস পর্যন্ত কাজে থাকতে পারব, না হলে জ্যৈষ্ঠের পরই ছুটি।’
‘তার মানে এরপর আপনারা সবাই বেকার হয়ে যাবেন?’
‘বেকার কেন হব? এরপর আষাঢ়-শ্রাবণে আবার আমন ধানের খেতে পাইট (দিনমজুর) দেওয়ার কাজে লেগে যাব। দিন বা বিঘা চুক্তিতে তখন কাজ করব। ধানের আগাছা সাফ করা পর্যন্ত কাজের কোনো অভাব নেই।’
‘এখানে কী কী কাজ করতে হয়?’
‘শুধু পাহারা দিলে তো চলে না, পুরো বাগানই দেখাশোনা করতে হয়, ঝরে পড়া আম কুড়াতে হয়, এমনকি ঝরা পাতাও কুড়াতে হয়।’
‘ঝরা পাতা? ওটা কেন সাফ করতে হয়?’
‘বাগানের ঝরা পাতাও বিক্রি হয়, প্রতি বস্তা ৩০ টাকা। শুকনো পাতা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হয়।’
‘আর কী কাজ করতে হয়?’
মিলন বললেন, ‘কি না করতে হয়? মালিকের ফাইফরমাশ খাটা থেকে শুরু করে আম বিক্রির ব্যবস্থা করা পর্যন্ত সবই করতে হয়। তবে মহাজন আমাদের খাওয়ান, আমাদের কোনো খাওয়া খরচ নেই। দেখছেন না, পাল ধরে রাজহাঁস পুষছি। মালিক ওগুলো দিয়ে গেছেন, মনে হয় ৬০-৭০টা হবে। আমরা একটা করে রাজহাঁস জবাই করি আর তার গোশত রেঁধে ভাত খাই। তবে গরু দুটো এনেছি কোরবানির হাটে মোটা করে বেচব বলে, ও দুটো মালিক দেয়নি, আমাদের। দিনের বেলায় রাঁধি-বাড়ি খাই আর বাগান পরিচর্যার টুকিটাকি কাজ করি, রাত হলে আমরা পালাক্রমে শক্তিশালী টর্চ হাতে বাগান চষে বেড়াই।’
মিলনের কথা শুনে কিছুটা হোঁচট খেলাম। যত দূর শুনেছি, চাঁপাইয়ের লোকজনের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, তারা কখনো অন্য কারও আমগাছের আম ছেঁড়ে না। হাতের কাছে থোকা ধরে যতই আম ঝুলতে থাকুক, কেউ তার গায়ে একটু হাত দেবে না। এ রকম যেখানকার অবস্থা, সেখানে আবার আমবাগান পাহারা দিতে হয় নাকি? কথাটা ওঁদের জিজ্ঞেস করে ফেললাম।
‘কথা মিছা না। ইচ্ছে করে এখন কেউ গাছ থেকে আম ছিঁড়ে না। কিন্তু রাত হলে আমচোরদের উপদ্রব বাড়ে। এক মণ আম সরাতে পারলেই তো দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। আমগাছের ডালে একটা বস্তা নিয়ে উঠলেই ওটা ১০ মিনিটের মধ্যে যেকোনো পাকা আমচোর কাজ সেরে পালাতে পারে। তাই বাগান পাহারা না দিয়ে করব কী?’
না আর গল্প নয়, তাহলে হয়তো ওঁদের আজ আর সকালে খাওয়াই জুটবে না। অতএব উঠে চললাম অন্য আমবাগানের দিকে, বালিয়াঘাটার পথে। সেখানে পৌঁছেও দেখলাম একই চিত্র। আমবাগানের মধ্যে বাঁশের একটা মাচাংয়ের নিচে একটা হারিকেন ঝুলছে, মাচাংয়ের ওপর একজন লোক শুয়ে মাঝেমধ্যে হাঁক ছেড়ে তাঁর সজাগ দৃষ্টির কথা জানান দিচ্ছেন ‘ওঁই হেঁ রেঁ...কেঁ ওঁই হে...হই।’
মৃত্যুঞ্জয় রায়
No comments