আ মা র এ ভা রে স্ট অ ভি যা ন-এ যেন এক পুনর্জন্ম by ওয়াসফিয়া নাজরীন
২৬ মে পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন ওয়াসফিয়া নাজরীন। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে তিনি ছিলেন তাঁর এভারেস্ট অভিযানে। পাঠকদের সেই অভিযানের কথা শোনাচ্ছেন তিনি। আজ ছাপা হলো এর শেষ পর্ব।
সাউথ কোলের পরের গন্তব্য ব্যালকনি। হঠাৎ করে ছড়ানো পর্বতের একটা অংশ। ব্যালকনির ওপরের জায়গাটায় পাথর পড়ছিল। যেন মনে হচ্ছিল ওপরে বসে কেউ আমাদের লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ছে। আমি বোকার মতো সাউথ কোলে হেলমেট ফেলে গেছি আর কাঠমান্ডুতে চশমা! তাই চোখেও কম দেখছিলাম। ব্যালকনি থেকে এগোনোর সময় শেরপা সর্দার নিমা আমার সামনে ঢাল হিসেবে থাকেন। তিনি এঁকেবেঁকে এগোতে থাকেন, আমিও তাঁর পেছনে এঁকেবেঁকে উঠতে থাকি। তবু ডান কাঁধে তিনবার পাথরের চোট লাগে। সাউথ কোল থেকে চূড়া পর্যন্ত প্রতিটি গন্তব্যে (জংশন) রেডিও ব্যবহার করে অবস্থা জানাতে হয়। এসব আবার পরে সার্টিফিকেট নিতেও কাজে লাগে।
ব্যালকনির পরের গন্তব্য সাউথ সামিট, টিলার মতো। এই যাত্রাটা বেশ কঠিন ছিল। আমার আরেক শেরপা দা কুসাং সাধারণত বেশি কথা বলেন না। ব্যালকনি ছাড়ার পর দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যামে আটকা থাকার সময় কুসাং হঠাৎ করেই বললেন, ‘স্কটকে দেখেছ?’ আমি ভাবলাম ও বুঝি, আমার প্রতিবেশী তাঁবুর স্কটের কথা বলছেন। কিন্তু তিনি বলছিলেন ইন টু দ্য থিন এয়ার বইখ্যাত স্কট ফিশারের কথা। যিনি ১৯৯৬ সালে অভিযানে এসে মারা যান। তাঁর দেহ এখনো আছে সেখানে। তাঁর দেহ দেখে আমি শিউরে উঠি। কুসাং শান্তভাবে বলছিলেন, ‘হিলারি স্টেপ থেকে একবার এক পর্বতারোহী পড়ে গিয়েছিল, তাঁর একটা হাত পাওয়া গিয়েছিল ক্যাম্প-২-এ।’ মনে মনে বলি, এমনিতে কথা বলো না আর এখন এসব কথা শোনাচ্ছ!
সাউথ সামিটে ওঠার পথে নিমা হঠাৎ বলেন, ‘বহেনজি, আপ বৈঠিয়ে।’ আমি অপেক্ষা করি, তিনি ক্র্যাম্পুন দিয়ে নিনজার মতো উঠে যান। ওপরে উঠে আরেকটি রশি নামিয়ে দেন। এটাই সেই ৫০ মিটার বাড়তি রশি। ‘উঠে এসো। অক্সিজেন বাড়িয়ে দাও।’ আমি বোতল থেকে অক্সিজেন বের হওয়ার গতি ২ দশমিক ৫ থেকে পাঁচে বাড়িয়ে দিই। ছয় পর্যন্ত এটা বাড়ানো যায়। এই বাড়তি রশির কারণেই আমরা আমাদের ঠিক করা সময়ের বেশ আগেই চূড়ায় উঠতে পেরেছিলাম।
সামিটের আগে সেই ভয়ংকর হিলারি স্টেপ। আমার নিচে তিব্বতের দিকে মাকালু, আর নেপালের দিকে লোৎসে পর্বত। হিলারি স্টেপ পুরোটাই একটা পাথর, হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে হয় এবং মরার গন্তব্য নির্ধারণ করা যায়। একদিকে পড়লে তিব্বত অন্যদিকে পড়লে নেপাল। আপনি কোথায় মরতে চান। আমাদের পেছনেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা দল এবং আরও কয়েকজন।
আমাদের হিসাবমতো সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সামিটে ওঠার কথা। কিন্ত ২৬ মে সকাল ছয়টা ২৬ মিনিটে আমি, নিমা আর কুসাং উঠলাম মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায়। উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না। প্রচণ্ড বাতাস। প্রথম কয়েক মিনিট শুধু আমরাই ছিলাম চূড়ায়। এখানে বাংলাদেশের পতাকা এবং শেরপাদের আনা নেপালের পতাকা নিয়ে ছবি তুললাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্যরা চলে এল।
এরই মধ্যে এভারেস্টের চূড়া থেকে স্যাটেলাইট ফোনে ঢাকায় বাংলাদেশ অন সেভেন সামিটের মুখপাত্র আমার বন্ধু করভী রাখসান্দকে কল করার চেষ্টা করি। লাইন কেটে যায়। রেডিওতে এভারেস্ট সামিটের কথা জানিয়ে দিই নিচের ধাপে থাকা ক্রিসকে। তিনি জানান করভীকে। ততক্ষণে আমিও করভীকে ফোনে পেয়ে যাই। এভারেস্টের ওপর নানা রঙের কাপড়ের টুকরা দেখা যায় বরফের সঙ্গে যেন আটকে আছে। এসব বৌদ্ধ ধর্মে ব্যবহূত ‘প্রেয়ার ফ্ল্যাগ’, যা শেরপারা চূড়ায় নিয়ে যান। চূড়ায় গৌতম বুদ্ধের দুটি মুর্তি আছে। সেগুলোর ওপর দিয়ে শেরপারা প্রেয়ার ফ্ল্যাগ পেঁচিয়ে রাখেন। প্রতি মৌসুমেই নতুন নতুন প্রেয়ার ফ্ল্যাগ নিয়ে যাওয়া হয়। লাল আগুন, নীল বায়ু—একেকটা রং একেক বিষয়কে প্রতিনিধিত্ব করে। তাঁরা বিশ্বাস করেন সেই ফ্ল্যাগে যে মন্ত্র লেখা আছে, বাতাসে তা আশপাশে জনবসতির কাছে ছড়িয়ে যাবে।
প্রেয়ার ফ্ল্যাগের পাশে দাঁড়িয়ে, বসে নানাভাবে ছবি তোলা হলো। অক্সিজেন মাস্ক খুলে একটা ছবি তুললাম। নিমাকে নিয়ে আমি চূড়া থেকে তিব্বতের দিকে ৫০ মিটার নিচে নেমে এলাম। অভিযানের সময় আমার সঙ্গে দালাইলামার একটা ছাপা ছবি নিয়ে গিয়েছিলাম। তিব্বতের দিকে গিয়ে সেই ছবি নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালাম। আমার এটা একটা ইচ্ছা ছিল। বেশ আনন্দ পেলাম। আবার উঠে গেলাম চূড়ায়।
নতুন শক্তি পেলাম। এভারেস্টের উচ্চতা আর আবেগ যেন মিশে গেল। চূড়াতেই ঠিক করে ফেললাম, আমার যদি কখনো বাচ্চাকাচ্চা হয়, তবে সবগুলোকে এভারেস্টে চড়াব। চূড়ার কাছাকাছি যখন ছিলাম তখন সূর্য ছিল আমাদের নিচে। এখন সূর্য আমার চোখ বরাবর। ৪০ মিনিটের মতো থাকলাম চূড়ায়।
সামিট করার পর নামার পালা। নিমা আমাকে বলতেন, ‘ওপরে ওঠার সময় সব শক্তি খরচ করবে না, মনে রেখো তোমার নামতে হবে।’ তবে আমার পুরোটা আস্থা ছিল নিমা আর কুসাংয়ের ওপর। আমি জানি, এঁরা কেউই বিপদে আমাকে একা ফেলে যাবেন না। আমার মাঝে মাঝে হাত ঠান্ডায় হিম হয়ে যেত। কুসাং হাত ঘষে ঘষে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করে দিত।
২৬ মে দুপুর ১২টার মধ্যেই ক্যাম্প-৪-এ ফিরে এলাম। আগের রাত সাড়ে আটটা থেকে টানা ওঠা এভারেস্ট চূড়ায় আর নেমে আসা। শরীর আর টানে না। ক্যাম্প-৪-এ ফিরে এসে নুডলস আর ভিটামিন সির পানীয় খেলাম। এরপর ঘুম। ১১-১২ ঘণ্টার টানা ম্যারাথন ঘুম। সেদিন রাতে কুসাং আমাকে বেশ কয়েকবার পানি এনে দিয়েছেন তাঁবুতে। শেরপারা এসে আমারে শরীর-স্বাস্থ্যের খবর নিচ্ছিলেন। আমরা ভোর পাঁচটায় তাঁবু থেকে বের হয়ে ক্যাম্প গোছানো শুরু করি। গোছাতে গিয়ে দেখলাম এত জিনিস! কুসাংকে আমরা বেশি বোঝা দিলাম। আমার নিজের কাঁধেই ছিল ২২ কেজি বোঝা। ক্যাম্প-৪-এর নিচে জেনেভা স্পার দিয়ে নামছিলাম ধীরে ধীরে। তখন পর্বতের অবস্থা দেখে বোঝা যায় যে মৌসুমের একেবারে শেষ সময় এসে গেছে। বরফ গলে নরম হচ্ছিল, ফাটলগুলো বড় হচ্ছিল। কুম্ভু আইসফলের আকার বদলে গেছে। ক্যাম্প-৪ থেকে নামার সময় ইয়েলো ব্যান্ড একটা জায়গায় পিছলে যাই। পিছলাতে পিছলাতে দেখি রশি শেষ হয়ে যাচ্ছে। মনে হলো, যাক সামিট করেই তো মরছি। শেষ মুহূর্তে অন্য দলের এক শেরপা আমার কাঁধ ধরে আটকে ফেলেন। ২৮ মে ফিরলাম বেসক্যাম্পে। সবাই অপেক্ষা করছিলেন। সুযোগ থাকলে যেন লাল গালিচা সংবর্ধনাই দিত। তবে রাতে বেসক্যাম্পেই বড়সড় একটা পার্টি দেওয়া হয়।
সাত মহাদেশের সর্বোচ্চ সাতটি পর্বত চূড়ায় ওঠার যে কর্মসূচি শুরু করেছি, এভারেস্ট দিয়ে তার তিনটা চূড়ায় ওঠা সম্ভব হলো। এখন পরিকল্পনা করছি অ্যান্টার্কটিকার মাউন্ট ভিনসেন্ট অভিযানে যাওয়ার। সেখানেও ওড়াতে চাই লাল-সবুজ পতাকা। গাইতে চাই বাংলাদেশের নারীর শক্তির জয়গান।
অভিযানের আগেই মন স্থির করেছিলাম এভারেস্ট সামিট যদি করতে পারি তবে নিজের সবচেয়ে প্রিয় কোনো জিনিস ত্যাগ করব। বেসক্যাম্পে নেমে আমার সাত বছরের লম্বা চুল খুর দিয়ে কেটে ফেলে দিলাম। আসলে আমার কাছে এটা শুধু্ই এক অভিযান নয়। অনুভব করি, এভারেস্ট থেকে ফিরে আসার পরই সত্যিই যেন আমার পুনর্জন্ম হয়েছে।
(শেষ)
wasfia@bdon7summits.org
ব্যালকনির পরের গন্তব্য সাউথ সামিট, টিলার মতো। এই যাত্রাটা বেশ কঠিন ছিল। আমার আরেক শেরপা দা কুসাং সাধারণত বেশি কথা বলেন না। ব্যালকনি ছাড়ার পর দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যামে আটকা থাকার সময় কুসাং হঠাৎ করেই বললেন, ‘স্কটকে দেখেছ?’ আমি ভাবলাম ও বুঝি, আমার প্রতিবেশী তাঁবুর স্কটের কথা বলছেন। কিন্তু তিনি বলছিলেন ইন টু দ্য থিন এয়ার বইখ্যাত স্কট ফিশারের কথা। যিনি ১৯৯৬ সালে অভিযানে এসে মারা যান। তাঁর দেহ এখনো আছে সেখানে। তাঁর দেহ দেখে আমি শিউরে উঠি। কুসাং শান্তভাবে বলছিলেন, ‘হিলারি স্টেপ থেকে একবার এক পর্বতারোহী পড়ে গিয়েছিল, তাঁর একটা হাত পাওয়া গিয়েছিল ক্যাম্প-২-এ।’ মনে মনে বলি, এমনিতে কথা বলো না আর এখন এসব কথা শোনাচ্ছ!
সাউথ সামিটে ওঠার পথে নিমা হঠাৎ বলেন, ‘বহেনজি, আপ বৈঠিয়ে।’ আমি অপেক্ষা করি, তিনি ক্র্যাম্পুন দিয়ে নিনজার মতো উঠে যান। ওপরে উঠে আরেকটি রশি নামিয়ে দেন। এটাই সেই ৫০ মিটার বাড়তি রশি। ‘উঠে এসো। অক্সিজেন বাড়িয়ে দাও।’ আমি বোতল থেকে অক্সিজেন বের হওয়ার গতি ২ দশমিক ৫ থেকে পাঁচে বাড়িয়ে দিই। ছয় পর্যন্ত এটা বাড়ানো যায়। এই বাড়তি রশির কারণেই আমরা আমাদের ঠিক করা সময়ের বেশ আগেই চূড়ায় উঠতে পেরেছিলাম।
সামিটের আগে সেই ভয়ংকর হিলারি স্টেপ। আমার নিচে তিব্বতের দিকে মাকালু, আর নেপালের দিকে লোৎসে পর্বত। হিলারি স্টেপ পুরোটাই একটা পাথর, হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে হয় এবং মরার গন্তব্য নির্ধারণ করা যায়। একদিকে পড়লে তিব্বত অন্যদিকে পড়লে নেপাল। আপনি কোথায় মরতে চান। আমাদের পেছনেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা দল এবং আরও কয়েকজন।
আমাদের হিসাবমতো সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সামিটে ওঠার কথা। কিন্ত ২৬ মে সকাল ছয়টা ২৬ মিনিটে আমি, নিমা আর কুসাং উঠলাম মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায়। উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না। প্রচণ্ড বাতাস। প্রথম কয়েক মিনিট শুধু আমরাই ছিলাম চূড়ায়। এখানে বাংলাদেশের পতাকা এবং শেরপাদের আনা নেপালের পতাকা নিয়ে ছবি তুললাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্যরা চলে এল।
এরই মধ্যে এভারেস্টের চূড়া থেকে স্যাটেলাইট ফোনে ঢাকায় বাংলাদেশ অন সেভেন সামিটের মুখপাত্র আমার বন্ধু করভী রাখসান্দকে কল করার চেষ্টা করি। লাইন কেটে যায়। রেডিওতে এভারেস্ট সামিটের কথা জানিয়ে দিই নিচের ধাপে থাকা ক্রিসকে। তিনি জানান করভীকে। ততক্ষণে আমিও করভীকে ফোনে পেয়ে যাই। এভারেস্টের ওপর নানা রঙের কাপড়ের টুকরা দেখা যায় বরফের সঙ্গে যেন আটকে আছে। এসব বৌদ্ধ ধর্মে ব্যবহূত ‘প্রেয়ার ফ্ল্যাগ’, যা শেরপারা চূড়ায় নিয়ে যান। চূড়ায় গৌতম বুদ্ধের দুটি মুর্তি আছে। সেগুলোর ওপর দিয়ে শেরপারা প্রেয়ার ফ্ল্যাগ পেঁচিয়ে রাখেন। প্রতি মৌসুমেই নতুন নতুন প্রেয়ার ফ্ল্যাগ নিয়ে যাওয়া হয়। লাল আগুন, নীল বায়ু—একেকটা রং একেক বিষয়কে প্রতিনিধিত্ব করে। তাঁরা বিশ্বাস করেন সেই ফ্ল্যাগে যে মন্ত্র লেখা আছে, বাতাসে তা আশপাশে জনবসতির কাছে ছড়িয়ে যাবে।
প্রেয়ার ফ্ল্যাগের পাশে দাঁড়িয়ে, বসে নানাভাবে ছবি তোলা হলো। অক্সিজেন মাস্ক খুলে একটা ছবি তুললাম। নিমাকে নিয়ে আমি চূড়া থেকে তিব্বতের দিকে ৫০ মিটার নিচে নেমে এলাম। অভিযানের সময় আমার সঙ্গে দালাইলামার একটা ছাপা ছবি নিয়ে গিয়েছিলাম। তিব্বতের দিকে গিয়ে সেই ছবি নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালাম। আমার এটা একটা ইচ্ছা ছিল। বেশ আনন্দ পেলাম। আবার উঠে গেলাম চূড়ায়।
নতুন শক্তি পেলাম। এভারেস্টের উচ্চতা আর আবেগ যেন মিশে গেল। চূড়াতেই ঠিক করে ফেললাম, আমার যদি কখনো বাচ্চাকাচ্চা হয়, তবে সবগুলোকে এভারেস্টে চড়াব। চূড়ার কাছাকাছি যখন ছিলাম তখন সূর্য ছিল আমাদের নিচে। এখন সূর্য আমার চোখ বরাবর। ৪০ মিনিটের মতো থাকলাম চূড়ায়।
সামিট করার পর নামার পালা। নিমা আমাকে বলতেন, ‘ওপরে ওঠার সময় সব শক্তি খরচ করবে না, মনে রেখো তোমার নামতে হবে।’ তবে আমার পুরোটা আস্থা ছিল নিমা আর কুসাংয়ের ওপর। আমি জানি, এঁরা কেউই বিপদে আমাকে একা ফেলে যাবেন না। আমার মাঝে মাঝে হাত ঠান্ডায় হিম হয়ে যেত। কুসাং হাত ঘষে ঘষে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করে দিত।
২৬ মে দুপুর ১২টার মধ্যেই ক্যাম্প-৪-এ ফিরে এলাম। আগের রাত সাড়ে আটটা থেকে টানা ওঠা এভারেস্ট চূড়ায় আর নেমে আসা। শরীর আর টানে না। ক্যাম্প-৪-এ ফিরে এসে নুডলস আর ভিটামিন সির পানীয় খেলাম। এরপর ঘুম। ১১-১২ ঘণ্টার টানা ম্যারাথন ঘুম। সেদিন রাতে কুসাং আমাকে বেশ কয়েকবার পানি এনে দিয়েছেন তাঁবুতে। শেরপারা এসে আমারে শরীর-স্বাস্থ্যের খবর নিচ্ছিলেন। আমরা ভোর পাঁচটায় তাঁবু থেকে বের হয়ে ক্যাম্প গোছানো শুরু করি। গোছাতে গিয়ে দেখলাম এত জিনিস! কুসাংকে আমরা বেশি বোঝা দিলাম। আমার নিজের কাঁধেই ছিল ২২ কেজি বোঝা। ক্যাম্প-৪-এর নিচে জেনেভা স্পার দিয়ে নামছিলাম ধীরে ধীরে। তখন পর্বতের অবস্থা দেখে বোঝা যায় যে মৌসুমের একেবারে শেষ সময় এসে গেছে। বরফ গলে নরম হচ্ছিল, ফাটলগুলো বড় হচ্ছিল। কুম্ভু আইসফলের আকার বদলে গেছে। ক্যাম্প-৪ থেকে নামার সময় ইয়েলো ব্যান্ড একটা জায়গায় পিছলে যাই। পিছলাতে পিছলাতে দেখি রশি শেষ হয়ে যাচ্ছে। মনে হলো, যাক সামিট করেই তো মরছি। শেষ মুহূর্তে অন্য দলের এক শেরপা আমার কাঁধ ধরে আটকে ফেলেন। ২৮ মে ফিরলাম বেসক্যাম্পে। সবাই অপেক্ষা করছিলেন। সুযোগ থাকলে যেন লাল গালিচা সংবর্ধনাই দিত। তবে রাতে বেসক্যাম্পেই বড়সড় একটা পার্টি দেওয়া হয়।
সাত মহাদেশের সর্বোচ্চ সাতটি পর্বত চূড়ায় ওঠার যে কর্মসূচি শুরু করেছি, এভারেস্ট দিয়ে তার তিনটা চূড়ায় ওঠা সম্ভব হলো। এখন পরিকল্পনা করছি অ্যান্টার্কটিকার মাউন্ট ভিনসেন্ট অভিযানে যাওয়ার। সেখানেও ওড়াতে চাই লাল-সবুজ পতাকা। গাইতে চাই বাংলাদেশের নারীর শক্তির জয়গান।
অভিযানের আগেই মন স্থির করেছিলাম এভারেস্ট সামিট যদি করতে পারি তবে নিজের সবচেয়ে প্রিয় কোনো জিনিস ত্যাগ করব। বেসক্যাম্পে নেমে আমার সাত বছরের লম্বা চুল খুর দিয়ে কেটে ফেলে দিলাম। আসলে আমার কাছে এটা শুধু্ই এক অভিযান নয়। অনুভব করি, এভারেস্ট থেকে ফিরে আসার পরই সত্যিই যেন আমার পুনর্জন্ম হয়েছে।
(শেষ)
wasfia@bdon7summits.org
No comments