সম্ভাবনা-জনসংখ্যা :ব্যাধি গৌণ, উপসর্গ নিয়েই যত উদ্বেগ by এ কে এম নূর-উন-নবী
এটা ঠিক যে, বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে রাশ টেনে ধরা সম্ভব হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু কমছে, গড় আয়ু বাড়ছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমছে। নারী শিক্ষার প্রসার ঘটছে। এর পাশাপাশি কিন্তু হতাশা ও উদ্বেগের চিত্রও রয়েছে।
গ্রামের অনেক মানুষের কাজ থাকে না। শহরে দলে দলে ছুটে আসে মানুষ। তারা ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করতে পারে না
প্রায় দেড় লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশ বাংলাদেশে কমবেশি ১৬ কোটি মানুষের বসবাস এবং প্রতি বছর তা ১৮-২০ লাখ করে বাড়ছে। সীমিত সম্পদ এবং অর্থনীতির চাকার অপেক্ষাকৃত মন্থরগতির কারণে এ চিত্র উদ্বেগের কারণ হয়ে আছে। শঙ্কাও ব্যক্ত হয় বিভিন্ন মহল থেকে। তবে এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রকৃতই সবসময় গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করা হয় বলে মনে হয় না। আমরা দ্রব্যমূল্য, যানজট, শেয়ারবাজার, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সংকট, হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, বস্তিজীবন প্রভৃতি ইস্যু নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করি। কিন্তু এসব তো হচ্ছে উপসর্গ, রোগ নয়। স্বল্প আয়তন ও সীমিত সম্পদের দেশে মানুষের সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে জিনিসপত্রের দাম বেশি পড়বে, যানবাহন কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভিড় বাড়বে_ এটাই স্বাভাবিক। অসাধু ব্যবসায়ীরা এর সুযোগ নেবে। একশ' পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে ১০-১২ হাজার যোগ্য লোকের আবেদন জমা পড়বে। কৃষিজমিতে চাপ বাড়বে।
এটাকে যদি বড় ধরনের সমস্যা মনে করি তাহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেই তা থাকা উচিত। কিন্তু আমরা তো ব্যস্ত উপসর্গ নিয়ে। আর এ কারণে উপসর্গ দিন দিন বেড়ে চলেছে। মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে খেদ, ক্ষোভ ও হতাশা। বীজ বপন হচ্ছে নৈরাজ্যের। অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। রাস্তায় কিংবা যানবাহনে চলার সময় সামান্য একটু গায়ে ধাক্কা লাগলেই ক্রোধের প্রকাশ হরহামেশাই লক্ষ্য করি। তবে অনেকের কাছেই '১৬ কোটি' সমস্যা নয়, বরং সম্পদ। তাদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করে দেশের হতশ্রী চেহারা পাল্টে দেওয়ার কথা বলেন তারা। তাদের বিবেচনায় জনসংখ্যার সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলেই কেবল সমস্যা বা সংকট হতে পারে। এ অভিমতের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ কম। সবাইকে যদি আমরা সাধারণ শিক্ষা দিতে পারি এবং বয়স ও ঝোঁক অনুযায়ী বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের আওতায় তাদের নিয়ে আসা যায়, তাহলে অবশ্যই পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন হতে পারে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা কাঠামোর প্রতি তাকানো যেতে পারে। এটা ভালো লক্ষণ যে, আমাদের দেশে বর্তমানে যুবা বয়সী জনগোষ্ঠী বেশি। ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সীরাই মোট জনসংখ্যার ৫৬ থেকে ৫৮ শতাংশ। তারা কর্মক্ষম ও উদ্যমী। তাদের উৎপাদনমূলক কাজে নিয়োজিত করা সম্ভব হলে সমাজ তার সুফল পাবেই। অন্যদিকে মোট জনসংখ্যার সাড়ে ছয় শতাংশের মতো রয়েছে ৬০ বছরের বেশি বয়সী। তাদের সংখ্যা ৯০ লাখ থেকে এক কোটি পর্যন্ত হবে। তাদের বেশিরভাগ উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে তেমন জড়িত থাকে না, কিন্তু ভোক্তা হিসেবে চাহিদা থাকে অনেক ধরনের।
ওপরে জনসংখ্যার যে চিত্র তুলে ধরেছি তাতে দেখা যায়, পরিবারে ও সমাজে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর তুলনায় সক্রিয়দের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। এটাই হচ্ছে সম্ভাবনার দিক। ইংরেজিতে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলে একটা কথা চালু আছে। আমাদের ডেমোগ্রাফিক কাঠামো এ ডিভিডেন্ড বা সুফল এনে দিতে পারে। তবে এটা আপনাআপনি হবে না। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী যাদের বলা হচ্ছে তাদের গুণমান যতটা বাড়ানো যাবে, তারা তত বেশি দিতে পারবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে। এটাও বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, যে ৫৬ থেকে ৫৮ শতাংশ সক্রিয় জনগোষ্ঠীর কথা আমরা বলছি তাদের অর্ধেক হচ্ছে নারী। কেবল পোশাক শিল্পের ৩০ লাখ নারীর কর্মসংস্থান দিয়ে তাদের বিচার করলে চলবে না। এখনও কোটি কোটি নারী রয়েছে যারা শিক্ষা-স্বাস্থ্য-চাকরির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। জটিল ব্যাধির শিকার হয়েও তারা দিনের পর দিন চিকিৎসা সুবিধা পায় না। জনসংখ্যাকে যখন সম্পদ বলব, তখন এ সমস্যার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলে চলবে না। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে ইকোনমিক ডিভিডেন্ডে পরিণত করতে হলে এ সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে হবে। এ ধরনের সমাজে, বিভিন্ন পরিবারে উপার্জন করার লোক বেশি থাকে এবং সে তুলনায় নির্ভরশীল লোক কম থাকে। এখন আমাদের চারপাশেই এমন অনেক অনেক পরিবারের দেখা মিলবে, যেখানে দুই বা তিনজন আয় করছে, কিন্তু তাদের ওপর নির্ভরশীল লোক এক বা দু'জন। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্যের যে সুবিধা এখন আমাদের রয়েছে সেটা সাধারণত ৩০-৩৫ বছর স্থায়ী হয়। বিশ্বের সর্বত্রই এমন চিত্র আমরা দেখি। একটা পর্যায়ে এর পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। এটা যখন ঘটতে থাকে তখন নতুন নতুন সমস্যা সামনে আসে। যেমন বয়স্ক লোকের সংখ্যা বেশি হয়ে পড়ে। তারা যতটা না উৎপাদক, তার চেয়ে ঢের বেশি ভোক্তা। তাদের জন্য স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়াতে হয়, পেনশনের বাজেট বড় হতে থাকে। গড় আয়ু বাড়তে থাকার কারণে তখন দেখা যাবে পরিবারে দু'জন আয় করছে; কিন্তু নির্ভরশীল লোখের সংখ্যা আরও ৩ থেকে ৫ জন। এমন পরিস্থিতি অবধারিত। এ কারণে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় ভবিষ্যৎ চিত্র সামনে রাখা চাই। মনে রাখতে হবে যে, ৩৫-৪০ বছর পর সমাজে বৃদ্ধ লোকের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে এবং সে তুলনায় কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা কমবে। অতএব, তখনকার কথা ভাবনায় আনতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে আমরা দেখি যে অনেক ধরনের কাজ করার মতো লোক নেই। তারা আমাদের দ্বারস্থ হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি লোক নানা দেশে কাজ করছে। বছরে তারা দেশে পাঠাচ্ছে প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি ডলার। তাদের বড় অংশই অদক্ষ বা সামান্য দক্ষ। তারা পরিবার ও দেশের জন্য কাজ করছে। আবার যেখানে কাজ করছে তাদেরও কল্যাণ সাধিত হচ্ছে। আমরা যদি আমাদের কর্মীদের আরও দক্ষ করে বিদেশে পাঠাতে পারি, তাহলে বছরে এক হাজার ৩০০ কোটি ডলার নয়, বরং এর চেয়ে ১০ গুণ বেশি ১৩ হাজার কোটি ডলার (এক লাখ কোটি টাকারও বেশি, বর্তমান বছরের বাজেটের প্রায় অর্ধেক) বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনতে পারি। এ সম্পদ হাতে এলে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু কিংবা এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করার জন্য উদ্বেগে থাকতে হয় না। শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অর্থের অভাব পড়ে না। এ জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের পথ খুঁজে পাওয়া চাই। কিন্তু হায়, আমরা যে রোগের চেয়ে উপসর্গকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে চলেছি!
বিভিন্ন দেশে দক্ষ লোক কাজের জন্য পাঠালে কী বিপুল সুবিধা মেলে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে ফিলিপাইন। তারা নানা দেশের চাহিদা বিবেচনায় রেখে কর্মী দলকে প্রশিক্ষণ দেয়। এর ফলে তারা নিয়োগকারী দেশ ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দরকষাকষি করতে পারে। অন্যদিকে আমরা প্রতিযোগিতায় নামি কম পারিশ্রমিক নিয়ে কর্মী পাঠানোর জন্য। তারা দেশ অনুযায়ী ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করে। আমরাও কি সেটা করতে পারি না?
জনশক্তি রফতানি করতে গিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির হালচাল বিবেচনায় রাখতে হবে। মন্দা যেন কাটছেই না। যদি কোনো দেশ থেকে এক সঙ্গে অনেক লোক বাংলাদেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়? লিবিয়ার অভিজ্ঞতা তো এই কয়েক মাস আগের ঘটনা। আমাদের প্রচণ্ড ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা কিন্তু প্রকৃতই সীমিত। বিশ্ব জনশক্তি বাজারের কথা ভেবে আমাদের দেশেও কিছু বিশেষ আয়োজন করা যেতে পারে। সিঙ্গাপুরে অনেক লোক যায় চিকিৎসার জন্য। তারা ধনবান। ভারতে যায় যারা তাদের বড় অংশ মধ্যবিত্ত। দেশেই এ ধরনের সুবিধা গড়ে তুলতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের সম্ভাবনা বাড়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও আমরা বিদেশিদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে পারি।
এটা ঠিক যে, বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে রাশ টেনে ধরা সম্ভব হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু কমছে, গড় আয়ু বাড়ছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমছে। নারী শিক্ষার প্রসার ঘটছে। এর পাশাপাশি কিন্তু হতাশা ও উদ্বেগের চিত্রও রয়েছে। গ্রামের অনেক মানুষের কাজ থাকে না। শহরে দলে দলে ছুটে আসে মানুষ। তারা ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করতে পারে না। বস্তিতে তাদের জীবন কাটে। গ্রাম থেকে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীও শহরে ভিড় জমায়। ফলে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে এবং তা বাড়ছে। পরিণতিতে গ্রামের উন্নয়ন সম্ভাবনা হ্রাস পাচ্ছে। এটাও মনে রাখা চাই যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমলেও প্রতি বছর ১৮-২০ লাখ নতুন মুখ আসছে এবং পরিণতিতে মোট জনসংখ্যা বাড়ছে। ছোট্ট ভূখণ্ডের এ দেশে তাদের সামলানোর উপায় কী? শহরে যে হারে লোক বাড়ছে তাতে এক পর্যায়ে গ্রাম ও শহরের লোকের অনুপাত ৫০ :৫০ হয়ে যাবে। এখন শহর ও গ্রামে সুযোগ-সুবিধা বণ্টনে বিস্তর পার্থক্য। এটা ঘোচানোর দায় রয়েছে। উন্নত বিশ্বে এ পার্থক্য তেমন স্পষ্ট নয়। সেখানে পার্থক্য কেবল পেশার ধরনে_ আর্থ-সামাজিক সুবিধা ভোগে নয়। এখানে পেশায় পার্থক্য, চিন্তায় পার্থক্য। জীবনযাপনের উপকরণে পার্থক্য। কাজের পরিবেশে পার্থক্য। গ্রাম যে বড়ই বঞ্চিত। শহরের মধ্যেও রয়েছে বৈষম্য। বস্তিবাসীর সংখ্যা বাড়ছে। তাদের জন্য নাগরিক সুবিধা অপ্রতুল। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা রয়েছে আমাদের। কিন্তু তারা নাগরিক সুবিধার বিপুল চাহিদার সামান্যই পূরণ করতে পারছে। শহরও যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে।
এটাও মনে রাখা চাই যে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট সাফল্য সত্ত্বেও এখনও মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স ১৫.৩ বছর (আইনে যদিও রয়েছে নূ্যনতম ১৮ বছরের আগে বিয়ে নয়)। ডেমোগ্রাফিক কারণেও প্রজনন ক্ষমতাসম্পন্ন মেয়েদের সংখ্যা বাড়ছে। ২০৪০ সালে সন্তান জন্মদানে সক্ষম নারীর সংখ্যা পেঁৗছাবে মোট নারীর ৫০ শতাংশ। আগে বিয়ে, আগে সন্তান_ এ অবস্থা এখনও বিদ্যমান। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কী করে ঘরে তুলব?
কিশোরীদের বিষয়টিও বিশেষভাবে ভাবতে হবে। আগেই বলেছি, আইনে যাই থাকুক, অল্প বয়সেই অনেকের বিয়ে হয়ে যায়। ১৯ বছর হওয়ার আগেই অনেকে মা হয়। এ কারণে তাদের পড়াশোনা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পেঁৗছায় না। তাদের স্বাস্থ্যহানি ঘটে। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে এটা বড় ধরনের বাধা।
আমরা জনসংখ্যার সম্ভাবনাকে অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করতে চাই। এটা করা না গেলে সমাজে বোঝা বাড়বে। বাবা-মা অনেক দিন বেঁচে থাকলে সেটা সন্তুষ্টির কারণ। আমরা সবাই আয়ু বাড়াতে চাই। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সফলতা রয়েছে এ ক্ষেত্রে। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ৩০-৩৫ বছর পর উৎপাদনক্ষম জনগোষ্ঠীতেও একইভাবে পরিবর্তন আসবে। তখন যেন আমরা সমস্যার সাগরে হাবুডুবু না খাই, আসুন সে জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিই। আর এ চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগ কিন্তু সৃষ্টি হয়ে আছে আমাদের সমাজেই_ মোট জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের তিন ভাগই যে এখন কর্মক্ষম। তাদের শ্রমে-সৃজনশীলতায় তারা একই সঙ্গে প্রবীণ ও নবীন প্রজন্মের জন্য সুন্দর সমাজ নির্মাণ করতেই পারে। এটা কিন্তু নিজেদের জন্যও কাজ করে যাওয়া। কারণ এখন যারা কর্মক্ষম, তারা কিন্তু তখন স্থান করে নেবে প্রবীণের দলে।
ড. এ কে এম নূর-উন-নবী : অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ
প্রায় দেড় লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশ বাংলাদেশে কমবেশি ১৬ কোটি মানুষের বসবাস এবং প্রতি বছর তা ১৮-২০ লাখ করে বাড়ছে। সীমিত সম্পদ এবং অর্থনীতির চাকার অপেক্ষাকৃত মন্থরগতির কারণে এ চিত্র উদ্বেগের কারণ হয়ে আছে। শঙ্কাও ব্যক্ত হয় বিভিন্ন মহল থেকে। তবে এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রকৃতই সবসময় গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করা হয় বলে মনে হয় না। আমরা দ্রব্যমূল্য, যানজট, শেয়ারবাজার, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সংকট, হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, বস্তিজীবন প্রভৃতি ইস্যু নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করি। কিন্তু এসব তো হচ্ছে উপসর্গ, রোগ নয়। স্বল্প আয়তন ও সীমিত সম্পদের দেশে মানুষের সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে জিনিসপত্রের দাম বেশি পড়বে, যানবাহন কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভিড় বাড়বে_ এটাই স্বাভাবিক। অসাধু ব্যবসায়ীরা এর সুযোগ নেবে। একশ' পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে ১০-১২ হাজার যোগ্য লোকের আবেদন জমা পড়বে। কৃষিজমিতে চাপ বাড়বে।
এটাকে যদি বড় ধরনের সমস্যা মনে করি তাহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেই তা থাকা উচিত। কিন্তু আমরা তো ব্যস্ত উপসর্গ নিয়ে। আর এ কারণে উপসর্গ দিন দিন বেড়ে চলেছে। মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে খেদ, ক্ষোভ ও হতাশা। বীজ বপন হচ্ছে নৈরাজ্যের। অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। রাস্তায় কিংবা যানবাহনে চলার সময় সামান্য একটু গায়ে ধাক্কা লাগলেই ক্রোধের প্রকাশ হরহামেশাই লক্ষ্য করি। তবে অনেকের কাছেই '১৬ কোটি' সমস্যা নয়, বরং সম্পদ। তাদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করে দেশের হতশ্রী চেহারা পাল্টে দেওয়ার কথা বলেন তারা। তাদের বিবেচনায় জনসংখ্যার সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলেই কেবল সমস্যা বা সংকট হতে পারে। এ অভিমতের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ কম। সবাইকে যদি আমরা সাধারণ শিক্ষা দিতে পারি এবং বয়স ও ঝোঁক অনুযায়ী বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের আওতায় তাদের নিয়ে আসা যায়, তাহলে অবশ্যই পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন হতে পারে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা কাঠামোর প্রতি তাকানো যেতে পারে। এটা ভালো লক্ষণ যে, আমাদের দেশে বর্তমানে যুবা বয়সী জনগোষ্ঠী বেশি। ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সীরাই মোট জনসংখ্যার ৫৬ থেকে ৫৮ শতাংশ। তারা কর্মক্ষম ও উদ্যমী। তাদের উৎপাদনমূলক কাজে নিয়োজিত করা সম্ভব হলে সমাজ তার সুফল পাবেই। অন্যদিকে মোট জনসংখ্যার সাড়ে ছয় শতাংশের মতো রয়েছে ৬০ বছরের বেশি বয়সী। তাদের সংখ্যা ৯০ লাখ থেকে এক কোটি পর্যন্ত হবে। তাদের বেশিরভাগ উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে তেমন জড়িত থাকে না, কিন্তু ভোক্তা হিসেবে চাহিদা থাকে অনেক ধরনের।
ওপরে জনসংখ্যার যে চিত্র তুলে ধরেছি তাতে দেখা যায়, পরিবারে ও সমাজে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর তুলনায় সক্রিয়দের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। এটাই হচ্ছে সম্ভাবনার দিক। ইংরেজিতে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলে একটা কথা চালু আছে। আমাদের ডেমোগ্রাফিক কাঠামো এ ডিভিডেন্ড বা সুফল এনে দিতে পারে। তবে এটা আপনাআপনি হবে না। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী যাদের বলা হচ্ছে তাদের গুণমান যতটা বাড়ানো যাবে, তারা তত বেশি দিতে পারবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে। এটাও বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, যে ৫৬ থেকে ৫৮ শতাংশ সক্রিয় জনগোষ্ঠীর কথা আমরা বলছি তাদের অর্ধেক হচ্ছে নারী। কেবল পোশাক শিল্পের ৩০ লাখ নারীর কর্মসংস্থান দিয়ে তাদের বিচার করলে চলবে না। এখনও কোটি কোটি নারী রয়েছে যারা শিক্ষা-স্বাস্থ্য-চাকরির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। জটিল ব্যাধির শিকার হয়েও তারা দিনের পর দিন চিকিৎসা সুবিধা পায় না। জনসংখ্যাকে যখন সম্পদ বলব, তখন এ সমস্যার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলে চলবে না। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে ইকোনমিক ডিভিডেন্ডে পরিণত করতে হলে এ সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে হবে। এ ধরনের সমাজে, বিভিন্ন পরিবারে উপার্জন করার লোক বেশি থাকে এবং সে তুলনায় নির্ভরশীল লোক কম থাকে। এখন আমাদের চারপাশেই এমন অনেক অনেক পরিবারের দেখা মিলবে, যেখানে দুই বা তিনজন আয় করছে, কিন্তু তাদের ওপর নির্ভরশীল লোক এক বা দু'জন। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্যের যে সুবিধা এখন আমাদের রয়েছে সেটা সাধারণত ৩০-৩৫ বছর স্থায়ী হয়। বিশ্বের সর্বত্রই এমন চিত্র আমরা দেখি। একটা পর্যায়ে এর পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। এটা যখন ঘটতে থাকে তখন নতুন নতুন সমস্যা সামনে আসে। যেমন বয়স্ক লোকের সংখ্যা বেশি হয়ে পড়ে। তারা যতটা না উৎপাদক, তার চেয়ে ঢের বেশি ভোক্তা। তাদের জন্য স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়াতে হয়, পেনশনের বাজেট বড় হতে থাকে। গড় আয়ু বাড়তে থাকার কারণে তখন দেখা যাবে পরিবারে দু'জন আয় করছে; কিন্তু নির্ভরশীল লোখের সংখ্যা আরও ৩ থেকে ৫ জন। এমন পরিস্থিতি অবধারিত। এ কারণে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় ভবিষ্যৎ চিত্র সামনে রাখা চাই। মনে রাখতে হবে যে, ৩৫-৪০ বছর পর সমাজে বৃদ্ধ লোকের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে এবং সে তুলনায় কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা কমবে। অতএব, তখনকার কথা ভাবনায় আনতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে আমরা দেখি যে অনেক ধরনের কাজ করার মতো লোক নেই। তারা আমাদের দ্বারস্থ হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি লোক নানা দেশে কাজ করছে। বছরে তারা দেশে পাঠাচ্ছে প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি ডলার। তাদের বড় অংশই অদক্ষ বা সামান্য দক্ষ। তারা পরিবার ও দেশের জন্য কাজ করছে। আবার যেখানে কাজ করছে তাদেরও কল্যাণ সাধিত হচ্ছে। আমরা যদি আমাদের কর্মীদের আরও দক্ষ করে বিদেশে পাঠাতে পারি, তাহলে বছরে এক হাজার ৩০০ কোটি ডলার নয়, বরং এর চেয়ে ১০ গুণ বেশি ১৩ হাজার কোটি ডলার (এক লাখ কোটি টাকারও বেশি, বর্তমান বছরের বাজেটের প্রায় অর্ধেক) বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনতে পারি। এ সম্পদ হাতে এলে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু কিংবা এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করার জন্য উদ্বেগে থাকতে হয় না। শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অর্থের অভাব পড়ে না। এ জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের পথ খুঁজে পাওয়া চাই। কিন্তু হায়, আমরা যে রোগের চেয়ে উপসর্গকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে চলেছি!
বিভিন্ন দেশে দক্ষ লোক কাজের জন্য পাঠালে কী বিপুল সুবিধা মেলে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে ফিলিপাইন। তারা নানা দেশের চাহিদা বিবেচনায় রেখে কর্মী দলকে প্রশিক্ষণ দেয়। এর ফলে তারা নিয়োগকারী দেশ ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দরকষাকষি করতে পারে। অন্যদিকে আমরা প্রতিযোগিতায় নামি কম পারিশ্রমিক নিয়ে কর্মী পাঠানোর জন্য। তারা দেশ অনুযায়ী ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করে। আমরাও কি সেটা করতে পারি না?
জনশক্তি রফতানি করতে গিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির হালচাল বিবেচনায় রাখতে হবে। মন্দা যেন কাটছেই না। যদি কোনো দেশ থেকে এক সঙ্গে অনেক লোক বাংলাদেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়? লিবিয়ার অভিজ্ঞতা তো এই কয়েক মাস আগের ঘটনা। আমাদের প্রচণ্ড ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা কিন্তু প্রকৃতই সীমিত। বিশ্ব জনশক্তি বাজারের কথা ভেবে আমাদের দেশেও কিছু বিশেষ আয়োজন করা যেতে পারে। সিঙ্গাপুরে অনেক লোক যায় চিকিৎসার জন্য। তারা ধনবান। ভারতে যায় যারা তাদের বড় অংশ মধ্যবিত্ত। দেশেই এ ধরনের সুবিধা গড়ে তুলতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের সম্ভাবনা বাড়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও আমরা বিদেশিদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে পারি।
এটা ঠিক যে, বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে রাশ টেনে ধরা সম্ভব হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু কমছে, গড় আয়ু বাড়ছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমছে। নারী শিক্ষার প্রসার ঘটছে। এর পাশাপাশি কিন্তু হতাশা ও উদ্বেগের চিত্রও রয়েছে। গ্রামের অনেক মানুষের কাজ থাকে না। শহরে দলে দলে ছুটে আসে মানুষ। তারা ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করতে পারে না। বস্তিতে তাদের জীবন কাটে। গ্রাম থেকে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীও শহরে ভিড় জমায়। ফলে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে এবং তা বাড়ছে। পরিণতিতে গ্রামের উন্নয়ন সম্ভাবনা হ্রাস পাচ্ছে। এটাও মনে রাখা চাই যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমলেও প্রতি বছর ১৮-২০ লাখ নতুন মুখ আসছে এবং পরিণতিতে মোট জনসংখ্যা বাড়ছে। ছোট্ট ভূখণ্ডের এ দেশে তাদের সামলানোর উপায় কী? শহরে যে হারে লোক বাড়ছে তাতে এক পর্যায়ে গ্রাম ও শহরের লোকের অনুপাত ৫০ :৫০ হয়ে যাবে। এখন শহর ও গ্রামে সুযোগ-সুবিধা বণ্টনে বিস্তর পার্থক্য। এটা ঘোচানোর দায় রয়েছে। উন্নত বিশ্বে এ পার্থক্য তেমন স্পষ্ট নয়। সেখানে পার্থক্য কেবল পেশার ধরনে_ আর্থ-সামাজিক সুবিধা ভোগে নয়। এখানে পেশায় পার্থক্য, চিন্তায় পার্থক্য। জীবনযাপনের উপকরণে পার্থক্য। কাজের পরিবেশে পার্থক্য। গ্রাম যে বড়ই বঞ্চিত। শহরের মধ্যেও রয়েছে বৈষম্য। বস্তিবাসীর সংখ্যা বাড়ছে। তাদের জন্য নাগরিক সুবিধা অপ্রতুল। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা রয়েছে আমাদের। কিন্তু তারা নাগরিক সুবিধার বিপুল চাহিদার সামান্যই পূরণ করতে পারছে। শহরও যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে।
এটাও মনে রাখা চাই যে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট সাফল্য সত্ত্বেও এখনও মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স ১৫.৩ বছর (আইনে যদিও রয়েছে নূ্যনতম ১৮ বছরের আগে বিয়ে নয়)। ডেমোগ্রাফিক কারণেও প্রজনন ক্ষমতাসম্পন্ন মেয়েদের সংখ্যা বাড়ছে। ২০৪০ সালে সন্তান জন্মদানে সক্ষম নারীর সংখ্যা পেঁৗছাবে মোট নারীর ৫০ শতাংশ। আগে বিয়ে, আগে সন্তান_ এ অবস্থা এখনও বিদ্যমান। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কী করে ঘরে তুলব?
কিশোরীদের বিষয়টিও বিশেষভাবে ভাবতে হবে। আগেই বলেছি, আইনে যাই থাকুক, অল্প বয়সেই অনেকের বিয়ে হয়ে যায়। ১৯ বছর হওয়ার আগেই অনেকে মা হয়। এ কারণে তাদের পড়াশোনা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পেঁৗছায় না। তাদের স্বাস্থ্যহানি ঘটে। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে এটা বড় ধরনের বাধা।
আমরা জনসংখ্যার সম্ভাবনাকে অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করতে চাই। এটা করা না গেলে সমাজে বোঝা বাড়বে। বাবা-মা অনেক দিন বেঁচে থাকলে সেটা সন্তুষ্টির কারণ। আমরা সবাই আয়ু বাড়াতে চাই। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সফলতা রয়েছে এ ক্ষেত্রে। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ৩০-৩৫ বছর পর উৎপাদনক্ষম জনগোষ্ঠীতেও একইভাবে পরিবর্তন আসবে। তখন যেন আমরা সমস্যার সাগরে হাবুডুবু না খাই, আসুন সে জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিই। আর এ চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগ কিন্তু সৃষ্টি হয়ে আছে আমাদের সমাজেই_ মোট জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের তিন ভাগই যে এখন কর্মক্ষম। তাদের শ্রমে-সৃজনশীলতায় তারা একই সঙ্গে প্রবীণ ও নবীন প্রজন্মের জন্য সুন্দর সমাজ নির্মাণ করতেই পারে। এটা কিন্তু নিজেদের জন্যও কাজ করে যাওয়া। কারণ এখন যারা কর্মক্ষম, তারা কিন্তু তখন স্থান করে নেবে প্রবীণের দলে।
ড. এ কে এম নূর-উন-নবী : অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ
No comments