কিছুই বদলায়নি, কিছুই বদলায় না by হায়দার আকবর খান রনো
কথাটি প্রথমে অবিশ্বাস্য মনে হলেও ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখেছি যে কথাটি সত্যিই বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন ক্রসফায়ারের বিষয়টি শুরু করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। এখন রাতারাতি বন্ধ করা যাবে না।
যদিও প্রধানমন্ত্রী সাফাই গেয়েছেন এবং দাবি করেছেন যে তিনি নিজে কখনোই বিচারবহির্ভূত হত্যা অনুমোদন করেন না। আমরা যদি প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় বিশ্বাস স্থাপন করে এটুকু আস্থা রাখি যে ক্রসফায়ার তিনি মোটেই পছন্দ করেন না, তবু তাঁরই স্বীকারোক্তি থেকে যা বেরিয়ে এল তা হলো প্রধানমন্ত্রীর অনিচ্ছা, আপত্তি ও বিরোধিতা সত্ত্বেও ক্রসফায়ার অব্যাহত রয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর সরল স্বীকারোক্তিকে সাধুবাদ জানাই এই জন্য যে তিনি সত্য গোপন করেননি। তাঁর নিজস্ব ব্যর্থতার কথাও আছে তাঁর কথার মধ্যে।
কেন এই ব্যর্থতা? কারণ আগের আমল থেকে যা চলে আসছে তা রাতারাতি বন্ধ হওয়ার নয়। কিছু বিষয় আছে, যার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হয়। যেমন_এক আমলে বিদেশের সঙ্গে কোনো বাণিজ্যিক চুক্তি হলে হঠাৎ করে পরিবর্তন সম্ভব হয় না। কোনো বিষয়ে জনগণ অভ্যস্ত হয়ে থাকলে, বিশেষ করে তা যদি সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে পরিবর্তনে সময়ের প্রয়োজন হয়। ক্রসফায়ার কি তেমনি কোনো প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, যা রাতারাতি বন্ধ করা সম্ভব নয়?
ক্রসফায়ার কথাটির আভিধানিক অর্থ যাই-ই হোক, আমরা ক্রসফায়ার বলতে বিচারবহির্ভূত হত্যার কথাই বুঝে থাকি। প্রধানমন্ত্রী সেই অর্থেই বলেছেন। অন্যথায় আভিধানিক অর্থে ক্রসফায়ার একটি অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা মাত্র। যখন দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয় তখন মাঝখানে পড়ে মারা পড়ল তৃতীয় ব্যক্তি। এটাকেই বলা হয় ক্রসফায়ার। না, আমরা এখন সে অর্থে বুঝি না। এখন ক্রসফায়ার বলতে যা বোঝায় তা কোনো হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা নয়। তা ইচ্ছাকৃত, পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় অ্যাকশন। র্যাব বা পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা এবং পরে ক্রসফায়ারের মিথ্যা গল্প বানানো।
একে বলা যেতে পারে রাষ্ট্রীয় ব্যভিচার, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচার, রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড, যা ফ্যাসিবাদেরই বৈশিষ্ট্য। কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে এটা চলতে পারে না। হ্যাঁ, বিগত বিএনপি আমলেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। প্রথমে হয়েছিল ক্লিনহার্ট অপারেশন। যৌথ বাহিনী এই অপারেশন পরিচালনা করেছিল। সেদিন বন্দি অবস্থায় অনেকেই মারা যান। স্পষ্টতই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ, র্যাব, সেনা সদস্যের অর্থাৎ যৌথ বাহিনীর অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত ছিল। তাদের বাঁচানোর জন্য সেদিনের বিএনপি-জামায়াত সরকার সংসদে দায়মুক্তির আইন পাস করিয়েছিল। এরপর এল ক্রসফায়ারের বানোয়াট কাহিনীগুলো, যা ছিল নির্জলা মিথ্যা ও পরিকল্পিত হত্যার ঘটনায় ভরপুর। রাষ্ট্র নিজেই যখন এই কাজ করে, তখন আর যাই হোক গণতন্ত্র বলে আর কিছুই থাকে না।
এরপর এল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেনাসমর্থিত এক আজব সরকার। ক্রসফায়ারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রইল। দুই বছর আগে এসেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। ক্রসফায়ারের ধারা কেবল অব্যাহতই থাকেনি, তা আরো জোরালো হয়েছে। এই সরকার নাকি দিনবদলের সূচনা করবে! হায়! বিচারের বাণী যে এখনো নীরবে-নিভৃতে কাঁদে! কোথায় বিচার? কিসের বিচার?
একটি সুনির্দিষ্ট ক্রসফায়ারের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের এক বেঞ্চ সুয়োমোটো মামলা গ্রহণ করেছিল। অর্থাৎ বিচারালয় নিজেই স্বপ্রণোদিত হয়ে বিষয়টি তদন্তের জন্য সরকারের প্রতি রুল জারি করে কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছিল। সরকার সাড়া দেয়নি। কিছুদিন পর দেখা গেল হাইকোর্টের সেই বেঞ্চ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এরপর সেই মামলার আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। তাহলে বিচারব্যবস্থাও এখানে অসহায়। অসহায় সাধারণ মানুষ। প্রবল শক্তিশালী কেবল দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী, যার প্রতাপের সামনে প্রধানমন্ত্রীও অসহায়। যিনি বলতে বাধ্য হচ্ছেন যে ক্রসফায়ার রাতারাতি বন্ধ করা যাবে না।
কেন বন্ধ করা যাবে না? ট্রিগার হ্যাপি র্যাব-পুলিশের কি এতটাই স্বাধীনতা? তাহলে আমরা কোন দেশে বাস করছি? ক্রসফায়ার যারা করে, তারা কি স্বাধীন? তারা কি প্রধানমন্ত্রীর বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় অবাধ্য হবে? তাই যদি হয়, তাহলে তো গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর উচিত, কথাটা আরো একটু স্পষ্ট করে বলে সেসব ঘাতক অফিসারের বিরুদ্ধে জনগণকে সমবেত করা। আর তা না করে তিনি বলছেন, কিছুই করা যাবে না, কারণ এটা অতীত থেকে চলে আসছে। এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য বরং ক্রসফায়ার যারা করে তাদের আরো উৎসাহী করবে। এমনিতেই ক্রসফায়ারের ঘটনা বেড়েই চলেছে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা পর্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, পৃথিবীতে আমাদের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। তার ওপর প্রধানমন্ত্রীর এহেন বক্তব্য প্রমাণ করবে যে দেশটিতে আর গণতান্ত্রিক শাসন চলছে না। অবশ্য বাস্তবেও তো গণতান্ত্রিক শাসন আছে বলে আমরা আর বলতে পারছি না, যা সত্য তাই তো জানবে বিশ্ববাসী।
দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলা আমাদের শাসকবর্গের সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর নিজের দোষ স্খলনের জন্য পরের ঘাড়ে দোষ চাপানো সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী আবারও কথার চমক দিয়েছেন। কথায় চমক দেওয়া তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম। অতিভাষণপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারির জন্যও দায়ী বিএনপি-জামায়াত চক্র। একটু পেছনে ফিরে যাই। তখন মহাজোট সরকার মাত্র ক্ষমতায় এসেছিল। ক্ষমতায় বসেই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রথম যে কয়টি কাজ করেছিল, তার অন্যতম ছিল বঙ্গোপসাগরের তিনটি গ্যাসক্ষেত্র দুটি বিদেশি কম্পানিকে দেওয়ার জন্য চুক্তিপত্র ঠিক করা। তার প্রতিবাদে বামপন্থী দলগুলো মিছিল করলে বিনা উস্কানিতে পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ করে এবং অনেকের মধ্যে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এমনভাবে আহত হন যে তাঁর পা ভেঙে যায়। তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছিল যে এই কাজ করেছে পুলিশের মধ্যে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা বিএনপির লোকজন। এ ব্যাপারে তদন্ত করা হবে বলেও আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল। সে তদন্ত এখনো হয়নি।
প্রশাসনে বিএনপি বা জঙ্গিরা রয়েছে এই গান গেয়ে কত দূর যাওয়া যাবে? ক্রসফায়ার করছে কারা? ওরাই, যারা বিএনপি আমল থেকে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। চালের দাম বাড়াচ্ছে কারা? সে-ও বিএনপির ব্যবসায়ীরা যারা সিন্ডিকেট করে, মজুদ করে দাম বাড়াচ্ছে। শেয়ারবাজারের এমন ধস নামছে কেন? তা-ও কতিপয় বিএনপিপন্থীর কারসাজি! এসব কথা শুনতে শুনতে আর ভালো লাগে না। সবই যদি ক্ষমতাবহির্ভূত বিএনপির লোকজন করার ক্ষমতা রাখে, তাহলে জনগণ বিপুল ভোট দিয়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন কেন?
আসল সত্য হলো, চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী সরকারি নীতি এবং সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট অথবা সরকারদলীয় ব্যবসায়ীদের অনৈতিক কারবার। চালের দাম এখন ৫০ টাকার ওপরে। মোটা চালের দামও চলি্লশের ঘরে। চালের এমন উচ্চমূল্য কোনো দিন হয়নি। চালের দামের সঙ্গে সরকারের জনপ্রিয়তার যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, তা নতুন কিছু নয়। সরকারের জনপ্রিয়তা যে হ্রাস পেয়েছে তা সাম্প্রতিক পৌরসভার নির্বাচনী ফল থেকেই বোঝা যায়। এই সরকার অতীতের সরকারের মতোই মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাস করে। যদিও আমাদের সংবিধানে সমাজতন্ত্রকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বলে ঘোষণা করা আছে, তবু ওটা কেবল বইয়ের পাতায় লেখা আছে। আওয়ামী লীগ পুঁজিবাদেই বিশ্বাস করে। শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের জবরদস্তি, টেন্ডারবাজি এবং তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে খুনাখুনি, রক্তারক্তি। এর পরিণামে অর্থনীতিতেও নৈরাজ্য চলছে। প্রশাসনের স্বাভাবিক কাজও বাধাগ্রস্ত। এই বাধা বাইরে থেকে আসছে না। বাধা সৃষ্টি করছে সরকারদলীয় মাস্তানরাই।
এখন লুটের মহড়া চলছে। চালের দাম বাড়বেই। এটাই পুঁজিবাদের, বিশেষ করে নিয়ন্ত্রণহীন মুক্তবাজার ব্যবস্থার অবধারিত পরিণাম। আর শেয়ার কেলেঙ্কারি! কয়েক দিন আগে এ বিষয়ের ওপর আমি কালের কণ্ঠে একটি লেখা লিখেছিলাম। সেসব কথার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। মোটকথা এই কেলেঙ্কারির পেছনে যারা দাবার ঘুঁটি চালছেন তাঁরা সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট ব্যক্তি। এরাই ১৯৯৬ সালে একই কাজ করেছিল। মাননীয় অর্থমন্ত্রী তো বলেছেন, তিনি জানেন কারা এসব করছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে তিনি অপারগ, যেভাবে প্রধানমন্ত্রী ক্রসফায়ার বন্ধ করতে অপারগ। যদিও শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে এমন বিচারবহির্ভূত হত্যা পছন্দ করেন না।
তাহলে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ বা ইচ্ছা-অনিচ্ছা দ্বারা কিছু এসে যায় না। ক্রসফায়ার চলছিল, চলবে। চালের দামের ঊর্ধ্বগতিকেও রোধ করা যাবে না। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদকে লাঠিপেটা করে পা ভাঙার পর সেই তদন্ত আর হবে না। বিচারকরা সুয়োমোটো ক্রসফায়ারের ব্যাপারে উদ্যোগ নিলেও তা কোনো ফল বহন করে আনবে না। শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারিতে কয়েক লাখ মধ্যবিত্তকে নিঃস্ব করে কয়েক হাজার কোটি টাকার লোপাট করার ঘটনা_সবই চলবে। তাহলে কিছুই বদলাবে না। কিছুই বদলায় না। কারণ এসবই হচ্ছে নিকৃষ্ট ধরনের পুঁজিবাদের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ। বুর্জোয়া আওয়ামী লীগ বুর্জোয়া বিএনপির ধারাকে বদলাতে পারে না।
তাহলে দিনবদলের কী হবে? কিছু লোকের ভাগ্য বদল হয়েছে বৈকি? কিন্তু সাধারণ মানুষের বেলায় দিনবদল_সে যে দুরাশা মাত্র! তার জন্য দরকার সেই রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার, যারা সমাজটাকেই বদলাবে, পুঁজিবাদের বদলে সংবিধানে বিধৃত সমাজতন্ত্রের পথে নতুন বিকল্প তুলে ধরবে।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট
কেন এই ব্যর্থতা? কারণ আগের আমল থেকে যা চলে আসছে তা রাতারাতি বন্ধ হওয়ার নয়। কিছু বিষয় আছে, যার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হয়। যেমন_এক আমলে বিদেশের সঙ্গে কোনো বাণিজ্যিক চুক্তি হলে হঠাৎ করে পরিবর্তন সম্ভব হয় না। কোনো বিষয়ে জনগণ অভ্যস্ত হয়ে থাকলে, বিশেষ করে তা যদি সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে পরিবর্তনে সময়ের প্রয়োজন হয়। ক্রসফায়ার কি তেমনি কোনো প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, যা রাতারাতি বন্ধ করা সম্ভব নয়?
ক্রসফায়ার কথাটির আভিধানিক অর্থ যাই-ই হোক, আমরা ক্রসফায়ার বলতে বিচারবহির্ভূত হত্যার কথাই বুঝে থাকি। প্রধানমন্ত্রী সেই অর্থেই বলেছেন। অন্যথায় আভিধানিক অর্থে ক্রসফায়ার একটি অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা মাত্র। যখন দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয় তখন মাঝখানে পড়ে মারা পড়ল তৃতীয় ব্যক্তি। এটাকেই বলা হয় ক্রসফায়ার। না, আমরা এখন সে অর্থে বুঝি না। এখন ক্রসফায়ার বলতে যা বোঝায় তা কোনো হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা নয়। তা ইচ্ছাকৃত, পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় অ্যাকশন। র্যাব বা পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা এবং পরে ক্রসফায়ারের মিথ্যা গল্প বানানো।
একে বলা যেতে পারে রাষ্ট্রীয় ব্যভিচার, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচার, রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড, যা ফ্যাসিবাদেরই বৈশিষ্ট্য। কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে এটা চলতে পারে না। হ্যাঁ, বিগত বিএনপি আমলেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। প্রথমে হয়েছিল ক্লিনহার্ট অপারেশন। যৌথ বাহিনী এই অপারেশন পরিচালনা করেছিল। সেদিন বন্দি অবস্থায় অনেকেই মারা যান। স্পষ্টতই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ, র্যাব, সেনা সদস্যের অর্থাৎ যৌথ বাহিনীর অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত ছিল। তাদের বাঁচানোর জন্য সেদিনের বিএনপি-জামায়াত সরকার সংসদে দায়মুক্তির আইন পাস করিয়েছিল। এরপর এল ক্রসফায়ারের বানোয়াট কাহিনীগুলো, যা ছিল নির্জলা মিথ্যা ও পরিকল্পিত হত্যার ঘটনায় ভরপুর। রাষ্ট্র নিজেই যখন এই কাজ করে, তখন আর যাই হোক গণতন্ত্র বলে আর কিছুই থাকে না।
এরপর এল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেনাসমর্থিত এক আজব সরকার। ক্রসফায়ারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রইল। দুই বছর আগে এসেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। ক্রসফায়ারের ধারা কেবল অব্যাহতই থাকেনি, তা আরো জোরালো হয়েছে। এই সরকার নাকি দিনবদলের সূচনা করবে! হায়! বিচারের বাণী যে এখনো নীরবে-নিভৃতে কাঁদে! কোথায় বিচার? কিসের বিচার?
একটি সুনির্দিষ্ট ক্রসফায়ারের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের এক বেঞ্চ সুয়োমোটো মামলা গ্রহণ করেছিল। অর্থাৎ বিচারালয় নিজেই স্বপ্রণোদিত হয়ে বিষয়টি তদন্তের জন্য সরকারের প্রতি রুল জারি করে কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছিল। সরকার সাড়া দেয়নি। কিছুদিন পর দেখা গেল হাইকোর্টের সেই বেঞ্চ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এরপর সেই মামলার আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। তাহলে বিচারব্যবস্থাও এখানে অসহায়। অসহায় সাধারণ মানুষ। প্রবল শক্তিশালী কেবল দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী, যার প্রতাপের সামনে প্রধানমন্ত্রীও অসহায়। যিনি বলতে বাধ্য হচ্ছেন যে ক্রসফায়ার রাতারাতি বন্ধ করা যাবে না।
কেন বন্ধ করা যাবে না? ট্রিগার হ্যাপি র্যাব-পুলিশের কি এতটাই স্বাধীনতা? তাহলে আমরা কোন দেশে বাস করছি? ক্রসফায়ার যারা করে, তারা কি স্বাধীন? তারা কি প্রধানমন্ত্রীর বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় অবাধ্য হবে? তাই যদি হয়, তাহলে তো গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর উচিত, কথাটা আরো একটু স্পষ্ট করে বলে সেসব ঘাতক অফিসারের বিরুদ্ধে জনগণকে সমবেত করা। আর তা না করে তিনি বলছেন, কিছুই করা যাবে না, কারণ এটা অতীত থেকে চলে আসছে। এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য বরং ক্রসফায়ার যারা করে তাদের আরো উৎসাহী করবে। এমনিতেই ক্রসফায়ারের ঘটনা বেড়েই চলেছে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা পর্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, পৃথিবীতে আমাদের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। তার ওপর প্রধানমন্ত্রীর এহেন বক্তব্য প্রমাণ করবে যে দেশটিতে আর গণতান্ত্রিক শাসন চলছে না। অবশ্য বাস্তবেও তো গণতান্ত্রিক শাসন আছে বলে আমরা আর বলতে পারছি না, যা সত্য তাই তো জানবে বিশ্ববাসী।
দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলা আমাদের শাসকবর্গের সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর নিজের দোষ স্খলনের জন্য পরের ঘাড়ে দোষ চাপানো সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী আবারও কথার চমক দিয়েছেন। কথায় চমক দেওয়া তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম। অতিভাষণপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারির জন্যও দায়ী বিএনপি-জামায়াত চক্র। একটু পেছনে ফিরে যাই। তখন মহাজোট সরকার মাত্র ক্ষমতায় এসেছিল। ক্ষমতায় বসেই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রথম যে কয়টি কাজ করেছিল, তার অন্যতম ছিল বঙ্গোপসাগরের তিনটি গ্যাসক্ষেত্র দুটি বিদেশি কম্পানিকে দেওয়ার জন্য চুক্তিপত্র ঠিক করা। তার প্রতিবাদে বামপন্থী দলগুলো মিছিল করলে বিনা উস্কানিতে পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ করে এবং অনেকের মধ্যে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এমনভাবে আহত হন যে তাঁর পা ভেঙে যায়। তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছিল যে এই কাজ করেছে পুলিশের মধ্যে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা বিএনপির লোকজন। এ ব্যাপারে তদন্ত করা হবে বলেও আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল। সে তদন্ত এখনো হয়নি।
প্রশাসনে বিএনপি বা জঙ্গিরা রয়েছে এই গান গেয়ে কত দূর যাওয়া যাবে? ক্রসফায়ার করছে কারা? ওরাই, যারা বিএনপি আমল থেকে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। চালের দাম বাড়াচ্ছে কারা? সে-ও বিএনপির ব্যবসায়ীরা যারা সিন্ডিকেট করে, মজুদ করে দাম বাড়াচ্ছে। শেয়ারবাজারের এমন ধস নামছে কেন? তা-ও কতিপয় বিএনপিপন্থীর কারসাজি! এসব কথা শুনতে শুনতে আর ভালো লাগে না। সবই যদি ক্ষমতাবহির্ভূত বিএনপির লোকজন করার ক্ষমতা রাখে, তাহলে জনগণ বিপুল ভোট দিয়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন কেন?
আসল সত্য হলো, চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী সরকারি নীতি এবং সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট অথবা সরকারদলীয় ব্যবসায়ীদের অনৈতিক কারবার। চালের দাম এখন ৫০ টাকার ওপরে। মোটা চালের দামও চলি্লশের ঘরে। চালের এমন উচ্চমূল্য কোনো দিন হয়নি। চালের দামের সঙ্গে সরকারের জনপ্রিয়তার যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, তা নতুন কিছু নয়। সরকারের জনপ্রিয়তা যে হ্রাস পেয়েছে তা সাম্প্রতিক পৌরসভার নির্বাচনী ফল থেকেই বোঝা যায়। এই সরকার অতীতের সরকারের মতোই মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাস করে। যদিও আমাদের সংবিধানে সমাজতন্ত্রকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বলে ঘোষণা করা আছে, তবু ওটা কেবল বইয়ের পাতায় লেখা আছে। আওয়ামী লীগ পুঁজিবাদেই বিশ্বাস করে। শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের জবরদস্তি, টেন্ডারবাজি এবং তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে খুনাখুনি, রক্তারক্তি। এর পরিণামে অর্থনীতিতেও নৈরাজ্য চলছে। প্রশাসনের স্বাভাবিক কাজও বাধাগ্রস্ত। এই বাধা বাইরে থেকে আসছে না। বাধা সৃষ্টি করছে সরকারদলীয় মাস্তানরাই।
এখন লুটের মহড়া চলছে। চালের দাম বাড়বেই। এটাই পুঁজিবাদের, বিশেষ করে নিয়ন্ত্রণহীন মুক্তবাজার ব্যবস্থার অবধারিত পরিণাম। আর শেয়ার কেলেঙ্কারি! কয়েক দিন আগে এ বিষয়ের ওপর আমি কালের কণ্ঠে একটি লেখা লিখেছিলাম। সেসব কথার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। মোটকথা এই কেলেঙ্কারির পেছনে যারা দাবার ঘুঁটি চালছেন তাঁরা সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট ব্যক্তি। এরাই ১৯৯৬ সালে একই কাজ করেছিল। মাননীয় অর্থমন্ত্রী তো বলেছেন, তিনি জানেন কারা এসব করছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে তিনি অপারগ, যেভাবে প্রধানমন্ত্রী ক্রসফায়ার বন্ধ করতে অপারগ। যদিও শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে এমন বিচারবহির্ভূত হত্যা পছন্দ করেন না।
তাহলে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ বা ইচ্ছা-অনিচ্ছা দ্বারা কিছু এসে যায় না। ক্রসফায়ার চলছিল, চলবে। চালের দামের ঊর্ধ্বগতিকেও রোধ করা যাবে না। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদকে লাঠিপেটা করে পা ভাঙার পর সেই তদন্ত আর হবে না। বিচারকরা সুয়োমোটো ক্রসফায়ারের ব্যাপারে উদ্যোগ নিলেও তা কোনো ফল বহন করে আনবে না। শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারিতে কয়েক লাখ মধ্যবিত্তকে নিঃস্ব করে কয়েক হাজার কোটি টাকার লোপাট করার ঘটনা_সবই চলবে। তাহলে কিছুই বদলাবে না। কিছুই বদলায় না। কারণ এসবই হচ্ছে নিকৃষ্ট ধরনের পুঁজিবাদের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ। বুর্জোয়া আওয়ামী লীগ বুর্জোয়া বিএনপির ধারাকে বদলাতে পারে না।
তাহলে দিনবদলের কী হবে? কিছু লোকের ভাগ্য বদল হয়েছে বৈকি? কিন্তু সাধারণ মানুষের বেলায় দিনবদল_সে যে দুরাশা মাত্র! তার জন্য দরকার সেই রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার, যারা সমাজটাকেই বদলাবে, পুঁজিবাদের বদলে সংবিধানে বিধৃত সমাজতন্ত্রের পথে নতুন বিকল্প তুলে ধরবে।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট
No comments