সাক্ষাৎকার-ঈশ্বর কণায় সৃষ্টি রহস্য ভেদ করা যাবে by অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম

সাক্ষাৎকার গ্রহণ :কাজী আবুল মনসুর খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস ড. জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার'স কলেজে পড়াশোনা করেন এবং লন্ডনের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি লাভ করেন।


মহাবিশ্বের ওপর রচিত তার গবেষণাধর্মী ৫০টিরও বেশি বই বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে তার কয়েকটি গ্রন্থ। একাধিক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর সঙ্গে তার যৌথ গবেষণা রয়েছে

সমকাল : ঈশ্বর কণা নিয়ে এত হৈচৈ কেন?
জামাল নজরুল : নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক আবদুস সালাম (১৯২১-১৯৯৬) বলতেন, বিংশ শতাব্দী ছিল পদার্থবিদদের এবং একবিংশ শতাব্দী হবে জীববিদদের শতাব্দী। ১৯৯৬ সালে জাপান সফরের সময় আমি এ কথা বিশিষ্ট জীববিদ অধ্যাপক কিম ইচিরো মিউরাকে বললাম। তিনি একমত হলেন এবং সেই সঙ্গে বললেন যে, একবিংশ শতাব্দীর জীববিদ্যায় পদার্থবিদরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। এই প্রভাব কয়েক দশক ধরেই লক্ষ্য করছি। বিংশ শতাব্দীর জীববিদ্যার অন্যতম আবিষ্কার হলো ফবড়ীুৎরনড়হঁপষরপ ধপরফ (উ.ঘ.অ) অণুর গঠন, যেটা ১৯৫৩ সালে ঔধসবং ডধঃংড়হ এবং ঋৎধহপরং ঈৎরপশ আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কার জীববিদ্যায় যুগান্তকারী বিপ্লব এনেছে, যেটার ব্যাপকতা এখনও সঠিকভাবে অনুমান করা যায় না। এর সঙ্গে এসেছে এবহবঃরপ ঊহমবহববৎরহম অর্থাৎ যে প্রযুক্তি দ্বারা প্রাণী অথবা উদ্ভিদ জগতের কোনো একটি প্রজাতির এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মের বিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে। ঠিক একই কথা বলা যায়, ঈশ্বর কণা বা হিগস-বোসন কণা সম্পর্কে। বিজ্ঞানী 'পিটার হিগস' ১৯৬৪ সালে এ গবেষণা শুরু করেন। তার গবেষণার সূত্র ধরেই বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে ব্যয়বহুল গবেষণায় যে 'কণা'টি আবিষ্কার করেন তাকে ঈশ্বর কণা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এখানে গুরুত্ব বোঝানোর জন্য ঈশ্বর শব্দটি আলোচনায় এসেছে। তবে এটির সত্যতা এখনও নিশ্চিত নয়, যদি সত্য নিশ্চিত হয় তবে অনেক কিছুই পাল্টে যাবে। পৃথিবীর জন্ম থেকে শুরু করে অনেক কিছুর রহস্য উন্মোচন হবে। পদার্থের ভরের ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। ভর রহস্যের সমাধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা মানুষের অস্তিত্বের কাছাকাছি চলে আসছে। আদিতে মহাবিশ্ব আজকের মতো এত বিশাল ছিল না। নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ কিছু ছিল না। একেবারে শূন্য। কোটি কোটি বছর পরে মহাশূন্যের এক কোণে একরকম আদিম কণিকার সৃষ্টি হয়। সেই কণিকা থেকে প্রোটন, নিউট্রন, ইলেকট্রন প্রভৃতির সৃষ্টি। এরপর শত শত কোটি বছরের ব্যবধানে প্রোটন, নিউট্রন, ইলেকট্রন থেকে পরমাণুর সৃষ্টি। আদিম কণিকা এক সময় জমাট বাঁধা বিশাল পিণ্ডে রূপ নেয়। পিণ্ডের ঘনত্বের সঙ্গে বাড়তে থাকে তাপ। প্রচণ্ড তাপে আদিম পিণ্ডে বিস্টেম্ফারণ ঘটে এবং তার ফলেই আদিম কণিকা ভেঙে সৃষ্টি হয়েছে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন প্রভৃতি। কণার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রোটন কণা। প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষের ফলে যে শক্তি সৃষ্টি হবে তা থেকে সৃষ্টি হবে পদার্থের ভর ব্যাখ্যার ঈশ্বর কণার।
সমকাল : এ আবিষ্কারের পেছনে বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর কী অবদান রয়েছে?
জামাল নজরুল : সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ব্যাপক গবেষণা ছিল 'ভর তত্ত্বের' ওপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের এক সময়ের জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন তিনি। মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের বিভিন্ন গবেষণার ওপর কাজ করেছেন। যে ঈশ্বর কণা সৃষ্টি নিয়ে এত হৈচৈ তার পেছনে সত্যেন বসুর অবদান অনেক। কারণ তার কল্পিত সূত্র অনুসারে আবিষ্কৃত এ কণার নাম হয়েছে 'হিগস-বোসন'। এ বিজ্ঞানীর সমসাময়িক প্রায় সবাই নোবেল পুরস্কার পেলেও তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। অথচ তার মৃত্যুর প্রায় ৪০ বছর পর তারই গবেষণালব্ধ ঈশ্বর কণার আবিষ্কার। তার ধারণা বিজ্ঞানী হিগসের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলের কাছাকাছি। ঈশ্বর কণা সত্যেন বসুর 'বোসন গোত্রের' না হলেও পিটার হিগসের গবেষণা ও সত্যেন বসুর গবেষণার উভয়ের ফল এই ঈশ্বর কণা, যা আগামীতে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে। তবে পৃথিবীর কী রহস্য বের হবে তা সময়ের ব্যাপার।
সমকাল : কী ধরনের গবেষণা ছিল সত্যেন বসুর?
জামাল নজরুল : গত দু'তিন দশকে বেশ কয়েকটি মৌলিক কণা আবিষ্কৃত হয়েছে। যাদের জীবনকাল ১০-১৭ সেকেন্ডের চেয়ে বেশি। এই সময়কালটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র। এই ক্ষুদ্র সময়কালগুলোর কিছু ধারণা আমরা করতে পারি। যদি আমরা নির্ণয় করি এই সময়কালে একটি আলোক কণা, অর্থাৎ ফোটন (আলোক রশ্মিও বলা হয়) কতটা দূরত্ব অতিক্রম করে। মৌলিক কণাগুলোর ভর এত ক্ষুদ্র যে 'গ্রাম'-এ সেগুলো নির্ণয় করা অথবা মাপা অবাস্তব হয়ে দাঁড়ায়। তাই এগুলো সাধারণত 'শক্তি'র এককে নির্ণয় করা হয়, অর্থাৎ সেই শক্তির পরিমাণ যেটা ভরকে আইনস্টাইনের সূত্র দ্বারা শক্তিতে পরিণত করলে আমরা পাই। উদাহরণস্বরূপ, ইলেকট্রনের ভর ০.৫১ মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট ধরে নেওয়া যায়। এ কণাগুলোর ভর এই পদ্ধতিতেই দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি মৌলিক কণার স্বকীয় কৌণিক ভরবেগ এবং এর অনুপাতের অর্থাৎ এর এককে মাপা হয়। যে কণাগুলোর স্পিন পূর্ণসংখ্যা হয়, অর্থাৎ ১, ২, ৩,.. ইত্যাদি, তাদের বোজন বা বোসন বলা হয়। এই তত্ত্ব বোজনের ক্ষেত্রে আবিষ্কার করেন আইনস্টাইন এবং সত্যেন বোস। তাই এই তত্ত্ব বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান হিসেবে পরিচিত। মূলত ঈশ্বর কণার আবিষ্কারের পেছনে বোসের এ পরিসংখ্যান তত্ত্বের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। তাই এখানে বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর অবদান বিষয়টি আলোচনায় আসছে।
সমকাল : কেন সত্যেন বসু নোবেল পাননি?
জামাল নজরুল : পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণ করে সেটা আমরা মাত্র গত কয়েক শতাব্দী ধরে জানি। মধ্যযুগের এই তথ্যটি উপস্থাপন করেন পোল্যান্ডের জ্যোতির্বিদ নিকোলাস কোপার্নিকাস তার বিখ্যাত পুস্তক উব জবাড়ষঁঃরড়হরনঁং ঙৎনরঁস ঈড়বষবংঃরঁস-এ (অর্থাৎ আকাশের ঘূর্ণায়মান বস্তুগুলো)। এটি প্রকাশিত হয় ১৫৪৩ সালে, তার মৃত্যুর বছরে। তারপর ইতালীয় জ্যোতির্বিদ ও চিন্তাবিদ জিওর্দানো ব্রুনো এবং গ্যালিলিও গ্যালিলাই আবার এই বিষয়টি উপস্থাপন করেন, এবার প্রকাশ্যে, কারণ কোপার্নিকাস তার জীবনকালে তার এ ধারণাটি প্রকাশ করেননি। তৎকালীন খ্রিস্টান চার্চের ধারণা ছিল যে, আকাশের সবকিছু পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। তাই এই কথাগুলো তাদের মনঃপূত হয়নি। এ কারণে ব্রুনোকে ১৬০০ সালে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল এবং গ্যালিলিওকে তার এই তত্ত্বটিকে প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছিল। পরবর্তীকালে ক্রমশ এ ধারণাটি গ্রহণযোগ্য হয় এবং অবশেষে সম্পূর্ণ সঠিক বলে মেনে নেওয়া হয়। সত্যেন বসুর ক্ষেত্রেও আমরা এ ধরনের ইঙ্গিত পাই। তার গবেষণার বিষয়টি বেশি প্রচার পায়নি। কেউ তা মেনে নিতে পারেনি। তিনি এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। তার গবেষণার বিষয়গুলো বা বোসন তত্ত্বটি তিনি ইংল্যান্ডের একটি জার্নালে পাঠালে তারা তা বাতিল করে দেয়। শেষ পর্যন্ত তা যায় আইনস্টাইনের কাছে। তবে সত্যেন বসুর মৃত্যুর পরও এ নিয়ে গবেষণা থেমে থাকেনি। শেষ পর্যন্ত জয় তার হয়েছে। আবিষ্কৃত ঈশ্বর কণা বা পিটার হিগসের 'হিগস' এবং সত্যেন বসুর 'বোসন' নাম অনুসারে হয়েছে। ৪০ বছর আগের গবেষণার সত্যতা বর্তমানে নিশ্চিত হচ্ছে। তবে এ জন্য সত্যেন বসুকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত ছিল। না দেওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক।
সমকাল : ঈশ্বর কণায় কি মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য জানা যাবে?
জামাল নজরুল : বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ঈশ্বর কণা বিষয়টি নিশ্চিত হলে অনেক রহস্যের দ্বার উন্মোচন হয়ে যাবে। পৃথিবী সৃষ্টি থেকে শুরু করে সৌরজগতের অনেক রহস্য বের হয়ে আসবে। তবে তা সময়ের ব্যাপার। বিজ্ঞানীরা 'হিগস-বোসন' কণাকে যেহেতু 'ঈশ্বর কণা' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, তাতে বোঝা যায় বিশাল কোনো সাফল্যের জন্য পৃথিবী অপেক্ষা করছে। সৌরজগতের এবং সূর্যের বয়স প্রায় পাঁচশ' কোটি বছর। কেমন করে এগুলো সৃষ্টি হয়, সেটা সঠিকভাবে এখনও জানা যায়নি; প্রত্যেকটি তত্ত্বে কতকগুলো অনিশ্চয়তা রয়েছে। একটা প্রস্তাব ছিল যে, অন্য একটি নক্ষত্রের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে সৌরজগতের (অর্থাৎ গ্রহ এবং সৌরজগতের অন্যান্য বস্তু) সৃষ্টি হয়েছে। এই তত্ত্বে কিছু অসুবিধা আছে, কারণ ছায়াপথের এই অঞ্চলে নক্ষত্রগুলোর পরস্পরের দূরত্ব বেশি বলে সংঘর্ষের সম্ভাবনা কম। আর একটা প্রস্তাব হলো আদিকালের বস্তুগুলো ক্রমশ জমাট হয়ে সূর্য এবং (বিশেষ কোনো কারণে) গ্রহাদির সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানীরা এ সম্পর্কে এবং সৌরজগতের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় ১০৯ গুণ এবং ভর পৃথিবীর ভরের প্রায় ৩৩৩০০০ গুণ। সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রায় ৬০০০০ ডিগ্রি। যেটা কেন্দ্রের দিকে গেলে বাড়তে বাড়তে প্রায় কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রিতে পেঁৗছায়। আবার তাপ বিকিরণের পরিমাণ প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৯ী১০২৫ ক্যালরি; প্রায় ৩০০০ ফুট বরফের বেষ্টনীকে এই তাপ ৯০ মিনিটে সম্পূর্ণ গলিয়ে দিতে পারে। এই তাপের উৎস হলো নিউক্লীয় প্রক্রিয়া, যেটাতে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ভারী কেন্দ্রতে পরিণত হয়। উদাহরণস্বরূপ চারটি হাইড্রোজেন পরমাণুর ভরের চেয়ে কিছু পরিমাণ কম। পরিষ্কার চন্দ্রহীন মেঘহীন রাতে হাজার হাজার নক্ষত্র দেখা যায়; আরও দেখা যায় আকাশের একদিক থেকে অন্যদিক পর্যন্ত একটি আলোর বেড়ি। যেটা আদিকাল থেকে মানুষের চোখে পড়েছে, যেটাকে আমরা 'ছায়াপথ' বলি। যে নক্ষত্রগুলো আমরা খালি চোখে দেখি, এমনকি যেগুলো একটি সাধারণ দূরবীক্ষণ দিয়ে দেখি সেগুলো আমাদের সূর্য এবং সৌরজগৎসহ একটি বিরাট নক্ষত্রসমষ্টিতে অবস্থিত। যেটাকে আমরা ছায়াপথ বলে থাকি; একে 'নীহারিকা' অথবা ইংরেজিতে এধষধীুও বলা হয়। ছায়াপথে সূর্যের মতো বহু নক্ষত্র রয়েছে। একটি নক্ষত্রের আলো এবং তাপের উৎস হলো নিউক্লীয় প্রক্রিয়া। এখানে মৌলিক প্রক্রিয়াটা হলো চারটি হাইড্রোজেনের পরিমাণু একত্রিত হয়ে একটি হিলিয়াম পরমাণুর সৃষ্টি। একটি হাইড্রোজেন পরমাণুতে (ঐ) একটি ইলেকট্রন (ব-) এবং একটি প্রোটন (ঢ়) থাকে। একটি হিলিয়াম পরমাণুতে (ঐব) দুটি ইলেকট্রন থাকে এবং এটার কেন্দ্রে (ঘঁপষবঁং) দুটি প্রোটন এবং দুটি নিউট্রন (হ) থাকে। নিউট্রনটি নিম্নলিখিত প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়। এখানে া হলো নিউট্রিনো (ঘবঁঃৎরহড়) নামক একটি মৌলিক কণা, যেটা সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে মহাশূন্যে চলে যায়। এই প্রক্রিয়ার জন্য কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রি তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়, যেটা সূর্যের (অথবা যে কোনো নক্ষত্রের) কেন্দ্রস্থলে পাওয়া যায়। তাহলে দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে এই প্রক্রিয়ায় দুটি নিউট্রনের সৃষ্টি হয় এবং এই দুটি নিউট্রন অন্য দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সঙ্গে মিলিত হয়ে একটি হিলিয়াম পরমাণু সৃষ্টি করে। এই প্রক্রিয়ার জন্যই অনুরূপ উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। এখন একটি হিলিয়াম পরমাণুর ভর চারটি হাইড্রোজেন পরমাণুর ভরের চেয়ে সামান্য পরিমাণে কম। এই অতিরিক্ত ভরটি শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র ঊ=গপ২অনুযায়ী যেটাতে ঊ হলো শক্তির পরিমাণ (অসড়ঁহঃ ড়ভ বহবৎমু), গ হলো ভর (গধংং) এবং প আলোর গতিবেগ, তিন লক্ষ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ডে। এই অতিরিক্ত শক্তি থেকেই সূর্য আলো এবং তাপ পায়। আসলে উপরোক্ত প্রক্রিয়াটি সরাসরি ঘটে না; কতকগুলো মধ্যবর্তী পর্যায় রয়েছে। আইনস্টাইনের এ সূত্রের মতো ঈশ্বর কণার মাধ্যমে আগামীতে কিছু সাফল্য পরিলক্ষিত হবে। তাতে পৃথিবীর আদি ও অন্ত রহস্যের ভবিষ্যৎ জানা যেতে পারে।
সমকাল : ভবিষ্যতে মানুষ জানতে পারবে মহাবিশ্বের পরিণতি সম্পর্কে?
জামাল নজরুল : বিশ্বের নিয়তি সম্বন্ধে কিছু বলা মানে এক ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করা। এই ভবিষ্যদ্বাণীটি আমাদের বর্তমান জ্ঞানের যে পরিসর আছে সেটার ওপর ভিত্তি করে করা হবে। নতুন তথ্য এবং তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গে এই ভবিষ্যদ্বাণী পরিবর্তন হতে পারে। অবশ্য এটা বলা যায় যে, মোটামুটিভাবে এই ভবিষ্যদ্বাণী সম্বন্ধে সাধারণ বিজ্ঞানীরা একমত হবেন। বর্তমান জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেও বিশ্বের নিয়তি সম্বন্ধে সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়। কারণ এখানে কয়েকটা অনিশ্চয়তা রয়ে যায়। কিন্তু বর্তমান জ্ঞানের সাহায্যে বিশ্বের নিয়তি কী হবে সেটা কয়েকটি নির্দিষ্ট সম্ভাবনার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায়। বিশ্বের মৌলিক উপাদান হলো নীহারিকাগুলো। একটি নীহারিকার মধ্যে প্রায় দশ হাজার কোটি নক্ষত্র থাকে। তারা পরস্পরকে আকর্ষণ করে অভিকর্ষ আইন অথবা মাধ্যাকর্ষণ সূত্র অনুযায়ী এবং তার ফলেই তারা একত্রে থাকে। সাধারণ নীহারিকাগুলো বিভিন্ন দলে থাকে এবং একটি দলে কয়েকটি অথবা কয়েক হাজার নীহারিকা থাকতে পারে। মহাবিশ্বে নীহারিকাগুলোর বিন্যাস গড়ে সব দিকে সমান বা সুষম। একটি নীহারিকার আকৃতি একটি বিরাট চাকতির মতো, যেটার ব্যাস প্রায় এক লাখ আলোক বছর এবং যেটার পুরুত্ব অথবা স্থূলতা কয়েক হাজার আলোক বছর। প্রত্যেকটি নীহারিকা চাকতির মতোই ঘূর্ণায়মান। মহাবিশ্বের একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকান জ্যোতির্বিদ ই.পি হাবল ত্রিশ দশকে। তিনি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, মহাবিশ্ব সদা সম্প্রসারণশীল। এর অর্থ এই যে, নীহারিকাগুলো পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যার দূরত্ব বেশি, তার সরে যাওয়ার গতিবেগও বেশি। এই অপসরণের হার থেকে অনুমান করা যায় যে, প্রায় এক হাজার বছর থেকে দুই হাজার কোটি বছর আগে নীহারিকাগুলো পরস্পরের খুব কাছে ছিল। অনুমান করা যায় যে, ওই সময় মহাবিশ্বে মহাবিস্টেম্ফারণ সংঘটিত হয়েছিল, যার ফলে সব বস্তু প্রচণ্ড গতিবেগে চারদিকে নিক্ষিপ্ত হয়। কালক্রমে পদার্থ জমাট হয়ে নীহারিকাগুলো সৃষ্টি করে। বর্তমানকালে মহাবিশ্বের যে সম্প্রসারণ দেখা যায় তা সেই আদি মহাবিস্টেম্ফারণের জের মাত্র। যতদিন আমাদের সূর্য বেঁচে থাকবে ততদিন আমাদের শক্তির অভাব হবে না। এই সময়টা হলো কয়েকশ' কোটি বছর। সূর্য ঠাণ্ডা হয়ে গেলে মানবজাতি অন্য কোনো নক্ষত্রে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। এ জন্য তারা পারমাণবিক কেন্দ্রীয় শক্তি ব্যবহার করতে পারে। প্রায় দশ হাজার কোটি বছর পরে সব নক্ষত্রই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। তখন শক্তির উৎস হবে ঘূর্ণায়মান কৃষ্ণ বিবর। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আর. পেনরোজ আবিষ্কার করেছেন যে, এক ধরনের প্রক্রিয়া দিয়ে ঘূর্ণায়মান কৃষ্ণ বিবর থেকে শক্তি আহরণ করা যায়।
সমকাল :আপনাকে ধন্যবাদ।
জামাল নজরুল :সমকাল পাঠকদের শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।
 

No comments

Powered by Blogger.