পদ্মা সেতুর অর্থায়ন ॥ নেতৃত্বে বাংলাদেশ-এডিবি, জাইকা ও আইডিবিকে চুক্তি অব্যাহত রাখতে অনুরোধপত্র দিচ্ছে সরকার by হামিদ-উজ-জামান মামুন

পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশ। এর পাশাপাশি সহযোগী অর্থায়নকারী খোঁজা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে চুক্তি অব্যাহত রাখতে তিন দাতা সংস্থাকে অনুরোধপত্র দিচ্ছে সরকার। বিশ্বব্যাংকের বাইরে বাকি দাতারা যাতে হাতছাড়া হয়ে না যায় সেজন্যই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।


শীঘ্রই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) প্রেসিডেন্টের কাছে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানানো হবে। এ লক্ষ্যে একটি চিঠির খসড়া তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এটি যাচাই করে নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ইআরডির একাধিক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি এ অনুরোধপত্র পাঠানো হবে। এতে স্বাক্ষর করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
তবে ইতোমধ্যেই অন্য দাতাদের রাজি করানোর আশ্বাস দিয়েছে জাপান। দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী কাতসুইয়া ওকাদা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোইছিরোগেমবা ও জাইকার প্রেসিডেন্ট আকিহিকো তানাকা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিকে এ আশ্বাস দিয়েছেন। গত সোমবার টোকিওতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন।
অন্যদিকে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরির জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ও মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্ত হলেও শেষ পর্যন্ত এ সেতু নির্মাণে দাতাদের অংশগ্রহণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এর অংশ হিসেবেই পাঠানো হচ্ছে অনুরোধপত্র।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, তিন দাতা সংস্থাকে পাঠানো অনুরোধপত্রে এ যাবত সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং অবস্থান তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন বিশ্বব্যাংকের সকল অভিযোগ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণ দেয়া হোক। সূত্র মতে, পদ্মা সেতুতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১২০ কোটি ডলার দেয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের। তাই লীড ডোনার করা হয়েছিল সর্বোচ্চ ঋণদাতা এ সংস্থাটিকে।
দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এ সংস্থাটি দেয়ার কথা ৬১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, যা ৪ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) দেয়া কথা ৪০ কোটি মার্কিন ডলার আর ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) দেয়া কথা ১৪ কোটি মার্কিন ডলার। বাকি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে দেয়ার কথা।
কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও দেনদরবার করার পরও শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি টেকানো যায়নি। বরফ গলেনি সর্বোচ্চ ঋণদাতা এ সংস্থাটির। নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গত ২৯ জুন আকস্মিক চুক্তি বাতিল করে সংস্থাটি। তখনও আশা জিইয়ে ছিল নতুন প্রেসিডেন্ড দায়িত্ব গ্রহণের পর যদি সিদ্ধান্ত বিবেচনা করেন। কিন্তু দায়িত্ব নিয়েই নতুন প্রেসিডেন্ট জিম ইয়াং কিম বলেছেন, দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বাংলাদেশের জন্য ঋণ চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত সঠিক। তার এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার সম্ভাবনা নিভে যায়। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের দায়িত্বশীলরাও জানান এ চুক্তি নিয়ে আর কোন আলোচনার সুযোগ নেই। যে চুক্তি বাতিল হয়ে গেছে সেটি বাতিলই। তবে এ সেতুতে অর্থায়নের বিষয়ে আবারও নতুন করে আলোচনা হতে পারে। সেটি হলেও গোড়া থেকেই শুরু করতে হবে। এ প্রেক্ষিতে সরকার নিজস্ব অর্থেই পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও ইআরডির একাধিক সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের বাইরে অন্য তিন দাতা যে পরিমাণ অর্থ দেবে তার বাইরেও নতুন দাতা সংস্থা খোঁজা হবে। এই তিন সংস্থাকে অনুরোধ দেয়ার পর পরবর্তী ধাপে নতুন অর্থায়নকারীদের আহ্বান জানানো হতে পারে। আর যদি কোন সংস্থাকে পাওয়া না যায় তাহলে বাকি টাকা যেভাবেই হোক সরকার নিজেই অর্থায়ন করবে। তাই অর্থায়নের এ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিতে চায় বাংলাদেশই। পাশাপাশি আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর লক্ষ্য নিয়েই নতুন উদ্যোগ শুরু করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে। কেননা সোমবারের মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থেই পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরুর নির্দেশ দিয়েছেন। তার আগে আনুষঙ্গিক প্রস্তুতিমূলক কাজ দ্রুত শেষ করতে বলেছেন তিনি।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ জানায়, এর মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংকের ঋণ-সহায়তা প্রত্যাহারের পর একই পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেয় এডিবি। এক বিবৃতির মাধ্যমে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, এডিবি জানতে পেরেছে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন প্রত্যাহার করেছে। সেতুটি বাংলাদেশ ও এ অঞ্চলের জন্য যুগান্তকারী একটি প্রকল্প। এ প্রকল্পে অর্থের বড় যোগানদাতা বিশ্বব্যাংক এডিবি, জাইকা ও আইডিবির মধ্যে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছে বিশ্বব্যাংক। যেসব কারণে ঋণ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্বব্যাংক, তা বুঝতে পেরেছে এডিবি। এ সিদ্ধান্তকে তারা সম্মান করে। বিশ্বব্যাংক ও এডিবি একই নীতি, নিয়ম ও কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করে। এডিবির দুঃখ যে দেশ ও আঞ্চলিক বিবেচনায় পদ্মা সেতুর বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও উভয় পক্ষ কাজ করার মতো কার্যকর একটি সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি।
জাইকা ও আইডিবি আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণ চুক্তি বাতিল করেনি। কিন্তু ইআরডি বলছে, আগের চুক্তি বিশ্বব্যাংক বাতিল করার কারণে আর কার্যকারিতা নেই। এজন্য আবার চুক্তি করা প্রয়োজন। এ প্রেক্ষিতে এডিবি, আইডিবি এবং জাইকাকে পূর্বের প্রতিশ্রুত ঋণ বহাল রাখার অনুরোধ করা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। এরই মধ্যে সংস্থা দুটির বাংলাদেশ কার্যালয়ের সঙ্গে ইআরডির আলোচনা হয়েছে বলেও জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.