দুই দু’গুণে পাঁচ-পুনশ্চ তেজারতি নিয়ে কথা by আতাউর রহমান

তেজারতি তথা ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত পছন্দের উক্তি হচ্ছে: হেনরি ফোর্ড, যিনি মোটরগাড়ি আবিষ্কারের অব্যবহিত পরেই সেই ১৯০৩ সালে সস্তায় একসঙ্গে অনেক গাড়ি তৈরির প্ল্যান্ট স্থাপন করে প্রায় রাতারাতিই ধনকুবের হয়ে যান, বলেছেন, ‘যে ব্যবসা কেবল পয়সা ছাড়া আর কিছুই বানায় না, সেটা পুওর তথা


ত্রুটিপূর্ণ ব্যবসা।’ প্রয়াত রাশিয়ান নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ বলে গেছেন, ‘আপনি (ব্যবসায়ী) যখন ক্রেতার চামড়া তুলছেন, তখন কিছু চামড়া রেখে দেওয়া উচিত, যাতে ওটা বৃদ্ধি পেলে পর পুনরায় চামড়া তুলতে পারেন।’ আর কে একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি বলেছেন, ‘লাভ ব্যতিরেকে কোনো বিক্রি বিক্রিই নয়, ওটা হচ্ছে ডোনেশন তথা দান।’
আরও আছে: গ্রিক ধনকুবের ব্যবসায়ী অ্যারিস্টটল ওনাসিস, যিনি মিসেস জ্যাকুলিন কেনেডিকে বিয়ে করে বিশ্বখ্যাতির পাদপ্রদীপে পৌঁছে গিয়েছিলেন, বলে গেছেন, ‘ব্যবসাতে সাফল্যের গোপন কথা হচ্ছে এমন কিছু জানা, যা অন্যেরা জানে না।’ আর ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের দুটো উল্লেখযোগ্য উক্তি প্রায় সবারই জানা আছে—‘অসম্ভব শব্দটা কেবল বোকাদের অভিধানেই পাওয়া যায়’ এবং ‘আমাকে উত্তম মা দাও, আমি তোমাদের উত্তম জাতি দেব।’ তৎসঙ্গে যোগ করা যেতে পারে তাঁর এই উক্তিটিও: ‘বণিকদের আমি পছন্দ করি না। একজন বণিক হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি এক শিলিংয়ের জন্য তাঁর দেশকে বিক্রি করে দেবেন।’ তো ইদানীং আমরা দেখেছি, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করল, তখন ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে গুদাম থেকে মাল গুম করে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়ে জনগণের ওপর প্রতিশোধ নিলেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মতো প্রাচীন রোমানরাও ছিল দেব-দেবীতে বিশ্বাসী এবং দেবতা গণেশ যেমন হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যবসায়ীদের সিদ্ধিদাতা, তেমনিভাবে রোমান গড মার্কারি ছিলেন রোমানদের বাণিজ্য-দেবতা। তো প্রাচীন রোমে প্রতিবছর মে মাসের ১৭ তারিখে ব্যবসায়ীরা নাকি একটি জনসভায় একত্র হয়ে পূর্ববর্তী বছরটিতে ব্যবসাসংক্রান্ত কাজে যে মিথ্যা ও শঠতার আশ্রয় নিয়েছেন, সে জন্য ওই দেবতার কাছে ক্ষমা চাইতেন। তা রমজান মাস আগত, এ উপলক্ষে এ দেশের ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম ইতিমধ্যেই বাড়াতে শুরু করে দিয়েছেন। তাঁদেরও উচিত হবে রমজানের পর জনসভা করে মহান স্রষ্টার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
সে যা হোক। একজন রম্য লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে তেজারতিকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। এই যেমন: তেজারতি তথা ব্যবসা হচ্ছে ঠেলাগাড়ির মতো, কেউ পেছন থেকে না ধাক্কালে সেটা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে অথবা ব্যবসা হচ্ছে অনেকটা টেনিস খেলার মতো, যাঁরা ভালো সার্ভ করেন না, তাঁরা হারবেনই। কিংবা বলা যায়, ব্যবসা হচ্ছে কোনো জোরজবরদস্তি ব্যতিরেকে অন্যের পকেট থেকে টাকাপয়সা বের করে নিয়ে আসার কলাকৌশল। আশ্চর্যের কিছুই নয় যে একজন চশমার দোকানের মালিক নবনিযুক্ত সেলসম্যানকে কীভাবে ক্রেতাকে চার্জ করতে হবে, সেটা শেখাচ্ছিলেন: তুমি যখন তাঁর চশমার ফ্রেমে গ্লাস লাগাচ্ছ তখন যদি তিনি জিজ্ঞেস করেন ‘দাম কত’ তাহলে তুমি বলবে, ‘এক হাজার টাকা’। এতে তাঁর মধ্যে কোনো ভাবান্তর লক্ষ না করলে বলবে, ‘শুধু ফ্রেমের দাম, গ্লাসের দাম পড়বে ৫০০ টাকা।’ এর পরেও কোনো ভাবান্তর লক্ষ না করলে যোগ করবে, ‘প্রত্যেকটির’।
আরও আছে। একজন ঘড়ি বিক্রেতাকে নাকি জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এত কম দামে ঘড়ি বিক্রি করে আপনি ব্যবসায়ে কীভাবে টিকে আছেন? প্রত্যুত্তরে তিনি জানালেন, সেগুলো ‘রিপেয়ার’ করে। আরেকজন হারমোনিয়াম ও বন্দুকের দোকান একসঙ্গে দিয়েছেন। তো তাঁকে যখন এই দুই বিপরীতধর্মী বস্তুর দোকান একসঙ্গে দেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করা হলো, তখন তাঁর সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল, ‘হারমোনিয়াম বিক্রির কয়েক দিনের মধ্যেই এই ক্রেতার প্রতিবেশী বন্দুক ক্রয় করতে আসেন।’
তা অন্য অনেক ব্যাপারের মতো তেজারতিতেও নৈতিক সততার প্রয়োজন। এক ছেলে তার বাপকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বাবা, ব্যবসায়ে সততা বলতে কী বোঝায়?’ বাপ প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘ধরো, আমি আর তোমার আংকেল জসীম একসঙ্গে পার্টনারশিপে ব্যবসা করছি। একজন মাল ক্রেতা ভুলক্রমে আমাকে ৫০ হাজার টাকা বেশি দিয়ে দিলেন। এখানে নৈতিকতা তথা সততার প্রশ্ন আসছে—টাকাটা কি আমি একা নিয়ে নেব, নাকি আমার পার্টনারের সঙ্গে শেয়ার করব?’
কী সুন্দর নৈতিকতার ব্যাখ্যা!
আর হ্যাঁ, ব্যবসায়ে সুনাম ও উত্তরোত্তর উন্নতি করতে হলে শুধু সততাই যথেষ্ট নয়, সেই সঙ্গে একটি সূক্ষ্ম বিচারশক্তি, যেটাকে ইংরেজিতে ‘বিজনেস এক্যুমেন’ বলে, সেটাও থাকা চাই। ছোটবেলায় আমাদের গাঁয়ের এক ব্যবসায়ী হাজি সাহেবের এই গুণটার কথা অহরহ শুনতাম। বড় হয়ে বিলেতে গিয়ে সেখানকার বিখ্যাত মেগাশপ সেলফ্রিজেসের মালিক মি. সেলফ্রিজের জীবনী পড়ে সেটার সম্যক উদাহরণ পাওয়া গেল। মি. সেলফ্রিজ একদিন তাঁর দোকানের জানালায় দাঁড়িয়ে দেখলেন আকাশের ঈশান কোণে ভীষণ কালো মেঘের সমাহার ঘটেছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কর্মচারীদের জানালায় রেইনকোট টাঙিয়ে রাখতে নির্দেশ দিলেন। একটু পরেই ভারী বর্ষণ শুরু হলো এবং ঘণ্টা খানেকের মধ্যে দেড় শ রেইনকোট বিক্রি হয়ে গেল। তো এই মি. সেলফ্রিজের একটা বাতিক ছিল যে তিনি দোকানে কর্মচারী নিয়োগের আগে তাকে তার নাম সই করতে বলতেন এবং স্বাক্ষর অস্পষ্ট বা হিজিবিজি হলে সেই লোককে আর নিয়োগ করতেন না। তাঁর বক্তব্য ছিল, যে লোক স্পষ্টভাবে নিজের নাম সই করতে জানে না, তার কিছু না কিছু লুকানোর আছে। (এ ম্যান হু ডাস নট নো টু সাইন হিস নেম ক্লিয়ারলি হ্যাজ সামথিং টু হাইড)।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি চটিগল্প যখন মনে পড়ে গেল, সেটি দিয়েই না হয় লেখাটা শেষ করি: সুপার মার্কেটের মালিক একজন ব্যবসায়ীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনি আপনার দোকানের কর্মচারী নিয়োগদানে সব সময় অবিবাহিতদের চেয়ে বিবাহিতদের অগ্রাধিকার দেন কেন?’
‘ওয়েল’, ব্যবসায়ী একগাল হেসে নিয়ে বললেন, ‘আমি যখন চিৎকার করে ওদের বকাঝকা করি তখন বিবাহিতরা মোটেই মনঃক্ষুণ্ন হন না; কারণ তাঁরা ঘরে এটা শুনে অভ্যস্ত।’
আতাউর রহমান: রম্য লেখক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.