নজরুল জন্মজয়ন্তী-জাগরণের কবি by মোঃ জিল্লুর রহমান
অসাম্প্রদায়িক চেতনার অনন্য প্রতীক নজরুল বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি যুগবাণী, ধূমকেতু, লাঙল, গণবাণী ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আরও ছিলেন খ্যাতিমান নাট্যকার, দক্ষ অভিনেতা ও চলচ্চিত্রকার এবং একজন সফল সমাজসংস্কারক
মানবতার কবি, জাগরণের কবি, বিদ্রোহী কবি ... নজরুল। প্রেমের কবি, সাম্যের কবি, সকলের কবি ... নজরুল।
জাতীয় কবি নজরুল আমাদের বড়ই আপন। বাংলাদেশের জনগণের চিন্তা-চেতনা ও আনন্দ-বেদনার সাথী। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাংলা সংস্কৃতির কর্ণধার। তার আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যের দেহে ও প্রাণে সঞ্চার করেছে তারুণ্যের বিপুল ঐশ্বর্য। তাঁর অগি্নঝরা লেখনী থেকে বেরিয়ে এসেছে মানবিক মূল্যবোধ, সমাজ পরিবর্তনের দর্শন, অন্যায়ের প্রতিবাদ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের চেতনা। তাঁর সৃষ্টি আমাদের জাতির অঙ্গ। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কবিতা ও গান মুক্তিযোদ্ধাসহ গোটা বাঙালি সমাজকে করেছে উজ্জীবিত, যুগিয়েছে অফুরন্ত প্রেরণা। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এ প্রবাদপুরুষের জন্মবার্ষিকীতে তাঁর মহান স্মৃতির প্রতি আমি সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
রবীন্দ্র-প্রতিভা যখন মধ্য গগনে পূর্ণ আভায় দেদীপ্যমান তখনই এক নতুন শৈলী নিয়ে ধূমকেতুর মতো অপর একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের আবির্ভাব ঘটে। উজ্জ্বল এই নক্ষত্রটি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২১ সালে 'বিদ্রোহী' কবিতা নিয়ে নজরুলের আবির্ভাবের পর বাংলা কাব্য ও ছন্দের জগতে নতুন একটি ধারার প্রবর্তন ঘটে, যা অপরাপর কবি-সাহিত্যিকদের কাব্যধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের। তাঁর আবির্ভাবটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে সচকিত করেছিল। তিনি কবিতার ভাষায় নজরুলকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন_
আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগি্ন-সেতু
দুর্দিনের এই দুর্গ-শিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে'
আছে যারা অর্ধ-চেতন।
বলাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের এই আহ্বানে বিদ্রোহী কবি সাড়া দিয়েছিলেন।
নজরুলের শৈশব জীবন একটি নিশ্চিন্ত স্বাভাবিক জীবন ছিল না। চরম দারিদ্র্য ও প্রবল চাঞ্চল্য তাঁর জীবনে একই সঙ্গে বিরাজমান ছিল। গৃহের শৃঙ্খলা ভেঙে অচেনা পথে বেরিয়ে পড়ার একটি স্পৃহা ছিল তার। তবুও জীবন-জীবিকার জন্য কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে সেই কৈশোর বয়স থেকে। জীবনের প্রথম পেশা মসজিদে আজান দেওয়া শুরু করেন তিনি কৈশোরে। তারপর রুটির দোকানে চাকরি, লেটোর দলে গান বাঁধা, যাত্রার দলে যোগ দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ নজরুল গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেন। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত বিচিত্র মানুষের সঙ্গে মেশেন, তাদের কথা, সুর ইত্যাদি রপ্ত করেন। তিনি দেখেছিলেন জীবন অত্যন্ত কঠিন। সমাজ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। তাই সাহিত্যের উপাদান ও উপজীব্য হিসেবে তিনি দারিদ্র্য, অবহেলা ও বঞ্চনাকেই গ্রহণ করেছিলেন। সমাজের বিরাজমান অন্যায় ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়েই তিনি 'বিদ্রোহী' হয়ে ওঠেন। তাই দ্রোহ, প্রেম, মানবতা ও সৌন্দর্যের সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টিতে। পরাধীন দেশে সাধারণ মানুষকে তিনি দারিদ্র্য ও পরাধীনতা থেকে মুক্তির গান শুনিয়েছেন।
জন্মসূত্রে তিনি মুসলমান। কোরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আবার হিন্দু পুরাণ ও মহাভারতের কাহিনীকে তিনি আত্মীয়করণ করেছিলেন অবলীলায়। তিনি লিখেছেন :
আমি হোম-শিখা, আমি সাগি্নক জমদগি্ন,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগি্ন।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ইন্দ্রাণী-সুত হতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য;
নজরুলের গানের শিল্পগুণ, সুর, মাধুর্য ও গায়কী ঢং অন্যান্য গানের চেয়ে সৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠত্বে ভরপুর। বাণীর ঐন্দ্রজালিক সমন্বয়ে রচিত গানগুলো অতিমাত্রায় উচ্চ মার্গীয়। গানের ভাষা, প্রকরণশৈলী ও সুর অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। তাঁর গানের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। আশৈশব দেশজ সঙ্গীতের যেসব ধারায় তিনি অবগাহন করেছেন যেমন বাউল, কীর্তন, ঝুমুর, সাঁওতালি এগুলোকে তিনি নিপুণ হাতে প্রয়োগ করেছেন তাঁর নতুন গানে। অনেক নতুন গানে অপ্রচলিত রাগ-রাগিণীকে প্রয়োগ করেছেন। তিনি ১৮টি নতুন রাগ সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দোলনচাঁপা, দেবযানী, মীনাক্ষী, অরুণ রঞ্জনী, নির্ঝরিণী, রূপমঞ্জুরি, সন্ধ্যা-মালতী, বনকুন্তলা, অরুণ ভৈরব, শিবানী ভৈরব, রুদ্র ভৈরব, উদাসী ভৈরব ও বেনুকা।
নজরুল কাব্যে আমপারা, অসংখ্য হামদ ও নাতে রাসূল (সা.) রচনা করেছেন। আবার শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন এবং বৃন্দাবন গীতও রচনা করেছেন অনেক। এত উচ্চমানের হাম্দ ও নাত অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিক লিখতে পারেনি। অপরদিকে প্রেম ও ভক্তিপূর্ণ মনোমুগ্ধকর শ্যামাসঙ্গীত বা কীর্তন কোনো কবি-সাহিত্যিক লিখতে পেরেছেন কি-না আমার জানা নেই। তাঁর হাম্দ ও নাত শুনলে অনাবিল আনন্দে হৃদয়-মন ভরে যায়। আবার কীর্তন ও শ্যামসঙ্গীত শুনলে অদৃশ্য আবেগে দেহমন আবিষ্ট হয়। আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে তিনি একমাত্র কবি, যিনি সমান দক্ষতায় হিন্দু-মুসলমান উভয় ঐতিহ্যকে আপন কাব্যে রূপায়িত করেছেন।
১৯৪২ সালের কথা। সৃষ্টিশীল জীবনের সায়াহ্নে তিনি 'বাঙালির বাংলা' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। নবযুগ পত্রিকায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধটি প্রমাণ করে নজরুল একজন মহান কবি বা সাহিত্যিকই নন বরং তিনি একজন দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক ছিলেন। প্রবন্ধটির শুরুতে তিনি লিখেছেন, 'বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে 'বাঙালির বাংলা'_ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে'। এই প্রবন্ধের শেষে নজরুল লিখেছেন_ 'বাংলা বাঙালির হোক! বাংলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক।'
তাঁর কবিতা ও গানে যুগে যুগে এ দেশের মানুষ অনুপ্রাণিত হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের অগি্নঝরা দিনগুলোতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তাঁর কবিতা ও দেশাত্মবোধক গান আমাদের দেহে ও প্রাণে প্রবল শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে_
'এই শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল/
কারার এই লৌহ কপাট-ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট/
মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম/
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে/
একি অপরূপ রূপে মা তোমার
হেরিনুপল্লী জননী/
এবং দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে
লঙ্ঘিত হবে রাত্রি নীশিথে যাত্রীরা হুশিয়ার'
তিনি রচনা করেছেন এ ধরনের আরও অনেক গান ও কবিতা।
নজরুলের কাব্যে সমুজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়েছে চিরকল্যাণময়ী নারীর শতরূপ। প্রেম, মমতা, বুদ্ধিমত্তা, সৌন্দর্য ও শৌর্যবীর্যের কথা রূপায়িত হয়েছে তার লেখায়। তিনি লিখেছেন :
নর নহে, নারী, ইসলাম, পরে প্রথম আনে ঈমান
আম্মা খাদিজা জগতে সর্বপ্রথম মুসলমান।
পুরুষের সব গৌরব ম্লান, এই এক মহিমায়।
তার শ্যামা সঙ্গীতেও মায়ের প্রতি ভক্তিরসের ধারা প্রবহমান_
ভক্তি, আমার ধূপের মত
ঊধর্ে্ব উঠে অবিরত
শিবলোকের দেব দেউলে
মা'র শ্রীচরণ পরশিতে।
নজরুল আরও লিখেছেন :
কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
অর্থাৎ নজরুল এখন থেকে প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে পরাধীন সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্য লক্ষ্য করেছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগে একটি স্বাধীন দেশে এখনও কি নারীরা সমান অধিকার বা মর্যাদা ভোগের সুযোগ পাচ্ছেন? আর নারীর অধিকার কিছুটা সমুন্নত করতে উদ্যোগী হলে আজও এ দেশে প্রবল বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা করতে হয়। তবে যত বাধাই আসুক বাংলাদেশে নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা বদ্ধপরিকর।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার অনন্য প্রতীক নজরুল বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি যুগবাণী, ধূমকেতু, লাঙল, গণবাণী ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আরও ছিলেন খ্যাতিমান নাট্যকার, দক্ষ অভিনেতা ও চলচ্চিত্রকার এবং একজন সফল সমাজসংস্কারক। তার গুণ ও অবদানের কথা বলতে গেলে বহু সময়ের প্রয়োজন। হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাসে নজরুলই প্রথম ও শেষ বাঙালি, যিনি সৃজনশীল প্রতিভায় বাঙালি চেতনাকে সামগ্রিকভাবে ধারণ করতে সক্ষম হন। আর এসব কারণেই তিনি বাঙালির জাতীয় কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
একটি পরিশীলিত সমাজ ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার মাধ্যমে আমরা তার প্রতি সত্যিকার অর্থে সম্মান প্রদর্শন করতে পারি।
মোঃ জিল্লুর রহমান : বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি
জাতীয় কবি নজরুল আমাদের বড়ই আপন। বাংলাদেশের জনগণের চিন্তা-চেতনা ও আনন্দ-বেদনার সাথী। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাংলা সংস্কৃতির কর্ণধার। তার আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যের দেহে ও প্রাণে সঞ্চার করেছে তারুণ্যের বিপুল ঐশ্বর্য। তাঁর অগি্নঝরা লেখনী থেকে বেরিয়ে এসেছে মানবিক মূল্যবোধ, সমাজ পরিবর্তনের দর্শন, অন্যায়ের প্রতিবাদ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের চেতনা। তাঁর সৃষ্টি আমাদের জাতির অঙ্গ। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কবিতা ও গান মুক্তিযোদ্ধাসহ গোটা বাঙালি সমাজকে করেছে উজ্জীবিত, যুগিয়েছে অফুরন্ত প্রেরণা। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এ প্রবাদপুরুষের জন্মবার্ষিকীতে তাঁর মহান স্মৃতির প্রতি আমি সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
রবীন্দ্র-প্রতিভা যখন মধ্য গগনে পূর্ণ আভায় দেদীপ্যমান তখনই এক নতুন শৈলী নিয়ে ধূমকেতুর মতো অপর একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের আবির্ভাব ঘটে। উজ্জ্বল এই নক্ষত্রটি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২১ সালে 'বিদ্রোহী' কবিতা নিয়ে নজরুলের আবির্ভাবের পর বাংলা কাব্য ও ছন্দের জগতে নতুন একটি ধারার প্রবর্তন ঘটে, যা অপরাপর কবি-সাহিত্যিকদের কাব্যধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের। তাঁর আবির্ভাবটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে সচকিত করেছিল। তিনি কবিতার ভাষায় নজরুলকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন_
আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগি্ন-সেতু
দুর্দিনের এই দুর্গ-শিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে'
আছে যারা অর্ধ-চেতন।
বলাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের এই আহ্বানে বিদ্রোহী কবি সাড়া দিয়েছিলেন।
নজরুলের শৈশব জীবন একটি নিশ্চিন্ত স্বাভাবিক জীবন ছিল না। চরম দারিদ্র্য ও প্রবল চাঞ্চল্য তাঁর জীবনে একই সঙ্গে বিরাজমান ছিল। গৃহের শৃঙ্খলা ভেঙে অচেনা পথে বেরিয়ে পড়ার একটি স্পৃহা ছিল তার। তবুও জীবন-জীবিকার জন্য কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে সেই কৈশোর বয়স থেকে। জীবনের প্রথম পেশা মসজিদে আজান দেওয়া শুরু করেন তিনি কৈশোরে। তারপর রুটির দোকানে চাকরি, লেটোর দলে গান বাঁধা, যাত্রার দলে যোগ দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ নজরুল গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেন। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত বিচিত্র মানুষের সঙ্গে মেশেন, তাদের কথা, সুর ইত্যাদি রপ্ত করেন। তিনি দেখেছিলেন জীবন অত্যন্ত কঠিন। সমাজ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। তাই সাহিত্যের উপাদান ও উপজীব্য হিসেবে তিনি দারিদ্র্য, অবহেলা ও বঞ্চনাকেই গ্রহণ করেছিলেন। সমাজের বিরাজমান অন্যায় ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়েই তিনি 'বিদ্রোহী' হয়ে ওঠেন। তাই দ্রোহ, প্রেম, মানবতা ও সৌন্দর্যের সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টিতে। পরাধীন দেশে সাধারণ মানুষকে তিনি দারিদ্র্য ও পরাধীনতা থেকে মুক্তির গান শুনিয়েছেন।
জন্মসূত্রে তিনি মুসলমান। কোরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আবার হিন্দু পুরাণ ও মহাভারতের কাহিনীকে তিনি আত্মীয়করণ করেছিলেন অবলীলায়। তিনি লিখেছেন :
আমি হোম-শিখা, আমি সাগি্নক জমদগি্ন,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগি্ন।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ইন্দ্রাণী-সুত হতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য;
নজরুলের গানের শিল্পগুণ, সুর, মাধুর্য ও গায়কী ঢং অন্যান্য গানের চেয়ে সৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠত্বে ভরপুর। বাণীর ঐন্দ্রজালিক সমন্বয়ে রচিত গানগুলো অতিমাত্রায় উচ্চ মার্গীয়। গানের ভাষা, প্রকরণশৈলী ও সুর অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। তাঁর গানের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। আশৈশব দেশজ সঙ্গীতের যেসব ধারায় তিনি অবগাহন করেছেন যেমন বাউল, কীর্তন, ঝুমুর, সাঁওতালি এগুলোকে তিনি নিপুণ হাতে প্রয়োগ করেছেন তাঁর নতুন গানে। অনেক নতুন গানে অপ্রচলিত রাগ-রাগিণীকে প্রয়োগ করেছেন। তিনি ১৮টি নতুন রাগ সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দোলনচাঁপা, দেবযানী, মীনাক্ষী, অরুণ রঞ্জনী, নির্ঝরিণী, রূপমঞ্জুরি, সন্ধ্যা-মালতী, বনকুন্তলা, অরুণ ভৈরব, শিবানী ভৈরব, রুদ্র ভৈরব, উদাসী ভৈরব ও বেনুকা।
নজরুল কাব্যে আমপারা, অসংখ্য হামদ ও নাতে রাসূল (সা.) রচনা করেছেন। আবার শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন এবং বৃন্দাবন গীতও রচনা করেছেন অনেক। এত উচ্চমানের হাম্দ ও নাত অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিক লিখতে পারেনি। অপরদিকে প্রেম ও ভক্তিপূর্ণ মনোমুগ্ধকর শ্যামাসঙ্গীত বা কীর্তন কোনো কবি-সাহিত্যিক লিখতে পেরেছেন কি-না আমার জানা নেই। তাঁর হাম্দ ও নাত শুনলে অনাবিল আনন্দে হৃদয়-মন ভরে যায়। আবার কীর্তন ও শ্যামসঙ্গীত শুনলে অদৃশ্য আবেগে দেহমন আবিষ্ট হয়। আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে তিনি একমাত্র কবি, যিনি সমান দক্ষতায় হিন্দু-মুসলমান উভয় ঐতিহ্যকে আপন কাব্যে রূপায়িত করেছেন।
১৯৪২ সালের কথা। সৃষ্টিশীল জীবনের সায়াহ্নে তিনি 'বাঙালির বাংলা' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। নবযুগ পত্রিকায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধটি প্রমাণ করে নজরুল একজন মহান কবি বা সাহিত্যিকই নন বরং তিনি একজন দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক ছিলেন। প্রবন্ধটির শুরুতে তিনি লিখেছেন, 'বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে 'বাঙালির বাংলা'_ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে'। এই প্রবন্ধের শেষে নজরুল লিখেছেন_ 'বাংলা বাঙালির হোক! বাংলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক।'
তাঁর কবিতা ও গানে যুগে যুগে এ দেশের মানুষ অনুপ্রাণিত হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের অগি্নঝরা দিনগুলোতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তাঁর কবিতা ও দেশাত্মবোধক গান আমাদের দেহে ও প্রাণে প্রবল শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে_
'এই শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল/
কারার এই লৌহ কপাট-ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট/
মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম/
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে/
একি অপরূপ রূপে মা তোমার
হেরিনুপল্লী জননী/
এবং দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে
লঙ্ঘিত হবে রাত্রি নীশিথে যাত্রীরা হুশিয়ার'
তিনি রচনা করেছেন এ ধরনের আরও অনেক গান ও কবিতা।
নজরুলের কাব্যে সমুজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়েছে চিরকল্যাণময়ী নারীর শতরূপ। প্রেম, মমতা, বুদ্ধিমত্তা, সৌন্দর্য ও শৌর্যবীর্যের কথা রূপায়িত হয়েছে তার লেখায়। তিনি লিখেছেন :
নর নহে, নারী, ইসলাম, পরে প্রথম আনে ঈমান
আম্মা খাদিজা জগতে সর্বপ্রথম মুসলমান।
পুরুষের সব গৌরব ম্লান, এই এক মহিমায়।
তার শ্যামা সঙ্গীতেও মায়ের প্রতি ভক্তিরসের ধারা প্রবহমান_
ভক্তি, আমার ধূপের মত
ঊধর্ে্ব উঠে অবিরত
শিবলোকের দেব দেউলে
মা'র শ্রীচরণ পরশিতে।
নজরুল আরও লিখেছেন :
কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
অর্থাৎ নজরুল এখন থেকে প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে পরাধীন সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্য লক্ষ্য করেছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগে একটি স্বাধীন দেশে এখনও কি নারীরা সমান অধিকার বা মর্যাদা ভোগের সুযোগ পাচ্ছেন? আর নারীর অধিকার কিছুটা সমুন্নত করতে উদ্যোগী হলে আজও এ দেশে প্রবল বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা করতে হয়। তবে যত বাধাই আসুক বাংলাদেশে নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা বদ্ধপরিকর।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার অনন্য প্রতীক নজরুল বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি যুগবাণী, ধূমকেতু, লাঙল, গণবাণী ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আরও ছিলেন খ্যাতিমান নাট্যকার, দক্ষ অভিনেতা ও চলচ্চিত্রকার এবং একজন সফল সমাজসংস্কারক। তার গুণ ও অবদানের কথা বলতে গেলে বহু সময়ের প্রয়োজন। হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাসে নজরুলই প্রথম ও শেষ বাঙালি, যিনি সৃজনশীল প্রতিভায় বাঙালি চেতনাকে সামগ্রিকভাবে ধারণ করতে সক্ষম হন। আর এসব কারণেই তিনি বাঙালির জাতীয় কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
একটি পরিশীলিত সমাজ ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার মাধ্যমে আমরা তার প্রতি সত্যিকার অর্থে সম্মান প্রদর্শন করতে পারি।
মোঃ জিল্লুর রহমান : বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি
No comments