কালান্তরের কড়চা-আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে তাড়ালেই কি বিশ্বব্যাংকের অর্থ পাওয়া যেত? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু নিয়ে সরকার শেষ পর্যন্ত একটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। সিদ্ধান্তটি হলো, তারা আর বিশ্বব্যাংকের অর্থ সাহায্যের জন্য ধরনা দেবে না। সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করবে। এটি একটি সুসিদ্ধান্ত ও সময়োচিত সিদ্ধান্ত।
এখন লক্ষ রাখতে হবে, এই প্রকল্পের জন্য অভ্যন্তরীণভাবে অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে গরিবের ওপর যেন ট্যাক্সের বোঝা না বাড়ে। মোবাইল ফোনের ওপর আরো চাপ সৃষ্টি বা ব্রিজ ট্যাক্স নামে সাধারণ মানুষের ওপর নতুন কোনো কর না চাপিয়ে সরকার কি ওয়েলথ ট্যাক্স প্রবর্তনের কথা ভেবে দেখেছে?
আমাদের দেশে নব্যধনীর সংখ্যা এখন প্রচুর। পাকিস্তানে একসময় ছিল ২৩ পরিবার। বাংলাদেশে নব্যধনী পরিবারের সংখ্যা ২৩ হাজার বললেও সংখ্যাটিকে খুব ছোট করে বলা হবে। এই ধনীদের ওপর ওয়েলথ ট্যাক্স বা সম্পদ কর আরোপ করা হলে সেতু প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের একটা বড় অংশ পাওয়া যাবে বলে আমার ধারণা। এ ব্যাপারে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও আপত্তি নেই।
সরকার ইচ্ছা করলে প্রাইজবন্ডের মতো ব্রিজবন্ডও প্রবর্তন করতে পারে। ব্রিটেনে বিভিন্ন চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানে যে ক্রমবর্ধমান বিপুল অর্থের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, তা মেটানোর জন্য ন্যাশনাল লটারি প্রবর্তন করা হয়েছে। তাতে বিপুল অর্থ সংগৃহীত হয়। বাংলাদেশ সরকার কেবল পদ্মা সেতুর জন্য এই ধরনের লটারির ব্যবস্থাও করতে পারে। আমি অর্থনীতিতে আনাড়ি। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থেকে এই কথাগুলো লিখলাম। অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেবের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ, তিনি বিশ্বব্যাংকের মতো মায়ামৃগীর পেছনে আর বেশি ছোটাছুটি না করে নিজেদের শক্তি ও সম্পদের দিকে তাকাবেন। তিনি তো রবীন্দ্রকাব্যের একজন ভক্ত। রবীন্দ্রনাথ এই ধরনের সমস্যায় কী বলেছেন তিনি তো জানেন।
'বারে বারে ঠেলতে হবে হয় তো দুয়ার খুলবে না,
তা বলে ভাবনা করা চলবে না।'
অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের এখন করণীয় হবে, বিশ্বব্যাংকের কাছে আত্মমর্যাদা খুইয়ে আর ধরনা না দেওয়া। তারা যদি নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়নে এগিয়ে আসে ভালো কথা, না এলে তাদের ওয়াআলাইকুম সালাম বলে নিজেদের শক্তি ও সাহায্য দানে আগ্রহী মিত্র দেশ ও বিদেশি সংস্থার সহায়তায় ওপর নির্ভর করা। আমার মতো আনাড়ির ধারণা, তাহলে হাসিনা সরকার তাদের বর্তমান মেয়াদেই সেতুর কাজটি শুরু করতে পারবে।
বিশ্বব্যাংকের উদ্দেশ্যমূলক চোখ রাঙানির কাছে নতিস্বীকার না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহস ও আত্মমর্যাদাবোধের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের চোখ রাঙানিকে পরোয়া না করে তিনি ভালো কাজ করলেও একটি ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণের জন্য তাঁকে একটি কাজে আরো সাহস ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে। সেটি হলো পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, সে সম্পর্কে সরকারের তরফ থেকে আরো স্বচ্ছ ও কঠোর তদন্তের ব্যবস্থা করা এবং এ ব্যাপারে কারো সামান্য দুর্নীতিও ধরা পড়লে তার জন্য কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করা।
তাতে বিশ্বব্যাংকের কাছে নতিস্বীকার না করেও তাদের অভিযোগ যে বাংলাদেশ সরকার হেলায় উড়িয়ে দেয়নি এটা প্রমাণ করা হবে এবং দেশের জনগণকেও আশ্বস্ত করা যাবে যে পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে তাদের শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। দুর্নীতি সম্পর্কে এই শঙ্কাটি দূর করা গেলে দেশের ও বিদেশের বিনিয়োগকারীদেরও এই সেতু প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগে আগ্রহী করে তোলা যাবে। তারা নিঃশঙ্ক মনে অর্থ বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। তাদের অর্থ নিয়ে যে নয়-ছয় হবে না- এ সম্পর্কে তারা নিশ্চিন্ত থাকবে।
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যে প্রচারণাটি এখনো বন্ধ হয়নি, তা হলো বিশ্বব্যাংক বারবার দুর্নীতি সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য তাগাদা দিলেও সরকার তাতে আগ্রহ দেখায়নি। দ্বিতীয়ত, তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ ও দুর্নীতির দায়ে শাস্তি দেওয়ার নির্দেশটিকেও পাত্তা দেওয়া হয়নি। দুটি প্রচারণাই কষ্টকল্পিত। এই প্রচারণা বিএনপি-জামায়াত ও তাদের অনুগ্রহভোগী কিছু কুবুদ্ধিজীবীকে গলাবাজি (ও কলমবাজি) করার সুযোগ দেওয়া ছাড়া দেশের কোনো কল্যাণে আসেনি। বরং পদ্মা সেতু নির্মাণের সম্ভাবনাকে তা বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছে।
লোকটির মনে চুরি করার উদ্দেশ্য ছিল, এই অভিযোগে কোনো আদালত কাউকে সাজা দেন না। দিতে পারেন না। পদ্মা সেতুর মতো বিরাট প্রকল্পেও নানা ধরনের এজেন্ট, কনট্রাক্টর, সাবকনট্র্রাক্টর দুর্নীতি করার উদ্যোগ নিয়ে থাকতে পারে (এখন তদন্তে দেখা যাচ্ছে, তাতে বিশ্বব্যাংকেরও একটি সুপারিশ ছিল)। কিন্তু যে প্রকল্পে এখনো একটি পয়সাও বিশ্বব্যাংক দেয়নি, সেখানে দুর্নীতি হলো কী করে? দুর্নীতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল- শুধু এ জন্যই কি মন্ত্রী আবুল হোসেনকে শাস্তি দিতে হবে? এটা বিশ্বব্যাংকের হুকুম। তাই সরকারকে মানতে হবে?
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে আগে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। সে জন্য তিনি শাস্তিও পেয়েছেন। গতবারের হাসিনা সরকার থেকে পাসপোর্ট ব্যবহার সংক্রান্ত এক অভিযোগে তাঁকে মন্ত্রিত্ব হারাতে হয়েছিল। বর্তমান মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি। তাহলে কি আগের অভিযোগের ভিত্তিতেই তাঁকে চিরকালের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে রাখতে হবে?
ভারত থেকে শুরু করে বহু দেশে দুর্নীতি বা অন্য কোনো অভিযোগে রাজনীতি ও মন্ত্রিত্ব থেকে সরে যাওয়া বহু ব্যক্তি রাজনীতি ও মন্ত্রিত্বে ফিরে এসেছেন। কেন, আমাদের দেশে ব্যারিস্টার মওদুদ কি দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে জেল খেটেও জিয়া, এরশাদ, খালেদার আমলে বারবার মন্ত্রী হননি? খালেদা জিয়ার গত মন্ত্রিসভায় খুনের আসামি, পুলিশের তালিকাভুক্ত চোরাচালানি, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীকে 'মাননীয় মন্ত্রী' হতে দেখা যায়নি? তখন তো এক শ্রেণীর টকশোঅলা ও কলমবাজকে এত গলাবাজি ও কলমবাজি করতে দেখা যায়নি।
তবু এবার বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগাযোগ ও পদ্মা সেতু-সংক্রান্ত দায়িত্ব থেকে আবুল হোসেনকে অব্যাহতি দিয়ে তাঁকে অন্য একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করেন। দুর্নীতি সম্পর্কেও দুদককে তদন্তের ভার দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের আর তর সয়নি। এই তদন্ত চলার মাঝখানেই তারা পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রধান যে সিদ্ধান্তটি নেন, নতুন প্রধান দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে কোনো খোঁজখবর নেওয়ার আগেই এই সিদ্ধান্ত সমীচীন বলে ঘোষণা করেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এটা তোতা পাখিকে শেখানো বুলি এবং পূর্বপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত।
পদ্মা সেতু-সংক্রান্ত বর্তমান সংকটের জন্য হাসিনা সরকারই দায়ী এবং আবুল হোসেনের মন্ত্রিপদ বদল নয়, তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকেই অপসারণ করে তাঁর টাকা-পয়সা জব্দ করলেই বিশ্বব্যাংক খুশি হয়ে বরাদ্দ অর্থ বাংলাদেশকে দিত- এমন একটা প্রচারণা বাংলাদেশে জোরেশোরে চালানো হচ্ছে। প্রচারণাটি যাঁরা চালাচ্ছেন, তাঁরা নিজেরাও জানেন, তাঁদের প্রচারণা সত্য নয়।
পদ্মা সেতুতে অর্থ বন্ধ করে বিশ্বব্যাংক ও আমেরিকা বাংলাদেশের ওপর তাদের নানা স্বার্থ আদায়ের চাপ সৃষ্টি করতে চায়। অনেকের বিশ্বাস ও অভিযোগ, এর পেছনে হিলারি-বান্ধব আমাদের নোবেলজয়ীরও কলকাঠি নাড়ানো আছে। যে গ্রামীণ ব্যাংকে আমেরিকার এক পয়সা ইনভেস্টমেন্ট নেই, তার ভালোমন্দ ভেবে আমেরিকা চিন্তায় অস্থির; আর পদ্মা সেতু নিয়ে যে দুর্নীতি এখনো হয়নি, সেই দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তারা রজ্জুতে সর্পভ্রম করছেন।
আমেরিকা ও বিশ্বব্যাংকের উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হলে, তাদের চাপের কাছে মাথা নত না করলে একটা কেন, দশটা আবুল হোসেনকেও মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংক থেকে টাকা আনতে পারবেন না। অতীত থেকে একটা উদাহরণ দিই। বঙ্গবন্ধুর সরকারে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন ওয়াশিংটনের চোখের কাঁটা। তাঁকে তখনকার মস্কো-দিল্লি শক্তিশিবিরের মিত্র মনে করা হতো এবং তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণের জন্য বঙ্গবন্ধু-সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ ছিল।
তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি কেন, কোনো ধরনের অপশাসনেরও অভিযোগ তোলা যায়নি। ফলে শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির চেষ্টা। টোকিওতে দেওয়া তাজউদ্দীন আহমদের বক্তৃতার একটি বিকৃত ভাষ্য বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া হয় এবং সেটি সঠিক বলে বঙ্গবন্ধুকে জানান ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
দেশে তখন অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টির জন্য খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল। মহাপ্লাবনে দেশের বেশির ভাগ এলাকা ডুবে গিয়েছিল। দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় বঙ্গবন্ধু আমেরিকার সঙ্গে খাদ্য সরবরাহের চুক্তি করেন। এই খাদ্য চুক্তি নিয়েও আমেরিকা বাংলাদেশের ওপর অনৈতিক চাপ সৃষ্টি শুরু করে।
এই সংকট সৃষ্টির আগে থেকেই বিশেষ মহল থেকে বলা হচ্ছিল, অর্থমন্ত্রী পদ থেকে তাজউদ্দীন আহমদকে সরানো হলে বাংলাদেশে মার্কিন সাহায্যের সব বাধা দূর হতো। তাজউদ্দীন আহমদ দেশে সংকট সৃষ্টি হওয়ার আগেই পদত্যাগে বাধ্য হন। তাতে প্রতিশ্রুত খাদ্য সাহায্য আসেনি। মার্কিন ম্যাগাজিন 'ফরেন অ্যাফেয়ার্সে' পরে স্বীকার করা হয়েছে, খাদ্যভর্তি জাহাজগুলো আমেরিকা হাই সি-তে নোঙর করে রেখেছিল। আর অপেক্ষা করছিল বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ঘটুক। মুজিবসরকার জনপ্রিয়তা হারাক এবং তার পতন ঘটুক। তাদের আশা পূর্ণ হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদও ওয়াশিংটনের চক্ষুশূল ছিলেন। কারণ, তাঁরও খায়খাতির বেশি ছিল তৎকালীন মস্কো-দিল্লি শক্তিশিবিরের সঙ্গে। তাঁকে কৃষিমন্ত্রী পদে সরিয়ে দিয়ে 'আমেরিকার নয়নমণি' বলে পরিচিত ড. কামাল হোসেনকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে বসানো হয়েছিল। তা মুজিব-হত্যার পরিকল্পনায় সিআইএ'র সহায়তা দান বন্ধ করেনি। এখন তো আবার বাংলাদেশে আমেরিকার আরো বড় নয়নমণি ড. ইউনূসের আবির্ভাব হয়েছে।
বর্তমান হাসিনা সরকার বিশ্বব্যাংকের দাবি মোতাবেক আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সম্পূর্ণ বাদ দিলেই পদ্মা সেতুর অর্থ পেত- এটা বিশ্বাস করা বোকামি। তাদের নেপথ্যের আসল উদ্দেশ্য সিদ্ধি না হলে এই সাহায্য আসত না অথবা ঝুলিয়ে রাখা হতো। উদ্দেশ্য সিদ্ধির কাজে আবুল হোসেন তাদের একটি স্কেপ গোট মাত্র। পদ্মা সেতু নির্মাণে হাসিনা সরকারকে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। বিশ্বব্যাংকের নিঃশর্ত সাহায্য যদি আসে আসুক, তা না হলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।
লন্ডন, ১০ জুলাই, মঙ্গলবার, ২০১২
আমাদের দেশে নব্যধনীর সংখ্যা এখন প্রচুর। পাকিস্তানে একসময় ছিল ২৩ পরিবার। বাংলাদেশে নব্যধনী পরিবারের সংখ্যা ২৩ হাজার বললেও সংখ্যাটিকে খুব ছোট করে বলা হবে। এই ধনীদের ওপর ওয়েলথ ট্যাক্স বা সম্পদ কর আরোপ করা হলে সেতু প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের একটা বড় অংশ পাওয়া যাবে বলে আমার ধারণা। এ ব্যাপারে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও আপত্তি নেই।
সরকার ইচ্ছা করলে প্রাইজবন্ডের মতো ব্রিজবন্ডও প্রবর্তন করতে পারে। ব্রিটেনে বিভিন্ন চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানে যে ক্রমবর্ধমান বিপুল অর্থের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, তা মেটানোর জন্য ন্যাশনাল লটারি প্রবর্তন করা হয়েছে। তাতে বিপুল অর্থ সংগৃহীত হয়। বাংলাদেশ সরকার কেবল পদ্মা সেতুর জন্য এই ধরনের লটারির ব্যবস্থাও করতে পারে। আমি অর্থনীতিতে আনাড়ি। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থেকে এই কথাগুলো লিখলাম। অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেবের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ, তিনি বিশ্বব্যাংকের মতো মায়ামৃগীর পেছনে আর বেশি ছোটাছুটি না করে নিজেদের শক্তি ও সম্পদের দিকে তাকাবেন। তিনি তো রবীন্দ্রকাব্যের একজন ভক্ত। রবীন্দ্রনাথ এই ধরনের সমস্যায় কী বলেছেন তিনি তো জানেন।
'বারে বারে ঠেলতে হবে হয় তো দুয়ার খুলবে না,
তা বলে ভাবনা করা চলবে না।'
অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের এখন করণীয় হবে, বিশ্বব্যাংকের কাছে আত্মমর্যাদা খুইয়ে আর ধরনা না দেওয়া। তারা যদি নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়নে এগিয়ে আসে ভালো কথা, না এলে তাদের ওয়াআলাইকুম সালাম বলে নিজেদের শক্তি ও সাহায্য দানে আগ্রহী মিত্র দেশ ও বিদেশি সংস্থার সহায়তায় ওপর নির্ভর করা। আমার মতো আনাড়ির ধারণা, তাহলে হাসিনা সরকার তাদের বর্তমান মেয়াদেই সেতুর কাজটি শুরু করতে পারবে।
বিশ্বব্যাংকের উদ্দেশ্যমূলক চোখ রাঙানির কাছে নতিস্বীকার না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহস ও আত্মমর্যাদাবোধের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের চোখ রাঙানিকে পরোয়া না করে তিনি ভালো কাজ করলেও একটি ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণের জন্য তাঁকে একটি কাজে আরো সাহস ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে। সেটি হলো পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, সে সম্পর্কে সরকারের তরফ থেকে আরো স্বচ্ছ ও কঠোর তদন্তের ব্যবস্থা করা এবং এ ব্যাপারে কারো সামান্য দুর্নীতিও ধরা পড়লে তার জন্য কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করা।
তাতে বিশ্বব্যাংকের কাছে নতিস্বীকার না করেও তাদের অভিযোগ যে বাংলাদেশ সরকার হেলায় উড়িয়ে দেয়নি এটা প্রমাণ করা হবে এবং দেশের জনগণকেও আশ্বস্ত করা যাবে যে পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে তাদের শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। দুর্নীতি সম্পর্কে এই শঙ্কাটি দূর করা গেলে দেশের ও বিদেশের বিনিয়োগকারীদেরও এই সেতু প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগে আগ্রহী করে তোলা যাবে। তারা নিঃশঙ্ক মনে অর্থ বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। তাদের অর্থ নিয়ে যে নয়-ছয় হবে না- এ সম্পর্কে তারা নিশ্চিন্ত থাকবে।
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যে প্রচারণাটি এখনো বন্ধ হয়নি, তা হলো বিশ্বব্যাংক বারবার দুর্নীতি সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য তাগাদা দিলেও সরকার তাতে আগ্রহ দেখায়নি। দ্বিতীয়ত, তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ ও দুর্নীতির দায়ে শাস্তি দেওয়ার নির্দেশটিকেও পাত্তা দেওয়া হয়নি। দুটি প্রচারণাই কষ্টকল্পিত। এই প্রচারণা বিএনপি-জামায়াত ও তাদের অনুগ্রহভোগী কিছু কুবুদ্ধিজীবীকে গলাবাজি (ও কলমবাজি) করার সুযোগ দেওয়া ছাড়া দেশের কোনো কল্যাণে আসেনি। বরং পদ্মা সেতু নির্মাণের সম্ভাবনাকে তা বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছে।
লোকটির মনে চুরি করার উদ্দেশ্য ছিল, এই অভিযোগে কোনো আদালত কাউকে সাজা দেন না। দিতে পারেন না। পদ্মা সেতুর মতো বিরাট প্রকল্পেও নানা ধরনের এজেন্ট, কনট্রাক্টর, সাবকনট্র্রাক্টর দুর্নীতি করার উদ্যোগ নিয়ে থাকতে পারে (এখন তদন্তে দেখা যাচ্ছে, তাতে বিশ্বব্যাংকেরও একটি সুপারিশ ছিল)। কিন্তু যে প্রকল্পে এখনো একটি পয়সাও বিশ্বব্যাংক দেয়নি, সেখানে দুর্নীতি হলো কী করে? দুর্নীতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল- শুধু এ জন্যই কি মন্ত্রী আবুল হোসেনকে শাস্তি দিতে হবে? এটা বিশ্বব্যাংকের হুকুম। তাই সরকারকে মানতে হবে?
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে আগে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। সে জন্য তিনি শাস্তিও পেয়েছেন। গতবারের হাসিনা সরকার থেকে পাসপোর্ট ব্যবহার সংক্রান্ত এক অভিযোগে তাঁকে মন্ত্রিত্ব হারাতে হয়েছিল। বর্তমান মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি। তাহলে কি আগের অভিযোগের ভিত্তিতেই তাঁকে চিরকালের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে রাখতে হবে?
ভারত থেকে শুরু করে বহু দেশে দুর্নীতি বা অন্য কোনো অভিযোগে রাজনীতি ও মন্ত্রিত্ব থেকে সরে যাওয়া বহু ব্যক্তি রাজনীতি ও মন্ত্রিত্বে ফিরে এসেছেন। কেন, আমাদের দেশে ব্যারিস্টার মওদুদ কি দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে জেল খেটেও জিয়া, এরশাদ, খালেদার আমলে বারবার মন্ত্রী হননি? খালেদা জিয়ার গত মন্ত্রিসভায় খুনের আসামি, পুলিশের তালিকাভুক্ত চোরাচালানি, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীকে 'মাননীয় মন্ত্রী' হতে দেখা যায়নি? তখন তো এক শ্রেণীর টকশোঅলা ও কলমবাজকে এত গলাবাজি ও কলমবাজি করতে দেখা যায়নি।
তবু এবার বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগাযোগ ও পদ্মা সেতু-সংক্রান্ত দায়িত্ব থেকে আবুল হোসেনকে অব্যাহতি দিয়ে তাঁকে অন্য একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করেন। দুর্নীতি সম্পর্কেও দুদককে তদন্তের ভার দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের আর তর সয়নি। এই তদন্ত চলার মাঝখানেই তারা পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রধান যে সিদ্ধান্তটি নেন, নতুন প্রধান দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে কোনো খোঁজখবর নেওয়ার আগেই এই সিদ্ধান্ত সমীচীন বলে ঘোষণা করেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এটা তোতা পাখিকে শেখানো বুলি এবং পূর্বপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত।
পদ্মা সেতু-সংক্রান্ত বর্তমান সংকটের জন্য হাসিনা সরকারই দায়ী এবং আবুল হোসেনের মন্ত্রিপদ বদল নয়, তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকেই অপসারণ করে তাঁর টাকা-পয়সা জব্দ করলেই বিশ্বব্যাংক খুশি হয়ে বরাদ্দ অর্থ বাংলাদেশকে দিত- এমন একটা প্রচারণা বাংলাদেশে জোরেশোরে চালানো হচ্ছে। প্রচারণাটি যাঁরা চালাচ্ছেন, তাঁরা নিজেরাও জানেন, তাঁদের প্রচারণা সত্য নয়।
পদ্মা সেতুতে অর্থ বন্ধ করে বিশ্বব্যাংক ও আমেরিকা বাংলাদেশের ওপর তাদের নানা স্বার্থ আদায়ের চাপ সৃষ্টি করতে চায়। অনেকের বিশ্বাস ও অভিযোগ, এর পেছনে হিলারি-বান্ধব আমাদের নোবেলজয়ীরও কলকাঠি নাড়ানো আছে। যে গ্রামীণ ব্যাংকে আমেরিকার এক পয়সা ইনভেস্টমেন্ট নেই, তার ভালোমন্দ ভেবে আমেরিকা চিন্তায় অস্থির; আর পদ্মা সেতু নিয়ে যে দুর্নীতি এখনো হয়নি, সেই দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তারা রজ্জুতে সর্পভ্রম করছেন।
আমেরিকা ও বিশ্বব্যাংকের উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হলে, তাদের চাপের কাছে মাথা নত না করলে একটা কেন, দশটা আবুল হোসেনকেও মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংক থেকে টাকা আনতে পারবেন না। অতীত থেকে একটা উদাহরণ দিই। বঙ্গবন্ধুর সরকারে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন ওয়াশিংটনের চোখের কাঁটা। তাঁকে তখনকার মস্কো-দিল্লি শক্তিশিবিরের মিত্র মনে করা হতো এবং তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণের জন্য বঙ্গবন্ধু-সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ ছিল।
তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি কেন, কোনো ধরনের অপশাসনেরও অভিযোগ তোলা যায়নি। ফলে শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির চেষ্টা। টোকিওতে দেওয়া তাজউদ্দীন আহমদের বক্তৃতার একটি বিকৃত ভাষ্য বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া হয় এবং সেটি সঠিক বলে বঙ্গবন্ধুকে জানান ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
দেশে তখন অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টির জন্য খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল। মহাপ্লাবনে দেশের বেশির ভাগ এলাকা ডুবে গিয়েছিল। দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় বঙ্গবন্ধু আমেরিকার সঙ্গে খাদ্য সরবরাহের চুক্তি করেন। এই খাদ্য চুক্তি নিয়েও আমেরিকা বাংলাদেশের ওপর অনৈতিক চাপ সৃষ্টি শুরু করে।
এই সংকট সৃষ্টির আগে থেকেই বিশেষ মহল থেকে বলা হচ্ছিল, অর্থমন্ত্রী পদ থেকে তাজউদ্দীন আহমদকে সরানো হলে বাংলাদেশে মার্কিন সাহায্যের সব বাধা দূর হতো। তাজউদ্দীন আহমদ দেশে সংকট সৃষ্টি হওয়ার আগেই পদত্যাগে বাধ্য হন। তাতে প্রতিশ্রুত খাদ্য সাহায্য আসেনি। মার্কিন ম্যাগাজিন 'ফরেন অ্যাফেয়ার্সে' পরে স্বীকার করা হয়েছে, খাদ্যভর্তি জাহাজগুলো আমেরিকা হাই সি-তে নোঙর করে রেখেছিল। আর অপেক্ষা করছিল বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ঘটুক। মুজিবসরকার জনপ্রিয়তা হারাক এবং তার পতন ঘটুক। তাদের আশা পূর্ণ হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদও ওয়াশিংটনের চক্ষুশূল ছিলেন। কারণ, তাঁরও খায়খাতির বেশি ছিল তৎকালীন মস্কো-দিল্লি শক্তিশিবিরের সঙ্গে। তাঁকে কৃষিমন্ত্রী পদে সরিয়ে দিয়ে 'আমেরিকার নয়নমণি' বলে পরিচিত ড. কামাল হোসেনকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে বসানো হয়েছিল। তা মুজিব-হত্যার পরিকল্পনায় সিআইএ'র সহায়তা দান বন্ধ করেনি। এখন তো আবার বাংলাদেশে আমেরিকার আরো বড় নয়নমণি ড. ইউনূসের আবির্ভাব হয়েছে।
বর্তমান হাসিনা সরকার বিশ্বব্যাংকের দাবি মোতাবেক আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সম্পূর্ণ বাদ দিলেই পদ্মা সেতুর অর্থ পেত- এটা বিশ্বাস করা বোকামি। তাদের নেপথ্যের আসল উদ্দেশ্য সিদ্ধি না হলে এই সাহায্য আসত না অথবা ঝুলিয়ে রাখা হতো। উদ্দেশ্য সিদ্ধির কাজে আবুল হোসেন তাদের একটি স্কেপ গোট মাত্র। পদ্মা সেতু নির্মাণে হাসিনা সরকারকে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। বিশ্বব্যাংকের নিঃশর্ত সাহায্য যদি আসে আসুক, তা না হলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।
লন্ডন, ১০ জুলাই, মঙ্গলবার, ২০১২
No comments