বহে কাল নিরবধি-সালমান তাসিরের হত্যাকাণ্ড এবং নৃশংসতার একটি ব্যবচ্ছেদ by এম আবদুল হাফিজ
জিন্নাহ সাহেব দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম দিলেও এ প্রক্রিয়ায় ধর্মের ভূমিকা সামান্যই ছিল এবং পাকিস্তানের স্রষ্টাও কোনো ধর্মান্ধ উগ্রপন্থী ছিলেন না। উপমহাদেশের মুসলমানদের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণে ও তাদের নিরাপত্তা বিধানের তাগিদে তাদের জন্য একটি ভিন্ন রাষ্ট্রের তাগিদ অনুভব করলেও তিনি ছিলেন জীবনযাপনে
আধুনিক এবং সেক্যুলার মনোভাবের মানুষ। তাই পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি তাঁর উদ্বোধনী ভাষণেই নতুন রাষ্ট্রের প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীর জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করেছিলেন। দুই যুগের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এ নিবন্ধকারেরও উপলব্ধি হয়েছে, একটি রক্তস্নাত অভ্যুদয় সত্ত্বেও পাকিস্তানের অধিবাসী প্রচণ্ডভাবে ধর্মপ্রাণ, না জিহাদি উন্মাদনায় জীবনবিমুখ। তাদের ধর্ম সম্পৃক্ততা বহুলাংশে তাদের রাজনৈতিক ফায়দা ওঠানোর তাগিদে নিয়ন্ত্রিত হতো।
দেশবিভাগ-পূর্ব আমলে অবিভক্ত ভারতবর্ষে সংগত কারণেই একই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বলে কিছু ছিল না। দেশজুড়েই বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ তাদের জীবিকা ও পেশা অনুযায়ী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। সেই সুবাদে এখনকার পাকিস্তান ভূখণ্ডেও নানা জাতি, ভাষাভাষী ও ধর্মাবলম্বীর বসবাস ছিল, যেমন ছিল বর্তমানের ভারতীয় ভূখণ্ডেও। ছিল বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নানা জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মানুসারীদের বসতি। উভয় দেশের লোকরা সর্বজনীনভাবে মাতৃ বা জন্মভূমিকে প্রচণ্ড ভালোবাসত।
দেশবিভাগের আগে তো বটেই, দেশবিভাগের সময় যখন অনেকে সত্যিকার অর্থে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়, তখনো সহজে তারা জন্মভূমি ছাড়তে চায়নি। ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের অবস্থান কিছুটা স্বতন্ত্র। তারা বহিরাগত হলেও তাদের মধ্যে বিশেষ করে মুসলমানরা ভারতে ৮০০ বছর রাজত্ব করেছিল। দিগ্বিজয়ী বেশে এলেও ভারতের মাটি ও মানুষকে তারা ভালোবেসেছিল এবং ভারতীয় সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছিল। তারা ভারতেরই স্থায়ী নাগরিকে পরিণত হয়েছিল এবং যে-ই যেখান থেকে এসে থাকুন না কেন, ভারত তার 'মহামানবের সাগর তীরে' তাদের উদার হস্ত প্রসারিত করেছিল। তাই দেখা যাবে, বন্ধুসুলভ ভারতকে দেশবিভাগের পরও অনেক মুসলমান ত্যাগ করতে চায়নি। তা ছাড়া ভারতে মুসলমানরা প্রশাসনের শত পক্ষপাতিত্ব সত্ত্বেও রীতিমতো একটি শক্তি। ভারতের বিলিয়ন প্লাস জনগোষ্ঠীর প্রায় ১২ শতাংশই মুসলমান। একসময়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, 'মুসলিম' দেশ পাকিস্তানের জনসংখ্যার চেয়ে ভারতের মুসলমানদের সংখ্যা বেশি ছিল। আশ্চার্য নয় যে, সে সময় ভারত সরকার ওআইসির সদস্যপদের জন্য চেষ্টা করেছিল। 'হিন্দু' ভারতের স্থপতিদের মধ্যে মওলানা আজাদের মতো ব্যক্তিত্বও ছিলেন।
পাকিস্তানে দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানকার হিন্দু বা খ্রিস্টানদের এমন কোনো সমীকরণ তৈরি হতে পারেনি। সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং সীমান্ত প্রদেশের কোথাও কোথাও অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বীর শুধু বসবাস ছিল না, ব্রিটিশ আমলে আন্তঃসম্প্রদায় সম্প্রীতি প্রবাদতুল্য ছিল। যাযাবরের বিখ্যাত উপন্যাস দৃষ্টিপাতের নায়িকা সুনন্দা আধারকর প্রেমের পটভূমিই ছিল লাহোরের মুসলমান রমণীরা সেকালের বিখ্যাত হোটেল ফ্ল্যাটিসে বা জিমখানায় হিন্দু-পুরুষদের সঙ্গে যুগল নৃত্যে লিপ্ত হতো। ল্যারি ডমিনিকের 'ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট' বইতে এসব তথ্যলিপি আছে। রাওয়ালপিন্ডি ক্লাবে খ্রিস্টান তরুণীরা চৌকস সেনা অফিসারদের সঙ্গে কণ্ঠলগ্না হয়ে ট্যাঙ্গো নাচ করত।
শংকরের বিখ্যাত উপন্যাস মরুতীর্থ হিংলাজ ব্যাপকভাবে পঠিত। আমি এর চলচ্চিত্র রূপটিও দেখেছি। হিন্দুদের এ বিখ্যাত তীর্থস্থান বেলুচিস্তানে অবস্থিত এবং তা ওই প্রদেশটিতে হিন্দু উপস্থিতিরই ইঙ্গিত বহন করে। জানি না, তারা এখন কোথায় হারিয়ে গেছে। তবে পাকিস্তানে খ্রিস্টানরা এখনো একেবারে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়নি এবং এরাই এখন পাকিস্তানে ধর্মান্ধদের টার্গেট।
জিন্নাহর আদর্শের বিপরীতে তাঁরই প্রধানমন্ত্রী সর্বপ্রথম রাজনীতিতে ধর্মের মিশ্রণ ঘটান, অসদুদ্দেশ্যে অর্থাৎ অঞ্চল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তিবিশেষের জন্য ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে। তিনিই প্রথম পাকিস্তানে সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে যে মূলনীতি বা ঙনলবপঃরাব জবংড়ষঁঃরড়হ প্রণয়ন করেন, সেটাই ছিল ধর্ম এবং ক্ষমতা একত্রীকরণের মৌতাত। এ মৌতাতে আসক্ত পাকিস্তানে শাসকরা আর তা বহন করতে পারেননি। সামরিক হোক বা বেসমারিক, পাকিস্তানের ক্ষমতালোভীরা একের পর এক ধর্মান্ধতার এই ঐতিহ্য সৃষ্টি করে প্রথমে ক্ষমতা দখল ও পরে তাকে বৈধ করেছেন। ধর্মকে হাতিয়ার করে সবচেয়ে লাভবান হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক, যিনি পাকিস্তানিদের ব্লাসফেমি আইন 'উপহার' দিয়ে পাকিস্তানে ধর্মীয় উগ্রতাকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানে সবচেয়ে জনবহুল ও প্রভাবশালী প্রদেশ পাঞ্জাবের গভর্নর এবং বহুগুণে গুণান্বিত সালমান তাসির এ ব্লাসফেমি আইন সমালোচনার শিকার। ইতিমধ্যে ধর্ম তার ভূমিকায় জেঁকে বসে। সেই পঞ্চাশের দশকে যে ধর্মান্ধতা পাকিস্তানের রাজনীতিতে স্থান করে নিয়েছিল, পাকিস্তানিরা শুধু এঙ্পেডিয়েন্সির খাতিরে তার লালন করেছিল এবং তাকে একটি ভয়ংকর দানবে পরিণত হতে সুযোগ করে দিয়েছিল, এমনকি একাত্তরের দুর্বিপাকের পর যখন ধর্মীয় রাজনীতির একটি স্তম্ভ দ্বিজাতিতত্ত্ব ভেঙে পড়েছে, তখন জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো প্রতিভাশালী নেতা ধর্মীয় রাজনীতি থেকেই পাকিস্তান পুনর্গঠনের পথ খুঁজছেন। স্মরণ করা যেতে পারে, কোনো বিশেষ শ্রেণীকে খুশি করে সত্তরের দশকের শেষ ভাগে আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করেছেন।
তবে ধর্মীয় উগ্রবাদ বলতে যা বোঝায় এবং যা মানুষের কনভিকশনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে, তাকে এক ভিন্ন সত্তায় পরিণত করে তার স্রষ্টা ছিলেন জিয়াউল হক, যার কাছে আধুনিক সংবেদনশীল, উচ্চশিক্ষিত এবং যৌক্তিক একজন রাজনীতিক সালমান তাসিরও পরাজয় মানেন। জিয়াউল হকেরই কীর্তি যে তিনি একজন মানুষকে কী পরিমাণ ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা এবং কাপুরুষতা শেখাতে পারেন যে তার আর বিশোধন নেই। ভুল করেও তো মানুষ অনুতপ্ত হতে পারে এবং তা হতে পারলে সে একটি উন্নত স্তরে আরোহণ করতে পারে, মহৎ হতে পারে ও চাইলে সমাজকে উথলে দিতে পারে। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ হন্তারক মমতাজ কাদরির মধ্যে নেই। কেননা তার তো মগজ এমনভাবে ধোলাই হয়ে গেছে যে তার সে চিন্তার পথগুলোই বন্ধ। শুধু তার নয়, কম হোক বা বেশি, যে মানুষগুলো তাকে বাহবা দিচ্ছে, তারাও সমাজ বা প্রজন্মের জন্য বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে না।
এলিট ফোর্সের কমান্ডো কাদরির চোখেমুখে প্রশান্তি। প্রশান্তি এ জন্য যে, সে এমন একজনকে হত্যা করেছে, যে অস্পৃশ্য এক খ্রিস্টান রমণী, যাকে সামান্য কারণে ব্লাসফেমি আইনে সাজা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার সাজা মওকুফের নানা পথ তালাশ করছে। এটুকুই ছিল তার অপরাধ। এমন অপরাধীকে হত্যা করে সে যে বেহেশতে তার স্থান করে নিয়েছে, সে সম্বন্ধে সে নিশ্চিত। সে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছে। তার এখন একটি ত্বরা-কত সত্বর সে এই নশ্বর ধাম ত্যাগ করতে পারবে। এই কট্টর দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীল গোষ্ঠীর কাছে আজ সমগ্র যুবসমাজ জিম্মি। এখানে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই, ভিন্নমত প্রকাশেরও সুযোগ নেই। ব্লাসফেসি আইন যতই মনুষ্য প্রণীত হোক না কেন, তা সংশোধন করা তো দূরের কথা, সেই ধারণা পোষণও ঘাতকের কাজ।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক,
বিআইআইএমএস ও কলামিস্ট
দেশবিভাগ-পূর্ব আমলে অবিভক্ত ভারতবর্ষে সংগত কারণেই একই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বলে কিছু ছিল না। দেশজুড়েই বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ তাদের জীবিকা ও পেশা অনুযায়ী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। সেই সুবাদে এখনকার পাকিস্তান ভূখণ্ডেও নানা জাতি, ভাষাভাষী ও ধর্মাবলম্বীর বসবাস ছিল, যেমন ছিল বর্তমানের ভারতীয় ভূখণ্ডেও। ছিল বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নানা জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মানুসারীদের বসতি। উভয় দেশের লোকরা সর্বজনীনভাবে মাতৃ বা জন্মভূমিকে প্রচণ্ড ভালোবাসত।
দেশবিভাগের আগে তো বটেই, দেশবিভাগের সময় যখন অনেকে সত্যিকার অর্থে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়, তখনো সহজে তারা জন্মভূমি ছাড়তে চায়নি। ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের অবস্থান কিছুটা স্বতন্ত্র। তারা বহিরাগত হলেও তাদের মধ্যে বিশেষ করে মুসলমানরা ভারতে ৮০০ বছর রাজত্ব করেছিল। দিগ্বিজয়ী বেশে এলেও ভারতের মাটি ও মানুষকে তারা ভালোবেসেছিল এবং ভারতীয় সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছিল। তারা ভারতেরই স্থায়ী নাগরিকে পরিণত হয়েছিল এবং যে-ই যেখান থেকে এসে থাকুন না কেন, ভারত তার 'মহামানবের সাগর তীরে' তাদের উদার হস্ত প্রসারিত করেছিল। তাই দেখা যাবে, বন্ধুসুলভ ভারতকে দেশবিভাগের পরও অনেক মুসলমান ত্যাগ করতে চায়নি। তা ছাড়া ভারতে মুসলমানরা প্রশাসনের শত পক্ষপাতিত্ব সত্ত্বেও রীতিমতো একটি শক্তি। ভারতের বিলিয়ন প্লাস জনগোষ্ঠীর প্রায় ১২ শতাংশই মুসলমান। একসময়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, 'মুসলিম' দেশ পাকিস্তানের জনসংখ্যার চেয়ে ভারতের মুসলমানদের সংখ্যা বেশি ছিল। আশ্চার্য নয় যে, সে সময় ভারত সরকার ওআইসির সদস্যপদের জন্য চেষ্টা করেছিল। 'হিন্দু' ভারতের স্থপতিদের মধ্যে মওলানা আজাদের মতো ব্যক্তিত্বও ছিলেন।
পাকিস্তানে দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানকার হিন্দু বা খ্রিস্টানদের এমন কোনো সমীকরণ তৈরি হতে পারেনি। সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং সীমান্ত প্রদেশের কোথাও কোথাও অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বীর শুধু বসবাস ছিল না, ব্রিটিশ আমলে আন্তঃসম্প্রদায় সম্প্রীতি প্রবাদতুল্য ছিল। যাযাবরের বিখ্যাত উপন্যাস দৃষ্টিপাতের নায়িকা সুনন্দা আধারকর প্রেমের পটভূমিই ছিল লাহোরের মুসলমান রমণীরা সেকালের বিখ্যাত হোটেল ফ্ল্যাটিসে বা জিমখানায় হিন্দু-পুরুষদের সঙ্গে যুগল নৃত্যে লিপ্ত হতো। ল্যারি ডমিনিকের 'ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট' বইতে এসব তথ্যলিপি আছে। রাওয়ালপিন্ডি ক্লাবে খ্রিস্টান তরুণীরা চৌকস সেনা অফিসারদের সঙ্গে কণ্ঠলগ্না হয়ে ট্যাঙ্গো নাচ করত।
শংকরের বিখ্যাত উপন্যাস মরুতীর্থ হিংলাজ ব্যাপকভাবে পঠিত। আমি এর চলচ্চিত্র রূপটিও দেখেছি। হিন্দুদের এ বিখ্যাত তীর্থস্থান বেলুচিস্তানে অবস্থিত এবং তা ওই প্রদেশটিতে হিন্দু উপস্থিতিরই ইঙ্গিত বহন করে। জানি না, তারা এখন কোথায় হারিয়ে গেছে। তবে পাকিস্তানে খ্রিস্টানরা এখনো একেবারে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়নি এবং এরাই এখন পাকিস্তানে ধর্মান্ধদের টার্গেট।
জিন্নাহর আদর্শের বিপরীতে তাঁরই প্রধানমন্ত্রী সর্বপ্রথম রাজনীতিতে ধর্মের মিশ্রণ ঘটান, অসদুদ্দেশ্যে অর্থাৎ অঞ্চল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তিবিশেষের জন্য ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে। তিনিই প্রথম পাকিস্তানে সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে যে মূলনীতি বা ঙনলবপঃরাব জবংড়ষঁঃরড়হ প্রণয়ন করেন, সেটাই ছিল ধর্ম এবং ক্ষমতা একত্রীকরণের মৌতাত। এ মৌতাতে আসক্ত পাকিস্তানে শাসকরা আর তা বহন করতে পারেননি। সামরিক হোক বা বেসমারিক, পাকিস্তানের ক্ষমতালোভীরা একের পর এক ধর্মান্ধতার এই ঐতিহ্য সৃষ্টি করে প্রথমে ক্ষমতা দখল ও পরে তাকে বৈধ করেছেন। ধর্মকে হাতিয়ার করে সবচেয়ে লাভবান হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক, যিনি পাকিস্তানিদের ব্লাসফেমি আইন 'উপহার' দিয়ে পাকিস্তানে ধর্মীয় উগ্রতাকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানে সবচেয়ে জনবহুল ও প্রভাবশালী প্রদেশ পাঞ্জাবের গভর্নর এবং বহুগুণে গুণান্বিত সালমান তাসির এ ব্লাসফেমি আইন সমালোচনার শিকার। ইতিমধ্যে ধর্ম তার ভূমিকায় জেঁকে বসে। সেই পঞ্চাশের দশকে যে ধর্মান্ধতা পাকিস্তানের রাজনীতিতে স্থান করে নিয়েছিল, পাকিস্তানিরা শুধু এঙ্পেডিয়েন্সির খাতিরে তার লালন করেছিল এবং তাকে একটি ভয়ংকর দানবে পরিণত হতে সুযোগ করে দিয়েছিল, এমনকি একাত্তরের দুর্বিপাকের পর যখন ধর্মীয় রাজনীতির একটি স্তম্ভ দ্বিজাতিতত্ত্ব ভেঙে পড়েছে, তখন জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো প্রতিভাশালী নেতা ধর্মীয় রাজনীতি থেকেই পাকিস্তান পুনর্গঠনের পথ খুঁজছেন। স্মরণ করা যেতে পারে, কোনো বিশেষ শ্রেণীকে খুশি করে সত্তরের দশকের শেষ ভাগে আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করেছেন।
তবে ধর্মীয় উগ্রবাদ বলতে যা বোঝায় এবং যা মানুষের কনভিকশনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে, তাকে এক ভিন্ন সত্তায় পরিণত করে তার স্রষ্টা ছিলেন জিয়াউল হক, যার কাছে আধুনিক সংবেদনশীল, উচ্চশিক্ষিত এবং যৌক্তিক একজন রাজনীতিক সালমান তাসিরও পরাজয় মানেন। জিয়াউল হকেরই কীর্তি যে তিনি একজন মানুষকে কী পরিমাণ ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা এবং কাপুরুষতা শেখাতে পারেন যে তার আর বিশোধন নেই। ভুল করেও তো মানুষ অনুতপ্ত হতে পারে এবং তা হতে পারলে সে একটি উন্নত স্তরে আরোহণ করতে পারে, মহৎ হতে পারে ও চাইলে সমাজকে উথলে দিতে পারে। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ হন্তারক মমতাজ কাদরির মধ্যে নেই। কেননা তার তো মগজ এমনভাবে ধোলাই হয়ে গেছে যে তার সে চিন্তার পথগুলোই বন্ধ। শুধু তার নয়, কম হোক বা বেশি, যে মানুষগুলো তাকে বাহবা দিচ্ছে, তারাও সমাজ বা প্রজন্মের জন্য বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে না।
এলিট ফোর্সের কমান্ডো কাদরির চোখেমুখে প্রশান্তি। প্রশান্তি এ জন্য যে, সে এমন একজনকে হত্যা করেছে, যে অস্পৃশ্য এক খ্রিস্টান রমণী, যাকে সামান্য কারণে ব্লাসফেমি আইনে সাজা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার সাজা মওকুফের নানা পথ তালাশ করছে। এটুকুই ছিল তার অপরাধ। এমন অপরাধীকে হত্যা করে সে যে বেহেশতে তার স্থান করে নিয়েছে, সে সম্বন্ধে সে নিশ্চিত। সে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছে। তার এখন একটি ত্বরা-কত সত্বর সে এই নশ্বর ধাম ত্যাগ করতে পারবে। এই কট্টর দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীল গোষ্ঠীর কাছে আজ সমগ্র যুবসমাজ জিম্মি। এখানে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই, ভিন্নমত প্রকাশেরও সুযোগ নেই। ব্লাসফেসি আইন যতই মনুষ্য প্রণীত হোক না কেন, তা সংশোধন করা তো দূরের কথা, সেই ধারণা পোষণও ঘাতকের কাজ।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক,
বিআইআইএমএস ও কলামিস্ট
No comments