অভিমত-বাজেট ও সামরিক খাত by মাহবুবুর রহমান

২০১২-১৩ সালের জাতীয় বাজেট আর কয়েক দিন পরে জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, এবারের বাজেট গত বছরের জাতীয় বাজেটের মতোই বিশাল ঢাউস বাজেট হবে। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে দেখছি দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক (macro economy) অবস্থা ক্রমাগত ভঙ্গুর।


জাতীয় প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) বিষয়ে অর্থনীতিবিদেরা হতাশাগ্রস্ত হচ্ছেন। আইএমএফ আশঙ্কা করছে, এ বছরের প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে। বর্তমানে জাতীয় বাজেটের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আমি মনে করি, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির বল্গাহীন অশ্ব দ্রুত বেগে ধাবমান। ইতিমধ্যে তা দুই ডিজিটে পৌঁছে গেছে। মূল্যস্ফীতি, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবী ও সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে ফেলেছে। তারা অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডলার ও ভারতীয় রুপির বিপরীতে টাকার মান ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। দেশের শেয়ারবাজারে ক্রমাগতভাবে ধস নেমেই চলেছে। হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাংকের তারল্যের সংকট। ব্যাংকগুলো থেকে প্রচুর অতিরিক্ত ঋণ গ্যাস ও বিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে দেওয়া হয়েছে। এসব ঋণ বহুলাংশেই স্থানান্তরিত হয়েছে। ঋণের বাজারে এক ভীষণ বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারল্যের সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। বিদেশি বিনিয়োগ অনেক আগে থেকেই বন্ধ হয়ে আছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের কাজে অত্যন্ত মন্থর গতি। প্রবাসী রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমতে কমতে প্রায় থেমে গেছে। এতসব প্রতিকূল বাস্তবতার মধ্যে অর্থমন্ত্রী সংসদে জাতীয় বাজেট ৭ জুনে উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন।
সরকারের উচিত হবে বাজেটকে বাস্তবসম্মত রাখা। শূন্যে অট্টালিকা তৈরি না করে স্বীয় অর্থনীতির ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে তাকে শক্তিশালী করা। ঋণং কৃতং ঘৃতং পিবেত মানসিকতা পরিহার করা। সরকারের উচিত হবে তার নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখিত দুর্নীতির মূল উৎপাটনের অঙ্গীকারকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তৎপর হওয়া। উচিত হবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকাণ্ডকে বেগবান করা, দুদককে কার্যকর ও শক্তিশালী করা। বিস্মিত হই যখন দেখি, দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বরাবর অসহায়ভাবে খেদোক্তি করে বলেন, ‘দুদক ইতিমধ্যে দন্তহীন ব্যাঘ্রে পরিণত হয়েছে। তার থাবার নখগুলো ছেঁটে ফেলা হয়েছে।’ সরকারের প্রয়োজন, জাতীয় ও সমাজ জীবনে আজ যে ভোগবাদী সংস্কৃতির বিস্তার ঘটছে, বিলাস ও জৌলুশ জীবনে বিত্তবানেরা আসক্ত হয়ে গোটা জাতিকে সংক্রমিত করছে, তাকে রোধ করা, সাধারণ জীবনযাপন ও কৃচ্ছ্রসাধনে উৎসাহিত করা। জাতীয় পর্যায়ের বিশাল অপচয়সমূহ বন্ধ করা। আর এর সূচনা হতে হবে রাষ্ট্রীয় ও সমাজের নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায় থেকে। মাত্র কয়েক শ মাইল দূরে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালে দেখি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা তাঁর পূর্বসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য এবং তাঁদের স্ব স্ব দলীয় রাজনৈতিক সহকর্মীরা সাধারণ জনগণের মধ্যে থেকেই তাঁদের মতোই অতি সাধারণ জীবনযাপন করেন।
শোনা যায়, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ এবারকার বাজেটেও থাকছে। কালোটাকার দৌরাত্ম্য ও তার বৈধকরণের সংসদীয় স্বীকৃতি জাতির জন্য অত্যন্ত ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনবে। আজ জাতীয় ও সমাজ জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমরা দুর্নীতি বিস্তারিত হতে দেখছি। দুর্নীতির অভিযোগে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থ সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছে। অভিযোগ এসেছে স্বয়ং সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। রেলমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও তেমনি অভিযোগ ওঠে এবং তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সম্প্রতি জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী ওকাদা সফর করে গেলেন। তিনি বাংলাদেশের দুর্নীতির বিস্তার ও ব্যাপকতায় গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন এবং সরকারকে দুর্নীতি দমনে পরামর্শ দেন। কালোটাকার উৎস দুর্নীতি এবং একমাত্র দুর্নীতি, যা আজ দেশে দানবীয় রূপ ধারণ করছে। প্রবহমান কালোটাকার বিষাক্ত কালো স্রোত গোটা জাতীয় অর্থনীতিকে কলুষিত করছে এবং তা জাতীয় সংসদের স্বীকৃতি নিয়ে, বৈধতা প্রাপ্ত হয়ে। এটা অনৈতিক, এটা মহা অন্যায়।

কৃষি ও শিক্ষা
জাতীয় বাজেটে অগ্রাধিকার খাতগুলো আমার মতে প্রথম কৃষি, দ্বিতীয় শিক্ষা। ১৬ কোটি মানুষ আমাদের দেশে। আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষক। কৃষক বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে। কৃষিতে আমাদের অনেক অর্জন আছে কিন্তু এখনো অনেক কিছু করার আছে। সম্ভাবনা অনেক। আমাদের কৃষি উৎপাদন চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম এসব আশপাশের দেশগুলো থেকে অনেক কম। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষককে উৎসাহিত করতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। প্রয়োজনে আরও বাড়াতে হবে। সার, বীজ, বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং তার মূল্যে অনেক সাশ্রয় আনতে হবে, সহজলভ্য করতে হবে। উৎপাদিত কৃষিপণ্যের বিক্রয়মূল্য কৃষকের স্বার্থের অনুকূল হতে হবে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করা এবং তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষাকে আরও ব্যাপক করা আজ জাতীয় প্রয়োজন। আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় আধুনিকায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির সংযোজন অত্যন্ত জরুরি। শ্রীলঙ্কা সার্কভুক্ত একটি দেশ। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের ভীষণ অস্থিরতার মধ্যেও সেখানে শিক্ষার হার ছিল ৯৭ শতাংশ। আমাদের সহস্রাব্দ উন্নয়ন গন্তব্যে ২০১৫ সালের মধ্যে পৌঁছাতে হলে সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হবে। দুর্বার গতির সঞ্চার করতে হবে। দুর্বৃত্তায়িত ও কলুষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ধুয়ে-মুছে সাফ করতে হবে, পবিত্র করতে হবে। থাকবে না সেখানে সংকীর্ণ রাজনীতির বিষাক্ত পরিবেশ, থাকবে না হানাহানি, সংঘাত আর অস্ত্রের ঝনঝনানি। এটা একটা বিরাট জাতীয় চ্যালেঞ্জ। সুশিক্ষিত, সভ্য ও প্রগতিশীল একটি জাতি নির্মাণে একটি স্পষ্ট ও দৃঢ় প্রতিশ্রুতি এ বাজেটে আমরা দেখতে চাই।

জাতীয় নিরাপত্তা
বাংলাদেশের ভূগোল, তার ভূ-অর্থনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত অবস্থান, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর বিষয়টিকে আরও জানান দিয়েছে। আমাদের ছোট্ট ভূখণ্ড তিন দিকেই প্রতিবেশী ভারত বেষ্টিত। চার হাজার ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ভারতের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত। দেশের মোট আয়তনের বিপরীতে মাত্র একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে এত দীর্ঘ সীমান্তের দেশ পৃথিবীতে বিরল। নিকট অতীতের এক মহা দুর্যোগে সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী বিডিআরের সমগ্র সংগঠন তছনছ হয়ে গেছে। পরিবর্তিত সীমান্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় বিজিবি সংগঠিত হচ্ছে। এই নতুন বাহিনীকে একটি পেশাদক্ষ আধাসামরিক বাহিনীর উৎকর্ষতায় ও পূর্ণতায় গড়ে তুলতে, লোকবলে, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে, সমর-সম্ভারে সুসজ্জিত ও সুপ্রশিক্ষিত করতে সরকারের বিশেষ মনোযোগ, উদ্যোগ ও তৎপরতার প্রয়োজন। প্রয়োজন বিশাল অঙ্কের রাষ্ট্রীয় বাজেট। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তার। ভুলে গেলে চলবে না সীমান্তে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের মানুষ বিএসএফের গুলি খেয়ে মারা যাচ্ছে। সীমান্তে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। অরক্ষিত সীমান্তবাসী নিরাপত্তাহীনতায় বিনিদ্র রজনী যাপন করছে। আশা করি, বিজিবির পুনর্গঠনের বিষয়টি অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে যথাযথ গুরুত্ব পাবে।
বাংলাদেশের মানচিত্রের পুরো দক্ষিণ দিকজুড়ে বিস্তীর্ণ বঙ্গোপসাগর। আমাদের সমুদ্রসীমা ভারতের সঙ্গে এখনো অনির্ধারিত। সম্প্রতি জার্মানির হামবুর্গে অনুষ্ঠিত ইটলসের রায়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের সমস্যাগুলোর নিষ্পত্তি হয়েছে। আমরা এক বড় জয় অর্জন করতে পেরেছি। আমাদের ২০০ নটিক্যাল মাইল বিস্তৃত বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা নিশ্চিত হয়েছে এবং ৪৬০ নটিক্যাল মাইল বিস্তৃত মহীসোপান এলাকার অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে। এখন আমাদের প্রয়োজন একটি শক্তিশালী ও আধুনিক নৌবাহিনীর। এই নৌবাহিনীকে হতে হবে ত্রৈমাত্রিক সেখানে থাকবে নৌবাহিনীর নিজস্ব বিমান শাখায় নৌ-অপারেশন উপযোগী আধুনিক উড্ডীয়মান বিমান, থাকবে পানিতে ভাসমান আধুনিক যুদ্ধ জাহাজের বহর আর গভীর সমুদ্রে থাকবে সাবমেরিনের গুচ্ছ। আমাদের নৌবাহিনী আজ উপকূলীয় নৌবাহিনী মাত্র, সুবিস্তীর্ণ সাগরের নীল জলের নৌবাহিনী মোটেই নয়। আমাদের সমুদ্রসীমার সার্বভৌমত্ব যদি নিশ্চিত করতে হয়, মূল্যবান সমুদ্র সম্পদগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে হয়, তাহলে আমাদের গোটা বঙ্গোপসাগর দাপিয়ে রাখা, সবাইকে জানান দেওয়া দৃশ্যমান একটি ত্রৈমাত্রিক আধুনিক শক্তিশালী নৌবাহিনী অপরিহার্য। এ বছরের বাজেটে সরকারের এ বিষয়ে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ও দিকনির্দেশনা থাকতে হবে এবং বাজেট বরাদ্দে তা প্রতিফলিত হতে হবে।
আমাদের সামরিক বাহিনীর অপর দুই অঙ্গ বাহিনী সেনা ও বিমানকেও যুগোপযোগী, আধুনিক ও শক্তিশালী করা আজ সময়ের দাবি। বাজেটে তারও প্রতিফলন প্রয়োজন। এখানে উল্লেখ করতে চাই, বাজেটে অনেকে সামরিক খাতকে অনুন্নয়ন খাত বলে মিথ্যা প্রচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে। এখানে বলা নিষ্প্রয়োজন, আমাদের সামরিক বাহিনী জাতীয় উন্নয়ন ও উৎপাদনে এক বৃহৎ ভূমিকা পালন করে চলেছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সেনা প্রদানকারী দেশ হিসেবে নিয়োজিত থেকে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগব্যবস্থা, রাস্তা, সেতু, বাঁধ ইত্যাদি নির্মাণ করছে। এখানে আরও উল্লেখ করতে চাই, গোটা দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে তথা এই পুরো অঞ্চলে তথা সারা বিশ্বে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যার প্রতিরক্ষা ব্যয় সর্বনিম্ন, যা জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ এবং সমগ্র জাতীয় বাজেটের মাত্র ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে নির্দ্বিধায় বলা যায়, বিশ্বের ন্যূনতম ব্যয়বহুল সামরিক বাহিনী। আশা করি, বিষয়টি অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের দৃষ্টিগোচর হবে।
লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.): সাবেক সেনাপ্রধান।

No comments

Powered by Blogger.