তেজগাঁও শিল্প এলাকায় প্লট বরাদ্দ-‘আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া যাঁরা প্লট পেয়েছেন তাঁরা সবাই চোর’

হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী ও তেজগাঁও শিল্প এলাকায় প্লট বরাদ্দে অনিয়ম হয়েছে কি না, তা তদন্তে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করতে মন্ত্রিপরিষদের সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।গতকাল মঙ্গলবার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন।


কমিটিতে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু আলম শহীদ খান, আইনসচিব আশীষ রঞ্জন দাশ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ইকবাল মাহমুদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরীকে রাখতে বলা হয়েছে। শুনানির একপর্যায়ে আদালত বলেন, ‘আমরা চিন্তা করতে পারি না, সরকারি জমি বিজ্ঞাপন ছাড়া কীভাবে দেওয়া হয়! যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না হওয়াটাই চুরি। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া সেখানে যাঁরা প্লট পেয়েছেন, তাঁরা সবাই চোর। যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া যারা কেনে, তারা এবং যারা বিক্রি করে, তারাও চোর। কারণ এটা জনগণের সম্পত্তি। তাদের না জানিয়ে এটা দেওয়া যায় না।’
পরে আদালত ওই এলাকায় প্লট বরাদ্দের প্রক্রিয়ায় কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে কি না, তা তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আগামী ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে আদালতে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। এ ছাড়া যথাযথ প্রক্রিয়া ও বিজ্ঞাপন ছাড়া কাদের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, সেই তালিকা আদালতে দাখিল করতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিবকে বলা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে সাংবাদিক শফিক রেহমান, সাবেক দুই প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও জিয়াউল হককে তাঁদের ঢাকার সম্পত্তির হিসাব দিতে বলা হয়েছে।
জানা যায়, তেজগাঁও শিল্প এলাকায় প্লট বরাদ্দ বিষয়ে ‘রাস্তাকে প্লট বানিয়ে ভাগাভাগি’ এবং ‘সড়ক প্রকল্প রাতারাতি হয়ে গেল শিল্প প্লট’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয় দুটি জাতীয় দৈনিকে। এটা আদালতের নজরে আনা হলে ৯ মে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করেন। একই সঙ্গে ব্যাখ্যা জানতে বিএনপির নেতা ও সাবেক দুজন প্রতিমন্ত্রী জিয়াউল হক জিয়া ও মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম এবং কামরুলের স্ত্রী নাজমা ইসলাম ও জিয়াউল হকের ছেলে জয়কে ১৬ মে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
ওই দিন শুনানি নিয়ে আদালত নাজমা ইসলাম ছাড়া যায়যায়দিন-এর সাবেক সম্পাদক শফিক রেহমান ও অন্য তিনজনকে ২২ মে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন। এই নির্দেশ অনুসারে তাঁরা গতকাল আদালতে হাজির হন। শুনানিকালে শফিক রেহমান, কামরুল ইসলাম ও জয়কে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা শুনানি হয়।
গতকালের শুনানি: শুনানির শুরুতে আদালত বিবাদীরা কোথায় জানতে চান। আদালত বলেন, কাউকে চেহারা দেখার জন্য ডাকা হয়নি। একপর্যায়ে এজলাসের ডান পাশে রাখা কাঠগড়ার কাছাকাছি এসে শফিক রেহমান ও অন্য দুজন দাঁড়ান। অসুস্থতার কারণে আদালত জিয়াউল হক জিয়াকে বসার অনুমতি দেন।
শুরুতে শফিক রেহমানের পক্ষে আইনজীবী আসাদুজ্জামান বলেন, শফিক রেহমানকে আসতে বলা হয়েছে, কোনো রুল ইস্যু হয়নি। আদালত বলেন, তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছে।
পরে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আলতাফ হোসেন বলেন, খুবই গুরুতর অভিযোগ এসেছে। জনগণের সম্পত্তি এভাবে বরাদ্দ দেওয়া যায় না। তিনি বলেন, ‘শফিক রেহমানের তত্ত্বাবধানে লন্ডনে স্পেকট্রাম নামে একটি রেডিও ছিল। ওই রেডিওর মাধ্যমে বাংলাদেশে বন্যাদুর্গতদের জন্য টাকা ওঠানো হয়েছিল। কিন্তু ওই টাকা বন্যাদুর্গতদের কাছে আসেনি। ব্রিটিশ পুলিশ সংস্থা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ঘটনার তদন্ত করছে। ওই তদন্ত এখন কোন পর্যায়ে আছে, আমার জানা নেই।’
আলতাফ হোসেন বলেন, ‘যাঁদের আমরা অনুসরণ করি, তরুণ প্রজন্ম অনুসরণ করে, তাঁদের যদি এই অবস্থা হয়, তা খুবই দুঃখজনক।’ একপর্যায়ে আদালত ওই তদন্তের অবস্থা এবং ওই ঘটনা সম্পর্কে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে নির্দেশ দেন।
আদালত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে জানতে চান, ওই ভূমি নেওয়ার প্রক্রিয়া কী। জবাবে আলতাফ হোসেন বলেন, শিল্প প্লট বরাদ্দে কোনো ধরনের আইন অনুসরণ করা হয়নি। আদালত বলেন, ‘তাহলে কি ক্ষমতাবানদের এসব প্লট দেওয়া হয়েছে? যাদের ওজন আছে, সে কি পানির দামে প্লট নিয়ে নেয়?’
এই পর্যায়ে আদালত শফিক রেহমানের আইনজীবীকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। জবাবে আসাদুজ্জামান বলেন, যায়যায়দিন পাবলিকেশনস লিমিটেডের নামে ২০০৩ সালে এক একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। তাঁর ব্যক্তিগত নামে জমির নিবন্ধন হয়নি। শফিক রেহমান ওই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কোম্পানিতে তাঁর স্ত্রী ও ছেলের নামে শেয়ার রয়েছে। আসাদুজ্জামান আরও জানান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শফিক রেহমান ওই কোম্পানি থেকে উচ্ছেদ হন। এ জন্য তিনি কোনো অর্থ পাননি। ‘আপনি কীভাবে জেনেছেন?’ আদালতের প্রশ্নের জবাবে আইনজীবী আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ব্যক্তিগত সোর্সে জেনেছি।’
আসাদুজ্জামান ওই এলাকায় কতগুলো প্লট আছে, কাদের নামে আছে, বর্তমান অবস্থা—এই তালিকা আদালতে দাখিল করার আরজি জানান। রাজউকের পক্ষের আইনজীবী কে এম সাইফুদ্দিন আহমেদ একই ধরনের আরজি জানান। প্রকল্পটি কোথায় অবস্থিত—আদালতের এই প্রশ্নের জবাবে কে এম সাইফুদ্দিন বলেন, এটা তেজগাঁও শিল্প এলাকায়।
একপর্যায়ে আদালত বলেন, ‘রাজউক যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ও বিজ্ঞাপন দেয়। ...আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া যাঁরা সেখানে প্লট পেয়েছেন, তাঁরা সবাই চোর।’
এরপর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আলতাফ হোসেন শুনানিতে অংশ নিয়ে কামরুল ইসলামের সম্পত্তির বিষয়ে একটি তালিকা পড়ে শোনান।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শুনানিতে অংশ নিয়ে কামরুল ইসলামের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী টি এইচ খান বলেন, ‘বাধা ছাড়া আমি কিছু বলতে পারব কি না, এটা আপনার দয়ার ওপর নির্ভর করছে।’ আদালত জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবীকে বসে বলার অনুমতি দেন। টি এইচ খান বলেন, ‘অনেক কথা আইনের বইতে লেখা থাকে না। তবু আমরা তা অনুসরণ করি। আপনারা আদালতে এলে আমরা দাঁড়িয়ে যাই। এটা কোনো বইতে লেখা নেই। তবু আমরা এটা করি। আপনি নোটিশ দিয়েছেন। আপনার নোটিশ না পেয়ে পত্রিকা দেখেই তাঁরা (হাজির হওয়া ব্যক্তিরা) আদালতে হাজির হয়েছেন। তাঁরা কোনো অপরাধী নন। আপনি তাঁদের দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা যায় না।’
আদালত বলেন, ‘অভিযোগ আছে বলেই তাঁদের ডাকা হয়েছে। আইনজীবীদের চেয়ারে আমরা তাঁদের বসতে দিতে পারি না।’ টি এইচ খান বলেন, ‘তাঁরা পেছনে বসবেন। আদালত অবমাননার আসামি হলে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারেন। কিন্তু এভাবে নোটিশ দিয়ে ডেকে এনে আপনি দাঁড় করিয়ে রাখতে পারেন না।’
আদালত বলেন, অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকে নিষ্পাপ। আদালত তাঁকে মূল মামলা নিয়ে বলতে বলেন। টি এইচ খান বলেন, ‘যে জায়গাটা লিজ দেওয়া হয়েছে, তা হাতিরঝিল প্রকল্পের নয়। শিল্প এলাকার এই প্লট আমি ছাড়া আরও “১০১” জন যেভাবে পেয়েছে, আমিও একইভাবে পেয়েছি। আমাকে একা কেন ডাকা হবে? প্রত্যেককেই ডাকতে হবে।’
আদালত বলেন, ‘আমরা কাউকেই ছাড়ব না। প্রত্যেককেই ডাকা হবে। আমরা তালিকা চাইব।’ টি এইচ খান বলেন, ‘পিক অ্যান্ড চুজ নীতির ভিত্তিতে চলতে পারেন না। যা হচ্ছে তা এখতিয়ারবহির্ভূত।’
পরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানিতে বলেন, সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। বিচারপতিরা সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন। ওই শপথ রক্ষায় বেআইনি কোনো ঘটনা ঘটলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া বিচারপতিদের দায়িত্ব।
এরপর বরাদ্দের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আদালত গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিবকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। জবাবে উপসচিব মো. রাশেদুল হাসান বলেন, সর্বশেষ এ জন্য ২০০২ সালে একটি কমিটি হয়। ইতিপূর্বে ১৯৯৩ সালের একটি প্রজ্ঞাপনে কিছু নীতিমালার বর্ণনা রয়েছে। আদালত জানতে চান, বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় কি না। জবাবে উপসচিব বলেন, সাধারণত বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় না। আদালত বলেন, ‘বিজ্ঞাপন না দিলে কীভাবে জানবে? তাহলে তো এটা আন্ডার দ্য টেবিল বন্দোবস্ত।’ পরে আদালত বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক মজিবুর রহমান ও সরওয়ার জাহানের বক্তব্য শোনেন। এরপর আদেশ দেন।

No comments

Powered by Blogger.