সদরে অন্তরে-চল্লিশ বছরেও শেষ হয়নি মুক্তির লড়াই by মোস্তফা হোসেইন
বিশ্রামগঞ্জে কি বিশ্রামে ছিলেন তাঁরা? আত্মজিজ্ঞাসার সম্মুখীন তাঁদের অনেকেই। কিশোরী কল্পনা কিংবা বাসনার কথা যদি বলা হয়, যদি জিজ্ঞেস করা হয় গীতার কথা, কেমন আছেন একাত্তরের সেই বীরকন্যারা? পাল্টা প্রশ্ন তাঁরাও করতে পারেন_'আমরা কি বিশ্রামগঞ্জে বিশ্রাম করতে গিয়েছিলাম?' তার চেয়েও বড় প্রশ্ন আছে কল্পনার মতো অনেক মুক্তিযোদ্ধার।
তাঁরা প্রশ্ন করেন_চল্লিশ বছর পর এসে আমাকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে_আমি কি মুক্তিযোদ্ধা নই?
বিশ্রামগঞ্জ মানে ভারতে অবস্থিত একাত্তরের সেই হাসপাতালের কথা বলছি। পদ্মা, বাসনা, কল্পনা, নীলিমা, গীতা (বড়), গীতা (ছোট), ইরা, মধুমিতা, আলোর মতো বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধারই খবর নেই আজকে। তাঁদের অধিকাংশই আবার স্বাধীন বাংলাদেশে চারটি দশক কাটিয়ে দিয়েছেন জীবন-সংগ্রামের মধ্যে। কল্পনা কিংবা বাসনা মুক্তির লড়াইয়ে বিজয়িনী হলেও জীবনযুদ্ধে পরাস্ত সৈনিক। কল্পনা ভৈরবে থাকেন অসহায় অবস্থায়। বাড়ি নেই, সহায়-সম্পদ কিছুই নেই। স্বামী-সন্তানও না। সহযোদ্ধাদের কয়েকজন জীবনযুদ্ধে পাশে আছেন বলে টিকে থাকা সম্ভব হয়েছে আজও। দুস্থ মুক্তিযোদ্ধার ভাতাও জোটেনি তাঁর কপালে। কল্পনার সুখ তাই কল্পনাতেই থেকে গেছে। একাত্তরের সেই ছোট মেয়েটি এখন বার্ধক্যে পেঁৗছেছেন। কিন্তু মনটা বুড়ো হয়ে যায়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের এই সৈনিক কি কারো কাছে হাত পাততে পারেন? আত্মমর্যাদায় বলীয়ান সেই মুক্তিযোদ্ধা তাই মাটি কামড়ে পড়ে আছেন ভৈরবে_স্বামীর ভিটায়।
অবাক কাণ্ডই বলতে হবে, কল্পনার নাম নেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়। ভাতা পাবেন কিভাবে? প্রশ্নটা অতি সত্য। আইনের বাহকেরা তাই প্রশ্ন করতেই পারেন_তিনি কি মুক্তিযোদ্ধা? সেও বাস্তব কথা। কিন্তু অন্যভাবেও তো প্রশ্নটা করা যায়_কোন কারণে তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন? ডাক্তার নাজিমউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) আক্তার বীর প্রতীক ও তাঁর স্ত্রী খুকু আক্তার, ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী, নীলিমা আহমেদ, সুলতানা কামাল টুলু, সাইদা কামাল লুলু, সাদেকুর রহমানের মতো আরো যাঁরা বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাসংশ্লিষ্ট কিংবা কর্মে নিয়োজিত ছিলেন, তাঁরা কি বলেন কল্পনার কথা? পদ্মা রহমানের স্পষ্ট কথা, আমরা যুদ্ধ করেছি সেবা দিয়ে। ঠিক যেভাবে নিয়মিত বাহিনীর মেডিক্যাল কোরের সদস্যরা করে, স্বাভাবিক অবস্থায় কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার যেসব যোগ্যতা থাকার কথা_তার শতভাগ পূরণ করার পরও কল্পনারা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লেখানোর সুযোগ পাননি। আর সে কারণে কি অসহায় অবস্থায় দিনাতিপাত করতে হবে কল্পনা কিংবা বাসনাদের? কল্পনার নাম ওঠেনি গ্যাজেটে। তাই মুক্তিযোদ্ধার সহযোগিতা কর্মসূচিতেও তাঁর অন্তর্ভুক্তি সম্ভব হয়নি আইনানুগ কারণে।
কিন্তু সার্টিফিকেট থাকার পরও কি সব দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পাচ্ছেন? কুমিল্লা জেলার চান্দলা ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার আবুল হাসেম বললেন তাঁর নিজ এলাকার যোদ্ধাদের কথা। শফিকুল ইসলাম, আবদুল হাকিম এবং আবদুল বারিক নামের তিন মুক্তিযোদ্ধা একই গ্রামের। শফিকুলের নিজের কোনো ঠিকানা নেই। তাঁর বাবা ছিলেন চান্দলায়, কোনো বাড়িঘর নেই তাঁর। এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় থাকেন অন্যের বাড়িতে। আবদুল হাকিম কিংবা আবদুল বারিকদের ভিটাও নেই। কী হবে তাঁদের সন্তানদের? এই প্রশ্ন যখন তাঁদের সামনে, তখন জবাবটাও পেয়ে যান একই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মরহুম শহিদুল ইসলামের প্রতিবন্ধী সন্তানের মানবেতর জীবন যাপন দেখে। কী দুর্বিষহ জীবন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের!
প্রশ্নটা তো আরো কঠিনভাবেই করা যায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার ইচ্ছাও কোন কারণে কার্যকর হয় না এই দেশে? তিনি তো মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণচিন্তা করেন সব সময়। কতটা প্রমাণ চাই এই তথ্যের। কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনের সূত্রেই বলা ভালো। প্রকাশ হয়েছিল, ভিটেছাড়া এক বীরবিক্রমের কথা। সেই লেখার সূত্র ধরেই প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে ভূমি সচিবকে লেখা হয়েছিল ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার সিদলাই গ্রামের আবদুল মান্নান বীরবিক্রমকে ভূমি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। তাগাদা দেওয়া হয়েছিল জরুরি ভিত্তিতে যেন ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে_২০১০ সালের এপ্রিল মাসে সেই চিঠির অনুলিপি কুমিল্লা জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের পাঠানো হলেও আজ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের সেই বীর সেনানির জন্য ৫ গণ্ডা জমি বের করে দেওয়া সম্ভব হয়নি কারো পক্ষে। সে তো এক বছর যায় যায়। সংগত কারণেই প্রশ্ন করতে পারেন সেই বীর সেনানি_প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালন হতে আর কত দিন লাগবে স্বাধীন এই বাংলাদেশে? আজও ২৬০০ টাকা মাসিক পেনশনধারী এই মুক্তিযোদ্ধাকে পরের বাড়িতে ভাড়া থেকে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। কাউকে দোষ দেওয়ার জন্য নয়_বলতে হচ্ছে, তাঁকে জমি দেওয়ার জন্য। একজন মুক্তিযোদ্ধা, যিনি নাকি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলেন, বীরত্ব দেখানোর কারণে এই দেশের সরকার যাঁকে বীরবিক্রম খেতাব পর্যন্ত প্রদান করেছে, সেই যোদ্ধা কি এক টুকরো জমি আশা করতে পারেন না এই দেশের সরকারের কাছে?
মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন। নিত্যই এমন সংবাদ প্রকাশ হয় পত্রিকান্তরে। কেন তাঁদের সহযোগিতা পর্যাপ্ত হচ্ছে না? কোন কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পরও ৪০ বছর কেটে যায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার আশায় আশায়। কতজন মুক্তিযোদ্ধা সরকারের কাছ থেকে নিয়মিত সহযোগিতা (ভাতাসহ) পাচ্ছেন? অথচ এমন কিন্তু হওয়ার কথা ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা লাভের পর পর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেছিলেন যোদ্ধাহত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সহযোগিতা করার জন্য। ৩২টি প্রতিষ্ঠান ছিল শুরুতে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকই বলতে হবে দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং অবহেলার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র তিনটি এখন লাইফ সাপোর্ট নিয়ে টিকে আছে। ৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আশির দশকের মাঝামাঝি সাতটি প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারীকরণ করা হয়। বাকিগুলোর মেশিনপত্র পর্যন্ত লুটপাট হয়ে গেছে কিংবা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের জমি আছে প্রায় ৫৫ একর। সেগুলোও এখন নানা ঝুট-ঝামেলায় পড়ে আছে। মাত্র কয়েক টুকরা জমি জঞ্জালমুক্ত করতে পেরেছে সম্প্রতি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীর মতো জায়গায় যে প্রতিষ্ঠানের ৫৫ একর জমি আছে, যে প্রতিষ্ঠানটির একসময় ৩২টি প্রতিষ্ঠান ছিল, সেই প্রতিষ্ঠানকে এখনো চলতে হয় সরকারের দেওয়া টাকার ওপর নির্ভর করে। অনেকটা পরের ধনে পোদ্দারির মতোই মনে হয়, তাদের মাধ্যমে শহীদ পরিবার ও যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করলে। সরকার তাদের প্রতিবছর ৬৩ কোটি টাকা প্রদান করে। আর সেই টাকা দিয়েই তাদের দিন চলে।
এত সম্পদের মালিক যে প্রতিষ্ঠান, সেই প্রতিষ্ঠান কি পারে না বছরে ৫০০ কোটি টাকা মুনাফা করতে? যদি প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ না হতো, যদি সেখানে দুর্নীতি না হতো, তাহলে নিশ্চিত করেই বলা যায় কল্পনা, শফিক, বারিক, হাকিমদের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের সব সমস্যারই সমাধান করতে পারত এই প্রতিষ্ঠানটি।
সরকার চাইলে প্রতিষ্ঠানটিকে পুনর্জীবন দিতে পারে। জমি উদ্ধার কাজে সাফল্য লাভ, তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ হওয়ার পথ থেকে ফিরিয়ে এনে লাভজনক করার উদাহরণ দেখে মনে হয় এখনো হয়তো আশাহত হওয়ার কারণ নেই। ৫৫ একর জায়গা থেকে কিছু জায়গা তো জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে আবাসন, চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে সহজেই গড়ে তোলা যায়। সুতরাং অর্থাভাবের কারণে কিছু করা যাবে না_এমন বলারও কারণ নেই।
আশাজাগানিয়া আরো কিছু উদাহরণও আমাদের সামনে আছে। সম্প্রতি শেরপুর জেলার রামপুর বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন দেখে মনে হচ্ছে_ইচ্ছা করলে অনেক কিছুই পারা যায়। সেই আবাসনে ৪৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকা ঘর করে দেওয়া হয়েছে। এমন আবাসন কি বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় করা যায় না? আমার তো মনে হয় না একটি জেলায় দুস্থ কিংবা ভূমিহীন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা গড়ে শতাধিক হবে। এটা কি সরকারের পক্ষে খুবই কঠিন ব্যাপার? এটা সম্ভব, সেই উদাহরণ শেরপুরের এই আবাসন ব্যবস্থা।
মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিণতি বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের সন্তানদের পরিণতি কি হবে এমন দুর্বিষহ? স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি এখন সরকার পরিচালনা করছে। সঙ্গত কারণেই মানুষের প্রত্যাশা থাকতেই পারে। প্রত্যাশার যদি পরিমাণগত দিক বিবেচনা করা হয়, তাহলে বলতেই হবে, খুবই সামান্য। তবে এও বলতে হবে, সততা, ইচ্ছা এবং দেশপ্রেম প্রয়োজন অনেক বেশি। তা নাহলে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের মতোই কোটি কোটি টাকা মাটিতে মিশে যাবে। আর মুক্তিযোদ্ধারা অসহায় অবস্থায় দিনাতিপাত করতে থাকবে।
mhussain_71@yahoo.com
বিশ্রামগঞ্জ মানে ভারতে অবস্থিত একাত্তরের সেই হাসপাতালের কথা বলছি। পদ্মা, বাসনা, কল্পনা, নীলিমা, গীতা (বড়), গীতা (ছোট), ইরা, মধুমিতা, আলোর মতো বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধারই খবর নেই আজকে। তাঁদের অধিকাংশই আবার স্বাধীন বাংলাদেশে চারটি দশক কাটিয়ে দিয়েছেন জীবন-সংগ্রামের মধ্যে। কল্পনা কিংবা বাসনা মুক্তির লড়াইয়ে বিজয়িনী হলেও জীবনযুদ্ধে পরাস্ত সৈনিক। কল্পনা ভৈরবে থাকেন অসহায় অবস্থায়। বাড়ি নেই, সহায়-সম্পদ কিছুই নেই। স্বামী-সন্তানও না। সহযোদ্ধাদের কয়েকজন জীবনযুদ্ধে পাশে আছেন বলে টিকে থাকা সম্ভব হয়েছে আজও। দুস্থ মুক্তিযোদ্ধার ভাতাও জোটেনি তাঁর কপালে। কল্পনার সুখ তাই কল্পনাতেই থেকে গেছে। একাত্তরের সেই ছোট মেয়েটি এখন বার্ধক্যে পেঁৗছেছেন। কিন্তু মনটা বুড়ো হয়ে যায়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের এই সৈনিক কি কারো কাছে হাত পাততে পারেন? আত্মমর্যাদায় বলীয়ান সেই মুক্তিযোদ্ধা তাই মাটি কামড়ে পড়ে আছেন ভৈরবে_স্বামীর ভিটায়।
অবাক কাণ্ডই বলতে হবে, কল্পনার নাম নেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়। ভাতা পাবেন কিভাবে? প্রশ্নটা অতি সত্য। আইনের বাহকেরা তাই প্রশ্ন করতেই পারেন_তিনি কি মুক্তিযোদ্ধা? সেও বাস্তব কথা। কিন্তু অন্যভাবেও তো প্রশ্নটা করা যায়_কোন কারণে তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন? ডাক্তার নাজিমউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) আক্তার বীর প্রতীক ও তাঁর স্ত্রী খুকু আক্তার, ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী, নীলিমা আহমেদ, সুলতানা কামাল টুলু, সাইদা কামাল লুলু, সাদেকুর রহমানের মতো আরো যাঁরা বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাসংশ্লিষ্ট কিংবা কর্মে নিয়োজিত ছিলেন, তাঁরা কি বলেন কল্পনার কথা? পদ্মা রহমানের স্পষ্ট কথা, আমরা যুদ্ধ করেছি সেবা দিয়ে। ঠিক যেভাবে নিয়মিত বাহিনীর মেডিক্যাল কোরের সদস্যরা করে, স্বাভাবিক অবস্থায় কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার যেসব যোগ্যতা থাকার কথা_তার শতভাগ পূরণ করার পরও কল্পনারা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লেখানোর সুযোগ পাননি। আর সে কারণে কি অসহায় অবস্থায় দিনাতিপাত করতে হবে কল্পনা কিংবা বাসনাদের? কল্পনার নাম ওঠেনি গ্যাজেটে। তাই মুক্তিযোদ্ধার সহযোগিতা কর্মসূচিতেও তাঁর অন্তর্ভুক্তি সম্ভব হয়নি আইনানুগ কারণে।
কিন্তু সার্টিফিকেট থাকার পরও কি সব দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পাচ্ছেন? কুমিল্লা জেলার চান্দলা ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার আবুল হাসেম বললেন তাঁর নিজ এলাকার যোদ্ধাদের কথা। শফিকুল ইসলাম, আবদুল হাকিম এবং আবদুল বারিক নামের তিন মুক্তিযোদ্ধা একই গ্রামের। শফিকুলের নিজের কোনো ঠিকানা নেই। তাঁর বাবা ছিলেন চান্দলায়, কোনো বাড়িঘর নেই তাঁর। এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় থাকেন অন্যের বাড়িতে। আবদুল হাকিম কিংবা আবদুল বারিকদের ভিটাও নেই। কী হবে তাঁদের সন্তানদের? এই প্রশ্ন যখন তাঁদের সামনে, তখন জবাবটাও পেয়ে যান একই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মরহুম শহিদুল ইসলামের প্রতিবন্ধী সন্তানের মানবেতর জীবন যাপন দেখে। কী দুর্বিষহ জীবন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের!
প্রশ্নটা তো আরো কঠিনভাবেই করা যায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার ইচ্ছাও কোন কারণে কার্যকর হয় না এই দেশে? তিনি তো মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণচিন্তা করেন সব সময়। কতটা প্রমাণ চাই এই তথ্যের। কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনের সূত্রেই বলা ভালো। প্রকাশ হয়েছিল, ভিটেছাড়া এক বীরবিক্রমের কথা। সেই লেখার সূত্র ধরেই প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে ভূমি সচিবকে লেখা হয়েছিল ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার সিদলাই গ্রামের আবদুল মান্নান বীরবিক্রমকে ভূমি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। তাগাদা দেওয়া হয়েছিল জরুরি ভিত্তিতে যেন ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে_২০১০ সালের এপ্রিল মাসে সেই চিঠির অনুলিপি কুমিল্লা জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের পাঠানো হলেও আজ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের সেই বীর সেনানির জন্য ৫ গণ্ডা জমি বের করে দেওয়া সম্ভব হয়নি কারো পক্ষে। সে তো এক বছর যায় যায়। সংগত কারণেই প্রশ্ন করতে পারেন সেই বীর সেনানি_প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালন হতে আর কত দিন লাগবে স্বাধীন এই বাংলাদেশে? আজও ২৬০০ টাকা মাসিক পেনশনধারী এই মুক্তিযোদ্ধাকে পরের বাড়িতে ভাড়া থেকে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। কাউকে দোষ দেওয়ার জন্য নয়_বলতে হচ্ছে, তাঁকে জমি দেওয়ার জন্য। একজন মুক্তিযোদ্ধা, যিনি নাকি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলেন, বীরত্ব দেখানোর কারণে এই দেশের সরকার যাঁকে বীরবিক্রম খেতাব পর্যন্ত প্রদান করেছে, সেই যোদ্ধা কি এক টুকরো জমি আশা করতে পারেন না এই দেশের সরকারের কাছে?
মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন। নিত্যই এমন সংবাদ প্রকাশ হয় পত্রিকান্তরে। কেন তাঁদের সহযোগিতা পর্যাপ্ত হচ্ছে না? কোন কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পরও ৪০ বছর কেটে যায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার আশায় আশায়। কতজন মুক্তিযোদ্ধা সরকারের কাছ থেকে নিয়মিত সহযোগিতা (ভাতাসহ) পাচ্ছেন? অথচ এমন কিন্তু হওয়ার কথা ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা লাভের পর পর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেছিলেন যোদ্ধাহত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সহযোগিতা করার জন্য। ৩২টি প্রতিষ্ঠান ছিল শুরুতে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকই বলতে হবে দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং অবহেলার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র তিনটি এখন লাইফ সাপোর্ট নিয়ে টিকে আছে। ৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আশির দশকের মাঝামাঝি সাতটি প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারীকরণ করা হয়। বাকিগুলোর মেশিনপত্র পর্যন্ত লুটপাট হয়ে গেছে কিংবা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের জমি আছে প্রায় ৫৫ একর। সেগুলোও এখন নানা ঝুট-ঝামেলায় পড়ে আছে। মাত্র কয়েক টুকরা জমি জঞ্জালমুক্ত করতে পেরেছে সম্প্রতি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীর মতো জায়গায় যে প্রতিষ্ঠানের ৫৫ একর জমি আছে, যে প্রতিষ্ঠানটির একসময় ৩২টি প্রতিষ্ঠান ছিল, সেই প্রতিষ্ঠানকে এখনো চলতে হয় সরকারের দেওয়া টাকার ওপর নির্ভর করে। অনেকটা পরের ধনে পোদ্দারির মতোই মনে হয়, তাদের মাধ্যমে শহীদ পরিবার ও যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করলে। সরকার তাদের প্রতিবছর ৬৩ কোটি টাকা প্রদান করে। আর সেই টাকা দিয়েই তাদের দিন চলে।
এত সম্পদের মালিক যে প্রতিষ্ঠান, সেই প্রতিষ্ঠান কি পারে না বছরে ৫০০ কোটি টাকা মুনাফা করতে? যদি প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ না হতো, যদি সেখানে দুর্নীতি না হতো, তাহলে নিশ্চিত করেই বলা যায় কল্পনা, শফিক, বারিক, হাকিমদের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের সব সমস্যারই সমাধান করতে পারত এই প্রতিষ্ঠানটি।
সরকার চাইলে প্রতিষ্ঠানটিকে পুনর্জীবন দিতে পারে। জমি উদ্ধার কাজে সাফল্য লাভ, তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ হওয়ার পথ থেকে ফিরিয়ে এনে লাভজনক করার উদাহরণ দেখে মনে হয় এখনো হয়তো আশাহত হওয়ার কারণ নেই। ৫৫ একর জায়গা থেকে কিছু জায়গা তো জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে আবাসন, চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে সহজেই গড়ে তোলা যায়। সুতরাং অর্থাভাবের কারণে কিছু করা যাবে না_এমন বলারও কারণ নেই।
আশাজাগানিয়া আরো কিছু উদাহরণও আমাদের সামনে আছে। সম্প্রতি শেরপুর জেলার রামপুর বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন দেখে মনে হচ্ছে_ইচ্ছা করলে অনেক কিছুই পারা যায়। সেই আবাসনে ৪৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকা ঘর করে দেওয়া হয়েছে। এমন আবাসন কি বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় করা যায় না? আমার তো মনে হয় না একটি জেলায় দুস্থ কিংবা ভূমিহীন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা গড়ে শতাধিক হবে। এটা কি সরকারের পক্ষে খুবই কঠিন ব্যাপার? এটা সম্ভব, সেই উদাহরণ শেরপুরের এই আবাসন ব্যবস্থা।
মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিণতি বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের সন্তানদের পরিণতি কি হবে এমন দুর্বিষহ? স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি এখন সরকার পরিচালনা করছে। সঙ্গত কারণেই মানুষের প্রত্যাশা থাকতেই পারে। প্রত্যাশার যদি পরিমাণগত দিক বিবেচনা করা হয়, তাহলে বলতেই হবে, খুবই সামান্য। তবে এও বলতে হবে, সততা, ইচ্ছা এবং দেশপ্রেম প্রয়োজন অনেক বেশি। তা নাহলে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের মতোই কোটি কোটি টাকা মাটিতে মিশে যাবে। আর মুক্তিযোদ্ধারা অসহায় অবস্থায় দিনাতিপাত করতে থাকবে।
mhussain_71@yahoo.com
No comments