প্রশাসনের নিরপেক্ষতা-সুশাসনের বেহাল অবস্থা by এ এম এম শওকত আলী
ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী অঙ্গীকারের মধ্যে অন্যতম ছিল প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া। পুলিশ বাহিনী প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। যেকোনো দেশে, বাংলাদেশে তো বটেই, আইনশৃঙ্খলা ও উন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকলে উন্নয়ন ব্যাহত হয়। এ পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক রাখার অন্যতম কৌশল হচ্ছে আইনের শাসন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে এ দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের। নির্বাহী বিভাগ যদি এ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা তথা আইনের শাসন ব্যাহত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অন্য স্তম্ভটি হলো নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ। একই সঙ্গে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সংসদের ভূমিকাও অতি গুরুত্বপূর্ণ। সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত এ তিনটি অঙ্গ যদি বস্তুনিষ্ঠভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়ে একযোগে এবং একে অপরের ওপর শ্রদ্ধাশীল হয়ে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, তাহলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। বাংলাদেশে বিগত কয়েক দশকে এ বিষয়টির অভাব উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান। এ অশুভ ধারাকে প্রতিরোধ করতে না পারলে উদ্ভূত পরিস্থিতি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
৬ মে তারিখের একটি দৈনিকের প্রধান সংবাদ ছিল ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের আদেশ-নির্দেশ অধস্তন কর্মকর্তারা পালন করছেন না। এ ধরনের পরিস্থিতি এর আগে জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। এর অর্থ এই নয় যে এ সমস্যা অতীতে ছিল না। পুলিশ সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত একটি শৃঙ্খলা বাহিনী। সোজা কথায় এর অর্থ, এ ধরনের বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্যের অভাব হলে সংশ্লিষ্ট শৃঙ্খলা বাহিনী অকার্যকর হয়ে যায়, যার ভয়াবহ পরিণাম অতীতে সামরিক বাহিনীসহ সাম্প্রতিক কালে বিডিআরের নির্মম হত্যাযজ্ঞে দৃশ্যমান হয়েছে। সামরিক শাস্ত্রে এ ধরনের ঘটনাকে বলা হয় Breakdown of Command Structure অর্থাৎ যথাযথ কর্তৃপক্ষের আদেশ পালন প্রক্রিয়ার ভঙ্গুর অবস্থা।
এ প্রসঙ্গে বলা নিষ্প্রয়োজন যে পুলিশ শৃঙ্খলা বাহিনী হলেও সামরিক বা আধাসামরিক বাহিনী নয়। এ কারণেই বাহিনীর অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য পুলিশ আইন সামরিক বা আধাসামরিক আইনের চেয়ে ভিন্নতর। এর মূল কারণ ঐতিহ্যগতভাবে পুলিশ একটি বেসামরিক বাহিনী। পুলিশের দৈনন্দিন কার্যসম্পাদন প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বেসামরিক আইনি কাঠামোর মাধ্যমে জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এ দায়িত্ব সামরিক বা আধাসামরিক বাহিনীর ওপর বর্তায় না, যদি না আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এদের ব্যবহার করা হয়।
তবে পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরে সদস্যদের শৃঙ্খলার বিলুপ্তির কারণে সাধারণ নাগরিকদেরই ভোগান্তি হয়। আইনের শাসন দুর্বল হয়ে যায়। বিগত ৫ মে পুলিশের মহাপরিদর্শকের সভায় এ বিষয়টিই দৃশ্যমান হয়েছে। সভায় উপস্থিত ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা ভঙ্গুর নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর জন্য যে বিষয়টি চিহ্নিত করেছেন, তা হলো পুলিশ বাহিনীর রাজনীতিকায়ন।
১৯৯১ সাল থেকে গণমাধ্যমে প্রশাসনের রাজনীতিকায়ন-সম্পর্কিত অসংখ্য সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদসহ অন্যান্য সূত্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট গবেষকেরা রাজনীতিকায়নের কয়েকটি প্রধান স্তর চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে (এক) প্রাথমিক নিয়োগ, (দুই) বদলি ও (তিন) পদোন্নতি। সরকারি প্রশাসনিক ক্যাডারের মধ্যে উপরোক্ত তিনটি স্তরের রাজনীতিকায়নের ধারাবাহিকতায় পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাবোধ বিলুপ্তপ্রায়। তবে আশার কথা এই যে, পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক এ বাহিনীর প্রধান হিসেবে তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছেন। গৃহীত পদক্ষেপ ভবিষ্যতেও যাতে রাজনৈতিকভাবে বাধাগ্রস্ত না হয়, তার দায়িত্ব ক্ষমতাসীন সরকারের। সরকারের আশু দায়িত্ব হলো শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর পুনর্বাসন। পুলিশের মহাপরিদর্শক শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের উদ্দেশে একটি সতর্কবাণীও উচ্চারণ করেছেন। ‘দলীয় প্রভাবে কেউ নিজেকে বাহিনীর ঊর্ধ্বে মনে করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে।’
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আইনসিদ্ধ আদেশ অমান্য ছাড়াও পুলিশের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার বিষয়ও সংশ্লিষ্ট সভায় ব্যক্ত করা হয়েছে। যেমন—(এক) ক্রয় প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা, (দুই) পোশাক পরার প্রতিষ্ঠিত নিয়ম অমান্য করা, (তিন) কনস্টেবলদের বেতনসংক্রান্ত বিষয় এবং (চার) পুলিশের অজ্ঞাতে অস্ত্রধারী আনসার নিয়োগ।
ক্রয় প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা বিষয়ে বলা হয়েছে, অজ্ঞাতনামা পত্রিকায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। বলা বাহুল্য, এ প্রক্রিয়ায় দরপত্রে প্রতিযোগিতার অভাব হওয়া স্বাভাবিক। ফলে অধিক মূল্যে পণ্য বা সেবা সংগ্রহ করা হয়। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হয়। তাহলে কি বিদ্যমান সরকারি ক্রয় আইন ও বিধি এ ক্ষেত্রে অকার্যকর। অমান্য করা তো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য আইন বা বিধিই যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষের স্বচ্ছ মানসিকতা, যার অভাব এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান।
পোশাক পরার প্রতিষ্ঠিত রীতির ব্যতিক্রম প্রায় প্রতিদিন টেলিভিশনে দেখা যায়। পুলিশ বিধিমালায় পোশাক পরার স্পষ্ট বিধানও রয়েছে। যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ ধরনের অনিয়মের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন, তাঁর পক্ষে কি বিধি অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া অসম্ভব ছিল? পুনরায় কারণ হিসেবে রাজনৈতিক কারণই উল্লেখ করা যায়। অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রভাবের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনিশ্চয়তার শিকার হয়েছেন।
কনস্টেবলদের বেতনসংক্রান্ত বিষয়টি মনে হয় আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আবদ্ধ। পুলিশ সদর দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালি করা যাবে না। কারণ, অর্থ বিভাগের সম্মতি ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তই প্রদানে সক্ষম নয়। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অধিকতর তৎপর হতে হবে।
পুলিশের অজ্ঞাতে অস্ত্রধারী আনসারের নিয়োগের বিষয়ে কাঠামোগত দুর্বলতাই চিহ্নিত করা যায়। এর ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে। কারণটি পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক সরকারের সঙ্গে জড়িত। এর আগে আনসার আইনের জন্মলগ্ন থেকেই বিকেন্দ্রীভূত কাঠামোতে এ বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার বিষয়ে এসপির পরামর্শ অনুযায়ী ডেপুটি কমিশনার সিদ্ধান্ত নিতেন। এ বাহিনীর সর্বোচ্চ পদের নাম ছিল পরিচালক। এ পদে একজন সিনিয়র এসপিকে নিয়োগ দেওয়া হতো। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে এ বাহিনীর সামরিকায়ন-প্রক্রিয়া শুরু হয়। গঠিত হয় পৃথক আনসার ব্যাটালিয়ন। এ প্রথার অবসান প্রয়োজন। পূর্ববর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে আনসার বাহিনীর ব্যবহারের প্রয়োজন অনুভূত হলে, তাদের সংখ্যা নির্ধারণ করা হতো এসপির পরামর্শে। এ প্রক্রিয়াকে বলা হতো Embodied Ansar । অর্থাৎ এ প্রক্রিয়ায় তারা দায়িত্বকালে পুলিশ বাহিনীর অংশ হিসেবে গণ্য হতো।
অস্ত্রধারী আনসার ডিসি ও এসপির অজ্ঞাতে ব্যবহারের ফলে কোনো অনভিপ্রেত ঘটনার জন্য ডিসি বা এসপিকে দায়ী করা যাবে না। অন্যদিকে পুলিশ বিধি ও সরকারের অনুসৃত রীতি অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য ডিসি-এসপিকেই দায়ী করা হয়।
যে বিষয়টির প্রয়োজন তা হলো জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত প্রক্রিয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ। পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী সময়ে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ কাঠামো কাজ করত। এখন সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত মূলত জাতীয় পর্যায়ে। এর ফলে জাতীয় পর্যায়ের যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ, মূলত পরিবীক্ষণ, গৃহীত ব্যবস্থার মূল্যায়ন ও নীতি নির্ধারণসংক্রান্ত কার্যসম্পাদন-প্রক্রিয়া দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হয়। এ বিলম্বের ফলে অনেক ধরনের অঘটনও ঘটে, যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
পুলিশের মহাপরিদর্শক ক্ষমতাসীন দলের দলীয় কর্মীদের টেন্ডারবাজি প্রতিরোধের বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। দলমতনির্বিশেষে এ ধরনের অপরাধ কঠোরভাবে দমন করা হবে মর্মে জানিয়েছেন। একই উক্তি এ ধরনের ঘটনার শুরু থেকেই খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীও বলেছিলেন। সর্বশেষ বললেন মহাপরিদর্শক। মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী বলা সত্ত্বেও এ অপরাধ ঘটেছে। অনেকে প্রশ্ন করেছেন, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি বা হচ্ছে না কেন? সেই একই উত্তর। অপরাধের সঙ্গে জড়িত দলীয় ব্যক্তিদের সুরক্ষা। তবে এ কথা স্বীকার করা প্রয়োজন, কয়েকটি স্থানে ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া চালু করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে কিছু অপরাধীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। ভালো কথা, তবে অধিকাংশ অপরাধী অভয়াশ্রমেই বিচরণ করছে।
আশঙ্কার কথা এই যে, চাঁদাবাজসহ টেন্ডারবাজদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে মামলা করার নির্দেশ দিয়েছেন মহাপরিদর্শক। বলা বাহুল্য, এ ধরনের অপরাধমূলক আচরণ আইন অনুযায়ী দ্রুত বিচার আদালতেই হওয়ার কথা। এর জন্য নির্দেশের প্রয়োজন কেন? এ ধরনের সব প্রশ্নের উত্তর একটিই—রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, যা প্রশাসনের রাজনীতিকায়নের মাধ্যমে অধিকতর সুসংহত হচ্ছে। এর শেষ কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর সব রাজনৈতিক দলকেই খুঁজে বের করতে হবে।
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
৬ মে তারিখের একটি দৈনিকের প্রধান সংবাদ ছিল ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের আদেশ-নির্দেশ অধস্তন কর্মকর্তারা পালন করছেন না। এ ধরনের পরিস্থিতি এর আগে জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। এর অর্থ এই নয় যে এ সমস্যা অতীতে ছিল না। পুলিশ সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত একটি শৃঙ্খলা বাহিনী। সোজা কথায় এর অর্থ, এ ধরনের বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্যের অভাব হলে সংশ্লিষ্ট শৃঙ্খলা বাহিনী অকার্যকর হয়ে যায়, যার ভয়াবহ পরিণাম অতীতে সামরিক বাহিনীসহ সাম্প্রতিক কালে বিডিআরের নির্মম হত্যাযজ্ঞে দৃশ্যমান হয়েছে। সামরিক শাস্ত্রে এ ধরনের ঘটনাকে বলা হয় Breakdown of Command Structure অর্থাৎ যথাযথ কর্তৃপক্ষের আদেশ পালন প্রক্রিয়ার ভঙ্গুর অবস্থা।
এ প্রসঙ্গে বলা নিষ্প্রয়োজন যে পুলিশ শৃঙ্খলা বাহিনী হলেও সামরিক বা আধাসামরিক বাহিনী নয়। এ কারণেই বাহিনীর অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য পুলিশ আইন সামরিক বা আধাসামরিক আইনের চেয়ে ভিন্নতর। এর মূল কারণ ঐতিহ্যগতভাবে পুলিশ একটি বেসামরিক বাহিনী। পুলিশের দৈনন্দিন কার্যসম্পাদন প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বেসামরিক আইনি কাঠামোর মাধ্যমে জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এ দায়িত্ব সামরিক বা আধাসামরিক বাহিনীর ওপর বর্তায় না, যদি না আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এদের ব্যবহার করা হয়।
তবে পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরে সদস্যদের শৃঙ্খলার বিলুপ্তির কারণে সাধারণ নাগরিকদেরই ভোগান্তি হয়। আইনের শাসন দুর্বল হয়ে যায়। বিগত ৫ মে পুলিশের মহাপরিদর্শকের সভায় এ বিষয়টিই দৃশ্যমান হয়েছে। সভায় উপস্থিত ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা ভঙ্গুর নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর জন্য যে বিষয়টি চিহ্নিত করেছেন, তা হলো পুলিশ বাহিনীর রাজনীতিকায়ন।
১৯৯১ সাল থেকে গণমাধ্যমে প্রশাসনের রাজনীতিকায়ন-সম্পর্কিত অসংখ্য সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদসহ অন্যান্য সূত্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট গবেষকেরা রাজনীতিকায়নের কয়েকটি প্রধান স্তর চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে (এক) প্রাথমিক নিয়োগ, (দুই) বদলি ও (তিন) পদোন্নতি। সরকারি প্রশাসনিক ক্যাডারের মধ্যে উপরোক্ত তিনটি স্তরের রাজনীতিকায়নের ধারাবাহিকতায় পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাবোধ বিলুপ্তপ্রায়। তবে আশার কথা এই যে, পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক এ বাহিনীর প্রধান হিসেবে তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছেন। গৃহীত পদক্ষেপ ভবিষ্যতেও যাতে রাজনৈতিকভাবে বাধাগ্রস্ত না হয়, তার দায়িত্ব ক্ষমতাসীন সরকারের। সরকারের আশু দায়িত্ব হলো শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর পুনর্বাসন। পুলিশের মহাপরিদর্শক শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের উদ্দেশে একটি সতর্কবাণীও উচ্চারণ করেছেন। ‘দলীয় প্রভাবে কেউ নিজেকে বাহিনীর ঊর্ধ্বে মনে করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে।’
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আইনসিদ্ধ আদেশ অমান্য ছাড়াও পুলিশের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার বিষয়ও সংশ্লিষ্ট সভায় ব্যক্ত করা হয়েছে। যেমন—(এক) ক্রয় প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা, (দুই) পোশাক পরার প্রতিষ্ঠিত নিয়ম অমান্য করা, (তিন) কনস্টেবলদের বেতনসংক্রান্ত বিষয় এবং (চার) পুলিশের অজ্ঞাতে অস্ত্রধারী আনসার নিয়োগ।
ক্রয় প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা বিষয়ে বলা হয়েছে, অজ্ঞাতনামা পত্রিকায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। বলা বাহুল্য, এ প্রক্রিয়ায় দরপত্রে প্রতিযোগিতার অভাব হওয়া স্বাভাবিক। ফলে অধিক মূল্যে পণ্য বা সেবা সংগ্রহ করা হয়। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হয়। তাহলে কি বিদ্যমান সরকারি ক্রয় আইন ও বিধি এ ক্ষেত্রে অকার্যকর। অমান্য করা তো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য আইন বা বিধিই যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষের স্বচ্ছ মানসিকতা, যার অভাব এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান।
পোশাক পরার প্রতিষ্ঠিত রীতির ব্যতিক্রম প্রায় প্রতিদিন টেলিভিশনে দেখা যায়। পুলিশ বিধিমালায় পোশাক পরার স্পষ্ট বিধানও রয়েছে। যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ ধরনের অনিয়মের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন, তাঁর পক্ষে কি বিধি অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া অসম্ভব ছিল? পুনরায় কারণ হিসেবে রাজনৈতিক কারণই উল্লেখ করা যায়। অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রভাবের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনিশ্চয়তার শিকার হয়েছেন।
কনস্টেবলদের বেতনসংক্রান্ত বিষয়টি মনে হয় আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আবদ্ধ। পুলিশ সদর দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালি করা যাবে না। কারণ, অর্থ বিভাগের সম্মতি ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তই প্রদানে সক্ষম নয়। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অধিকতর তৎপর হতে হবে।
পুলিশের অজ্ঞাতে অস্ত্রধারী আনসারের নিয়োগের বিষয়ে কাঠামোগত দুর্বলতাই চিহ্নিত করা যায়। এর ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে। কারণটি পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক সরকারের সঙ্গে জড়িত। এর আগে আনসার আইনের জন্মলগ্ন থেকেই বিকেন্দ্রীভূত কাঠামোতে এ বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার বিষয়ে এসপির পরামর্শ অনুযায়ী ডেপুটি কমিশনার সিদ্ধান্ত নিতেন। এ বাহিনীর সর্বোচ্চ পদের নাম ছিল পরিচালক। এ পদে একজন সিনিয়র এসপিকে নিয়োগ দেওয়া হতো। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে এ বাহিনীর সামরিকায়ন-প্রক্রিয়া শুরু হয়। গঠিত হয় পৃথক আনসার ব্যাটালিয়ন। এ প্রথার অবসান প্রয়োজন। পূর্ববর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে আনসার বাহিনীর ব্যবহারের প্রয়োজন অনুভূত হলে, তাদের সংখ্যা নির্ধারণ করা হতো এসপির পরামর্শে। এ প্রক্রিয়াকে বলা হতো Embodied Ansar । অর্থাৎ এ প্রক্রিয়ায় তারা দায়িত্বকালে পুলিশ বাহিনীর অংশ হিসেবে গণ্য হতো।
অস্ত্রধারী আনসার ডিসি ও এসপির অজ্ঞাতে ব্যবহারের ফলে কোনো অনভিপ্রেত ঘটনার জন্য ডিসি বা এসপিকে দায়ী করা যাবে না। অন্যদিকে পুলিশ বিধি ও সরকারের অনুসৃত রীতি অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য ডিসি-এসপিকেই দায়ী করা হয়।
যে বিষয়টির প্রয়োজন তা হলো জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত প্রক্রিয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ। পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী সময়ে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ কাঠামো কাজ করত। এখন সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত মূলত জাতীয় পর্যায়ে। এর ফলে জাতীয় পর্যায়ের যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ, মূলত পরিবীক্ষণ, গৃহীত ব্যবস্থার মূল্যায়ন ও নীতি নির্ধারণসংক্রান্ত কার্যসম্পাদন-প্রক্রিয়া দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হয়। এ বিলম্বের ফলে অনেক ধরনের অঘটনও ঘটে, যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
পুলিশের মহাপরিদর্শক ক্ষমতাসীন দলের দলীয় কর্মীদের টেন্ডারবাজি প্রতিরোধের বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। দলমতনির্বিশেষে এ ধরনের অপরাধ কঠোরভাবে দমন করা হবে মর্মে জানিয়েছেন। একই উক্তি এ ধরনের ঘটনার শুরু থেকেই খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীও বলেছিলেন। সর্বশেষ বললেন মহাপরিদর্শক। মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী বলা সত্ত্বেও এ অপরাধ ঘটেছে। অনেকে প্রশ্ন করেছেন, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি বা হচ্ছে না কেন? সেই একই উত্তর। অপরাধের সঙ্গে জড়িত দলীয় ব্যক্তিদের সুরক্ষা। তবে এ কথা স্বীকার করা প্রয়োজন, কয়েকটি স্থানে ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া চালু করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে কিছু অপরাধীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। ভালো কথা, তবে অধিকাংশ অপরাধী অভয়াশ্রমেই বিচরণ করছে।
আশঙ্কার কথা এই যে, চাঁদাবাজসহ টেন্ডারবাজদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে মামলা করার নির্দেশ দিয়েছেন মহাপরিদর্শক। বলা বাহুল্য, এ ধরনের অপরাধমূলক আচরণ আইন অনুযায়ী দ্রুত বিচার আদালতেই হওয়ার কথা। এর জন্য নির্দেশের প্রয়োজন কেন? এ ধরনের সব প্রশ্নের উত্তর একটিই—রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, যা প্রশাসনের রাজনীতিকায়নের মাধ্যমে অধিকতর সুসংহত হচ্ছে। এর শেষ কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর সব রাজনৈতিক দলকেই খুঁজে বের করতে হবে।
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
No comments